উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/সাগরে জল আনিবার কথা

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

সাগরে জল আনিবার কথা

 অগস্ত্য মুনি সাগরের জল খাইয়া ফেলিয়াছিলেন। সে জল তাহার পেটে গিয়া হজম হইয়া গেল, সুতরাং কাজের সময় তিনি আর তাহা ফিরাইয়া দিতে পারলেন না। বহুকাল পর্যন্ত, মরা নদীর খাতের ন্যায়, সাগর শুকনো পড়িয়া ছিল। তারপর কেমন করিয়া আবার জল আসিল, সে অতি আশ্চর্য ব্যাপার।

 ইক্ষ্বাকু বংশে সগর নামে একজন অতি প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। রূপে, গুণে, বিদ্যায়, বীরত্বে, তাঁহার সমান আর সেকালে কোন রাজাই ছিলেন না। সকল বিষয়েই তিনি সুখী ছিলেন, কেবল এক বিষয়ে তাঁহার বড়ই দুঃখ ছিল, তাঁহার পুত্র ছিল না। পুত্র লাভের জন্য তিনি তাঁহার বৈদর্ভী এবং শৈব্যা নাম্নী দুই রানীকে লইয়া কৈলাস পর্বতে গিয়া কঠিন তপস্যা আরম্ভ করিলেন। কিছুদিন পরে, শিব রাজার তপস্যায় তুষ্ট হইয়া তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন, “মহারাজ, তুমি কি চাহ?”

 রাজা ভক্তিভরে শিবকে প্রণাম করিয়া, জোড় হাতে বলিলেন, “ভগবন, আমার পুত্র নাই। আমার মৃত্যুর পর আমার বিশাল সাম্রাজ্য ভোগ করিবার লোক থাকিবে না; আমার বংশলোপ হইয়া যাইবে, সুতরাং, যদি আমার প্রতি আপনার দয়া হইয়া থাকে, তবে অনুগ্রহ করিয়া, যাহাতে আমার পুত্র হয়, এমন বর দিন।”

 শিব কহিলেন, “মহারাজ, তোমার এক রানীর ষাট হাজার পুত্র হইবে, কিন্তু তাহারা সকলেই এক সঙ্গে মরিয়া যাইবে। আর এক রানীর একটি মাত্র পুত্র হইবে, সে-ই তোমার বংশ রক্ষা করিবে।”

 কিছুদিন পরে বৈদর্ভীর ষাট হাজার আর শৈব্যার একটি পুত্র হইল। বৈদর্ভীর ষাট হাজার পুত্র জন্মিবার সময় বড়ই আশ্চর্য ঘটনা হয়। ছেলেগুলি একটি লাউয়ের ভিতরে ছিল। লাউ দেখিয়া রাজা তাহা ফেলিয়া দিবার আজ্ঞা দিয়াছেন, এমন সময় আকাশ হইতে কে যেন অতি গম্ভীর স্বরে বলিল, “মহারাজ, ওটাকে ফেলিয়া দিও না। উহার ভিতরেই তোমার ষাট হাজার পুত্র আছে। উহার ষাট হাজারটি বীচিকে ঘৃতের কলসির ভিতর রাখিয়া দাও, দেখিবে তোমার ষাট হাজার পুত্র হইবে।”

 সুতরাং রাজা আর লাউটি ফেলিয়া না দিয়া, উহার বীচিগুলি ঘিয়ের ভিতরে রাখিয়া দিলেন ইহাতে অনেক দিন পরে, সেই বীচির ভিতর হইতে ষাট হাজারটি সুন্দর খোকা বাহির হইল; সেই খোকাগুলি বড় হইয়া ষাট হাজারটি অসুরের মতন গোঁয়ার গুণ্ডা হইল। তাহাদের জ্বালায় মানুষের কথা আর কি বলিব, দেবতা গন্ধর্ব পর্যন্ত সুস্থির হইয়া বসিতে পাইত না।

 শেষে সকলে ইহাদের দৌরাত্ম্যে জ্বালাতন হইয়া, ব্রহ্মার নিকট গিয়া বলিল, “ভগবন্, আর ত পারি না! ইহাদের দৌরাত্ম্য নিবারণের একটা উপায় করুন!”

 ব্রহ্মা বলিলেন, “তোমাদের কোন চিন্তা নাই। আর অতি অল্পদিনের ভিতরেই ইহারা নিজের স্বভাব দোষে নষ্ট হইবে।”

 এ কথায় সকলে কতকটা নিশ্চিত হইয়া ব্রহ্মাকে প্রণাম পূর্বক যে যাহার ঘরে ফিরিল।

 তারপর সগর অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। যজ্ঞের ঘোড়ার রক্ষক হইল ঐ ষাট হাজার রাজপুত্র। তাহারা দিনকতক তাহাকে দেশে দেশে তাড়াইয়া ফিরিল। সে শুকনো সাগরের বালির উপর দিয়া ছুটতে ছুটতে কোথায় যে চলিয়া গেল, রাজপুত্ররা তাহার কিছুই বুঝিতে পারিল না। তখন তাহারা দেশে ফিরিয়া তাহদের পিতাকে বলিল, “বাবা, সর্বনাশ ত হইয়াছে, ঘোড়া হারাইয়া গিয়াছে!”

 এ কথা শুনিয়া সগর বলিলেন, “তোমরা সকলে মিলিয়া তাহকে খুব ভাল করিয়া খোঁজ!”

 তখন রাজপুত্রেরা আবার ঘোড়া খুঁজিতে বাহির হইল, কিন্তু সমস্ত পৃথিবী খুঁজিয়াও তাহার সন্ধান করিতে পারিল না। সুতরাং তাহারা আবার তাহদের পিতার নিকট আসিয়া বিনয়ের সহিত বলিল, “বাবা আমরা শহর, বাজার, পাহাড়, পর্বত, বন, বাদাড়, কিছুই বাকি রাখি নাই। কিন্তু ঘোড়া ত কোথাও খুঁজিয়া পাইলাম না!”

 এ কথায় সগর রাজা অস্থির হইয়া বলিলেন, “দূর হ তোরা এখন হইতে! ঘোড়া না লইয়া তোরা আর দেশে মুখ দেখাইতে পাইবি না।”

 সুতরাং আবার ষাট হাজার ভাই ঘোড়ার সন্ধানে বাহির হইল। খুঁজিতে খুঁজিতে তাহারা আবার সমুদ্রে উপস্থিত হইয়া দেখিল যে, তাহার এক জায়গায় একটি গভীর গর্ত রহিয়াছে। তখন ষাট হাজার ভাই, ষাট হাজার কোদাল লইয়া সেই গর্তের চারিধারে খুঁড়িতে আরম্ভ করিল। কিন্তু অনেক খুঁড়িয়াও তাঁহারা সেই সর্বনেশে গর্তের তলা পাইল না। দিন গেল মাস গেল, বৎসর চলিয়া গেল, তথাপি সেই গর্তের ভিতরে উঁকি মারিলে, যেমন অন্ধকার ছিল, তেমনি অন্ধকার দেখা যায়।

 ইহাতে তাহারা রাগের ভরে আরো বেশি করিয়া খুঁড়িতে লাগিল, গর্ত যতই অন্ধকার দেখা যায়, তাহারা ততই খালি বলে, “খোঁড়্, খোঁড়্, খোঁড়্!” এমনি করিয়া খুঁড়িতে খুঁড়িতে তাহারা একেবারে পাতালে গিয়া উপস্থিত হইল। পাতালে গিয়াই তাহারা দেখিল যে, সেখানে কপিল মুনি বসিয়া আছেন, আর ঘোড়াটি তাঁহার কাছেই ঘাস খাইতেছে। ঘোড়া দেখিয়া আর কি তাহারা স্থির থাকিতে পারে? তখনই কপিল যে সেখানে বসিয়া আছেন তাহা যেন তাহারা দেখিয়াও দেখিতে পাইল না। কপিলকে অগ্রাহ্য করিয়াই তাহারা ঘোড়া ধরিতে ছুটিয়া চলিল।

 ইহাতে কপিল রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে দুই চক্ষু লাল করিয়া ভীষণ ভ্রুকূটির সহিত উহাদিগের পানে তাকাইবামাত্র সেই ষাট হাজার রাজপুত্র পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল।

 যখন এই ভয়ঙ্কর ঘটনা হয়, তখন নারদ মুনি সেইদিক দিয়া যাইতেছিলেন। তিনিই রাজপুত্রগণের মৃত্যুর সংবাদ সগরকে শুনান। পুত্রদিগের মৃত্যুর কথা শুনিয়া সগর দুঃখে অনেকক্ষণ কথা কহিতে পারিলেন না। তারপর নিজের নাতি অংশুমানকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “এখন ঘোড়া না আনিতে পারিলে তা আর উপায় দেখি না।”

 শৈব্যার যে একটি পুত্র হয়, তাহার নাম ছিল অসমঞ্জ, অসমঞ্জ এমনই দুষ্ট ছিল যে, সে ছোট ছোট ছেলেপিলের গলা ধরিয়া তাহাদিগকে জলে ফেলিয়া দিত। তাহার জ্বালায় অস্থির হইয়া সকলে সগরের নিকট নালিশ করাতে তিনি তাহাকে দেশ হইতে তাড়াইয়া দিলেন। অংশুমান সেই অসমঞ্জর পুত্র।

 সগরের কথায় অংশুমান সেই গর্তের ভিতর দিয়া পাতালে চলিয়া গেলেন। কপিল তখনো সেখানে বসিয়া ছিলেন, আর ঘোড়াটাও তাঁহার কাছে ছিল। অংশুমান মুনিকে দেখিবামাত্র ভক্তিভরে তাঁহাকে প্রণাম করাতে, মুনি তাহার উপর সস্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, বাঃ, বেশ ত ছেলেটি! তুমি কি চাও বৎস?”

 অংশুমান জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন্, আপনি দয়া করিয়া ঘোড়াটিকে আমাকে দিলে আমাদের যজ্ঞ শেষ হইতে পারে।”

 মুনি বলিলেন, “বটে? তোমাদের যজ্ঞের ঘোড়া? এখনি তুমি ওটাকে নিয়া যাও। তোমার আর কিছু চাই?”

 অংশুমান জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন্ দয়া করিয়া যদি আমার খুড়া মহাশয়দিগকে উদ্ধার করিয়া দেন তবে বড় ভাল হয়।”

 মুনি বলিলেন, “তুমি যখন চাহিতেছ তখন তাহাও হইবে কিন্তু সে এখন নহে, আর তাহা এত সহজে হইবে না। তোমার যে নাতি হইবে, সে মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করিয়া, তাহার সাহায্যে, গঙ্গাদেবীকে স্বর্গ হইতে পৃথিবীতে লইয়া আসিবে। সেই স্বর্গের নদী গঙ্গার জল লাগিলে, তোমার খুড়াগণ উদ্ধার পাইবে, ইহাতে সন্দেহ নাই। এখন শীঘ্র ঘোড়া লইয়া দেশে গিয়া যজ্ঞ শেষ কর, তোমার মঙ্গল হউক।”

 এইরূপে অংশুমান ঘোড়া লইয়া দেশে ফিরিলে, সগরের অশ্বমেধ শেষ হইল।

 অংশুমানের পুত্র দিলীপ, গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনার জন্য বিস্তর চেষ্টা করেন, কিন্তু তাহার চেষ্টায় কোন ফল হয় নাই। তারপর তাঁহার পুত্র পরম ধার্মিক এবং সত্যবাদী মহারাজ ভগীরথ জন্মগ্রহণ করিলেন।