উনিশে মে: ভাষার সংকট/কথাকবিতা/বাংলার ছোটোগল্প: বরাক উপত্যকার কথা-বয়নে উপভাষার প্রয়োগিক সমস্যা
বাংলা ছোটোগল্প: বরাক উপত্যকার কথা-বয়নে
উপভাষার প্রায়োগিক সমস্যা
পাঠক সম্পর্কের দুরূহ জটিলতাকীর্ণ ভাব-অভাবের জঙ্গমতাকে স্বাভাবিক সরল মধুরতায় সহনীয় করে তোলার প্রাথমিক দায় লেখকের। প্রাথমিকভাবে পাঠোত্তীর্ণ প্রবেশিকায় পাঠক এক নৌকার সহযাত্রী হয়ে যান সহজ বিনিময়সূত্রে। সম্পর্ক পাল্টে যায়, রাজার সঙ্গে রাজার মতো, চরাচর হারানো অভেদ সাম্যে পাঠকের অস্তিত্বও হয় লুপ্ত। লেখকের প্রস্তাবিত সংকেত প্রবাহ পাঠকের মস্তিষ্ক তরঙ্গে সঠিক অভিঘাত তৈরিতে সমর্থ হয় যখন, তখনই পাঠকের ভূমিকা পাল্টায়। সহলেখকের, লেখকের আসনেই রাজদণ্ড নিয়ে বসে পড়েন ভক্ত বিদ্রোহী। বিনিময় প্রথানুসারী চিত্তপ্রিয় মাধ্যমে শুধু লেখক-পাঠককেই কেন একাকার করে দেওয়া। অন্য অনেক যোটক সম্বন্ধও মনের মনোহারী স্তরে আঘাত করে অবস্থান্তর ঘটায়। এই বিনিময় পর্বে পক্ষ দুটো থাকে, প্রেরক-গ্রাহক বা রাজা-প্রজার আপাতবিরোধী অনুষঙ্গ। লেখক পাঠকের সমগোত্রে ছবিভাস্কর্য দর্শক এবং নির্মাতা, নাটক চলচ্ছবিতে নির্মাতা দর্শক শ্রোতা আর আলোচ্য শব্দগ্রাহ্য মাধ্যমকে আলোকিত করে আছেন লেখক পাঠক। যে মাধ্যমের আধেয় হয়ে আছে কবিতা, প্রবন্ধ (ইংরেজি প্রোজ, নন ফিকশনাল) সাংবাদিকতা এবং কথাকারিতা, যা ছোটোগল্প, নাটক, নভেল, উপন্যাস আদির সাব-মেনুতে বিভক্ত। মাধ্যম খুঁজলে আরও হয়তো পাওয়া যাবে, তবে দৃশ্য শ্রাব্য মনোতোষ যা উপকরণ আছে তার একটি ব্রাত্য ধারা রয়েছে যাকে কখনও লৌকিক নাম দিয়ে মাথায় তুলে রাখি, আবার অন্ত্যজ বলে দুরছাইও করি। বলা হয় লৌকিক মাধ্যমগুলিই চরিত্র খুইয়ে ধ্রুপদী রূপ নেয়, এ-ও কি ঠিক, লৌকিক শিল্পে কি সর্বথা কোনো চরিত্র থাকে। গ্রহণ বর্জনের প্রক্রিয়ায় পাক খেয়ে খেয়েই না মহাকালের আঁকড়ে ধরা। লৌকিক সহজিয়ার সাথে প্রথানুগ শিল্পের একটা বিরোধাভাস তৈরি করে পূর্ব প্রসঙ্গে যাওয়া ভালো। শব্দসম্ভব শিল্পকথাকে একটা নির্দিষ্ট আকারে এবং অবস্থানে নিয়ে না এলে গুছিয়ে বলার উচ্চাবচতা সামলানো যাবে না।
শব্দ পটুয়াদের প্রধান তিন উপাদানেই ধৃত রয়েছে মানুষের মুখের কথা। অক্ষর, বর্ণ, শব্দের আর শব্দকথার অমরাবাস। আদিতে অক্ষর ছিলেন বা আদিতে বাক্য ছিলেন সে ভিন্ন কূট কথা, আমার এই রচনা প্রচেষ্টার কথামুখে কবির, কথাকারের, নাট্যকারের, প্রাবন্ধিকের, সাংবাদিকের অধিষ্ঠান। সকলেই নির্মাণপটু প্রজ্ঞাবান। মানুষের মনকে, মনের কথাকে সঠিক সংকেতে গ্রহণ এবং যথাযথরূপে প্রেরণে সক্ষম বলেই তারা রূপদক্ষ কান্তিবিদ। কবির পরাবাস্তব সংকেত পাঠকের তরঙ্গ কক্ষে সঠিক ছিটকিনিতে কড়া নাড়ে, কথাকারের চেতনাপ্রবাহ সিম্সিম্ সংকেতকে কখনও ভুল করে না, নাটকে বিমূর্ততার ত্রিমাত্রিক অধিষ্ঠানও যোগাযোগে অসহজ হয় না, বা নন ফিকশনাল প্রোজে ক্রিটিসিজমের নবতম সংকেতগুলিও সাহিত্যবিচারে মাত্রান্তর ঘটিয়ে চলেছে অব্যাহত। সংকেতগুলিও সব সচেতন রচনা, নির্মাণ। শব্দ অক্ষরের চুনসুরকি ভিতে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃত জ্ঞানকে, ছয়তম স্থানে মানুষমনের ভাবে, এরা এইসব নির্মাণপটু কারিগরেরা বিভিন্ন অবয়বে নিয়ে আসেন। কেউ কবি, কেউ প্রাবন্ধিক, কেউ কথাকার। বাংলা ভাষায় কবিতে কথাকারে ভেদ ছিল না। কথাকে ছন্দে গাঁথা হতো মিলে, পয়ার ত্রিপদীর সীমাবদ্ধতা কবিতাকে শাসন করত। কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস ওঝা, ভারতচন্দ্র রায় তাই কবি। বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, ত্রৈলোক্যনাথ কথাকে ছন্দের কৃত্রিমতা থেকে সরিয়ে আনলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবময় কাব্যিকতা গল্পগুচ্ছে কথা রচনার এক অনন্য ধারার সূচনা করল।
হাসান আজিজুল হক সমালোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গল্পকে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার বাইরে রেখেছেন। তার কথায় রবিকথা, প্রাত্যহিকতা খসিয়ে দিয়ে মানুষের ধারণাটাকেই ফুটিয়ে তুলেছে। জগদীশ গুপ্ত, প্রভাতকুমার কথাকে সমকালীন ইউরোপীয় গদ্যধারার পাশাপাশিতে নিয়ে গেলেন। তারপর অন্য পরিক্রমা, কল্লোল থেকে কিন্নর রায়। এই টানা-পোড়েন এখন শেষতম বৃত্তেই ক্রমাগত। বাংলা সাহিত্য এখন বৃত্তান্তরে যাওয়ার প্রয়াসে নিরত। কথা দিয়ে চেতনার বিভিন্ন স্তরে ব্যতিক্রমী আলোড়ন তোলার প্রচেষ্টা চলছে বিশ্বময়। গদ্যে, কথাসাহিত্যের বিস্মৃততম মাধ্যম, উপন্যাস যান্ত্রিকতায় দুষ্ট। কেউ কেউ বলেন যান্ত্রিকতাই ক্লাসিক সাহিত্যের প্রধান উপাদান। বিরোধ নেই বিন্দুমাত্র নির্মাণই তো সৃষ্টির সার, তবে জীবনবিমুখ নির্মিত পণ্য কখনই সাহিত্য নয়। কথাসাহিত্যের ছোটো শরিক ছোটোগল্প এখনও সম্পূর্ণ জীবনমুখী রয়েছে। লাতিন আমেরিকার ছোটোগল্প বাংলা ভাষায় এখন প্রেরণাস্থল না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না, হলো কই। মার্কেজ এখনো নামে মাত্র পরিচিত, অন্যরা তাও না। মানুষমনের কথা, মানুষের কথা জানতে হলে সেই সময়ের আন্তর্জাতিক মানুষমনকে জেনেই মানুষের ভাষা আয়ত্তে আনা। না হলে জীবনানন্দ যেমন বলেছেন:
‘মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া, বিশেষণ, এলোমেলো নিরাশ্রয়
শব্দের কঙ্কাল।’
দুই
‘কে বলে এ আমার নয়? তোমার নয় কে বলে?
এইখানে পা রেখে জানি মিথ্যে এ ছিন্নতা।’—শঙ্খ ঘোষ
বরাক উপত্যকার সাহিত্য-ভাবনায় আমার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার আগে বিষয়-নির্দিষ্ট করে নিতে চাই। বিষয় হওয়া উচিত ছিল ‘বাংলা ছোটোগল্প: বরাক উপত্যকার কথা-বয়নে উপভাষা’। কোনো রিপোর্ট বা গবেষণাপত্র নয় এ প্রয়াস। মানুষের কথা, মানুষের ভাষা তার অভিব্যক্তির সচলতম প্রকাশ, বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলার মূল দুই ভুবন থেকে দূরে, অনেকটাই দূরে। ভৌগোলিক দূরত্ব এক অংশের সঙ্গে, অন্য অংশ রাজনৈতিক সুদূরতায়। এত দূরত্ব সয়েও সুন্দরী বরাকভূমি তার ভাষা সাহিত্যে দুই ভুবনের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে দায়িত্ব সহকারে। এই ভুবনে, মানুষমনের বিভিন্নতা, বৈচিত্র্য, জটিলতা সবই আলাদা। দুই ভুবন যত কথা বলে, তৃতীয় ভুবনের কথা তার থেকে কম নয় কিছু। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কলকাতার মহানাগরিক আতান্তর বা সুখ নেই সত্য, তবু শিলচর করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি, লালাবাজারই বা কম কীসে, সংকেত বিপ্ বিপ্ করছে সব ঠাঁই। সংকেত ধরতে কথাকারেরাও নিশ্চুপ বসে নেই। অকথিত নয় বলেই বরাক উপত্যকার ছোটোগল্প এখনও সাহিত্যের দুরন্ত প্রাণময় অংশ। বরাকভূমির ছোটোগল্প হাড় মাংসকে শক্ত ও পেশীবহুল করতে, রক্তকে সচল দ্রুতগামী করার হৃদয় ও মস্তিষ্ককে সতেজ দুরন্ত রাখছে।
তিন
বরাক উপত্যকার কথারচনার পরম্পরা, ইতিহাস একেবারে অর্বাচীন নয়। এই ভুবনের কথাচর্চার বর্তমান শৈলীর উত্তরাধিকার আমরা নিশ্চিন্তে সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী থেকে শুরু করতে পারি। অন্য তিন সমসাময়িক কথাকার—রামকুমার নন্দী, লাবণ্যকুমার চক্রবর্তী বা সুরেন্দ্রলাল সেনগুপ্তর কোনো মুদ্রিত রচনা না থাকায় গদ্যভঙ্গির ধারণা রচনাকারের সাধ্যের বাইরে। কলকাতার তৎকালীন মূল বাংলা গদ্যভঙ্গিতে রচিত সুরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীর উপন্যাসের ভাষা কখনই এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে রচিত মনে হয় না।
‘বদরপুর স্টেশন ছাড়িয়া কিয়দ্দূর গিয়াই প্রশস্ত ‘বরাক’ নদীর উপর সুবিশাল লৌহসেতু—ইহাও স্থপতি বিদ্যার এক আশ্চর্য্য কীর্তি।
‘সেতু উত্তীর্ণ হইয়াই গাড়িখানি দেখিতে দেখিতে নীরদের কল্পনা চিত্রিত সেই শৈলমালার সম্মুখীন হইতে লাগিল। নীরদ হর্ষ বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে চাহিয়া দেখিল—কী বিরাট, কী মনোহর—কী মহিমময় সে দৃশ্য। অত্যুচ্চ পর্বতরাজি—একটির পশ্চাতে আরটি মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দেখিবামাত্রই মনে পড়ে কবির সেই ভাবচিত্র—
‘অদ্রির উপরে অদ্রি, অদ্রি তদুপরে’ (নারীশক্তি বা অশ্রুমালিনী)’
ষাট সত্তর বৎসর আগে বরাকভূমির রূপ তার সৌন্দর্য বাখানির শক্তিধর কথাকারকে অভিবাদন জানাতেই হয়। সেই সময়ে কোনো ছোটোগল্প বরাকভূমিতে রচিত হয়েছে কিনা সে তথ্য তো অজানা। কথাকারের, ছোটোগল্পকারের মানসিকতার অভাব ছিল না অশ্রুমালিনীর লেখকে। হয়তো তৎকালীন বরাক উপত্যকায় সাহিত্যিক পরিবেশ, প্রকাশ-মাধ্যম, ছাপাখানার অভাব লেখককে বিচিত্রগামী হতে দেয়নি। কুললক্ষণ স্থির হলেও লিখনশৈলীতে বঙ্কিমী ধারার অনুকরণ থাকায় উল্লিখিত উদ্ধৃতিমধ্যে বদরপুর আর বরাক এই শব্দ দুটিই আমাদের হর্ষ বিস্ময়োৎফুল্ল হয়ে ওঠার কারণ হয় মাত্র। একটা সময় পর্যন্ত বরাক উপত্যকার কথাকারদের সৃষ্ট চরিত্রেরা বাংলার স্বীকৃত ভাষায় কথা বলেছেন। বিবরণের ভাষাকে মেনে নিলেও, ‘আইচ্চা’, ‘কেনে’, ‘কিতা’ বা ‘মাত’ স্বীকৃত বাংলায় অনুবাদ করে গল্পকথাকে কালোত্তীর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। শিকড়ের সোঁদা শৈশব-ঘ্রাণ লেগে আছে তার অন্ত্যজ জীবনে, ব্রাত্যকথার কথনেই মুক্তি, অনেক পরে এ সার জেনেছেন বরাক উপত্যকার কথাকারেরা।
সংলাপের সমস্যা প্রধানত নাট্যকারের ও কথাসাহিত্যিকের। বরাক উপত্যকার নাট্যকার চিত্রভানু সিলেটি উপভাষায় নাটক লিখে পুরস্কৃত হয়েও অতৃপ্ত। প্রশ্ন করেন, বরাকের উপভাষায় নাটক কতটা রসোত্তীর্ণ, পুরস্কার কি নতুনত্বের স্বীকৃতি, নাকি উপভাষার কমিক এফেক্ট, কী দিয়ে পাঠক, দর্শক শ্রোতা আকর্ষিত হচ্ছেন। আবার জবাবও দেন, দীনবন্ধু মিত্র অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেছেন। তীর্থঙ্কর চন্দ, আর এক নাট্যকার, কলকাতায় থেকে দুর্ধর্ষ নাটক লিখে বিখ্যাত নাট্যগোষ্ঠীর পুরস্কার শুধু না, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পত্রিকায় পরিপাটি ছাপা হয়েও বেরোল বরাকের উপভাষার নাটক। চিত্রভানুর জবাবই সঠিক, দীনবন্ধু মিত্রর নাটক যদি বাংলা নাটক হয়ে থাকে, হুতমো, আলালী যদি বাংলা হয় বরাকের উপভাষাও বাংলা নিশ্চয়। এই উপভাষার লোকায়ত পেশির জোরে তাঁরা কেন সাহিত্যে নতুন নির্মাণ উপকরণ নিয়ে আসবেন না! মানুষের মুখের ভাষাই তার সাহিত্যের ভাষা হবে। বরাক উপত্যকায়ও তার কথাসাহিত্যের প্রধান উপাদান হচ্ছে তার নবীন উপভাষা। সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও স্থানীয় কাছাড়ি মানুষের মুখের কথা দিয়ে তৈরি এ ডায়লেক্ট। কাছাকাছির চা শ্রমিকদের ভাষা, অসহজ মণিপুরিও অনেকটা মুখের কথায় এসে গেছে। এর বিপরীতে নাগরিক বাংলা বা স্বীকৃত বাংলা তো উপত্যকার কোনো শহরেরই মুখের ভাষা নয়। গ্রামের মানুষ শুদ্ধভাষায় কেউ কথা বলছে শুনলেই বিদ্রূপে মুখর হয় ‘তাইন ছাপার অক্ষরে মাতিত্রা’। তবে কেন এ অনুবাদের বাংলা! এমনকি লিখনশৈলী, বাক্যরীতিতে ও মূল বয়নেও যদি মুখের ভাষার কিছুটা অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়, বাংলা সাহিত্যের দিগন্তই বাড়বে। বাড়বাড়ন্ত দেখতে হলে রচনাশৈলীতে লোকায়তিকের অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে, উপভাষার সম্পূর্ণ ভিতটাই তো লোকজীবন-নির্ভর। লোকজীবন জুড়ে আছে লোককথার অগাধ ভাণ্ডার আর সমৃদ্ধ পুরাকথা, কথাসাহিত্যে এই উপকরণ দুটি বড়ো জরুরি। এই প্রসঙ্গে তপোধীর ভট্টাচার্য কথাবয়নে বিকল্প-বাস্তবের কথা বলেছেন, স্থানিক ও কালিকমাত্রায় বিশ্বস্ত থেকে উপভাষার ঢঙে তৈরি কৃত্রিম বাক্রীতিই হবে উত্তরণের বিকল্প-বয়ন। এই বিকল্প বাস্তবের দিকে বিকল্প বয়ন রীতির পথ উপল-বন্ধুর বলে পরিহারের অবকাশ নেই। ঠাক্মা দিদিমার ঝুলি ঝেড়ে সাত রাজার ধন অনেক মাণিক কুড়িয়ে পাওয়া যাবে আর কথা-বয়নে অনাগরিক মানসিকতা উপভাষাকে সুয়োরানীর মর্যাদা দিতে পারে। আলোচনার শিরোনামে ‘সমস্যা’ শব্দটাই আমাকে সমস্যায় ফেলবে, আশঙ্কার কারণ বরাক উপত্যকার স্বয়ম্ভরতা।
চার
এত যে লোককথা, প্রত্নকথার প্রসঙ্গ আসছে ঘুরে-ফিরে বরাক উপত্যকায়, এর ব্যবহার যে কেউ কেউ করেননি তাও তো নয়। কথাকার দীপেন্দু দাসের ‘চাঁদ সদাগর’, ‘রোদরাজা মেঘরাজার গল্প’, উপত্যকায় নতুন কথাভাবনার দিশারী নিঃসন্দেহে। দীপেন্দু বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গেছেন তার কথা অন্বেষণে। জীবনের কিছু আলোহীন অংশকে অন্ধ আলো নিয়ে খুঁজতে চেয়েছিলেন বলে বিতর্কসঙ্গী ছিল তাঁর কোনো কোনো রচনা। তবে উপভাষার ব্যবহারে এখনও নাগরিক দীপেন্দু।
ঠাক্মা দিদিমার ঝুলির ধন যদি চুরি করে নিয়ে যায় কেউ, কেমন লাগে! মানবাজারের উপভাষায় সৈকত রক্ষিত আমাদেরই এক ‘কিচ্ছা’র অংশ ব্যবহার করে আমাদের বলেন,
‘কুটুর কুটুর পান চিবাছো
দিঘল দিঘল দাড়ি
খুটুর মুটুর কী ভাইলছো
কথায় তুমার বাড়ি?
লছুও তালে তালে থুতনি নেড়ে দেখায়। কখনো সে বাঘ সাজে, কখনো ছাগল । ছাগলটির মৃত্যু অনিবার্য জেনে বাঘের কাছে বিরাট করে তার পরিচয় দেয়। তারপর বীরোচিত গর্ব নিয়ে বলে ওঠে:
বাঘ মারলম শিয়াল মারলম
আর মারলম হাতি
যার গায়ে টিকা ফঁটা
তাকেই নাই পছি।
এই শুনেই বাঘ উল্টো দিকে ঘুরে চম্পট দেয়। লঘু কাছা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে থাকলে বাচ্চাগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ে। তাদের কোমরের ঘুনসিতে বাঁধা ভেলা বিচিগুলো দোল খেতে থাকে সেই হাসির শব্দে।
মনে পড়ে আমাদের ‘কিচ্ছা’:
‘ছুচিমুখো ঘুচি দাড়ি
খনে খনে মুখ লাড়ি
সিংহের ভাগিনা আমি
নরহরি দাস
আঠারো আঠারো বাগে
এক্কই গরাস
এক বাগে এক পানিতরাস।’
‘এই শুনেই বাঘ উল্টো দিকে ঘুরে চম্পট দেয়।’ কিচ্ছার শেষেও তো এক চম্পটের কথাই থাকে।
মানবাজার ছাড়িয়ে এবার দখ্নো দেশ-এর এক কথাকার অনিল ঘড়াই ‘কটাশ’ গল্পে ভাম/কটাশ মানুষের গল্প এক গানের কথা পাল্টে অসাধারণ দক্ষতায় রসোত্তীর্ণ করে তোলেন—‘পুকুরেরি পাড়ে খড়ি বেড়ার ধারে/ হংস বসিয়াছিল/ কটাশ আসিয়া পটাশ করিয়া হংস লইয়া/ গেল গো-ও-ও!’ কটাশ তো আমাদের খাটাশ। তিনি অন্য গল্পের শুরুও করেন বাউলের তত্ত্বমুখী গানের সাথে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মাটির রস টেনে আনেন কথা-বয়নে। মাটির টানে গাছে ভাঁড় বেঁধে দেওয়া—
‘গাছে ভাঁড় বেঁধে দেনা, বেঁধে দেনা—
রস খাবি তুই জিরেন কাটের
গুড় খাবি মিছরি দানার।
হাতে গোনা, ঠিক বুকের এক বিঘৎ নীচে ডুগি—ভুবন বাউলের দিঘল প্রসারিত চোখে বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে মেলা। বাঁধ যেখানে কাছিমের পিঠের চেয়েও উঁচু, আকাশ যেখানে হাতের মুঠোয় ধরা যায়— সেই বিশেষ জায়গাটি গাঁয়ের একেবারে পিছনে, অনেকটা লেজের মত দেখতে হলেও—এই বিশেষ জায়গাটা ভুবন বাউলের খুব পছন্দ’। (ভুবন বাউল)
অনিল ঘড়াই যদি অনেক কথা বলে ভুবন বাউলের মনপছন্দ জায়গায় গিয়ে বসেন, এই বরাক-ভুবনের আর এক অবাক কথাকার কম কথায় অনেক কথা বলার দক্ষতা দেখাতে পারেন। তিন দেবাশিস তরফদার—
‘ওধারটায় ঘাস। একটা মাত্র গরু। চাঁদ কপালী। গরুর পিঠে রোদ। সরে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়লো ‘বিকেল ঝিল পাখি’। কেনো মনে পড়লো বলা মুশকিল। আমার দেশের ভাষায় বলে ‘হুদা’।’ (ছুটির গল্প)।
এক ‘ছদ্দা’ শব্দে ব্রহ্মস্বাদ অনুভবে আসে। কথার জাল বুনতে হয় না, ফাৎনায় মোক্ষম টান পড়ে ‘হুদ্দা’ নামে এক বিচ্ছিরি সুন্দর শব্দে।
সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তুলনা বা কথা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিতেই হচ্ছে। আমরা, আমাদের কথাকারেরা স্বয়ম্ভর, তবু আমরা কেন ব্রাত্যজীবন বরণ করলাম। বরণ, না অভিমানের নির্বাচন, না অন্য কারণ? অভিমন্যু পটুত্বের অসহায়তা কি আমাদের প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক! নইলে সমস্যার কথা আমরা যা বলি, প্রধান ভুবন কলকাতার কথাকারও তো তাই বলেন। ভগীরথ মিশ্র বাংলাভাষার সব্যসাচী কথাকার, নাগরিক ভাষায় যেমন, রাঢ়গ্রামীণ, সাওতালী, শুদ্ধ বাংলায় সমান পটু। তাঁর গল্প শুধু পুরুলিয়া বা দখ্নো দেশে ঘোরে না। ভগীরথ মিশ্রর চোখ যেখানে যায় মাটির একাত্মতা না নিয়ে কলমে আঁচড় কাটে না। পশ্চিমবাংলার গল্পকারদের মধ্যে উজ্জ্বল ভগীরথ গল্পকার উপভাষা, নাগরিক ভাষায় সমান সিদ্ধ তবু তারও কথা-ভাবনায় প্রধান সমস্যা, উপভাষার প্রয়োগ। সাঁওতালিরা বাংলা বোঝে মোটামুটি, বাংলায় কথা বলে না কিন্তু সাঁওতাল চরিত্রে ‘যাবেক লাই’, ‘খাবেক লাই’, দিয়ে সংলাপ স্বভাবের একটা নমুনা তৈরি করে নিয়েছি। এও কি সঠিক! আবার ওদের নিজস্ব ভাষার সংলাপ ব্যবহার করলে বাংলা ছোটোগল্প দুর্বোধ্যতার দায়ে পড়বে কিনা, এ সংকট কথাকারের। কথোপকথনের ভঙ্গিতে বলা প্রশ্নের পাশাপাশি আমারও সমস্যা ছিল মণিপুরি, কাছাড়ি ভাষার চরিত্র নিয়ে, চা শ্রমিকের ভাষা নিয়ে, আমরাও তো তেমন আদর্শ সংলাপ স্বভাব তৈরি করে নিয়েছি চা শ্রমিকদের জন্য। বরাক উপত্যকার বহুপ্রজ গদ্যকার গণেশ দে-এর একটি গল্পের দুটি অংশ থেকে সাক্ষ্য নেওয়া যায়—
‘যেতে যেতে সর্দার পূর্ব প্রসঙ্গ টেনে বলল—ই তুমি ঠিক বাত বইলছ বাবু সাব। হামরা মাটি কোপাই, ধারায় ভিজি, তাপে পুড়ি, জঙ্গল সাফ করি তবে না চাহের গাছ বাড়ে, পাত্তি হয়।’
বা
‘সিকমানিয়া এই বাগানেরই একটা মেয়ের নাম। এরা হাসপাতালকে বলে ‘সিকমান’। হাসপাতালেই অর্থাৎ সিকমানেই ও লালিত হয়েছিল বলেই হয়তো ওর নাম রয়ে গেছিল ‘সিকমানিয়া।’
যদিও ওর পিতৃপরিচয় জানা ছিল না তবু ও যে শ্রমিক মায়ের পেটে কোনো ফর্সা চামড়ার বাবু জাতীয় কাপুরুষের সন্তান, তা ওকে দেখলেই মনে হতো। সর্দারের ভাষায়-‘বাবুদের লেড়কির মতো ধলা, লরম, লরম...।’ (সিকমানিয়া)
বা আর একজন গদ্যকারেরও সাক্ষ্য নিতে পারি, বাংলা রচনা থেকে যিনি এখন বহুদূরে, কলকাতা স্টেট্সম্যান-এর সাহিত্য ক্রোড়পত্রে প্রায়ই যার বিশাল সব বুক রিভিউ, আলোচনা ছাপা হয়। একদার কথাকার নির্মলকান্তি ভট্টাচার্যর বিস্মৃত এক গল্পাংশে চা বাগানিয়া সংলাপ-এর আদর্শ ব্যবহার ছিল।
‘কীরে ঝিলুয়া, হরিয়া, কী আলাপ করছিলে এতক্ষণ?
বলতে বলতে মাসডরবাবু নাচঘরে এসে দাঁড়ালো।
হরিয়া বললে—বহুত জরুরি বাৎ-চিৎ মাসডর বাবু। বড়ো সাহেব আজ লছমিকে বাংলায় ডেকে নিয়ে খুব মারধর করেছে। টিলাবাবু উর বিরুদ্ধে নালিশ করেছিল সাহেবের কাছে। লছমি নাকি গতকাল টিলাবাবুর ছোটো লেড়কির গলার হার চুরি করেছে।” (মাসডর বাবু)
চেষ্টা করেও বরাক উপত্যকার অখ্যাত কথাকারকে পশ্চিমবাংলার বিখ্যাতদের সমপর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে না, এ সত্য জেনেই ভগীরথ মিশ্রের ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে, বরাকের সমস্যাকে প্রতিতুলনায় তুলে ধরিনি। কালিদাসের সিদ্ধান্তেরই পুষ্টি করেছি, সংস্কৃতের পাশাপাশি প্রাকৃত সংলাপ যথেষ্ট ব্যবহার করেছেন মহাকবি। আর কথাবয়ন তো সিয়ামিজ সিলেটি অনাগরিকে হবে না, হবে না মাদ্রাজি মানবাজারিতে। ব্যতিক্রমকে সামাল দেওয়া সক্ষম কথাকারের দায়িত্ব।
কথাকারের ক্ষমতার প্রশ্নে আবার লৌকিক জীবনে ফিরে যেতে হয়। বরাকের লোককথা, লোকবিশ্বাসের ভাণ্ডার এত অফুরন্ত, কিন্তু কথা বয়নে এত অব্যবহৃত যে ভাবনার চোখ ফেরালেই রত্নভাণ্ডার। সংকেতের সিম্সিম্কে ভুল করলে চলবে না। বরাক উপত্যকায়ও তো তেমন লোকবিশ্বাস আছে। এক যুগে একবার বাঁশ ফুল ফোটে, মন্বন্তরের পূর্বাভাস দেয়। আমাদেরই ঘরের কথাকে কেমন পেড়ে নিয়ে এক অসাধারণ গল্পে নিয়ে এলেন ভগীরথ মিশ্র—
‘মন্ত্রীর গৃহিণী পিংকি। আজীবন দিল্লীবাসিনী।
‘একবার কৃষিমন্ত্রীর ডিনারে গিয়ে বাঁশের ফুলের ‘ইকেবানা’ দেখেছিলেন পিংকি সে যে কী সুন্দর।’
‘...তা বলো তুমি বাঁশের ফুল খুইজবে গেরামে গেরামে ঘুর্যে? তুমি কি শনি নাকি?’
‘আমি নয়। বাঁশের ফুল খুঁজে উই ডিল্লী উয়ালী ম্যাম সাহাব’।
‘ঘর সাজাবেক!’
‘বাঁশের ফুল দিয়ে ঘর সাজাবেক? কী আচানক কথা। বাঁশের ফুলে যে ঘর ভাঙ্গে হে! ঘর ভাঙ্গে। সন্সার ভাঙ্গে। গাঁ গঞ্জ, বিশ্বভুবন শ্মশান হইয়ে যায়।’ (বাঁশফুলের কাব্য)
একদিকে একপয়েণ্টে ভগীরথ, দুইভুবনের কথাকাররা, এগিয়ে গেলেও দশপয়েণ্টে আমরা জিতছি। ভারত জোড়া, বাংলা জোড়া যে জাতিবৈরিতার ভ্রাতৃদাঙ্গা ভ্রাতৃহত্যা চলছে, এর উত্তরে বরাক উপত্যকার কথাকারেরা যেমন জাগ্রত, ভিডিপি-র রাতজাগা প্রহরীরাও তেমন চৌখস থাকে না। জাতিবৈর বিরোধিতায় তাই নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি মাটির মানুষের কাছাকাছি হতে চেয়েছেন বরাকপারের কথাকারেরা। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, এ সত্যে অটল এককাট্টা বরাকভূমির কথাকারেরা। একই প্রসঙ্গে বিভিন্ন কথাকারের উল্লেখ একসাথেই করতে হচ্ছে। প্রথম, দ্বিতীয় এভাবে কাউকেই উচ্চারণে আনা যায় না। বরাক উপত্যকার কথাশিল্পের সাদাবাড়ির স্তম্ভ এই ক-জন। নামে কারো বিশেষণ দিতে হয় না। রচনার উদ্ধৃত অংশগুলি থেকেই তাদের বিশিষ্টতা ধরা পড়বে। শেখর দাশের অনবদ্য গল্পে দাঙ্গাদোসর গুজবের আগুন তার ভয়াবহতা নিয়ে উপস্থিত—
‘রাইডিং স্কোয়াডের বাইক চলে গেছে অনেকক্ষণ। পুব আকাশ সাফ একদম। কলের ট্যাপে সোঁ সোঁ শব্দ। জল আসবে এখনি। সান্ধ্য আইন হলেও এ-এলাকায় এত কড়াকড়ি নেই। গলিপথে বেরিয়েছে সবাই। রাতের কোলাহল নিয়ে বিতণ্ডা। সবজান্তা চিনু বলছে,
—উজানী গাঁওর সব কাচা ঘর ছালি’
বিরক্ত হন মোহন বাবু। বললেন,
—রাইত্ তুমি কিতা হন-অ আছলায় নি?’
—না মানে হুনছি আর কি’
—মাঝ রাইত্ আইয়া তুমারে কে কইয়া গেল?’
চিনু ঠেলা খায়। মোহনবাবু বললেন,
—কেনেরে বাবা, আতাল ঝাতাল বকিত্ রায়’
—না কাকু সত্যি কইয়ার। বংশী কামলা বাড়ির বাগান অইয়া বান্ধর উদিকে গেছিল। হিখানে অ মাইনষে মাত্রা।’
—বাজে কথা। এমন গুজবে কিতা অয় জাননি? গুজবে মিছা আগুন হাচাউ আগুন লাগায়।” (আজান)
মলয়কান্তি দে বিপর্যস্ত স্বদেশভাবনাকে তার গল্পের বিষয় করেন—
‘—কি অর কুটুম। জমিদারের লগে আবার কুটুম্বিতা। শুয়োরের বাইচ্ছা মানুষ নি।
—যাইরায় যাও। হিন্দুস্থানো গিয়াউ কুনু সুখ পাইবানি। গেলা তো কত উ...’
বা
'—তুমি নি আসরাফ আলি?
- আইজ্ঞা অয়।
—তুমি তো বাংলাদেশী। কবে আইছো?”
বা,
‘এমনি বিপর্যস্ত অবস্থায় জঙ্গলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আসরাফ। আব্দুল জিজ্ঞেস করছে—ও বাবা আমরা দেশে যাবো না? আসরাফ উত্তর দেয় না। এখন যে জায়গাটায় সে দাঁড়িয়ে আছে—সেটা নো ম্যানস্ ল্যাণ্ড। এখানে দাঁড়িয়ে আসরাফ বুঝতে পারছে—পৃথিবীতে কোথাও তার কোনো স্বদেশ নেই। পাকিস্তানে তার স্বদেশ কেড়েছে ইরফান চাচা, হিন্দুস্থানে কাদের মিয়া। স্বদেশ এখন তাদের মুঠোয়। আর আসরাফ? নো ম্যানস ল্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আসরাফ আসলে এখন নো ম্যান—একটা নন এণ্টিটি।’ (আসরাফ আলীর স্বদেশ)
পরম ভট্টাচার্যের ভাবনায় সাম্প্রদায়িকতার নগ্নরূপ চাবুকের সপাং হয়ে আমাদের বিশ্বাসকে হঠাৎ আঘাত করে।
‘——কিতা খবর? সেণ্ট্রাল রোডর দিকে গেছলায় নি?
—অয় অয় যে অবস্তা···।
—কেনে কিতা অইছে?
—বেজান বম ফুটার, অস্ট্রেলিয়া জিন্দাবাদ কইয়া চিল্লার—আমার জানাশুনা এক মুসলমান পাব্লিকরে হিখানো পাইসলাম। আমারে চুপচাপ জিগায়—পাকিস্তান আরছে দেখিয়া অত ফুর্তি কেনে বা...
আমি কইলাম ‘তুমরা ইণ্ডিয়া আরলে করনানি...' আমার কথা শেষে অওয়ার আগেউ কিগুয়ে কয় ‘আইজ বাবাই পাদুমপুদুম ছুটাইয়া ছাড়ছে অস্ট্রেলিয়ার....।’
‘টিম অইল অস্ট্রেলিয়া, খেললে বাবাই ওলা খেল, এল্লাগিউতো আমরা বম ফুটাইরাম কিশুয়ে কিতা কইতরে...।
ইতা কথা শুনিয়া নানি মুসলমান পাব্লিক ইণ্ড আমারে কয়
—যাই গিয়া ভাই মানে মানে...।
হালার হালাইন অলা কমুনেল গেলারিত বইয়াও আল্লা আকবর ডাকে ...।
আল্লায় আইয়া পাকিস্তানরে বাচাইছিল নি?' (অসংগত
অন্যজন শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী। ধর্মান্ধতা নয়, তাঁর নির্বাচিত বিষয় ভাষা বৈরিতা—
‘অন-অসমীয়া যারা আসামে স্থায়ীভাবে বাস করছে তাদের কি আপনারা বহিরাগত মনে করেন? নহয় তেনে কথা আমি কোয়া নাই দে। ১৯৫১ চনর পিছত অহা মানুহবোরক বহিরাগত বুলি চিহ্নিত কবির লাগে।
কেন বলুন তো? ৫১'র পরে যারা এসেছে তারা কী দোষ করেছে? দোষর কথা নহয়। বহিরাগতর কারণে অসমর সমস্যা বোর বহুত বাড়ি গৈছে। আমার চাকুরি পোয়াটো টান হৈ পরিছে।’ (মানুষ মানুষের জন্য)
অন্যজন অরিজিৎ চৌধুরি। এক এক করে এতজন যীশুর গল্প শুনে ধন্দ লাগে, ব্যাপারটা কী, কেউ কি কারো কথা শুনছে না বরাকভূমিতে। ব্যর্থ পরিহাস হয়ে রয়েছে সব শুভ প্রচেষ্টা, প্রেমের কথা কেউ শুনছে না। নইলে এত মমতায় যে গল্প লেখা হয়, গল্পকারও তো সেই সমাজেরই লোক, সেই সমাজের মুখপাত্রও তো সে জন। তবে কেন মহেন্দ্রর ঘর জ্বলবে। অসমীয়া মহেন্দ্র বাঙালি ভুলুদা, বৌদির স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পড়বে। শত্রুতাই কেন, আত্মীয়তাই কেন!
‘দিন পনেরো কেটে গেল ভুলুদাদের বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া খুবই সংক্ষিপ্ত, তবু মহেন্দ্র লজ্জা বোধ করে। আর কতদিন এভাবে থাকা যায়, ভুলুদা ও বৌদির কাছে এসব কোনো ব্যাপার না, তাদের বাড়িতে প্রায়ই বাইরের লোকজন এসে থাকে। মহেন্দ্র যাবার কথা বলতেই ভুলুদা মৃদু হাসেন, যাইতায় কই। আসুয়ে নু তুমারে বিদেশির দালাল বানাই থই দিছে।
বউদিও যেতে দিতে নারাজ, থাকো রেবা কয়দিন, নলবাড়ি সাইডের অবস্থা শান্ত হউক, তার পরে বাড়িত যাইবায় নে।’ (আগুন)
মনে হচ্ছে যেন আমরা আলোচ্য থেকে সরে এসেছি। বিষয় ছিল উপভাষার প্রায়োগিক সমস্যা। সমস্যা কোথায় থাকল, এ দেখছি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অপ্রতিষ্ঠ করা। একই বিষয়ে কিন্নর রায়ের গল্পের এই অংশটুকু কি কোনো সীমা নির্দেশ করে। এ গল্পাংশ বরাক-পারের, এটুকু পশ্চিম বাংলার। পশ্চিম বাংলার লেখক হলে বাড়তি সুবিধাটুকু বরাকে অলভ্য। অরিজিৎ চৌধুরির উপরের গল্পটি পশ্চিম বাংলারই এক পত্রিকায় ছেপে বেরিয়েছে যদিও, তবু কিন্নর রায়-এর মতো গল্পকারের পংক্তিভুক্ত হবেন কি প্রধান ভুবনে। অরিজিৎকে ফিরে আসতেই হবে সাহিত্য, অক্ষরবৃত্ত বা ওষধিপত্র পূর্বদেশে। শক্তিমান গল্পকার কিন্নর রায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিপন্নতাকে গল্পের বিষয় করেন—
“তুই চুপ মার
তুই চুপ মার
দু'জনের পরিত্রাহি চিৎকারে গোটাবাড়ি ভূমিকম্পের পটভূমি হয়ে ওঠে।
তুই বলেচিলি না মাগীটাকে দেখিয়ে—অত ফরসা গায়ের চামড়া।
আমি বলিচি এই কথা, আল্লার কিরে খা দিকিনি। খায়রুলের কিরে খা—
সবার কিরে খেতে পারি। তুই আরও কী কী বলেছিস বলব— বাকি কথা শোনার মতো অবস্থা থাকে না আসগরের।
নরেন্দ্রপুরের কাছাকাছি আমার দুটো ঘর উঠছে। বনেদ, দেয়াল উঠেছে। লিনটেল অব্দি। খালি ঢালাই বাকি। একটা পায়খানা রান্নাঘর। দেড়কাঠা জমির উপর ওইটুকুর জন্যে এত কষ্ট। আমি, জয়তী, তুলি সবাই কষ্টে।
কোনো হিন্দু বাড়িঅলা আমায় ঘর ভাড়া দেবে না। আমি মুসলমান। সঙ্গে হিন্দুর সুন্দরী মেয়ে, যে আমার রেজিষ্ট্রি করা বউ। তাই ব্যাপারটি আরও গোলমেলে, হিন্দু বাড়িঅলার কাছে। (আলি আসগর, জয়তী অথবা ধর্মনিরপেক্ষতার গল্প)।'
সিকমানিয়া আর মাসডর বাবুর সাথে ‘কেশবলালের ভূমিকা’কে এক করে দিইনি, বরাক উপত্যকার অন্যতম সৃষ্টিশীল গদ্যকার মিথিলেশ ভট্টাচার্যকে আলাদা করে দেখার তাগিদে। অনেক লেখার অ্যালান বর্ডার মিথিলেশকেও দেখছি, ইদানীং উপভাষা আর বিকল্প বয়ন সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। কথারচনার মোক্ষম প্যাঁচ-পয়জার মিথিলেশের মতো ক-জন জানে বরাকে। কে বলতে পারে ‘হায় রাম তুই টিরেনচ নাই চিনলিরে, কবর দেখিস নাই তুই?'—
‘তারপর আবার বলেছিল বলদেও 'লড়াইটা নাকি এইবার হামাদের দিকেও চলে আসবে, দাসবাবু বলেছে হামাদেরও টিরেনচ খুঁড়তে হবে।’ কেশবলাল অবাক গলায় প্রশ্ন করেছিল ‘টিরেনচ কীরে?’
‘হায় রাম তুই টিরেনচ নাই চিনলিরে, কবর দেখিস নাই তুই?' (কেশবলালের ভূমিকা)
অমিতাভ দেবচৌধুরি বরাক উপত্যকার কথাসাহিত্যে ভিন্নপথগামী। সম্পূর্ণ রণসাজসহ অ্যারিনাতে ঢুকেছেন এই মল্ল। অমিতাভ বড়ো দুরন্ত, তাই সপ্রতিভ বুদ্ধির বাংলা লেখেন, শুধু মল্ল নামটা ঘুচিয়ে সেনানায়ক হতে হবে তাকে। তার স্মার্ট গদ্যকে উপলব্ধির মননে ঋদ্ধ করতে হবে। ‘প্রসিদ্ধ রক্ত'র প্রসিদ্ধ গদ্যাংশ তো বাংলা ভাষারই সম্পদ।
‘কী কুৎসিত শেপলেস ভিড় হয় এখানকার বাসে। ওই লোকটার রং কালো ছিল, সাঁওতাল নাকি বাঙালি, পুরুলিয়ার অথবা বাঁকুড়ার? ওর সমাজও কি মাতৃতান্ত্রিক কিন্তু বাঁশি কেন প্রেমের, প্রেমিকার উপহার কি? নাকী অভিসার সংকেত
—কোর পরা, স্যার?
—ঘরর পরা— ।
—আজি আরু কালি স্কুল বন্ধ ডিক্লেয়ার —?' (প্রসিদ্ধ রক্ত)
বরাক উপত্যকার মানুষের মুখের ভাষাকে নাগরিক পরিশীলন থেকে সযত্ন দুরে রেখে স্বকীয়তায় বিশিষ্ট থাকতে পেরেছেন বদরুজ্জামান চৌধুরি। বদরুজ্জামানের কথারচনায় গ্রামজীবনের দ্বেষ, হিংসা, ভালোবাসা সবই স্থাবর সম্পদের সারল্যে উঠে আসে। তার রচনার রূপময়তা অননুকরণীয়—
‘আইতাম কুনবালা’ গালে পান সুপারি চুনসাদায় পুঁটুলিটা ঠেসে দিয়ে কিছুক্ষণ চিবোলো ফাজরের বউ। তারপরে প্যাঁচ করে বেশ খানিকটা পিক-লালা-কফ মিশ্রিত তরল পদার্থ নিক্ষেপ করলো দাওয়ার ঠিক নীচেই। ফুলজান ঘৃণায় বিরক্তিতে তবু নিরুপায়, যেখানে সেখানে পিক্ থুথু ফেলা তার নাপছন্দ, কিন্তু মামীকে কিছু বলাও যায় না। যা চোপা, ঝগড়া বাঁধিয়ে কুরুক্ষেত্র করবে। ফজিরের পেয়ারের বিবিজান পিক উৎক্ষেপিত করার পর মুখবিবরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চিবানো সুপারির মণ্ড একটু ওলটপালট করে নিয়ে বলল, ‘তুইন তো আরামে আছোস্, বাইচ্চা কাইচ্চা নাই, বিয়ার তো তিন বছর অই গেল। আমার বুকো, পিঠো, কান্ধো কাঁখো পনে দুই গণ্ডা। এরে গো, ওষুধ-ফসুধ থুড়া কুছ খাইছত নি? আইজ কাইল তো কত রকমোর ছিনালী বারইছে। তিন বছরে তো চাইরটা বাইচ্চার দুনিয়া দেখার কথা। তর ভাইছাব হিদিন আমারে জিগার করলো।’ (ফুলজান বিবির কথামালা)
কথাকারের কাছে সংবাদপত্রে চাকরি করার মতো শ্লাঘনীয় পেশা দ্বিতীয় নেই। বাহারউদ্দিন এক সময় গল্প লিখতেন, এ উচ্চারণ উপত্যকাবাসীর কাছে পীড়াদায়ক। এখন কেন লেখেন না। উপভাষা প্রয়োগকারী যে-কোনো কথাকারই বরাকের পাঠকের বড়ো আপনজন। কাজের ব্যস্ততা যদি তার গল্প লেখায় ব্যাঘাত ঘটায় তবে বলতেই হয় ‘কাম না কচু। সব ব্যাটাই নিমক হারাম।’
‘——পুয়ারে তো মানুষ করছত। আইজ আর বাড়ি আয় না। এই অয় বুঝলি?
—কী করি কও? পুয়া আমার বড়ো অইছে। মানুষ অইছে। তার কত কাম-কাজ ঈদের দিনও আইল না।
—কাম না কচু। সব ব্যাটাই নিমক হারাম।
—না মাই। আমার পুয়া মার লাগি বেহুস।
—অইচ্ছা পুয়ার লাগি বড়াই করতে অইত নায়। জানি জানি। সব কথাউ জানি। পুয়ায় তরে ভুলি গেছে। তার চকুত রঙ ধরছে।’ (নিজের সঙ্গে দেখা)
দুই ভাই গল্পকারের গল্প বলার আগে আর এক ভুবন বেড়িয়ে আসা যাক। আমাদের প্রতিবেশি বাংলার দ্বিতীয় ভুবনের লেখক হাসান আজিজুল হকের গল্পে উপভাষার শব্দ কেমন ব্রহ্মসমান বিদ্ধ করে আমাদের মর্ম। একটি মাত্র শব্দ এখানে তীর হয়ে ছুটেছে ‘নাইখো।’—
“...। বাচ্চা হয়েছিল তোর, তার কী হলো রে?
তার সেই নিচু কর্কশ গলায় সে বলে, ‘নাইখো’
কেন, কোথায় দিয়েছিস তাকে? কঠিন গলায় আমি বলি। আমার হঠাৎ রাগ হয়ে যায়।
কিছুমাত্র পরিবর্তন নেই তার মধ্যে। ঠিক আগের কথাটিই আবার বলে, নাইখো।
কোথায় কাকে দেয় সে সন্তান? দেবতাদের শাপমুক্ত করছে নাকি? আয়েশা ধীর পায়ে গাছতলার দিকে ফিরে যায়।” (জননী)
শুভঙ্কর চন্দের ‘চরমানুষ’ গল্পের কথায় যাওয়ার আগে আয়েশার কথা বলে নেওয়া গেল। মরিয়ম বিবির গল্প আয়েশার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা। মরিয়মের হাহাকারের সাথে আয়েশার দুঃখ একাকার করা যায় না। উপরের কথা অংশে ‘নাইখো’ যদি শব্দের চরম হয় তবে ‘পকেটমারের কিচ্চা ইতা হুদা মিছা’ কথার শীর্ষ।—
‘অনেকবার সাহস সঞ্চয় করিয়া আবার ভীত হইয়া পড়িয়া একসময় দুম করিয়া শামাদ বলিয়া ফেলিল: ‘তুমি আইচ্ছা কইলেউ যাইব।’ মরিয়ম প্রথমে কথাটা বুঝিল না। কিন্তু হঠাৎ একেবারে লাফ মারিয়া মাচাং এ উঠিয়া বসিয়া কহিল: যায়। ‘মানে?’ শামাদও ততক্ষণে উঠিয়া বসিয়াছে। সন্ত্রস্ত সতর্ক গলায় বলিতে লাগিল— ‘ঔষদ পন্র টেকা, খাওয়া পাঁচ টেকা, আর আড়াই টেকায় বাইচ্চাটার গঞ্জি একটা, আড়াই টেকা মালিকর বিবিরে দিয়াইছি, বেটিরে কাইল সকালে একটু দেখত খাইবার দিত এর লাগি.... পকেটমারের কিচ্ছা ইতা হুদা মিছা।’ (চর-মানুষ)
তপোধীর ভট্টাচার্যর গল্পবিষয়ক বিখ্যাত প্রবন্ধের প্রধান অংশ জুড়ে আছে অভিজিৎ সেন এর ‘মাছ’ গল্প। পশ্চিম বাংলারই ভৌগোলিক বিভাগ উত্তরবঙ্গের লেখক অভিজিৎ সেন এর ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ মূলহীন মানুষের মূলে যাওয়ার, বেঁচে থাকার লড়াই-এর ইতিহাস। নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনার অন্যতম। তবে ‘মাছ’ গল্পে যে লড়াই-এর কথা বলেছেন প্রবন্ধকার, সে-সত্যকে মেনে নিয়েও বরাক উপত্যকার গল্পকার তীর্থঙ্কর চন্দ’র গল্প ‘ছমছু মিয়ার মাছ’কেও লড়াই এবং কথাবয়নের সার্থকতায়, সমসাময়িকতার দৃষ্টান্তে, পংক্তি থেকে দূরে রাখার মতো নয়—এ সত্য মনে করিয়ে দিতেই উদ্ধৃতি—
‘দু-জনেই জালের দু-দিকে দাঁড়িয়ে মাছগুলোকে ধরে খলইতে রাখে। জীবনের স্বাদ। ‘মাছ লামিতরারে। ছুবে জাল ফালাও।’ খলই-এর ভেতরে মাছগুলি লাফায়। ছমছু ভাবে কোনটা আগে আনবে। ‘পানী’র কাপড় খুব দরকার। ... দুই তিন দিন খালেকর তশলাদি চালানি যাইব। হিতার পাক অইলে তেউ পাক করা অউত্য। আর ‘আল্লায় অলা পাঁচ দশ খেও মাছ দিলে হাবুইতা অইব।’ নিজের মনকে নিজেই বোঝায় ছমছু। এবার নেশাটা জমছে। মাছ জালে না পড়লে নেশার ঘনত্ব কমতে থাকে। ‘তুল’। চার-পাঁচটা ‘ঘুড়া’ আর চার-পাঁচটা ‘লাচর বাচ্চাইন’। সত্যি মাছ ‘লামের’। আলিম মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। ‘কানর দুল’ কালই কিনবে। ‘শিলচর বেজান দাম’। (ছমছু মিয়ার মাছ)
আর এক প্রধান গল্পকারের একই বিষয়ের উপর রচিত গল্পাংশতে দৃষ্টি দিতে হচ্ছে দুটি কারণে। এক বিষয়, এতেও মাছ এবং বরাক উপত্যকার গল্পের গ্রামীণ সম্পদ যেমন চা বাগান তেমনি তার মাছ তার হাওর আর ‘মাইমল’। ‘মাইমল’দের ব্যবহৃত উপভাষা। দেবব্রত চৌধুরির গল্পের উপাদান কদাচিৎ সখের শহর। ‘বুড়ো হাজিম আপশোষ করে ‘ধুর এমনটা জাইনলে আইজকা ঘরথ্যা বারাইতাম না।’
আপশোষ নীলকণ্ঠেরও, কিন্তু সে হতাশ নয়। জলের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে ‘খাড়অও হাজু ভাই, বড়ো মাছ আইজকা লাগাইমুই, নাওখান বার কইর্যা হাওরের মুখো নেওন লাগে।’
দুধনাথের ভয়টা এখনও কাটেনি। আমতা আমতা করে বলে, হিয়ানদা জলর টান যে বড়ো জব্বর গো নীলুদা!’
নীলকণ্ঠ এবারে ক্ষেপে যায়, ‘জানের অত দরদ তোর আইল ক্যারে, যা ঘরো মার বুক চুষগা যা’। (চোরাঘূর্ণি)
কথার পিঠ চেপে কথা আসে। দেবব্রত চৌধুরি বরাকপারের কথাকার আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলার দ্বিতীয় ভুবনের শ্রেষ্ঠ লেখক। ইলিয়াস বাংলাদেশের প্রতিটি উপভাষায় সমান দক্ষ। সংলাপ রচনার জাদুও তার করায়ত্ত। উপভাষার সঠিক উচ্চারণে ধ্বনিতত্ত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন, ‘গোলজার’ বানানের শুদ্ধতায় গুলজারকে হারিয়ে দেয়। দেবব্রত চৌধুরির গল্পের উদ্ধৃতাংশের শেষ কথাটি কেমন অবিকল ইলিয়াসের গল্পাংশে এসে গেছে। ইলিয়াস একটু উচ্চকিত, দেবব্রত তেড়েফুঁড়ে না হোক দারুণভাবে তো বেরিয়ে এলেন। ইলিয়াসের গল্পাংশ—
‘ল, গঙ্গাজলিটার মইদ্যে একটা পাক দিয়া যাই। আউজকা তরে বউনি করাইয়া দেই।’
‘না ওস্তাদ।’
—‘তে চল, এ্যাম্বে বইয়া থাকবি, এক বোতল মাল টানবি, আমি কাম সাইরা বারাইয়া আহুম চল।’
‘না ওস্তাদ।’
‘যা ঘরে গিয়া বউয়ের বুনি চোষ গিয়া।’ আসাদুল্লা চটে যায়।
‘তরে মানুষ করতে পারলাম না গোলজার।’ (তারাবিবির মরদপোলা)
পাঁচ
উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি সাজিয়ে কী পরিচয় হলো, পাঠককে লেখক সাজিয়ে সে জবাব চাওয়া যায়। উত্তর একবাক্যই হবে, উপভাষার ব্যবহার যথেষ্ট এবং সার্থক বরাকভূমিতে। সমস্যা মিটল কি। সমস্যা তার অবস্থানেই স্থির আছে। পশ্চিমবাংলা, বাংলাদেশ আর বরাক উপত্যকার ত্রয়ী অবস্থানকে পৃথক করে দেখা, অভিমানেরই নামান্তর। আমরা অন্য কোনো কারণে বাংলার মূল ভাষা-অ্যারিনার ঢুকতে পারছি না। বা শূন্যমূল বয়নভাবনা আমাদের কথাকে ভিত দিতে পারছে না। হয়তো কথা রচনায় সাধারণ তত্ত্বভাবনার অভাব রয়েছে। উপভাষার ব্যবহারে বিকল্প বাস্তবের বীজতলি তৈরি করতে বিকল্পবয়ন-ভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। পথও ঠিক হয়ে আছে, মানুষের মুখের কথা, ভাষাই হবে তার কথা রচনার কথা। মানুষের ভাষা, মানুষের মুখের কথাকে যেমন শুনছি যেমন দেখছি বয়নে নিয়ে আসছি বলেই হয়তো বাস্তবতা থেকে দূরে থাকছে আমাদের কথা-রচনা। বিকল্প বাস্তবকে ছুঁতে গিয়েও অধরা থাকছে। পাঠক নিজেকে চিনতে পারবে আভাসে, চেনা আধো চেনা এক আলো-আঁধারির বিশ্বস্ত অপর বাস্তবতায় নিমগ্ন হবে পাঠক। লেখকের মধ্যস্থতায় সঠিক বাস্তব বিকল্প পাঠে সময় হারানো বিশ্বময়তায় পরিব্যাপ্ত হবে। তাই, বরাক উপত্যকার কথাসাহিত্যে উপভাষা ব্যবহারে সার্থক হয়েও সঠিক পাঠকৃতি, বয়নের অন্তর্গত আপাত-পাঠ থেকে প্রকৃত-পাঠে উত্তরণ, নির্মাণ-অতিরিক্ত মাত্রা-সংকেত বা কৃৎকৌশলগত পটুত্ব। সমস্যাহীনতা থেকেও যেসব সংকটের আভাস পাওয়া গেল তা নিরসনের একমাত্র উপায় আমার প্রাথমিক প্রস্তাবেই নিহিত রয়েছে। লেখক-পাঠক সম্পর্কের নিবিড়তা আর মানুষের কথা কথনের নব্যভাষা দিয়ে বাস্তবকে নতুনত্ব দেওয়া, যা আছে সেও যেমন সত্য, তেমনি সত্যকে সত্যের অধিকে নিয়ে যাওয়াতেই শব্দকঙ্কালে রূপারোপের একমাত্র উপায়।