উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/ভূতের গল্প
ভূতের গল্প
আমি ভূতের গল্প বড় ভালবাসি। তোমরা পাঁচ জনে মিলিয়া ভূতের গল্প কর, সেখানে পাঁচ ঘণ্টা বসিয়া থাকিতে পারি। ইহাতে যে কি মজা; একটা শুনিলে আর-একটা শুনিতে ইচ্ছা করে, দুটা শুনিলে একটা কথা কহিতে ইচ্ছা করে। গল্প শেষ হইয়া গেলে একাকী ঘরের বাহিরে যাইতে ইচ্ছা হয় না। তোমাদের মধ্যে আমার মতন কেহ আছ কি না জানি না, বোধহয় আছে। তাই আজ তোমাদের কাছে একটা গল্প বলিব। গল্পটা একখানি ইংরাজি কাগজে পড়িয়াছি। তোমাদের সুবিধার জন্য ইংরাজি নামগুলি বদল করিয়া দিতে ইচ্ছা ছিল, কিন্তু গল্পটি পড়িলেই বুঝিতে পারিবে যে শুধু নাম বদ্লাইলে কাজ চলিবে না। সুতরাং ঠিক যেরূপ পড়িয়াছি প্রায় সেইরূপ অনুবাদ করিয়া দেওয়াই ভাল বোধ হইতেছে।
‘স্কট্ল্যাণ্ডের ম্যাপ্টার দিকে একবার চাহিয়া দেখিলে বাঁ ধারে ছোট-ছোট দ্বীপ দেখিতে পাইবে। তাহার উপরেরটির নাম নর্থ উইষ্ট্, নীচেরটির নাম সাউথ্ উইষ্ট্। এর মাঝামাঝি ছোট-ছোট আর কতকগুলি দ্বীপ দেখা যায়। এ সেকালের কথা, তখন স্টীম্ এঞ্জিনও ছিল না টেলিগ্রাফও ছিল না; আমার ঠাকুরদাদা তখন এর একটি দ্বীপে স্কুলে মাস্টারি করিতেন।
‘সেখানে লোক বড় বেশি ছিল না। তাদের কাজের মধ্যে কেবল মাত্র মেষ চরান, আর কষ্টে সৃষ্টে কোন মতে দিন চলার মত কিছু শস্য উৎপাদন করা। সেখানকার মাটি বড় খারাপ; তারি একটু একটু সকলে ভাগ করিয়া নেয় আর জমিদারকে খাজনা দেয়। ... এরা বেশ সাহসী লোক ছিল। আর ঐরকম কষ্টে থাকিয়া এবং সামান্য খাইয়াও বেশ একপ্রকার সুখে স্বচ্ছন্দে কাল কাটাইত।
‘এই দ্বীপে এল্যান, ক্যামেরণ্ নামে একজন লোক ছিলেন, তাঁহার বাড়ি গাঁ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে। এল্যানের সঙ্গে মাস্টারমহাশয়ের বড় ভাব, তাঁর কাছে তিনি কতরকমের মজার গল্প বলিতেন। হঠাৎ একদিন ক্যামেরণ্ বড় পীড়িত হইলেন, আর কিছুদিন পরে তাঁহার মৃত্যু হইল। তাঁহার কেউ আপনার লোক ছিল না, সুতরাং তাঁহার বিষয় সমস্ত বিক্রি হইয়া গেল। তাঁর বাড়িটা কেহই কিনিতে চাহিল না বলিয়া তাহা অমনি খালি পড়িয়া রহিল।
এর কয়েক মাস পরে একদিন জ্যোৎস্না রাত্রিতে ডনাল্ড্ ম্যাকলীন বলিয়া একটি রাখাল ঐ বাড়ির পাশ দিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ জানালার দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল, আর সে ঘরের ভিতরে এল্যান্ ক্যামেরণের ছায়া দেখিতে পাইল। দেখিয়া ত তার চক্ষু স্থির! সেখানেই সে হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার চুলগুলি খ্যাংরা কাঠির মত সোজা হইয়া উঠিল, ভয়ে
উপেন্দ্র—৫৯ প্রাণ উড়িয়া গেল, গলা শুকাইয়া গেল।
শীঘ্রই তাহার চৈতন্য হইল। ঐরকম ভয়ানক পদার্থের সঙ্গে কাহারই বা জানা শুনা করিবার ইচ্ছা থাকে? সে ত মার দৌড়। একেবারে মাস্টারমহাশয়ের বাডিতে। তাঁহার কাছে সব কথা সে বলিল। মাস্টারমহাশয় এ সব মানেন না, তিনি তাহাকে প্রথম ঠাট্টা করিলেন, তা্রপরে বলিলেন তাহার মাথায় কিঞ্চিৎ গোল ঘটিয়াছে; আরো অনেক কথা বলিলেন—বলিয়া যথাসাধ্য বুঝাইয়া দিতে চেষ্টা করিলেন যে ঐরূপ কিছুতে বিশ্বাস থাকা নিতান্ত বোকার কার্য।
'ডনাল্ড্ কিন্তু ইহাতে বুঝিল না, সে অপেক্ষাকৃত সহজ বুদ্ধি বিশিষ্ট অন্যান্য লোকের কাছে তাহার গল্পটি বলিল। শীঘ্রই ঐ দ্বীপের সকলেই এই গল্প জানিতে চাহিল। ঐসব বিষয় মীমাংসা করিতে বৃদ্ধরাই মজবুত, তাঁহারা ভবিষ্যতেব সম্বন্ধে ইহাতে কত কুলক্ষণই দেখিতে পাইলেন।
'ঐ দ্বীপের মধ্যে কেবলমাএ মাস্টারমহাশয়ের কাছেই খবরের কাগজ আসিত। মাসের মধ্যে একবার করিয়া কাগজ আসিত আর সেদিন সকলে মাস্টারমহাশয়ের বাড়িতে গিয়া নূতন খবর শুনিয়া আসিত। সেদিন তাহাদের পক্ষে একটা খুব আনন্দের দিন। রান্নাঘরে বড় আগুন করিয়া দশ-বার জন তাহার চারিদিকে সন্ধ্যার সময় বসিয়া কাগজের বিজ্ঞাপন হইতে আরম্ভ করিয়া অমুক কর্তৃক অমুক যন্ত্রে মুদ্রিত হইল ইত্যাদি পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ের তদারকি ও তর্কবিতর্ক করিত। শেষের কথাগুলি সকলেরই একপ্রকার মুখস্থ হইয়াছিল এবং পড়া শেষ হইলে ঐ কথাটা প্রায়ই সকলে একসঙ্গে একবার বলিত।
'এই-সকল সভায় রাখাল, কৃষক, গির্জার ছোট পাদরি প্রভৃতি অনেকেই আসিতেন। গ্রামের মুচি বরীও আসিত। বরী ভয়ানক নাছোড বান্দা লোক, একটা কথা উঠিলে তাহাকে একবার আচ্ছা করিয়া না ঘাঁটিয়া সহজে ছাড়িবে না।’
ডনাল্ড্ ম্যাকলীনের ঐ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন সকলে এইরূপ সভা করিয়া বসিয়াছে, মাস্টারমহাশয় চেঁচাইয়া তর্জমা করিতেছেন, এমন সময় একজন অসিয়া বলিল যে, এল্যান্ ক্যামেরণেব ছায়া আবার দেখা গিয়াছে। এবারে একজন স্ত্রীলোকে দেখিযাছে। ঐ রাখাল যে স্থানে যেভাবে উহাকে দেখিয়ছিল এও ঠিক সইরকম দেখিয়াছে।
‘এরপর আর পড়া চলে কি করিয়া। মাস্টারমহাশয় চটিয়া গেলেন এবং ঠাট্টা করিতে লাগিলেন। বরী তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিবাদ করিল। বরী কোন কথাই ঠিক মানে না, এবারেও মাস্টারমহাশয়ের কথাগুলি মানিতে পারিল না। প্রচণ্ড তর্ক উপস্থিত। ভূতের কথা লইয়া সাধারণভাবে এবং ক্যামেরণেব ভূতের বিষয় বিশেষভাবে বিচার চলিতে লাগিল; আর সকলে বেশ মজা পাইতে লাগিলেন। কিন্তু বরীর মেজাজ গরম হইয়া উঠিল, সে বলিল—
‘দেখ মাস্টারের পো, যতই কেন বল না, আমি এক জোড়া নতুন বুট হারব, তোমার সাধ্যি নেই আজ দুপুর-রেতে ওখান থেকে গিয়ে দেখে এস।’
'সকলে করতালি দিয়া উঠিল। মাস্টারমহাশয় হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিলেন, কিন্তু বরী ছাড়িবে কেন? সে সকলের উপর বিচারের ভার দিল। তাহারা এই মত দিল যে, মাস্টারমহাশয় যখন গল্পগুলি মানিতেছেন না, সে স্থলে তাঁহার উচিত যে নিদেনপক্ষে তিনি যে এ মানেন না তা প্রমাণ করিয়া দেন। মাস্টারমহাশয় দেখিলেন, অস্বীকার করিলে যশের হানি হয়। তিনি বলিলেন, ‘যাব বইকি? কিন্তু আমি গিয়ে ফিরে এলেও এর চাইতে আর তোমাদের জ্ঞান বাড়িবে না।’
বরী—'আচ্ছা দেখা যাউক।’
মাস্টারমহাশয়—'ভাল, ওখানে গিয়ে আমি কি করব?'
'বরী—'ওখানে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনবার বলবে-—'এল্যান ক্যামেরণ আছ গো।’ কোন জবাব না পাও ফিরে এস আমি আর ভূত মানবো না।’
মাস্টারমহাশয় হাসিয়া বলিলেন, ‘এটা ঠিক জেনো যে, এল্যান সেখানে থাকলে আমার কথার উত্তর দিবেই। আমাদেব বড় ভাব ছিল।’
‘একজন বলিল, ‘তাকে যদি দেখতে পাও তা হলে মুচির কাছে যে ও টাকা পেত সে’ কথাটা তুল না।’ এ কথায় সকলে হাসিয়া ফেলিল, বরী একটু অপ্রস্তুত হইল।
'এইরূপে হাসি তামাশা চলিতে লাগিল, ক্রমে মাস্টারমহাশয়ের যাওয়ার সময় হইয়া আসিল।'
শেষে মুচি ঘড়ির দিকে চাহিয়া বলিল, ‘বারটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।’
'তুমি এখন গেলে ভাল হয়, তাহলেই ঠিক ভূতের সময়টাতে পৌঁছতে পারবে।’
'বেশ করিয়া মানসিকভাবে সহজ হইয়া মাস্টারমহাশয় যষ্টি হস্তে সেই বাড়ির দিকে চলিলেন। মাস্টারমহাশয় যাইবার সময় সকলেই দু’ একটা খোঁচা দিয়া দিল, এবং স্থির করিল, ফলটা কি হয় দেখাই যাইবে।’
'রাত্রি অনেক হইল। ততক্ষণে চাঁদ দেখা যাইতেছিল। কিন্তু এক্ষণে কাল কাল মেঘ আসিয়া চাঁদকে ঢাকিয়া ফেলিতেছে। মাস্টার চলিয়া গেলে সকলে আরম্ভ করিল যে, সমস্ত রাস্তাটা সাহস করিয়া যাওয়া তাহার পক্ষে সম্ভব কিনা। ছোট পাদরি বলিল যে তিনি হয়ত অর্ধেক পথ গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া যাহা ইচ্ছা বলিবেন, তখন আর কাহারো কিছু বলিবার থাকিবে না। ইহা শুনিয়া মুচির মনে ভয় হইল জুতাজোড়া যদি নেহাত ফাঁকি দিয়া নেয়, এটা তাহার ভাল লাগিবে না। তখন সকলে প্রস্তাব করিল যে বরী যাইয়া দেখিয়া আসুক।’
'প্রথমে বরী ইহাতে আপত্তি করিল। কিন্তু উহাকে বুঝাইবার পরে রাজি হইল। সকলে তাহাকে সাবধান করিয়া দিল যেন মাস্টার তাহাকে দেখিতে না পায়, তারপর সে বাহির হইল। খুব চলিতে পারিত এই গুণে শীঘ্রই সে মাস্টারকে দেখিতে পাইল। বরী একটু দূরে দূরে থাকিতে লাগিল—রাস্তাটা একটা জলা জায়গার মধ্য দিয়া একটি গাছপালা নাই যে মাস্টার ফিরিয়া চাহিলে তাহার আড়ালে থাকিয়া বাঁচিবে।'
‘পরে মাস্টারমহাশয় যখন ঐ বাড়িতে পৌঁছিলেন তখন বরী একটু বুদ্ধি খাটাইয়া খানিকটা ঘুরিয়া বাড়ির সমুখে আসিল। সেখানে একটা নিচু বেড়া ছিল, তাহার আড়ালে শুইয়া পড়িল।'
‘সে অবস্থায় দূতের কার্য করিতে যাইয়া তাহার অন্তরটা গুর গুর করিতে লাগিল। মাস্টারমহাশয় ছিলেন বলিয়া, নহিলে সে এতক্ষণ চেঁচাইয়া ফেলিত। কষ্টেসৃষ্টে কোন মতে প্রাণটা হাতে করিয়া দেখিতেছে কি হয়। মনে করিয়াছে মাস্টারমহাশয় যেরূপ ব্যবহার করেন তাহা দেখা হইয়া গেলেই সে বাহির হইবে।'
‘গ্রামের গির্জার ঘড়িতে বারটা বাজিল। সে বেড়ার ছিদ্র দিয়া চাহিয়া দেখিল যে মাস্টারমহাশয় নির্ভয়ে দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
‘মাস্টারমহাশয় গলা পরিষ্কার করিলেন এবং একটু শুষ্ক স্বরে বলিলেন—
‘এল্যান্ ক্যামেরণ আছে গো!’ —কোন উত্তর নাই।
‘দু-এক পা পশ্চাৎ সরিয়া একটু আস্তে আবার বলিলেন, ‘এল্যান্ ক্যামেরণ্ আছ গো!’— কোন উত্তর নাই।
‘তারপর বাড়িতে আসিবার রাস্তাটির মাথা পর্যন্ত হাঁটিয়া গিয়া থতমত স্বরে অর্ধ চিৎকার অর্ধ আহ্বানের মত করিয়া তৃতীয়বার বলিলেন, ‘এল-ক্যামেরণ—আছ—।’ তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা নাই। —সটান চম্পট।
‘কি সর্বনাশ! কোথায় মাস্টারের সঙ্গে বাড়ি যাইবে, মাস্টার যে এ কি করিয়া ফেলিলেন। মুচি বেচারীর আর আতঙ্কের সীমা নাই। তবে বুঝি ভূত এল। আর থাকিতে পারিল না। এই সময়ে তার মনে যে ভয় হইয়াছিল, তারই উপযুক্ত ভয়ানক গোঁ গোঁ শব্দ করিতে করিতে সে মাস্টারমহাশয়ের পেছনে ছুটিতে লাগিল।
‘সেই ভয়ানক চিৎকার শব্দ মাস্টারমহাশয়ের কানে গেল। মুচি দৌড়িতেছে আর ডাকিতেছে ‘দাঁড়াও গো মাস্টারমশাই! দাঁড়াও!’ মাস্টারমহাশয় শুনিতে পাইলেন। পশ্চাতে একপ্রকার শব্দও শুনিতে পাইলেন। আর কি? ঐ এল্যান্ ক্যামেরণ! ভয়ে আরো দশ গুণ দৌড়িতে লাগিলেন। ররী বেচারা দেখিল বড় বিপদ! ফেলিয়াই বুঝি গেল। কি করে তারও প্রাণপণ চেষ্টা। মাস্টারমহাশয় দেখিলেন পাছেরটা আসিয়া ধরিয়াই ফেলিল। তাঁহার গায়ের বল চলিয়া যাইতে লাগিল।
‘অবশেষে মাস্টারমহাশয় যখন দেখিলেন যে আর রক্ষা নাই, তখন তিনি সাহসে ভর করিলেন, এবং খুব শক্ত করে লাঠি ধরিয়া সেই কল্পিত ভূতের দিকে ফিরিলেন এবং আর মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া যত জোর ছিল একবার সেই কল্পিত ভূতের মস্তকে সপাট— সাংঘাতিক এক ঘা। তারপর সেটাও যেন কোথায় অন্ধকারে অদৃশ্য হইল।
‘ভূতটা যাওয়াতে এখন একটু সাহস আসিল, কিন্তু তথাপি যতক্ষণ গ্রামের আলোক না দেখা গেল ততক্ষণ থামিলেন না। গ্রামের প্রবেশ করিবার পূর্বে সাবধানে ঘাম মুছিয়া ঠাণ্ডা হইয়া লইলেন। মনটা যখন নির্ভয় হইল তখন ঘরে গেলেন—যেন বিশেষ একটা কিছু হয় নাই। অনেক কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিনি সকলগুলিরই উত্তরে বলিলেন
‘ঐ আমি যা বলেছিলাম; ভূতটুত কিছুই ত দেখতে পেলাম না!’
এরপর মুচির জন্য সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিল। মাস্টারকে তাহারা বলিল যে, সে স্থানান্তরে গিয়াছে, শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবে।
‘আধঘণ্টা হইয়া গেল তবু মুচি আসে না। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। চিন্তা বাড়িতে লাগিল, ক্রমে একটা বাজিল! তারপর আর থাকিতে পারিল না, মুচির অনুপস্থিতির কারণ তাহারা মাস্টারমহাশয়কে বলিয়া ফেলিল, মাস্টারমহাশয় শুনিয়াই চিৎকার করিয়া উঠিলেন। লাফাইয়া উঠিয়া লণ্ঠন হাতে করিয়া দৌড়িয়া বাহির হইলেন এবং সকলকে পশ্চাৎ আসিতে বলিয়া দৌড়িয়া চলিলেন।
‘সকলেরই বিশ্বাস হইল মাস্টারমহাশয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাইয়াছে। হৈ চৈ কাণ্ড! সকলেই জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারটা কি? তাড়াতাড়ি ঘরের বাহিরে আসিয়া তাহারা মাস্টারকে দাঁড়াইতে বলিতে লাগিল। তাঁহাদের শব্দ শুনিয়া কুকুরগুলি খেউ খেউ করিয়া উঠিল। কুকুরের গোলমালে গাঁয়ের লোক জাগিল! সকলেই জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারখানা কি?
‘এই সময়ে মাস্টারমহাশয় জলার মধ্য দিয়া দৌড়িতেছেন। মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে— কেবল পুলিস—মাজিস্ট্রেট—জুরী ইত্যাদি ভয়ানক বিষয় মনে হইতেছে। তাঁহার লণ্ঠনের আলো দেখিয়া অন্যেরা তাঁহার পশ্চাৎ আসিতেছে।
সকলে তাঁহার কাছে আসিয়া তাঁহাকে ধরিল এবং ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। মাস্টারমহাশয়ের উত্তর দিবার পূর্বেই সেই মাঠের মধ্যে হইতে গালি এবং কোঁকানি মিশ্রিত একপ্রকার শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। কতদূর গিয়া দেখা গেল একটা লোক জলার ধারে বসিয়া আছে। লণ্ঠনের সাহায্যে নির্ধারিত হইল যে এ আর কেহ নহে, আমাদের সেই মুচি। সেইখানে বেচারা দুই হাতে মাথা চাপিয়া বসিয়া আছে আর তাহাদের মাস্টারের উদ্দেশ্যে গালাগালি দিতেছে। তাহার নিকট হইতে সকলে সমস্ত ঘটনা শুনিল।
‘শেষে অনুসন্ধানে জানা গেল যে ঐ বাড়ির জানালার ঠিক সম্মুখে একটা ছোট গাছ ছিল। তাহারই ছায়া চন্দ্রের আলোকে দেয়ালে পড়িত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সেই ছায়ার আকৃতি দেখিতে ঠিক ক্যামেরণের মুখের মত। সেদিন চন্দ্র ছিল না বলিয়াই মাস্টারমহাশয় সেই ছায়া দেখিতে পান নাই।’