উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/বুদ্ধিমান চাকর

বুদ্ধিমান চাকর

 এক কাজি সাহেবের এক চাকর ছিল তার নাম বুদ্ধু। চাকরটা একে বিদেশী, তাতে বুদ্ধিসুদ্ধির ধার ধারে না কাজেই কাজি সাহেবের মহা মুস্কিল। চাকরটা কায়দা কানুন কিছুই জানে না বাড়িতে লোক আসলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একদিন কাজি সাহেব তাকে দুই ধমক দিয়ে বলেন, ‘ফের যদি এরকম বেয়াদবী করিস—কাউকে সেলাম না করিস তবে তোকে আমি দেখাব। সকলকে খাতির করবি আর ‘সেলাম’ বল্‌বি।

 সেই থেকে রাস্তায় বেরিয়ে যাকে দেখে সকলকেই বুদ্ধু ‘সেলাম’ করে। ছেলে বুড়ো মানুষ গরু কাউকে বাদ দেয় না। এক গাধাওয়ালা তার গাধা নিয়ে চলেছে—চাকরটা তাকে সেলাম করল আর গাধাগুলোকেও খুব খাতির করে বলল “সেলাম”। তা শুনে গাধাওয়ালা খুব হাসতে লাগল, আর বলল, ‘দূর আহাম্মক ওদের বুঝি সেলাম বলতে হয়;ওদের “হেই হেই” ক’রে চালাতে হয়।’ বুদ্ধ বেচারা কিছু দূর গিয়ে দেখল একজন শিকারী ফাঁদ পেতে বসে আছে, আর অনেকগুলো পাখি সেই ফাঁদের কাছে ঘুরছে। তাই দেখে সে ‘হেই হেই’ করে এম্‌নি চেঁচিয়ে উঠ্‌ল যে পাখি টাখি সব উড়ে পালাল। শিকারী ত চটে লাল!

 আর-একদিন এক বড় লোকের বাড়িতে কাজি সাহেবের নেমন্তন্ন। বুদ্ধু ও সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে। তারা নবাব বংশের লোক—আশ্চর্য তাদের আদবকায়দা। খেতে খেতে নিন্ত্রণকর্তার দাড়িতে একটা ভাত পড়ল—ওমনি একজন চাকর যেন গান করছে এমনি ভাবে গুণ গুণ ক’রে বলতে লাগল—

ফুলের তলে বুল্‌বুল ছানা
তারে উড়িয়ে দেনা—উড়িয়ে দেনা—

 অমনি তার মনিব ইশারা বুঝতে পেরে দাড়ি ঝেড়ে ভাত ফেলে দিল।

 কাজি সাহেব বাড়ি এসে বুদ্ধকে বললেন, ‘দেখ্‌লি ত কেমন কায়দা! আমার দাড়িতে যদি খাবার সময় ভাত লাগে তুইও ঠিক তেমনি ক’রে বলবি।’ তারপর একদিন কাজি সাহেবের বাড়িতে খুব ভোজ হচ্ছে, কাজি সাহেব চাকরের কেরামতি দেখাবার জন্য ইচ্ছা করে তাঁর দাড়িতে একটা ভাত ফেলে দিলে আর বুদ্ধুকে চোখ টিপে ইশারা করলেন। বুদ্ধ অমনি চেঁচিয়ে বল, ‘সেই যে সেদিন অমুক্‌দের বাড়িতে না কিসের কথা হয়েছিল? আপনার দাড়িতে তাই হয়েছে নানা তানা।’ শুনে সব লোক হো হো করে হেসে উঠল।

 একদিন মনিব বল্লেন, ‘দেখ্‌ তুই বড় বিশ্রী ভাত রাঁধিস। তুই এখনো ফেন গালাতেই শিখিস নি। আজ যখন ভাত বানাবি, ভাত সিদ্ধ হ’লেই আমাকে ডাকিস আমি দেখিয়ে দেব। আমাকে না দেখিয়ে কিছু করিস্‌ নি।’

 সেদিন ভাত সিদ্ধ হতেই ত চাকর মনিবকে ডাকতে গিয়েছে। দরজার বাইরে থেকে উঁকি মেরে একটা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সে মনিবকে ডাকতে লাগল। কাজি সাহেব তখন দরজার দিকে পিছন ফিরে কি যেন লিখছিলেন তিনি এসব কিছুই জানেন না। চাকরটা ঘণ্টাখানেক এইরকম ডেকে শেষটায় হয়রান হয়ে পড়ল। তখন সে রেগে চিৎকার করে বলল, ‘আর কতক্ষণ ডাকব? এদিকে ভাতটাত সব ত পুড়ে ছাই হয়ে গেল।’ তখন কাজি সাহেব ফিরে দেখেন চাকর তাঁকে একটা আঙুল দিয়ে ইশারা করেছে—ওদিকে সত্যি সত্যিই ভাত পুড়ে ছাই।

 একদিন রাত্রে কাজি সাহেবের বাড়ি চোর ঢুকেছে। বুদ্ধু খচ্‌মচ্ শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে রে? চোরটা গম্ভীরভাবে বলল, ‘কেউ নই বাবা, কেউ নই।’ তা শুনে বুদ্ধু আবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে লাগল। সকালে উঠে কাজি সাহেব দেখেন তাঁর সব চুরি হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধুকে জিজ্ঞাসা করে যখন রাত্রের সব শুনলেন তিনি খুব রেগে গালাগালি করতে লাগলেন। কিন্তু বুদ্ধু তাতে মুখ ভারি বেজার করে বলল, ‘তা কি করব—সে আমায় বারবার করে বললে, ‘কেউ নই, কেউ নই’ লোকটা ত দেখছি শুধু চোর নয়—ব্যাটা বেজায় মিথ্যাবাদী।’

 একদিন কাজি সাহেব সহরের বাইরে কোথায় যাবেন। যাবার সময় বুদ্ধুকে বলে গেলেন, ‘দেখিস, দরজাটার উপর ভাল করে চোখ রাখিস দরজা ছেড়ে কোথায়ও যাস নে, তাহলে চোরে আমার সব নিয়ে যাবে।’ কাজি সাহেব চলে গেলেন—চাকর বেচারা একটা লাঠি নিয়ে দরজায় পাহারা দিতে লাগল। একদিন গেল, দুদিন গেল। তার পরদিন বুদ্ধু শুনল এক জায়গায় ভারি তামাশা দেখান হচ্ছে। তাই ত, বেচারা কি করে? অনেক ভেবে সে করল কি বাড়ির দরজাখানা খুলে সেটাকে ঘাড়ে নিয়ে তামাশা দেখতে গেল। এদিকে বাড়িতে চোর ঢুকে যা কাণ্ড করে গেল সে আর কি বলব! কাজি সাহেব বাড়িতে এসে দেখেন সর্বনাশ, বাড়ির সিন্ধুক আলমারি সব খালি। ওদিকে বুদ্ধ বসে তামাশা দেখছে আর খুব সাবধানে দরজা পাহারা দিচ্ছে।