উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বাঘের গল্প

বাঘের গল্প

 বাঘ যে কেমন ভয়ঙ্কর জন্তু সে কথা আর আমাদিগকে বলিয়া বুঝাইতে হয় না। এই ভয়ঙ্কর জন্তু যে মাঝে মাঝে হাসির কাজও করে, সেই কথাই আমি আজ বলিতে আসিয়াছি। দুঃখের বিষয়, গল্পগুলির প্রত্যেকটিই সত্য কিনা, এ কথা ঠিক করিয়া বলিবার উপায় নাই। তবে, এইমাত্র বলিতে পারি যে, যারা প্রথমে গল্পগুলি বলিয়াছিল তাহারা খুব গম্ভীরভাবেই বলিয়াছিল।

 বাঘের যদি কোনরকম খাবার না জোটে, তবে দু-একটা মাছ ধরিয়া খাইতে তাহার আপত্তি নাই। একটি ভদ্রলোক আমাকে বলিয়াছিলেন যে একবার তাঁহাকে নৌকায় চড়িয়া কয়েক মাস সুন্দরবনে থাকিতে হয়। সেই সময়ে তিনি রোজ ভোরবেলায় একটা বাঘকে দেখিতে পাইতেন, সে জলের ধারে ধারে চলিয়া যায়, আর মাঝে মাঝে খপ করিয়া যেন একটা কিছু ধরিয়া সেটাকে কাদায় গুঁজে রাখে। খানিকবাদে আবার সে ফিরিয়া আসে, আর সেই জিনিসগুলি তুলিয়া খায়। ভদ্রলোকটি ভাবিলেন, বিষয়টা কি, না দেখিলে তো নয়। তিনি খুব সাহসী লোক ছিলেন, শিকার করাই ছিল তাঁর কাজ। তাই পরদিন ভোরবেলায় বাঘ আসিবামাত্রই তিনি বন্দুক হতে প্রস্তুত হইয়া রহিলেন। বাঘ শিকার ধরিয়া কাদায় গুঁজিতে গুঁজিতে যখন অনেক দূর চলিয়া গিয়াছে, তখন তিনিও নৌকা হইতে নামিয়া সেই পথে চলিলেন। তখন তিনি দেখিতে পাইলেন যে, বাঘ যে শিকার ধরিয়াছে, সেগুলি ছোটছোট মাছ। বাঘের মেজাজটা বোধ হয় একটু শৌখিন-গোছের ছিল, খাইতে খাইতে শিকার ধরাটা সে পছন্দ করিত না। তাই সে আগে অনেকগুলি মাছ ধরিয়াঁ লইয়া, তারপর মনের সুখে সেগুলি খাইত। যাহা হউক, সেদিন অন্তত তাহার মাছ ধরাই সার হইয়াছিল, খাইবার সুবিধা আর হয় নাই।

 আর-এক বাঘ এক বিলের ধারে গিয়াছিলেন, মাছ ধরিয়া খাইতে গিয়াই তিনি দেখিলেন, জলের উপরে একটা মাছ ছট্‌ফট্‌ করিতেছে। বাঘ মহাশয় তো তখনই তাহাকে কপ্‌ করিয়া গিলিয়া বসিয়াছেন, সেটা যে একটা প্রকাণ্ড বঁড়শিতে গাঁথা ছিল সেদিকে খেয়াল করেন নাই। বঁড়শি তো মাছের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে তাঁহার পেটে গিয়া বিঁধিয়া বসিয়াছে, তারপর বাঘ মহাশয় যখন চলিয়া যাইতেছেন তখন সে বলে, ‘কোথায় যাও?’ সে রাত্রে বাঘের চিৎকারে আর আশপাশের গ্রামের লোকের ঘুম হয় নাই। তার পরদিন সকালবেলায় তাহারা আসিয়া দেখে, বাঘ বঁড়শি গিলিয়া হাঁ করিয়া মরিয়া রহিয়াছে।

 আর-এক বাঘ গিয়াছিল এক কুয়ার ধারে, বাছুর খাইতে, বেটা এমনি আনাড়ি ছিল যে, লাফাইয়া কোথায় বাছুরের ঘাড়ে পড়িবে, না সে কুয়ার ভিতরে। তখন সে চিৎকার! কিন্তু চ্যাঁচাইলে কি হইবে? তাহাতে তো আর কুয়া হইতে উঠিয়া আসা যাইবে না, লাভের মধ্যে বাঁশ লইয়া গ্রামের লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। তারপর যাহা হইল, বুঝিতেই পার।

 আর-এক বাঘ গাছে উঠিয়া বসিয়াছিল। মতলবটা এই যে, সেই পথে গোরু বাছুর আসিলে তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িবে। গোরু যখন আসিল তখন সে লাফ দিল বটে,

কিন্তু গোরুর ঘাড়ে পড়িবার আগেই পেটে বিষম বাঁশের খোঁচা লাগিয়া তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গেল। একটা সরু বাঁশ কেহ ট্যারচা কোপে কাটিয়া নিয়াছিল, তাহার গোড়ার দিকটা ছুরির মতন ধারাল হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বাঘ তাহা দেখিতে পায় নাই।

 সান দেশে ভয়ানক বন, আর তাহাতে বাঘও তেমনি। সেই দেশে আমাদের একজন জরীপ করিতে গিয়াছিলেন। সঙ্গে লোকজন অনেক ছিল, আর ছিল তাহার চাকর শশী। সকালে উঠিয়াই চারটি খাইয়া জরীপে বাহির হইতে হয়, তাহার আগে রান্না শেষ হওয়া চাই, তাই শশী রাত চারটায় উঠিবার জন্য ঘড়িতে ‘য়্যালার্‌ম’ চড়াইয়া রাখে। থাকিতে হয় তাঁবুতে। শশীর এক তাঁবু, তাহার মনিবের এক তাঁবু, আর সকলের আলাদা তাঁবু। রাত্রে বাঘ আসিয়া শশীর তাঁবুতে মাথা ঢুকাইয়াছে। একেবারে ভিতরে আসিতে পারে নাই, তাঁবুর বেড়ার তলা দিয়া কোমর অবধি ঢুকাইয়া ঠেলাঠেলি করিতেছে, আর চারিদিক হাতড়াইতেছে,—আর আধ হাত আসিলেই শশীর মাথা পাইবে। এমন সময় “ক্ক-ড়্‌-ড়্‌-র্‌-র্‌-!” শব্দে য়্যালার্‌ম বাজিয়া উঠিল। বাঘ ভাবিল সর্বনাশ! বুঝি আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল।” সে বেজায় চমকিয়া গিয়া এমনি এক লাফ দিল যে, তাহাতে তাঁবুর দড়ি ছিঁড়িয়া, খোঁটা উঠিয়া একেবারে তাঁবুসুদ্ধ উলটপালট! গোলমাল শুনিয়া সকলে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল কি ভয়ানক ব্যাপার! তাঁবুর ভিতরে বাঘের বুকের দাগ আর নখের আঁচড় স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। ভগবানের কৃপায় ঠিক সময়টিতে য়্যালার্‌ম না পড়িলে আর উপায়ই ছিল না।