উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/জলকণার গল্প

জলকণার গল্প

 খোকার জল খাইবার ছোট গেলাসটিতে বিরানববই লক্ষ কোটি জলের অনু আছে। তাহা কি সকলেই একস্থান হইতে আসিয়াছে? ঝি তাহাদিগকে কলসী হইতে আনিয়াছে বটে, রামা চাকর কলসীতে করিয়া তাহাদিগকে পুকুর হইতে আনিয়াছিল বটে, কিন্তু পুকুরে তাহারা কোথা হইতে আসিল? খোকা এই কথা ভাবিতেছে। জলকণাবা যদি কথা কহিত, আর খোকা যদি তাহাদিগকে এই সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিত, তবে অবশ্যই তাহারা তাহার উত্তর ভালোরূপ দিতে পারিত। ইহার উত্তরে তাহারা কত আশ্চর্য গল্পই বলিতে পারিত। মনে কর খোকা এক-একটিকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, আর তাহারা উত্তর দিতেছেঃ

 ১ আমরা তিনহাজার জড়াজড়ি করিয়া টুপ করিয়া আকাশ হইতে লাফাইয়া পুকুরে পড়িয়াছিলাম।

 ২ আমরা ষাটলক্ষ রাত্রিকালে গাছের পাতায় বিশ্রাম করিতে বসিয়াছিলাম, সেখান হইতে গড়াগড়ি করিয়া পুকুরে পড়িয়াছিলাম।

 ৩ আমরা ডাঙ্গা হইতে পুকুরে নামিয়াছিলাম।

 ৪ আমরা দলে দলে পর্বত হইতে সমুদ্রে যাইতেছিলাম। পথে বালুকণার ফাঁকের ভিতরে বেড়াইতে গিয়া পথ হারাইয়া ফেলিলাম। শেষে কষ্টেসৃষ্টে সেই বালির ভিতর দিয়া এখানে আসিয়াছে।

 খোকার ক্ষুদ্র মাথায় গোল লাগিয়া গেল। তাহার জিজ্ঞাসা ফুরাইল না। সে আরো কত শত কথাই তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিল। কত কথাই সে শিখিল। ইহারা বলিল, ‘এককালে আমরা সকলেই সমুদ্রে ছিলাম। এখন খোকাবাবু আমাদিগকে গেলাসে পূরিয়া গিলিয়া ফেলিতেছে, তখন আমরা তোমাদের বড়-বড় জাহাজগুলিকে ইচ্ছা করিলে গিলিয়া ফেলিতে পারিতাম। সমুদ্র হইল কি না আমাদের সমাজ। সমুদ্র আর কি? আমরাই তো সমুদ্র। সমুদ্রে যখন ছিলাম, বেশ ছিলাম।”

 ‘একবার বড় গরম হইল। গরম হইলে অনেকগুলি গা ঘেঁষার্ঘেষি করিয়া থাকিতে বড় কষ্ট হয়। আমরা ফাঁক ফাঁক হইয়া বাতাসে মিশিয়া আকাশে উঠিলাম। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে কত স্থানেই গেলাম, কত তামাশাই দেখিলাম। তখন কিন্তু আমাদিগকে কেহই দেখিতে পাইত না, আমরা বাতাসের ভিতরে ছিলাম।”

 'একদিন বেশ ঠাণ্ডা বোধ হইতে লাগিল। আমরা তখন বাতাসের বাহিরে আসিয়া দলবদ্ধ হইলাম, মনে করিলাম নীচে নামিয়ে দেখি কেমন লাগে। তখন তোমরা আমাদিগকে দেখিতে পাইলে, আর মেঘ বলিয়া ডাকিলে। যখন আমরা পড়িতে লাগিলাম, তখন তোমরা বলিলে ‘বৃষ্টি হইতেছে’। আমাদের কেহ কেহ তোমাদের পুকুরে পড়িলাম। কেহ কেহ অন্য স্থানে পড়িয়াও শেষে কেমন করিয়া পুকুরেই আসিল। আর সকলের কি হইল বলিতে পারি না—’

 এমন সময় খোকার পাতে সন্দেশ পড়িল। খোকা অমনি সব ভুলিয়া গিয়া সন্দেশ লইয়া ব্যস্ত হইল। ইহা নিতান্তই দুঃখের বিষয়। খোকার লোভ একটু কম হইলে আমরা জলকণাদের নিকট আরো কত গল্প শুনিতে পাইতাম৷