উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/তারপর?

তারপর?

 এক যে রাজা;তার ভারি গল্প শোনার শখ। কিন্তু তা থাকলে কি হয়, রাজামশাইকে কেউ গল্প শুনিয়ে খুশি করতে পারে না।

 রাজামশাই বলেন, ‘যে আমাকে গল্প শুনিয়ে খুশি করতে পারবে, তাকে আমার অর্ধেক রাজ্য দিব, না পারলে কান কেটে নিব।’ তা শুনে দেশ বিদেশের কত ভারি ভারি নামজাদা গল্পওয়ালা কোমর বেঁধে গোঁফে তা দিয়ে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে আসে, কিন্তু কেউ রাজামশাইকে খুশি করতে পারে না। যাবার সময় সকলেই কাটা কান নিয়ে দেশে যায়।

 গল্প বলতে গেলেই রাজামশাই খালি বলেন, ‘তারপর?’ ‘তারপর’ ‘তারপর’ করে গল্পওয়ালার দফা শেষ করে তবে তিনি ছাড়েন। রাক্ষস মরে গেল’— ‘তারপর?’ রাজপুত্র বেঁচে গেলেন— ‘তারপর?’ বৌ নিয়ে দেশে এলেন’- ‘তারপর?’ ভারি আনন্দ হল— ‘তারপর? আমার কথা ফুরল’ ‘তারপর?’ নটে গাছটি মুড়ল’—‘তারপর?’ এমনি করে আর কত বলবে? কাজেই শেষে একবার তাকে বলতে হয়, ‘আর আমি জানি না’ বা ‘আর বলতে পারছি না।’

 তা হলেই রাজা বলেন ‘তবে গল্প বলতে এসেছিলে কেন? কাট তবে বেটার কান।’

 এই ত ব্যাপার। রাজামশাইয়ের তারপরের শেষও কেউ করে উঠতে পারে না, অর্ধেক রাজ্যও পায় না, লাভের মধ্যে কানটি যায়।

 সেই দেশে থাকে এক নাপিত সে বড় কুঁড়ে, কিন্তু ভারি সেয়ানা। সে ভাবল অর্ধেক রাজ্য যদি পাই;তবে নেহাৎ মন্দ হবে না;একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি? নাহয় কানটা যাবে।

 এই বলেই সে জামা জোড়া পরে, মস্ত পাগড়ি বেঁধে, লম্বা ফোঁটা কেটে, রাজার সভায় গিয়ে লম্বা সেলাম ঠুকে জোড়হাতে বলল, ‘মহারাজের জয় হোক হুকুম হয়ত কিছু গল্প শোনাই।’

 রাজা বললেন ‘ভাল, ভাল, কিন্তু আমার সর্ত জান ত, খুশি করতে পারলে অর্ধেক রাজ্য দিব, না পারলে কানটি কেটে নিব।’

 নাপিত বলল, ‘আমার গল্পের আগাগোড়া শুনতে হবে, মাঝখানে থামতে বলতে পারবেন না।’

 রাজা বললেন, তাই সই, আমিও ত তাই চাই।

 তখন নাপিত চাকর মহলে গিয়ে আচ্ছা করে ছিলিম আট দশ তামাক টেনে এসে খুব গম্ভীর হয়ে বলতে লাগল। —মহারাজ, এখান থেকে অনেক দূরে এক আজব দেশ আছে। অমনি মহারাজ বললেন, ‘তারপর?’

 সেইখানে অনেকদিন আগে ভারি নামজাদা এক রাজা ছিলেন। —‘তারপর?’

 তার রাজ্যের একধার থেকে আরেক ধার যেতে ছ’মাস লাগত। —‘তারপর?’

 আর সে রাজ্যের মাটি যে কি সরেস ছিল, কি বলব?—তারপর? তাতে একসের ধান বুনলে, দশমন ধান পাওয়া যেত—তারপর?

 তাই দেখে রাজামশাই তাঁর রাজ্যের সকল জমিতে ধানের চাষ করালেন।—তারপর?

 আর তাতে ধান যা হল! সে ধান রাখবার জন্য যে গোলা তয়ের হয়েছিল, তার একধারে দাঁড়ালে আর এক ধার দেখা যেত না।—তারপর?

 লাখে লাখে মোষের গাড়ি লেগেছিল, সে ধান গোলায় আনতে। এত বড় গোলা তাতে একেবারে বোঝাই হয়ে গিয়েছিল, আর-একটু হলেই ফেটে যেত।—তারপর!

 তারপর সেই ধানের খবর পেয়ে পঙ্গপাল যা এল! পঙ্গপালে দশদিক ছেয়ে গেল, আকাশ অন্ধকার, হাওয়া চলবার জো নাই, শ্বাস টানলে ঝাঁকে ঝাকে পঙ্গপাল নাকে ঢোকে।—তারপর? তারপর?

 বেটারা এসেছে ধান খেতে। কিন্তু রাজামশায়ের গোলা কি যেমন তেমন করে গড়া? পঙ্গপালের সাধ্যি কি, তাতে ঢুকবে? দশদিন বেটারা বন্ বন্ করে গোলার চারধারে ঘুরে বেড়াল, বেড়ার কোনখানে একটা বিঁধ বার করতে পারল না।—তারপর? তারপর?

 তারপর এগার দিনের দিনে কয়েকটা ডানপিটে ছোকরা পঙ্গপাল খুঁজে খুঁজে কোথেকে গিয়ে একটা বিঁধ বার করেছে, অনেক ঠেলাঠেলি করলে তা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়।—তারপর? তারপর?

 তখন তাদের পালের গোদাটা এসে সেই বিঁধের মুখে বসে বলল, ঠ্যাল্ ত রে বাপু— সকলে তোরা সবাই মিলে, দেখি, ভিতরে ঢুকতে পারি কি না— তারপর?

 তারপর, ওঃ, সে কি বিষম ঠেলাঠেলি, গোদা বেটা চ্যাপ্টা হয়ে গেল, তবু বলল, ‘ঠ্যাল ঠ্যাল।’— তারপর?

 শেষে অনেক কষ্টে, অর্ধেক ছাল বাইরে রেখে তবে গিয়ে ভিতরে ঢুকল—তারপর?

 ঢুকে একটি ধান মুখে করে নিয়ে, বিঁধের কাছে এসে বলল, এবারে আমাকে টেনে বার কর।—তারপর? ওহ! সে কি টানাটানি! আর একটু হলেই বেটা ছিঁড়ে যেত। যা হোক অনেক কষ্টে সে ধানটি নিয়ে বাইরে এল।—তারপর?

 তারপর আর-এক বেটা গিয়ে বসেছে সে বিঁধের মুখে, আর তেমনি ঠেলাঠেলির পর ভিতরে ঢুকেছে আর একটি ধান নিয়ে তেমনি টানাটানির পর বাইরে এসেছে।—তারপর?

 তারপর আরেক বেটা—আরেক বেটা।—তারপর আরেক বেটা। তারপর? আরেক বেটা।—

 রাজামশাই যতই বলেন, তারপর? নাপিত ততই খালি বলে, আরেক বেটা।—

 দণ্ডের পর দণ্ড এইভাবে গেল, রাজামশাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, কিন্তু না শুনে উপায় নেই।—বলছেন আগা-গোড়া শুনবেন, থামিয়ে দিতে পারবেন না। সন্ধ্যার সময় রাজামশাই আর থাকতে না পেরে বললনে, ‘আরে, আর কত বলবে? এখনো কি শেষ হল না?’

 নাপিত জোড়হাতে বলল, ‘সে কি মহারাজ? সবে ত আরম্ভ। গুটি কয়েক পঙ্গপাল সবে গুটি কয়েক ধান নিয়েছে। এখনো গোলা ধানে বোঝাই, আকাশ পঙ্গপালে অন্ধকার।’

 কাজেই আর কি করা যায়? আরো দুদিন বসে পঙ্গপালের কথা শুনলেন। তারপর আর কিছুতেই থাকতে না পেরে, কেঁদে বললেন, ‘আমার ঢের হয়েছে বাবা, অর্ধেক রাজ্য নেও, নিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও, আমি একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।’

 তখন নাপিতের খুব মজা হল।