উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বেলুন: ১
বেলুন: ১
তোমাদের অনেকেই বেলুন দেখিয়াছ আসল বেলুন না দেখিয়া থাকাই সম্ভব, কিন্তু বেলুনের নকল সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়। বেলুনে চড়িয়া মানুষ আকাশে উঠে এ কথাও অনেকে শুনিয়া থাকিবে। অনেক সময় হয়তো তোমরা কেহ কেহ ভাবিয়াছ যে, ওরূপ একটা বেলুনে চড়িতে পারিলে না জানি কি মজাই হয়! তোমাদিগকে বেলুনে চড়াই, আমার তেমন সাধ্য নাই, কিন্তু যাহাতে তোমরা চারি-পাঁচ দিন স্বপ্নে পড়িয়া বেলুনে চড়িতে পার আজ একটা পুস্তক হইতে তাহারই কিঞ্চিৎ ব্যবস্থা করা যাইতেছে।
ইউরোপে জোজেফ্ মণ্ট গল্ফিয়র এবং ষ্টীভ্ন মণ্ট গল্ফিয়র নামে দুই ভাই থাকিতেন, তাঁহারাই প্রথমে বেলুন উড়াইতে শিখেন। তাঁহারা দেখিলেন যে ধোঁয়া উর্দ্ধে উঠে। ইহাতে তাঁহার মনে করিলেন যে, ধোঁয়াকে যদি খুব হালকা একটা থলের ভিতর পুরিয়া দেওয়া যায়, তবে ঐ থলেটাও ধোঁয়ার সঙ্গে উর্দ্ধে উঠিবে। এই মনে করিয়া তাঁহার একটা কাপড়ের থলে প্রস্তুত করিলেন এবং তাহাকে একটু উচ্চ স্থানে রাখিয়া তাহার নীচে আগুন জ্বালাইয়া দিলেন। কিছুকাল পরেই বেলুনটা উঠিতে লাগিল এবং প্রায় দেড় মাইল দূরে গিয়া মাটিতে পড়িল।
মণ্ট গল্ফিয়রদের এই অদ্ভুত কীর্তির বিবরণ লোকে শুনিয়া হাঁ করিয়া থাকিতে লাগিল—অনেকে বিশ্বাস করিল না। প্যারিস নগরে মসু চার্লস্ নামে একজন লোক থাকিতেন, তিনি কিন্তু এরূপ করিলেন না। তিনি মনে করিলেন যে, শুধু ধোঁয়ার মধ্যে এমন কিছু থাকিতে পারে না যে, তাহাতে বেলুনটাকে ঠেলিয়া আকাশে তুলিতে পারে। ধোঁয়াটা যতক্ষণ খুব গরম, ততক্ষণ সেটা বাতাসের চাইতে অনেক হালকা থাকে। হালকা থাকে বলিয়াই বেলুনটাকে ঠেলিয়া তুলিতে পারে। এইপ্রকার চিন্তা করিয়া তিনি এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, বাতাসের চাইতে হালকা অন্য কোনো জিনিস দিলেও ঐরূপ হইবে। তিনি কাপড়ের একটা বেলুন প্রস্তুত করিলেন। বেলুনের ভিতর হইতে বাতাস যেন পলাইতে না পারে, এইজন্য তাহাতে বেশ করিয়া ভালো আঠা মাখাইয়া দিলেন। এই বেলুনের ভিতর জলযান বায়ু পুরিয়া তাহাকে শূন্যে উড়াইবেন সিদ্ধান্ত করিয়া তিনি প্যারিস নগরে বিজ্ঞাপন দিলেন যে, ‘২৭-এ অগাস্ট
(১৭৮৩) আমি একটা প্রকাণ্ড গোলাকার জিনিস শূন্যে ছাড়িয়া দিব; আর সে আপনাআপনি উর্দ্ধে চলিয়া যাইবে।” যে স্থান হইতে উড়াইবার কথা হইল, ২৭-এ অগাস্ট সেখানে লোকে লোকারণ্য। যাহারা সেখানে আসিয়াছিল, তাহদের মধ্যে অতি অল্প লোকই চার্লস সাহেবের কথায় বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছিল। তাহারা মনে মনে স্থির করিয়া আসিয়াছিল যে পক্ষী ফড়িং ছাড়া আর কোনো জিনিস আপনা হইতেই ঊর্দ্ধে উঠিতে পারে না। চার্লস সাহেবের গোলাকার জিনিসটা যখন উঠিতে না পারিয়া মাটিতে পড়িয়া যাইবে, তখন তাহাকে কিঞ্চিৎ উত্তম-মধ্যম উপদেশ প্রদানের যুক্তিও স্থির করিয়া আসিয়াছিল। নিরূপিত সময়ের একটু পূর্বেই অনেকে অধৈর্য প্রকাশ করিতে লাগিল। যখন ছাড়িবার সময় হইল তখন যে দড়ি দ্বারা বেলুন বাঁধা ছিল তাহা খুলিয়া দেওয়া হইল; আর দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড জিনিসটা তিন হাজার ফিটেরও বেশি ঊর্দ্ধে উঠিয়া গেল। দর্শকগণের মনে তখন কিরূপ ভাবের সঞ্চার হইয়াছিল, তাহা সহজেই বুঝা যাইতে পারে। ফ্রান্স দেশের একটি ছোট গ্রামে বেলুনটি পড়িল। সেখানকার লোকেরা মনে করিল, এটা না জানি একটা কি? উচ্চ হইতে নীচে পড়িবার সময় সকল জিনিসই লাফায়; বেলুনটাও সেইরূপ লাফাইতে লাগিল। শহরে যে বেলুন উড়ান হইয়াছে, এ গ্রামের অধিবাসীগণ তাহা জানিত না; সুতরাং এ সব দেখিয়া তাহারা মনে করিল যে এ জানোয়ারটা একটা মস্ত পাখি বৈ আর কিছুই নহে। চারিধারে গণ্ডী করিয়া লোকের সার দাঁড়াইয়াছে, বুকের ভিতর একটু-একটু গুর্গুর্ করিতেছে। ইচ্ছা আছে জানোয়ারটাকে দুই-একটা খোঁচা দিয়ে তামাশা দেখে, কিন্তু সাহস হইতেছে না—পাছে ঠোক্রায়! শেষে কয়েকজন সাহসী লোক অনেক কষ্টে কোমর বাঁধিয়া অনেক বার অগ্রসর এবং অনেকবার পশ্চাৎপদ হইয়া অল্পে অল্পে তাহার কাছে আসিতে লাগিল। তাহাদের মধ্যে যে খুব সাহসী সে খোঁচা দিবার উপযোগী একটা যন্ত্র হাতে লইয়া অগ্রসর হইল। একবার এদিক একবার ওদিক হইতে সেই যোদ্ধা বিস্তর সংগ্রাম কৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিল। শেষে সাহসে নির্ভর করিয়া প্রাণপণে জানোয়ারের গাত্রে অস্ত্রাঘাত করিল, অমনি সেটা ফোঁস্ ফোঁস্ শব্দ করিতে লাগিল, আর যে দুর্গন্ধ—গ্রামবাসীরা রণে ভঙ্গ দিল। কিছুকাল পরে জানোয়ারটা যেন খুব শুঁটকাইয়া গেল; তখন তাহারা মনে করিল যে এবারে আঘাত সাংঘাতিক হইয়াছে। অবিলম্বে জানোয়ারটাকে বন্দী করত গ্রামবাসী ভট্টাচার্য মহাশয়দের নিকট লইয়া যাওয়া হইল। তাঁহারা দেখিয়া বলিলেন, ‘ইহা এতাবৎকাল অপরিজ্ঞাত জন্তু বিশেষের চর্ম।
প্রথমবারেই এইরূপ সুন্দর ফল লাভ করিয়া চার্লস সাহেবের সাহস বাড়িল। তিনি আর একটা বেলুন প্রস্তুত করিয়া তাহাতে আরোহণ পূর্বক আকাশে উঠিতে কৃতসংকল্প হইলেন।