উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/দাসত্বপ্রথা: ২
আমরা যাহাদের কথা বলিতেছি তাহদের উপর ঈশ্বর সদয় হইলেন। জাহাজ ছড়িবার পর এক সপ্তাহের ভিতরেই ইলেণ্ডের একখানা যুদ্ধ জাহাজ তাহদের পিছু পিছু আসিয়া দাস-ব্যবসায়ীদিগকে আত্মসমপণ করিতে বলিল। দাস-ব্যবসায়ীরা পলায়নদ্যত হইল। জাহাজ হালকা করিবার জন্য পিপায় পুরিয়া নিগ্রোদিগকে সমুদ্রে ফেলিয়া দিতে লাগিল।
ইহা দেখিয়া ইংরাজদের জাহাজ অধিকতর বেগে অগ্রসর হইতে লাগিল, এবং শীঘ্রই দাস-ব্যবসায়ীদিগকে ধরিয়া ফেলিল। কিছুকাল ভয়ানক যুদ্ধের পর পর্তুগীজেরা পরাজিত হইল, জাহাজ ইংরেজদের হস্তগত হইল, দাসদিগকে উপরে আনিয়া খাইতে দেওয়া হহল এবং তাহারা সেইখানেই থাকিতে পাইল। এরপর জাহাজ লাইবেরিয়ার দিকে চলিল দেখিয়া; বেচারা নিগ্রোদের মনে আনন্দ হইল।
লাইবেরিয়াতে আনিয়া তাহাদিগকে নানা স্থানে পাঠাইয়া যাহাতে তাহাদের জীবিকা উপার্জনের পন্থা হয় তাহার চেষ্টা হইতে লাগিল। আমাদের পরিচিত নিরাশ্রয় মাতৃহীন শিশুটিকে এবং অন্যান্য অনেক শিশুকে মিশনারিদের ইস্কুলে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল। এইখানে থাকিয়া তিনি লেখাপড়া শিখিতে লাগিলেন। মিশনারিরা মাঝে মাঝে তাহাকে উপশিক্ষকের কাজ করিতে দিতেন, তাহাতে তাঁহার বিশেষ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাইয়া, সন্তুষ্ট হইয়া একটি স্কুলমাস্টারিতে তাঁহাকে নিযুক্ত করিলেন। এই সময়ে ইহাকে খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করিয়া জনসাউথ নাম দেয়া হয়। জনসাউথ অনেকদিন এই কার্যে ছিলেন, শেষটা তাঁহাকে প্রচারকের পদে নিযুক্ত করা হইল। এই কার্যে তিনি বিশেষরূপে লোকের শ্রদ্ধা ও ভালোবাস আকর্ষণ করিয়াছেন।
দাসদিগের দুঃখের কথা বলিয়া শেষ করা যায় না। পথে কিরূপ ক্লেশ সহ্য করিতে হইত তাহাই বলিয়াছি। এরপর যাহারা তাহাদিগকে কিনিত, তাহাদিগের নিকট আরো অত্যাচার সহ্য করিতে হইত। সমস্ত দিন ক্রমাগত খাটিতে হইত। সে যে কি ভয়ানক খাটনি তাহা আর কি বলিব! এত খাটিয়াও প্রভুর সন্তোষ নাই, অল্প কাজ হইয়াছে বলিয়া বেত্রাঘাত হইত। সামান্য একটু অবাধ্যতা হইলে তাহাকে মারিয়া তাহার হাড় ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইত যাহারা টমকাকার কুটির পড়িয়াছ তাহার জান টমের মতন একজন ভালো লোককেও অকারণ এইরূপ প্রহারে একটা পশুর মতন লোকের হাতে প্রাণ হারাইতে হইয়াছিল। অনেক হতভাগ্য পলাইয়া এই পাশব অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইবার চেষ্টা করিত। দেশের এরূপ আইন ছিল যে এই সকল লোকদিগকে যে আশ্রয় দিবে তাহারই শাস্তি হইবে। পলাতক দাস যদি একবার ধরা পড়িত তবে আর তাহার যাতনার সীমা থাকিত না। এই সকল লোককে প্রথমে দাস-ব্যবসায় উঠিয়া যায়। আমেরিকার উত্তরে ইংরাজাধিকৃত কানাডা দেশ, পলাতক তাহারা জানিত যে ধ্রুবতারা সকল সময়েই উত্তর দিকে থাকে, সুতরাং এই তারার দিকে গেলেই উত্তরের সেই কানাডা দেশে যাওয়া যাইবে। এইরূপে রাত্রিতে ধ্রুবতারা লক্ষ্য করিয়া ক্রমাগত উত্তর দিকে আসিতে আসিতে অনেকে শেষে কানাডায় আসিয়া স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে। কতজন জঙ্গলে বন্য জন্তুর গ্রাসে প্রাণ হারাইয়াছে। এইরূপ একজন পলাতক দাস এখন কানাডা দেশের একজন সম্মানিত লোক। তিনি পলাইয়া আসিবার সময় কিরূপে সাপের হাতে পড়িয়া রক্ষা পাইয়াছিলেন তাহা বলিয়াছেন।
'আমি তাড়াতাড়ি লাফাইয়া একটা গর্ত পার হইবার সময় একটা কোমল পিছল জিনিসের উপর পড়িয়া আছাড় খাইলাম। আমি উঠিতে না উঠিতেই একটা কি যেন আমাকে জড়াইয়া ধরিতে লাগিল। আমি বুঝিতে পারিলাম আমাকে সাপে ধরিয়াছে। আমাকে এমন আঁটিয়া ধরিয়াছে যে আমি দুই হাতে মাথা ঢাকিয়া ছিলাম ভয়ে ও কষ্টে নিজের অবস্থা বুঝিবার শক্তি ছিল না। ক্রমে আমরা পাঁজরা ভাঙ্গিবার উপক্রম হইল। আমি প্রাণের আশা পরিত্যাগ করিয়াছি, এমন সময় আমার বন্ধুদিগের শব্দ শুনিতে পাইলাম। তাঁহাদের একজন কাটারি দিয়া সাপের গলা কাটিয়া ফেলিলেন, কিন্তু তবু তাহার শরীরটা আমাকে পূর্বের ন্যায়ই আঁটিয়া ধরিয়া থাকিল। এমন সময় আমার বন্ধুরা ল্যাজের দিকে প্রায় দুই ফিট কাটিয়া ফেলিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ বন্ধন মুক্ত হইলাম, কিন্তু তখন আর উঠিবার, কি কথা বলিবার শক্তি নাই। সুখের বিষয় জল নিকটেই ছিল, আমি শীঘ্রই সুস্থ হইলাম। আমরা যতদূর বুঝিতে পারিলাম, অজগরটা ষোলো ফুট লম্বা হইবে এবং তাহার শরীরের খুব মোটা জায়গাটা একজন বলিষ্ট লোকের ঠ্যাঙের মতন মোটা। সাপটা বিষধর ছিল না, কিন্তু আমার এক হাতে এমন দুই-একটি আঁচড় দিয়াছিল যে, অনেক বৎসর পর্যন্ত তাহার দাগ যায় নাই। অনেকদিন পর্যন্ত সাপ দেখিলে, এমন-কি, সাপের নাম শুনিলেই আমার গা শিহরিয়া উঠিত। অনেকদিন পর্যন্ত আমি ঘুমের ভিতরে মাঝে মাঝে চীৎকার কবিয়া উঠিতাম। আজ পর্যন্তও আমার সেদিনকার ভয়টা দূর হয় নাই৷
দাসত্বপ্রথা আমেরিকা হইতে উঠাইয়া দিতে অনেকদিন লাগিয়াছিল। অনেক মহৎলোকের বহু দিনব্যাপী চেষ্টার পর দাসত্বপ্রথা রহিত করিবার আইন হইল। কিন্তু যাহারা দাসদিগকে খাটাইত তাহারা এ আইন কিছুতেই মানিতে চাহিল না। অবশেষে তাহারা বিদ্রোহী হইয়া, ভয়ানক যুদ্ধ করিল। অনেক লোকের প্রাণনাশের পর, সাধু লোকদেরই জয় হইল। দাসগণ স্বাধীনতা পাইল। ইহার কিছুদিন পরেই দাস-ব্যবসায়ীদের একজন লোক আমেরিকার সভাপতি লিংকন্কে হত্যা করিল। লিংকন্ পূর্বেই জানিতে পারিয়াছিলেন, দাসব্যবসায়ীগণ বিনামী চিঠি লিখিয়াছিল যে, দাসত্বপ্রথা উঠাইয়া দিলে তাঁহার প্রাণ যাইবে। কিন্তু লিংকনের ন্যায় মহৎলোক অতি অল্পই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি এই সকল চিঠি একটা পুলিন্দায় রাখিয়া দিতেন, সেই পুলিন্দার উপরে লেখা ছিল, ‘খুনের চিঠি’। কিন্তু সেই-সকল চিঠির ভয়ের প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ না দিয়া, তিনি নির্ভয়ে দাসত্বপ্রথা উঠাইয়া দিলেন। এইজন্য একটা দুর্বৃত্ত থিয়েটাবের ভিতর তাহাকে খুন করিল। দাসগণ যখন লিংকনের মৃত্যু-সংবাদ শুনিল তখন তাহারা পাগলের ন্যায় রাস্তায় ছুটাছুটি করিতে লাগিল। জীবিতাবস্থায় যখনই দাসগণ তাঁহাকে দেখিতে পাইত তখনই দু হাতে সেলাম করিয়া নৃত্য করিত আর বলিত, ‘ধন্যা পরমেশ্বর! ধন্য পরমেশ্বর! প্রভু লিংকাম!’ লিংকন্ শব্দ নিগ্রোরা উচ্চারণ করিতে না পারিয়া ‘লিংকাম’ বলিত। অনেক নিগ্রোর বিশ্বাস হইয়াছিল যে, লিংকন্ পরমেশ্বর। একবার একজন নিগ্রো ধর্মযাজক তাঁহার শিষ্যদিগকে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন—‘হে ভাইসকল, প্রভু লিংকাম্ তিনি সকল স্থানেই আছেন, প্রভু লিংকাম্ আমরা যাহা বলি সবই শোনেন, প্রভু লিংকাম্ আমাদের মনের কথা সব জানেন৷’
দক্ষিণ আমেরিকায় এতদিন দাসত্বপ্রথা ছিল, কিছুদিন হইল তাহাও উঠিয়া গিয়াছে৷
এতক্ষণ অন্যান্য দেশে অতীতকালে যাহা ঘটিয়াছে তাহাই বলিয়াছি। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান কালেই ছোটখাটো রকমে সেই-সকল ব্যাপার ঘটিতেছে। আসামে অনেক সাহেবের ‘চা’র চাষ আছে। চা-ক্ষেত্রে কাজ করিবার জন্য অনেক কুলির প্রয়োজন হয়। এই-সকল কুলির উপর অনেক সময় ভয়ানক অত্যাচার হইয়া থাকে। ভয়ানক খাটুনি, অমানুষিক অত্যাচার এই সকলই এই কুলিদিগকে অনেক সময় সহ্য করিতে হয়। অল্প কয়েকজন দয়ালু লোক আছেন, যাঁহাদের বাগানে কুলিদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার হয় এবং তাহারা অনেক পরিমাণে সুখে থাকে, কিন্তু এরূপ পাশব প্রকৃতির অনেক লোক আছে যাহারা কুলিদিগকে আমেরিকার দাসের ন্যায় ব্যবহার করে। ইংরাজ রাজ্যে বলপূর্বক লোককে ধরিবার সাধ্য নাই, সুতরাং কুলি সংগ্রহ করিবার জন্য ইহাদের নিযুক্ত লোকেরা, (ইহাদিগকে আড়কাঠি বলে), অন্যরকম উপায় অবলম্বন করে। তাহারা ধার্মিকের বেশে গ্রামে গ্রামে যায় এবং অল্পবুদ্ধি লোকদিগকে কম কাজ এবং বেশি বেতনের লোভ দেখাইয়া ভুলইয়া আনে। একবার ইহাদিগকে হস্তগত করিয়া আডডায় (ডিপো) আনিয়া ফেলিতে পারিলে আর সহজে নিস্তার নাই। এইরূপ করিয়া যাহারা লোক সংগ্রহ করে তাহার সম্ভবত কখনই তাহাদের উপর পরে ভালো ব্যবহার করে না। জন্সাউথ রাস্তায় যেরূপ কষ্ট পাইয়াছিলেন এই সকল আড়কাঠিদের হাতে কুলিরাও প্রায় সেইরূপ ক্লেশ পায়। কিছুদিন ভালো ব্যবহার করে, সম্পূর্ণরূপে হস্তগত হইলেই অন্য মূর্তি ধারণ করে। আধপেটা খাওয়া, কথায় কথায় প্রহার, অযত্নে থাকা ইত্যাদি তো আছেই, ইহার মধ্যে যাহার কোনোরূপ রোগ হয় সে বেচারার আর রক্ষা নাই। অনেকে সময় থাকিতে টের পাইয়া এই-সকল পশুর নিকট হইতে পলায়ন করে। আমাদের একটা ঝি একবার ইহাদের হাতে পড়িয়াছিল। ইহারা যে আড়কাঠি, তাহা সে প্রথমে জানিতে পারে নাই। তাহার সঙ্গে আরো দুইজন ছিল। ইহাদিগকে আড়কাঠিরা বলিয়াছিল যে ভালো ব্রাহ্মণের বাড়িতে কাজ করিতে হইবে, ছয় টাকা মাইনে আর খোরাক-পোশাক পাইবে। তাহারা সহজেই রাজি হইল এবং সেই লোকগুলির সঙ্গে একটা বাড়িতে আসিল। সেখানে তাহাদিগকে অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইল। আমাদের ঝি একটু ব্যস্ত হইল এবং শীঘ্র শীঘ্র কাজ পাইবার জন্য তাগাদা করিতে লাগিল। আড়কাঠিরা তাহাকে বুঝাইয়া বলিল যে, ‘সাহেব আসিবেন, তিনি যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করেন সব কথাতেই হাঁ বলিও, তা হইলেই তোমার কাজ হইবে৷’ ঝির তো শুনিয়া চক্ষুস্থির—‘ওমা! সে কিগো! বামুনের বাড়িতে কাজ কোত্তে এলাম, তা আবার সাহেব কেন আসবে গো?’ ঝির প্রাণে বিষম খট্কা বাধিল। সে আড়কাঠিদের কথা কিছু কিছু জানিত, তাহার মনে গুরুতর সন্দেহ হইল। সে কাঁদিতে লাগিল। তাহাকে খাইতে দিল, সে কিছুই খাইল না। এইরূপে বেলা শেষ হইয়া আসিল। বিকালবেলায় অনেক কথাবার্তা, তর্ক, বিতর্ক, সন্দেহ প্রবোধ ইত্যাদি চলিতে লাগিল, ইহার মধ্যে আমার ঝি—বোঁ করিয়া ছুট্! একেবারে বাড়িতে! অন্যকয়টির শেষটা কি দশা হইল সে বলিতে পারে না৷
আড়কাঠির কথা এখন এত প্রসিদ্ধ হইয়াছে যে এখন হঠাৎ কেহ অদৃশ্য হইলেই উহাদের কথা মনে হয়। এ বিষয়ে লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার ভিতরে একটি ঘটনা হইয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করি৷
আমাদের একটি ভাগ্নে আমার দাদার বাড়িতে থাকিত। একদিন সকালে সে অদৃশ্য হইল। বারোটার সময়ও বাড়ি ফিরে নাই দেখিয়া দাদা আমাদের বাড়িতে লোক পাঠাইলেন। সকালে সে আমাদের এখানে আসিয়াছিল বটে, কিন্তু আটটার পূর্বেই চলিয়া গিয়াছিল। জোড়াসাঁকোতে তাহার জ্যেঠামহাশয় থাকেন, সেখানে লোক পাঠাইয়া জানা গেল, সে সেখানেও যায় নাই। দেখিতে দেখিতে দুইটা বাজিল, তখন সকলেই চিন্তিত হইলাম৷ কলকাতার থানা এবং ডাক্তারখানা একটিও বাকি রহিল না, নারিকেলডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানেও অনুসন্ধানের ত্রুটি হইল না, কিন্তু তাহার কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না। বাড়ির মেয়েরা ইহার অনেক পূর্ব হইতেই কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এই-সকল অনুসন্ধানে রাত্রি আটটা বাজিয়া গেল। এমন সময় আমাদের মনে হইল যে, হয়তো সে আড়কাঠিদের হাতে পড়িয়াছে। এই চিন্তায় আমাদের মনের কিরূপ অবস্থা হইল সহজেই বুঝিতে পার।
আমাদের একজন বন্ধু, (তাঁহাকে বিদ্যারত্ব মহাশয় বলিব), আড়কাঠিদের সম্বন্ধে অনেক খবর রাখেন। ইনিই প্রথমে কুলিদের অবস্থার প্রতি দেশের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিদ্যারত্ব মহাশয় যেই খবর শুনিলেন, অমনি তিনি লাঠি হাতে করিয়া অনুসন্ধানে বহির হইলেন। এ বিষয়ে কলিকাতার যত সন্দিগ্ধ স্থান আছে, তিনি তাহার প্রায় সকলগুলির কথাই জানেন, কিন্তু যত জায়গায় গেলেন, কোথাও কোনরূপ সন্ধান পাইলেন না। শেষে যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে কতগুলি ষণ্ডা লাঠি লইয়া তাঁহাকে তাড়া করিয়াছিল। তিনি অনেক পুণ্যের জোরে সেই ভয়ানক সংকীর্ণ গলির ভিতর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া বড় রাস্তায় আসিয়া বাঁচিলেন।
বারোটাব সময় বিদ্যারত্ব মহাশয় ক্ষুন্ন মনে ঘরে ফিরিলেন। স্টেশনে স্টেশনে লোক গিযছিল তাহারা ইহার অনেক পূর্বেই ফিরিয়াছে। সকলেই স্তব্ধ, কাহারো মুখে কথাটি নাই। যেরূপে বাত্রি কাটিল, তাহার কিঞ্চিৎ কেহ কেহ বুঝিতে পারবেন, আমার বলিবার সাধ্য নাই।
ভোরে উঠিয়া আবার সকলে অনুসন্ধানে বাহির হইলেন। কেবলমাত্র দাদা বাড়িতে রহিলেন। সাতটার সময় একজন লোক আসিয়া দরজায় ঘা দিল। প্রশ্নের পর সে বলিল, ‘আমি মযরা, মহাশয়ের বাডিতে একটি ছেলের নিকট জলখাবার দরুন টাকা পাইব। কাল সকালে বিশেষ করিয়া তাগাদা করাতে বলিয়াছিল আমার সঙ্গে এস। আমরা লোক সঙ্গে দিলাম, তাহাকে এই বাড়ির দরজায় দাঁড় করাইয়া ভিতরে গেল। কিছুকাল পরে বাহিবে আসিয়া বলিল, এখানে নয়, ও বাড়ি (লেখকের বাড়ি) চল।’ ও বাড়িতে কিছুকাল থাকিয়া আমায় বলিল—‘বিকালে’। তাই আমি আসিয়াছি, টাকাটা এখন পাইব কি? এত ছোটছেলেকে ওরকম করিয়া ধারে সন্দেশ কেন খাওয়াইলে জিজ্ঞাসা করাতে ময়রা তাহার কোনো ভালো উত্তর দিতে পারিল না। অপ্রতিভ হইয়া সম্প্রতি সরিয়া পরিল।
আমার ভাগ্নের সম্বন্ধে প্রকৃত কথা এখন একটু একটু বুঝিতে পারা গেল। তাহার জ্যাঠামহাশয়ের বাড়িতে তৎক্ষণাৎ পুনরায় লোক পাঠানো হইল। সেখানে গিয়া দেখা গেল যে, সে ঠোঙ্গায় করিয়া জলখাবার খাইতেছে। দূর হইতে কে আসিতেছে দেখিয়াই ঠোঙ্গাটি রাখিয়া বসিয়া রহিল। অনেক প্রশ্নের পর তাহার ইতিহাস বলিল আর বলিল যে, ‘তোমরাই কি শুধু পরিশ্রম করিয়াছ? আমিও ঢের ঘুরিয়াছি।’
আমাদের ওখান হইতে বাহির হইয়া সে কালীঘাট গিয়াছিল। তাহার সঙ্গে একটিও পয়সা ছিল না, সুতরাং এই রাস্তাটুকু হাঁটিয়াই যাইতে হইয়াছিল। ময়রার ভীষণ মূর্তি তাহার প্রাণে জাগিতেছিল। তারপর ময়রা যদি মাতুল মহাশয়কে বলে, তবে নিতান্তই লজ্জার বিষয় হইবে এবং শাস্তিরও বিশেষ সম্ভাবনা বোধ করিল। কাজেই তাহার কাছে আসিতে কিছুতেই ভরসা হইতেছিল না। কালীঘাটে পরিচিত স্থান নাই, সুতরাং শীঘ্রই সেখান হইতে ফিরিতে হইল। এরপর হাইকোর্টের দিকে চলিল। গড়ের মাঠের মাঝামাঝি আসিয়া বড়ই ক্লান্তি বোধ করিতে লাগিল, সুতরাং কাছে বটগাছতলায় একটা বেঞ্চ দেখিতে পাইয়া সেখানে কয়েক ঘণ্টা নিদ্রা গেল। তারপর হাইকোর্ট, হাওড়া স্টেশন ইত্যাদি পরিদর্শন করিয়া পাঁচটার সময় তাহার জ্যাঠামহাশয়ের বাড়ি উপস্থিত। সেখানে আসিয়াই ঢক্ ঢক্ করিয়া জল পূর্ণ একটি গ্লাসকে খালি করিল। সে বাড়ির লোকেরা তাহার চোখ মুখের অবস্থা দেখিয়া বড়ই ব্যস্ত হইলেন, কিন্তু তাহাকে কিছু খাইতে দিয়া প্রকৃতিস্থ না করিয়া কোনো প্রশ্ন করিতে সাহস করিলেন না। কিছুকাল বিশ্রামের পর শেষে সে উপরিলিখিত বিবরণটি বলিল। সন্ধ্যার সময় তাহার জ্যাঠামহাশয় একজন লোক সঙ্গে দিয়া বাড়ি পাঠাইয়া দিলেন। অর্ধেক পথ আসিয়া হঠাৎ সে ছুটু দিল। সঙ্গের লোকটি কিছুতেই তাহাকে ধরিতে পারিল না। মাইল খানেক তাহাব পশ্চাতে দৌড়িয়া শেষটা তাহাকে বলিল যে, “তোমার বাড়ি যাইবার দরকার নাই, আমাদের বাড়িতে আইস। সে আশ্বস্ত হইল, এবং তাহার জ্যাঠামহাশয়ের বাড়িতে ফিরিয়া আসিল।
সে বাড়ি ফিরিয়া আসিতে কিছুতেই রাজি হইল না।