উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/নিতান্ত প্রাচীন কচ্ছপ

নিতান্ত প্রাচীন কচ্ছপ

 যখন প্রলয় হয়, মার্কণ্ডেয় মুনি তখন উপস্থিত ছিলেন, তিনি অনেক দিনের মানুষ। আবার তাঁহারও আগের মানুষ ছিলেন মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন যে কত দান,কত ধর্ম, কত যজ্ঞ করিয়াছিলেন, আর তাতে তাঁহার যে কত পুণ্য হইয়াছিল, তাহা বলিবার আমার সাধ্য নাই।

 সেই পুণ্যের ফলে মহারাজ স্বর্গে গিয়া হাজার হাজার বৎসর বাস করিয়াছিলেন। হাজার হাজার বৎসর পরে তাঁহার পুণ্য ফুরাইয়া গেল, কাজেই তখন আবার তাঁহাকে এই পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিতে হইল।

 ততদিনে পৃথিবীর লোকে তাঁহার কথা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিল এত দান, এত ধর্ম, এত যজ্ঞ যে তিনি করিয়াছিলেন, সেসকলের কথা জানা দূরে থাকুক, তাঁহার নামটি পর্যন্ত কাহারো মনে ছিল না।

 রাজা ভাবিলেন, ‘মার্কণ্ডেয় মুনি খুব পুরানো মানুষ, তাঁহার নিকট যাই তাঁহার হয়ত আমার কথা মনে থকিতে পারে।’

 তাই তিনি মার্কণ্ডেয় মুনির নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মুনি-ঠাকুর আমার কথা ত সকলেই ভুলিয়া গিয়াছে। আপনি কি আমাকে চিনিতে পারেন?”

 মার্কণ্ডেয় মুনি বলিলেন, “আমরা তীর্থে তীর্থে ঘুরিয়া বেড়াইতে ব্যস্ত থাকি, তাহাতে নিজের কথাই কতবার ভুলিয়া যাই। আপনাকে আবার কি করিয়া চিনিতে পারিব?”

 তাহা শুনিয়া রাজা বলিলেন, “আচ্ছা মুনি-ঠাকুর, আপনার চেয়েও পুরানো লোক কি কেহ আছে?”

 মার্কণ্ডেয় মুনি বলিলেন, “হিমালয় পর্বতে প্রবীরকর্ণ বলিয়া এক প্যাঁচা আছে, সে আমার চেয়েও ঢের বুড়া হইয়াছে। হয়ত সে আপনাকে চিনিতে পারিবে। আপনার সেখানে যাইতে ইচ্ছা হইলে, আমি আপনার সঙ্গে যাইতে পারি। কিন্তু সে ঢের দূরের পথ!”

 রাজা বলিলেন, “তাহাতে কি? আমি আপনাকে বহিয়া লইয়া যাইব।”

 এই বলিয়া তিনি মার্কণ্ডেয় মুনিকে বহিয়া, সেই প্যাঁচার নিকট উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওহে বাপু, তুমি ত শুনিয়াছি যার পর নাই পুরানো লোক তুমি কি আমাকে চিনিতে পার?”

 এ কথায় প্যাঁচা তাহার গোল গোল চোখ দুটি বড় করিয়া, খুব ব্যস্তভাবে, আগে বসিয়া, তারপর দাঁড়াইয়া, তারপর উঁকি দিয়া, তারপর গুঁড়ি মারিয়া, রাজাকে মনোযোগের সহিত পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তারপর অতিশয় গম্ভীর ভাবে বলিল, “না মহাশয়! আমার ত বোধ হয়, যেন বা আপনাকে চিনি বলিয়া মনে হইতেছে না!”

 তাহা শুনিয়া রাজা বলিলেন, “আচ্ছা, তোমার চেয়েও বুড়া কি কেহ আছে?”

 প্যাঁচা খানিক চিন্তা করিয়া বলিল, “ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক সরোবর আছে। তাহার ধারে নাড়ীজঙঘ বলিয়া এক বক থাকে। সে আমার চেয়েও বুড়া, তাহার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করুন।”

 প্যাঁচা তাহাদিগকে পথ দেখাইয়া সেই সরোবরের ধারে সেই বকের নিকট লইয়া আসিলে, মার্কণ্ডেয় মুনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওহে নাড়ীজঙঘ, তুমি কি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জান?”

 বক এক পায়ে দাঁড়াইয়া খানিক চিন্তা করিয়া বলিল, “মহাশয়! আমি ত তাহার কথা কিছুই জানি না।”

 রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার চেয়েও প্রাচীন কেহ আছে কি?”

 ক বলিল, “এই সরোবরেই এক কচ্ছপ থাকে, তাহার নাম অকুপার, সে আমার চেয়েও অনেক প্রাচীন।”

 এ কথায় তাঁহারা সেই বককে লইয়া অকুপারকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন। বকের ডাক শুনিয়া, সে তাড়াতাড়ি জল হইতে উঠিয়া আসিলে, মার্কণ্ডেয় মুনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “অকুপার, তুমি এই ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজাকে জান?”

 এ কথা শুনিয়াই অকুপার কাঁদিতে লাগিল। তারপর একটু শান্ত হইয়া সে বলিল, “আহা! ইঁহাকে জানিব না ত জানিব কাহাকে? এত যাগ-যজ্ঞ আর কে করিয়াছে? ইনি যজ্ঞের সময় যেসকল গরু দান করিয়াছিলেন, তাহাদের খুরের ঘায় এই সরোবর হইয়াছে, তাহাতে সেই অবধি আমি পরম সুখে বাস করিতেছি।”

 তখন স্বর্গ হইতে দেবতারা ইন্দ্রদ্যুম্নকে ডাকিয়া বলিলেন, “মহারাজ, এখনো তোমার পুণ্যের কথা লোকে ভুলিয়া যায় নাই, সুতরাং তুমি আবার স্বর্গে চলিয়া আইস!”

 সেই কচ্ছপটি না জানি কতই বুড়া ছিল। আমরা তাহার কথা সহজে ভুলিব না। সে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে মনে রখিয়াছিল। তাই তিনি আবার স্বর্গে যাইতে পাইলেন।