উভয় সঙ্কট/প্রথম পরিচ্ছেদ
উভয় সঙ্কট।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
টিপ্ টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি পড়িতেছে—গুড়্ গুড়্ গুড়্ আকাশ ডাকিতেছে—মিট্ মিট্ মিট্ গ্যাসের আলো জ্বলিতেছে, তবে মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ চম্কিতেছিল, তাই সেই অন্ধকার রাত্রে এখনও চলিতে পারা যায়। সেই দুর্য্যোগ রাত্রে, আমি কলিকাতার রাস্তায় বাহির হইয়াছি। আবার রাত্রি তখন প্রায় দুই প্রহর। একে অমাবস্যার রাত্রি, তায় এই দুর্য্যোগ, সুতরাং আমার পক্ষে এরূপ সুযোগ আমি ছাড়িতে পারিলাম না। হাতে কাজ না থাকিলেও এ সময় শয্যার উপর অর্দ্ধমৃত অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে আমার কেমন প্রবৃত্তি হয় না, তাই বাহির হইয়াছি। কারণ, পৃথিবীর যত পাপ কার্য্যই এইরূপ অন্ধকারে ও দুর্য্যোগ রাত্রে সম্পন্ন হইয়া থাকে।
ঘুরিতে ঘুরিতে আমি যখন মেছুয়াবাজারের মোড়ের উপর আসিয়া পৌঁছিলাম, তখন দেখি, জনৈক সাহেব ইনস্পেক্টর একজন নিম্নপদস্থ পুলিশ-কর্ম্মচারীর সহিত রোঁদে বাহির হইয়াছেন। তিনি আমায় দেখিয়া থম্কিয়া দাঁড়াইলেন, এবং কহিলেন, “এ দুর্য্যোগে আপনি এখানে কেন? কোন জরুরী কাজ হাতে আছে না কি?”
আমি উত্তর করিলাম, “সেরূপ কাজ আমার হাতে নাই বলিয়াই আমি কাজের চেষ্টায় ঘুরিতেছি।”
সাহেব ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “না, অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে, এ স্থানটা যে অতি কু-স্থান। সেইজন্য সহরে এত স্থান থাকিতে এ দুর্য্যোগ রাত্রে এ স্থানে কাজের চেষ্টায় ঘোরা, কথাটা হঠাৎ আমি বিশ্বাস করিতে পারি না।”
আমিও ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “দুর্য্যোগ রাত্রে এরূপ কুস্থানেই কাজের চেষ্টায় ঘুরিতে হয়। আপনার মত অভিজ্ঞ ও পদস্থ পুলিস-কর্ম্মচারীর মুখে ওরূপ কথা শোভা পায় না।”
আমাদের মধ্যে এইরূপ কথাবার্ত্তা চলিতেছে, এমন সময় অদুরে একটা পিস্তলের শব্দ হইল। আমরা সকলেই সে শব্দ শুনিয়া একবারে চম্কিয়া উঠিলাম। আমি কহিলাম, “এই দেখুন, এ যে পিস্তলের শব্দ! এমন সময় পিস্তলের শব্দ কেন হইল, সে বিষয় অনুসন্ধান করা উচিত।”
সাহেব কহিলেন, “নিশ্চয়—আর বিলম্বে কাজ নাই। আসুন, আসুন।”
যেদিক হইতে শব্দ আসিয়াছিল, আমরা সকলেই তখন সেইদিকেই দৌড়িলাম। যে বাড়ীটা হইতে পিস্তলের আওয়াজ আসিয়াছে বলিয়া আমরা সন্দেহ করিলাম, সে বাড়ীটার দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। প্রথমে দরজায় কড়া নাড়িলাম, উত্তর নাই! ধাক্কা দিয়া জোরে জোরে শব্দ করিতে লাগিলাম, তথাপি সাড়া-শব্দ নাই। “কে আছ, দরজা খোল” বলিয়া চীৎকার করিলাম, তবুও কেহ কোন উত্তর দিল না। মৃতব্যক্তির একটা গোঁয়ানী শব্দ এই সময় আমাদের কর্ণে গিয়া পৌঁছিল। তখন আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না, দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। বাড়ীর ভিতরে গিয়া দেখি, উপরে একটা গৃহের মধ্যে আলো জ্বলিতেছে। আমরা উপরে উঠিতে যাইতেছি, এমন সময় দেখি; একটা লোক বাড়ীর খিড়কীর দরজার দিকে অন্ধকারে পলাইতেছে। আমাদের সঙ্গে যে আলো ছিল, সেই আঁধার-আলো তখন সেই দিকে ধরা গেল। যেই আলো ধরা, লােকটা অমনি আমাদিগকে দেখিয়া আর পলাইল না, এক বিকট মুর্ত্তিতে আমাদের সম্মুখে দাঁড়াইল। বিস্ফারিত তাহার বড় বড় দুটা চক্ষু ক্রোধে তখন রক্তবর্ণ, হস্তে একটা পিস্তল, পিস্তলের লক্ষ্য সাহেবের দিকে। সে মুর্ত্তি দেখিয়া আমার প্রাণে বড় ভয় হইল, আর সেই লােকটাই যে এইমাত্র একটা খুন করিয়াছে, সে বিষয়ে আমাদের মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। লোকটা সেই স্থান হইতে চীৎকার করিয়া কহিল, “নৎ আও—হুঁই খাড়া রও, এক্ কদম্ আনেসে জান্ যাগা।”
আমি ভয় পাইয়াছিলাম, কিন্তু এ অবস্থায়ও সাহেবকে ভীত দেখিলাম না। এই সময় হঠাৎ পিস্তলের দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। দেখিলাম, পিস্তলটা তে-নলা। আমরা একটা মাত্র আওয়াজ শুনিয়াছি, এখনও আরো দুইটা নল নিশ্চয়ই গুলিভরা আছে। মুহূর্ত্তের মধ্যে সেই কথা আমি সাহেবকে কাণে কাণে বলিলাম। আমার কথায় সাহেবের তখন চৈতন্য হইল; সাহেব বিপদ আশা করিয়া আর অগ্রসর হইলেন না। এই সময় আমি আরো ভাল করিয়া দেখিলাম—পিস্তলের লক্ষ্য কেবল সাহেবের দিকে। হঠাৎ একটা কথা আমার মনে হইল, আমি অন্ধকারের মধ্যে লুকাইয়া গিয়া লোকটার পিছন দিক হইতে কায়দায় সহিত একবারে তাহাকে জড়াইয়া ধরিলাম। তখন সম্মুখ দিক হইতেও সাহেব ও পাহারওয়ালা আসিয়া পড়িল। এই সময় লোকটা চীৎকার করিয়া উঠিল, “পুলিশ হামকো পাক্ড়া হ্যায়।”
মুহুর্ত্তের মধ্য এই সকল ঘটনা ঘটিল, বেকায়দায় পড়িয়া লোকটা গ্রেপ্তার হইল। তাহা না হইলে গুলি-ভরা পিস্তল হস্তে সেরূপ একজন বলবান্ লোককে গ্রেপ্তার করা বড় সহজ ব্যাপার নহে। সৌভাগ্যক্রমে আমার সঙ্গে একটা হাতকড়ি ছিল, আমি সেই হাতকড়ি বাহির করিয়া সাহেবকে দিলাম। সাহেব তৎক্ষণাৎ পিস্তল কাড়িয়া লইয়া তাহার হাতে হাতকড়ি পরাইয়া দিলেন। লোকটা কাবুলেওয়ালা না পাঠান? সে কথার তখন মীমাংসা করিবার আমাদের অবকাশ ছিল না। সাহেব এই সময় উপরে যাইতে কহিলেন। আমি সিঁড়ি দিয়া দ্বিতলে উঠিলাম। যে ঘরে আলো জ্বলিতেছিল, সেই ঘরে গিয়া দেখি, এক ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড! মেজের উপর একটা লোক চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে—তাহার বুকেই গুলির আঘাত লাগিয়াছে—ক্ষতস্থান হইতে তখনও রক্তস্রোত বহিতেছিল। কিন্তু আমার আসিবার পূর্ব্বেই তাহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গিয়াছে। লোকটা যে অবস্থায় পড়িয়াছিল, সেই অবস্থাতেই রহিল; আমি আর কোনরূপ নাড়াচাড়া না করিয়া ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া আসিলাম। আসিয়া সাহেবকে সকল কথা বলিলাম। সাহেব শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। তার পর আমায় কহিলেন—“এরূপ একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা আমি বড় সাহেবকে না জানাইয়া আর থাকিতে পারিতেছি না—আপনি এখানে লাসের কাছে থাকুন—আমি আসামীকে থানায় লইয়া যাই। সেখান হইতে বড় সাহেবকে টেলিফোঁ করি। আর একজন আপনার সঙ্গে রাখিতে পারিলে ভাল হয়, কিন্তু আমরা দুইজন না হইলে আসামীকে থানায় লইয়া যাইতে পারিব না।” সেই সময় একজন জমাদার সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া আমি কহিলাম, “তবে জামদারকে আমার কাছে রাখিয়া যান।”
জমাদারকে রাখিয়া সাহেব তখন আসামীকে লইয়া থানায় চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় আমায় কহিলেন, “লাস যে ভাবে যেখানে পড়িয়া আছে—ঠিক্ যেন সেইভাবেই থাকে; কোন রকম নাড়াচাড়া করা যেন না হয়।”
আমি উত্তর করিলাম, “সে কথা আমায় বলিতে হইবে না।”
ইনস্পেক্টার সাহেব যে জমাদারকে আমার নিকট রাখিয়া গেলেন, তাঁহার নাম—কেনারাম ঘোষ। ঘোষজা মহাশয় অনেক দিন এই পুলিস-বিভাগে কার্য্য করিতেছেন, কিন্তু সেরূপ চালাক চতুর নহেন বলিয়া আর তাঁহার উন্নতি হইল না—জমাদারীতেই বুড়া হইয়া গেলেন। তবে প্রথম শ্রেণীর জমাদার—সব-ইন্স্পেক্টারী যে তাঁহার অদৃষ্টে আর ঘটিবে, তাহা ত বোধ হয় না। আমি তাঁহাকে কেনারাম দাদা বলিতাম। আসামী লইয়া সকলে চলিয়া গেলে পর, আমরা নীচের সদর ও খিড়কী দরজা বন্ধ করিয়া উপরে যে ঘরে হত্যাকাণ্ড হইয়াছে, সেই ঘরে আসিলাম। আমার মনে কেমন একটা খট কা জন্মিয়াছিল, আমি সেই কারণ কেনারাম দাদাকে কহিলাম, “কেনারাম-দা, খিড়্কী দিয়া অমন পলাইবার পথ যখন রহিয়াছে, তখন আসামী মনে করিলে আমাদের সাড়া পাইয়াই স্বচ্ছন্দে পলাইতে পারিত, কিন্তু কেন পালায় নাই বলিতে পার?”
কেনা। তা আসামীর মনের কথা আমি কেমন করিয়া জানিব ভাই?
আমি। আমার বোধ হয়, আসামীর সঙ্গে আরো কেহ ছিল, সে ঐ খিড়্কী দিয়া পলায়ন করিয়াছে।
কেনারাম দাদা বড় সাদাসিধে লোক। তিনি অম্লানবদনে কহিলেন—“তার আর আশ্চর্য্যটা কি?”
আমি। কমিশনার সাহেব আসিবার পুর্ব্বে আমরা সে বিষয়ে একটা অনুসন্ধান করি এস না দাদা।”
কেনা। অত হাঙ্গামায় দরকার কি? লাস চৌকি দিবার ভার পাইয়াছি, লাসই চৌকী দিই এস।
অল্পক্ষণ পরেই পুনরায় কেনারাম দাদা কহিলেন, “তবে তুমি যখন ডিটেক্টিভ বিভাগের লোক, তখন সে বিষয়ে অনুসন্ধান করাটা তোমার উচিত বটে।”
আমি। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় দাদা?
কেনা। কিসে তুমি অনুমান কর, তা ত আমি কিছুই বুঝিতে পারি না ভাই! একজন লোকে কি গুলি করিয়া অপর একজনকে মারিতে পারে না——যে তুমি আসামীর সঙ্গে আরো লোক ছিল, অনুমান করিতেছ?
আমি। তার একটা বিশেষ কারণ আছে—সে যখন ধরা পড়ে, তখন সে “পুলিস হাম্কো পাক্ড়া হ্যায়”—বলে চীৎকার করিয়া উঠিবে কেন? আমার মনে হয়, নিশ্চয়ই তার সঙ্গী বাহিরে দাঁড়াইয়া ছিল, ঐ কথার দ্বারা তাহাকে অপেক্ষা করিতে নিষেধ করা হইল।
কেনা। কথাটা বলিয়াছ মন্দ নয় রে ভাই! সে কথা নিশ্চয়ই অন্যের উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছিল। তা না হইলে সে কথার ত কোন অর্থই হয় না।
কেনারাম দাদার মতন একজন লোকেরও মনে যখন আমার উক্ত কথায় এই সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছে দেখিলাম, তখন আর আমি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। দেখিলাম, সে গৃহটি সুসজ্জিত। সেখানে অন্য আলোরও অভাব ছিল না। আমি একটা হারিকেন্ ল্যাম্প জ্বালিয়া লইয়া কেনারাম দাদাকে আমার সঙ্গে আসিতে বলিলাম। প্রথমে আমরা তন্ন তন্ন করিয়া সেই বাড়ীর অন্যান্য ঘর খুঁজিলাম। কোথাও কিছু দেখিতে পাইলাম না। শেষে নীচে নামিয়া নীচেরও সমস্ত ঘর খোঁজা হইল—কি জানি, যদি এই বাড়ীর মধ্যেই অপর কেহ লুকাইয়া থাকে, তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়াও আসামী উপরোক্ত কথা বলিতে পারে। কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তখন আমি আস্তে আস্তে খিড়্কীর দরজাটি খুলিলাম দেখি—সম্মুখেই একটা বিস্তীর্ণ মাঠ। তখন হঠাৎ একটা কথা আমার মনে পড়িয়া গেল। অল্পক্ষণ পূর্ব্বেই বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, যদি খিড়্কী দিক হইতে কেহ মাঠের উপর দিয়া গিয়া থাকে, নিশ্চয়ই তাহার পায়ের দাগ দেখিতে পাওয়া যাইবে। আলো লইয়া দেখি—একজন মানুষের পায়ের দাগ স্পষ্ট স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। তখন কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া সেই মাঠে সেই পায়ের দাগ ধরিয়া চলিলাম। কেনারাম দাদার হস্তে আলো—আর আমার দৃষ্টি সেই পদচিহ্নের দিকে। মাঠের অর্দ্ধেক গিয়া দেখি—আর একজন লোক মাঠের অপর দিক হইতে আসিয়া এইখানে দুইজনে একত্রিত হইয়াছে! তার পর দুইজনই একত্রে সে মাঠ পার হইয়া গিয়াছে। মাঠের অপর পারে একটা খোলার ঘরের বস্তি। দুইদিকে খোলার ঘর, আর তার মধ্যে সরু রাস্তা—সেই রাস্তা—বড় রাস্তায় গিয়া পড়িয়াছে। সেই সরু রাস্তার মধ্যেও আমি সেই দুইজনের পদ-চিহ্ন ধরিয়া চলিলাম। যখন বড় রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, আর পদ-চিহ্ন নাই—একখানা গাড়ীর চাকার দাগ স্পষ্ট রহিয়াছে। সেইখানে গাড়ীখানা মোড় ফিরাইয়া চলিয়া গিয়াছে। আমার যেন স্পষ্ট বোধ হইল, সেই গাড়ীতেই সেই দুইজনে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু কোথায় যে গিয়াছে, তাহা আর ধরিতে পারিলাম না—কারণ বড় রাস্তায় সেইরূপ অনেক গাড়ী গিয়াছে— তাহাদের চাকার দাগের সঙ্গে এ গাড়ীর চাকার দাগ ধরিতে পারা গেল না। তখন আমরা ফিরিলাম। আসিতে আসিতে কেনারাম দাদাকে কহিলাম, “কেনারাম-দা, আমাদের আসিবার পূর্ব্বে কে পলাইয়া গিয়াছে—বলিতে পার?”
কেনা। কেমন করিয়া বলিব ভাই? আমি ত জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ি নাই?
আমি। পুলিস-বিভাগে কর্ম্ম করিতে হইলে সকল শাস্ত্রই জানা উচিত। আসামীর সঙ্গে নিশ্চয়ই একজন স্ত্রীলোক ছিল। কারণ যে খিড়্কীর দরজা দিয়া পলায়ন করিয়াছে, সে স্ত্রীলোক। এখন আমি সব বুঝিতে পারিয়াছি—সেই স্ত্রীলোককে বাঁচাইতে গিয়াই আসামী নিজে ধরা দিয়াছে। দাদা, আমার ত মনে হয় এ কেবল খুন নহে, ইহার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর রহস্য লুক্কায়িত আছে।
কেনারাম দাদা অবাক হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি কহিলাম, “চল দাদা, শীঘ্র চল—আমরা লাস ফেলিয়া আসিয়াছি।”
তখন পুনরায় খিড়কী দিয়া আমরা সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই খিড়কীর দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম। তার পর উপরে যে ঘরে লাস পড়িয়াছিল, সেই ঘরে আসিলাম। এইবার কেনারাম দাদা একটু বিশ্রাম করিবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু আমার প্রাণে সে ইচ্ছার লেশমাত্র ছিল না। আমি কেবল এই খুনের কথা ভাবিতে লাগিলাম। যে ব্যক্তি খুন হইয়াছে—সে ব্যক্তিকে একজন সন্ত্রান্ত মুসলমানবংশীয় বলিয়া আমার মনে হইল। আর তাহার পোষাক-পরিচ্ছদ দেখিয়া বুঝিলাম, হয় বাহির হইতে এ বাড়ীতে আসিয়াছিল, না হয়— বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, এমন সময় খুন হইয়াছে বাড়ীর লোকে গৃহে থাকিবার সময় সচরাচর সেরূপ পোষাক পরিয়া থাকে না। আমি এ সকল কথা মনে মনে চিন্তা করিতেছি, এমন সময় একটা কথা হঠাৎ আমার মনে হইল। আমি কেনারাম দাদাকে কহিলাম, “কেনারাম-দা, একখানা কোদাল আনিতে পার?”
কেনারাম দাদা আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, “তুমি কোদাল লইয়া কি করিবে? লাসটা পুঁতিয়া ফেলিবার মৎলব আছে নাকি?”
কেনারাম দাদার কথা শুনিয়া আমি হাসিলাম। আমার হাসিবার অর্থ এই—কেনারাম দাদা পুলিসের একজন পুরাতন কর্ম্মচারী হইয়া কেমন করিয়া এরূপ কথা কহিলেন। লাস পুঁতিয়া ফেলিবার সম্বন্ধে আমাদের হাত কি থাকিতে পারে? তখন কেনারাম দাদাকে কোদালের আবশ্যকতা বুঝাইবার জন্য কহিলাম, “দেখ, কেনারাম-দা, পিছনের মাঠে যে দুই রকমের পায়ের দাগ দেখিয়া আসিয়াছি, সেই পায়ের দাগ রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে মাটী শুদ্ধ কাটিয়া লওয়াই আমার ইচ্ছা। সেই জন্যই কোদাল চাহিয়াছি, কারণ, এর পর সে পায়ের দাগ নষ্ট হইয়া যাইবে।
তখন আমার কথা কেনারায় দাদা বুঝিতে পারিয়া আমার বুদ্ধির অনেক প্রশংসা করিলেন। আমি তখন আরো একটু উৎসাহিত হইয়া কহিলাম,—“আচ্ছা, কেনারাম-দা, আমার মনে হয়, যেমন সকল খুনের মধ্যে কোন না কোন রকমে মেয়ে মানুষের সংস্রব থাকে, এ খুনের মধ্যেও তাই আছে। তবে বেশীর ভাগ আসামীকে এখানে ছদ্মবেশী পুরুষ বলিয়া আমার মনে হয়।”
কেনা। খুনের মধ্যে মেয়েমানুষের সংস্রব থাকিতে পারে, কিন্তু খুনের মধ্যে আসামী যে একজন ছদ্মবেশী লোক একথা কিরূপে বুঝলে?
আমি। আসামী সাধারণ লোক হইলে—সে অনায়াসে আমাদের এ বাড়ীতে প্রবেশের পূর্ব্বেই লম্বা দিতে পারিত। এক জন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত লোক না হইলে একজন স্ত্রীলোকের মানসম্ভ্রম রক্ষার জন্য আপনার জীবনকে বিপদাপন্ন করিবে কেন? আর সে স্ত্রীলোককেও সম্ভ্রান্তবংশীয়া বলিয়া আমার মনে হয়।
কেনা। তোমার মাথাটা খারাপ হইয়া গিয়াছে ভাই—তাই এই সকল প্রলাপ বকিতেছ। তোমার কল্পনাশক্তির আমি প্রশংসা করিতে পারি কিন্তু আর অন্যের কাছে এ সকল কথা মুখে আনিও না।
কেনারাম দাদার এই মৃদুভর্ৎসনায় আমার সে উৎসাহ কোথায় উড়িয়া গেল। আমি মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়া সেই ঘরের মধ্যে ইতস্তত বেড়াইতেছি—এমন সময় ঘরের মেজের এক কোণে একটা কি চক্ চক্ করিতেছে দেখিতে পাইলাম। তাড়াতাড়ি গিয়া তুলিয়া দেখিলাম, সেটা একটা বহুমূল্যের হীরাচুনি পান্না বসান ইয়ারিং! সেই ইয়ারিং পাইয়া আমার আনন্দের আর সীমা রহিল না; আমার অনুমান যে সত্য—সে সম্বন্ধে আমার মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। আমি কেনারাম দাদাকে সেই ইয়ারিং দেখাইয়া কহিলাম, “কেনারাম দা, আমার কথা যে কল্পনা নয়, এই ইয়ারিং তাহার যথেষ্ট প্রমাণ। এই ইয়ারিং স্পষ্ট বলিতেছে—এখানে একজন স্ত্রীলোক ছিল—এই ইয়ারিং দেখিয়াই আমি বুঝিতেছি—সে স্ত্রীলোক সম্ভ্রান্তবংশীয়া—এখন আমার মনে আর কোন সন্দেহ নাই।”
আমি উপরোক্ত কথা বলিতেছি—এমন সময় একখানি গাড়ী আসিয়া সদর দরজায় থামিল। কে আসিলেন—বুঝিলাম। নীচে নামিয়া দরজা খুলিয়া দেখিলাম, পুলিসের বড় সাহেব!