উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/পুরাতন কথা: ১

পুরাতন কথাঃ ১

 পরিষ্কার আকাশ হইলে ক্রমাগত চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা করে। চিলগুলি ঘুরিতে ঘুরিতে ঐ কত উঁচুতে উঠিতেছে। দু-একটা শকুন আবার এর চাইতেও কত উপরে উঠিয়া গিয়াছে। নীল আকাশে তাহাদিগকে এক-একটি কালো বিন্দুর মতো দেখায়। কতদিন দেখিয়াছি আকাশের একস্থানে কোথা হইতে এখটি অতি হালকা সাদা মেঘ আসিয়াছে। কোথা হইতে আসিল কিছুই বলিতে পারিতেছিনা। মুহূর্তেক আগে সেটি সেখানে ছিল না, অন্য কোনোদিক দিয়া কখনই আসে নাই—তাহা হইলে দেখিতে পাইতাম৷

 মেঘটি কোথা হইতে আসিল? আবার ঐ দেখ সে কোথায় চলিয়া গিয়াছে। ঠাকুরমা বলিয়াছিলেন, ‘পাহাড়ে গাছের কচি পাতা খাইবার জন্য অভ্রেরা দল বাঁধিয়া শূন্য পথে চলিয়া যায়, আমরা তাহাদিগকে মেঘ বলি, কিন্ত পাহাড়ের লোকেরা বল্লম হাতে লইয়া প্রচ্ছন্নভাবে তাহাদের অপেক্ষা করিতেছে। এরা যেই পাহাড়ে পৌঁছাইবে, অমনি ইহাদিগকে বধ করিয়া বাজারে বিক্রি করিতে আনিবে৷’ কিন্তু ঠাকুরমার কথা তো দেখিতেছি এখানে খাটিতেছে না৷

 মেঘেরা তবে কে? মেঘেরা অতি সূক্ষ্ম জলকণার সমষ্টি। গরম বাতাসের ভিতরে জলীয়বাষ্প মিশ্রিত থাকে, তখন আমরা তাহাকে দেখিতে পাই না। বরং শুষ্ক বায়ুর ভিতর পরিষ্কার দেখি। ঠাণ্ডা লাগিলে সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম জলের কণাসকল বায়ু হইতে পৃথক হইয়া পড়ে। তখন তাহাদিগকে আমরা মেঘ বলি। ইহারা যখন আরো ঘন হইয়া মাটিতে পড়িবে, তখন বৃষ্টি হইবে। নদী পুকুর ইত্যাদিতে জল দাঁড়াইবে। ঠাণ্ডা দেশে আবার কত জায়গায় এই জল জমিয়া বরফ হইবে৷

 মেঘের বেলায় যাহা হইয়াছে, পৃথিবীর বেলাও বিস্তৃত আকারে কতকটা তেমনি হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবী এককালে বাষ্পের আকারে ছিল, ক্রমে শীতল হইয়া তরল হয়, শেষটা তাহার বর্তমান কঠিনত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। এখনো পৃথিবীর সমস্তটা কঠিন হয় নাই। আগ্নেয়গিরি হইতে মাঝে মাঝে অতিশয় গরম গলানো জিনিস সব বাহির হয়, এ কথা তোমরা জান। ঐগুলি পৃথিবীর ভিতরকার জিনিস। ঘি জ্বাল দিয়া রাখিলে যেমন প্রথমে তাহার উপরে খানিকটা জমে, কিন্তু ভিতরটা তরল অবস্থায়ই থাকে, পৃথিবীরও এখন সেই অবস্থা। আরও কয়েক শত কোটি বৎসর পরে পৃথিবী এত ঠাণ্ডা হইবে যে, তাহার ভিতর অবধি জমিয়া যাইবে। তখন শীত এত বাড়িবে যে, পৃথিবী আর জীবজন্তুর বসবাসের উপযোগী থাকিবে না। চন্দ্র বেচারির এখন এই দশা হইয়াছে। তাহার ভিতরকার আগুন অনেককাল নিবিয়াছে। অনেককাল হইল তাহার মৃত্যু হইয়াছে— আমরা তাহার কঙ্কালমাত্র দেখিতেছি। কি ভাগ্য, ভাই, অমর হই নাই। তাহা হইলে সেই ভয়ানক শীতের সময় কি কষ্টই হইত। তুলার গাছ মরিয়া যাইত, সুতরাং কাপড় পরিতে পাইতাম না। ভেড়াগুলি মরিয়া গেলে শীত নিবারণের উপায় থাকিত না। খাবার জিনিস যাহাবা জোগায়, তাহাদের মৃত্যু হইলে ক্ষুধায় চিরকালটা ক্লেশ পাইতাম৷

 সূর্যের ঘূর্ণনের চোটে মাঝে মাঝে তাহার এক-এক টুকরা তাহার ভিতর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়াছিল। ঐ সকল টুকরা শূন্যে ঘুরিতে ঘুরিতে গোল আকার ধারণ করিল। প্রথমে ইহারা সূর্যের ন্যায় গরম ছিল। এক কড়া গরম দুধ হইতে এক চামচে দুধ তুলিয়া লইলে যেমন চামচের দুধ শীঘ্র ঠাণ্ডা হয় কিন্তু কড়ার রাশিকৃত দুধ তত শীঘ্র শীতল হইতে পায় না। সেইরূপ এই নকল টুকরা শীঘ্র শীঘ্রই ঠাণ্ডা হইয়া প্রথমে তরল তৎপরে কঠিন হইয়াছে, কিন্তু সূর্য আজিও অতিশয় গরম বাম্পেল আকারে রহিয়াছে। এইরূপ একটি টুকরার সঙ্গে আজকাল আমাদের বড়ই ঘনিষ্ঠতা গুইয়াছে এবং আমরা পৃথিবী বলিয়া তাহার নামকরণ করিয়াছি৷

 পৃথিবীর উপরিভাগ কঠিন হইয়াও অনেককাল খুব নরম ছিল। পৃথিবীর জলভাগ তখন বাম্পের আকারে ছিল। ক্রমে পৃথিবী আরো ঠাণ্ডা হইল, তখন তাহার পূর্বে জল জমিতে আরম্ভ হইল। এইরূপে সমুদ্রগুলির জন্ম হইল৷

 বস্তু সকল যতই ঠাণ্ডা হইতে থাকে, ততই তাহাদের আয়তন কমিতে থাকে। কঠিন পদার্থের চাইতে তরল পদার্থের আয়তন খুব শীঘ্র শীঘ্র কমে। পৃথিবীর ভিতরকার তরল জিনিস শীঘ্র শীঘ্র কমিয়া যত ছোট হইতেছে, বাহিরের কঠিন আবরণ দেরিতে কমার দরুন, তত ছোট হইতে পারিতেছে না, সুতরাং সে কোঁকড়াইয়া যাইতেছে। এইরূপে পৃথিবীর উপরিভাগ ক্রমশ অধিক উঁচু-নিচু হইতেছে। এই ব্যাপার আমাদের চক্ষের সামনে অবিরত ঘটিতেছে। এককালে পৃথিবীর কোনো স্থান সমুদ্রের নীচে ছিল, তাহা জাগিয়া উঠিতেছে, কোনো স্থান-বা আগে উঁচু ছিল, এখন ক্রমে নিচু হইতেছে। কোনো স্থান-বা প্রথমে একবার উঁচু থাকিয়া, মাঝে নিচু হইয়া, শেষে আবার উঁচু হইতে আরম্ভ করিয়াছে। সুন্দরবনে কোনো সময়ে সমৃদ্ধিশালী নগব ছিল, এখন জলে ডুবিয়া যাইতেছে। হিমালয় পর্বতের অনেক স্থানে সামুদ্রিক জীবের চিহ্নসকল পাওয়া গিয়াছে, সুতরাং হিমালয় পর্বতের ঐ-সকল স্থান এক সময়ে সমুদ্রের নীচে ছিল। ইটালিতে একস্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করা হইয়াছিল। সেই স্থান ক্রমশ নিচু হইয়া মন্দিরের স্তম্ভ গুলির কিয়দংশ পর্যন্ত ডুবিয়া যায়। আবার সেই স্থান উঁচু হইতে আরম্ভ করিয়াছে। নরওয়ের অনেক স্থান নিচু হইতেছে। সুইডেনের অনেক স্থান উঁচু হইতেছে। বপ্টিক সমুদ্রের তলা ক্রমশ উঁচু হইয়া তাহার গভীরতা কমিয়া যাইতেছে। এইরূপে সাগর শুকাইয়া দেশ হইতেছে এবং দেশ ডুবিয়া সাগর হইতেছে। ভূমিকম্প ইত্যাদি কারণে অনেক সময় খুব শীঘ্র শীঘ্র ভূপৃষ্ঠে গুরুতর পরিবর্তন সকল ঘটে। দক্ষিণ আমেরিকায় একবার ভূমিকম্প হইয়া এক দেশের কিয়দংশ একেবারে ডুবিয়া গিয়াছিল৷