উভয় সঙ্কট/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
আমরা দুইজনে পুলিসের কায়দাদুরস্ত লম্বা সেলাম করিলাম। বড় সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে ইনস্পেক্টার সাহেব এবং পুলিস-সার্জ্জন -সাহেবও গাড়ী হইতে নামিলেন। গাড়ীর ছাদের উপর দুইজন পাহারওয়ালা ছিল, তাহারাও নামিল। আমরা বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। যে স্থলে যে অবস্থায় আমরা আসামীকে প্রথমে দেখিতে পাইয়াছিলাম, ইন্সপেক্টার সাহেব সেই স্থান দেখাইয়া সমস্ত বর্ণনা করিলেন। এক্ষেত্রে আমার বিশেষ প্রশংসাও সাহেব করিলেন। আমি পশ্চাৎদিক হইতে সেরূপভাবে আসামীকে কায়দা করিয়া না ধরিলে, নিশ্চয়ই সেই স্থলে আরো দুই তিনটা খুন হইত, কারণ আসামীর পিস্তলের আরো দুইটা নল যে গুলিভরা ছিল, সে পিস্তল পরীক্ষা করিয়া ইন্সপেক্টার সাহেব তাহা জানিতে পারিয়াছেন। বড় সাহেব কোন কথা কহিলেন না, কেবল একটিবার আমার দিকে কট্মট্ করিয়া চাহিয়া দেখিলেন।
তার পর আমরা সকলে উপরে উঠিলাম। যে ঘরে লাস ছিল, প্রথমে সেই ঘরেই সকলে উপস্থিত হইলাম। পুলিস-সার্জ্জন ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, “রাইট ভেণ্টিকেলের মধ্যে গুলি প্রবেশ করিয়াছে, সেই কারণ আঘাতের দুই তিন মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু হইয়াছে।” বড় সাহেব কহিলেন,—“আসামী যে বলে, এ ব্যক্তি আত্মহত্যা করিয়াছে—সে সম্বন্ধে আপনার মত কি? আহত ব্যক্তি যেরূপভাবে চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে—আত্মহত্যাতে কি এরূপ হয়—সেই বিষয় পরীক্ষা করিবার জন্যই আপনাকে এই ভোরের সময় কষ্ট দিলাম।
পুলিস-সার্জ্জন কহিলেন,—“এ আত্মহত্যা নহে। হত ব্যক্তি যেভাবে পড়িয়া আছে, আমি কেবল তাহা দেখিয়া এ কথা বলিতেছি না। গুলির দ্বারা আত্মহত্যার অন্য পরীক্ষাও আছে। গুলি দ্বারা আত্মহত্যা করিবার সময় মানুষে পোষাক পরিয়া আত্মহত্যা করে না। আর আমাদের প্রধান পরীক্ষা এই— পিস্তল স্বহস্তে লইয়া আত্মহত্যা করিলে ক্ষতস্থানের উপর বারুদের কাল-দাগ নিশ্চয়ই থাকিত। যেরূপ সাদা পোষাক পরা, তাহাতে কাল দাগ নিশ্চয়ই পড়িবে।”
পুলিস-সার্জ্জনের কার্য্য শেষ হইয়া গেলে পর, তিনি বিদায় গ্রহণ করিলেন। তখন বড় সাহেব আমার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন,—“তুমি এখানে কিরূপে আসিলে?”
সে প্রশ্নের আমার আর কোন উত্তর দিতে হইল না। ইন্স্পেক্টার সাহেবই উত্তর দিলেন,—"হঠাৎ রাস্তায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, আর তার পর বরাবরই সঙ্গে ছিলেন, সে সকল কথা ত আমি আপনাকে জানাইয়াছি।”
বড় সাহেব সে কথা শুনিয়া এইবার আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ খুন সম্বন্ধে তোমার কোন কথা বলিবার আছে?”
আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “কি সম্বন্ধে আজ্ঞা করুন।”
বড় সাহেব। এটা খুন না আত্মহত্যা?
আমি। আজ্ঞে, এটা যে খুন—সে সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই। আমি অনুসন্ধানে আরো কিছু জানিতে পারিয়াছি, অনুমতি হইলে নিবেদন করি।
বড় সাহেব। কি জানিতে পারিয়াছ বল?
অমি। খুনের সময় এখানে আর একজন সম্ভ্রান্ত স্ত্রীলোক ছিলেন, আমাদের আসিবার পূর্ব্বেই তিনি পলায়ন করিয়াছেন।
বড় সাহেব। কিরূপে জানিলে?
আমি। খিড়কীর দরজার দিকে যে মাঠ আছে, সেই মাঠের উপর পায়ের চিহ্ন দেখিয়া আমার মনে প্রথমে সন্দেহ হয়। রাত্রে বিলক্ষণ বৃষ্টি হইয়াছিল, সেইজন্য মাঠের উপর বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট পায়ের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম। আর সেই পায়ের চিহ্ন দেখিয়া স্ত্রীলোকের পায়ের দাগ বলিয়া আমার বড়ই সন্দেহ হইল। তার পর এই ঘরের মধ্যে এই ইয়ারিং যখন কুড়াইয়া পাইলাম, তখন আর আমার সন্দেহ রহিল না। নিশ্চয়ই এ বাড়ীতে একজন স্ত্রীলোক ছিল, সে পলাইয়া গিয়াছে।
এই কথা কয়েকটি বলিয়া আমি সেই ইয়ারিং সাহেবের হস্তে দিলাম। সাহেব একবার মাত্র ইয়ারিংএর প্রতি দৃষ্টি করিয়া আমায় কহিলেন,—“সে স্ত্রীলোক যে সম্ভ্রান্ত—সে কথা কিরূপে বুঝিলে?”
আমি। সম্ভ্রান্ত না হইলে, এরূপ বহুমূল্য ইয়ারিং কোথায় পাইবে?
বড় সাহেব। অনুসন্ধানে আর কোন কথা জানিতে পারিয়াছ কি?
আমি। আর একজন ঐ মাঠের অর্দ্ধপথ পর্য্যন্ত আসিয়া সেই স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছে।
বড় সাহেব। এ কথা কিরূপে জানিলে?
আমি। সেও ঐ মাঠে পায়ের দাগ দেখিয়া জানিতে পারিয়াছি।
বড় সাহেব। সে লোক স্ত্রীলোক না পুরুষ?
আমি। পুরুষ।
বড় সাহেব। কিরূপে জানিলে?
আমি। পায়ে জুতা ছিল—সুতরাং পুরুষ।
বড় সাহেব। তাহারা কোথায় গেল—সে সম্বন্ধে কোন অনুসন্ধান করিয়াছ কি?
আমি। তাহারা মাঠ পার হইরা বস্তীর গলির রাস্তা দিয়া বড় রাস্তায় গিয়াছে। বড় রাস্তা হইতে গাড়ী করিয়া কোথায় গিয়াছে, তাহা আর ধরিতে পারা গেল না।
বড় সাহেব। আর কিছু জান?
আমি। আসামীও একজন ছদ্মবেশী সম্ভ্রান্ত লোক।
বড় সাহেব। কিরূপে জানিলে?
আমি। আসামী সেই স্ত্রীলোকের সম্ভ্রম বাঁচাইবার জন্য নিজে ধরা দিয়াছে;—মনে করিলে আমাদের আসিবার পূর্ব্বে সে অনায়াসে পলাইতে পারিত। যে একজন স্ত্রীলোকের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করিতে পারে, তাহাকে সাধারণ খুনী আসামী বলিয়া মনে কেমন বিশ্বাস হয় না। আর ধরা পড়িবামাত্র সে চীৎকার করিয়া—“পুলিশ হাম্কো পাকড়া হ্যায়”—এ কথা বলিবে কেন? নিশ্চয়ই অন্যকে সতর্ক করিবার জন্যই সে এইরূপ ভাবে চীৎকার করিয়া সে কথা বলিয়াছিল। “আমায় পুলিশে ধরিয়াছে”—এ কথা বলিবার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য ছিল, আমার ত এইরূপ মনে হয়। খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করিতে গেলে সচরাচর যেমন মূলে স্ত্রীলোক প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই খুনের মূলেও সেইরূপ স্ত্রীলোক আছে। আর এই যে আসামী, এ একজন সাধারণ খুনী আসামী নয়—ছদ্মবেশী কোন অসাধারণ লোক।”
আমার কথা শেষ হইলে বড় সাহেব একবার ইন্স্পেক্টার সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন। ইন্স্পেক্টার সাহেব সে চাহনির অর্থ বুঝতে পারিয়া কহিলেন,—“বাবুর মাথা, বোধ হয়, হঠাৎ খারাপ হইয়া গিয়াছে। তা না হইলে এরূপ প্রলাপ বাক্য কখনই শুনিতে পাইতাম না। আমি ত এর ভিতর কোন অসাধারণ ব্যাপার দেখিতে পাই না। আসামীর আকার-প্রকার দেখিয়া আমার ত মনে সে রকম কোন সন্দেহ হয় না।”
সাহেব সে উত্তরের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কথাই কহিলেন না। এই সময় কেবল মাত্র আমায় কহিলেন,—“চল—সেই মাঠে গিয়া একবার দেখিয়া আসি।”
আমি বড় সাহেবকে সঙ্গে লইয়া নীচে নামিলাম। আমাদের সঙ্গে ইন স্পেক্টার সাহেবও আসিলেন। খিড়কীর দরজা হইতে মাঠের উপর যে পায়ের দাগ আরম্ভ হইয়াছিল, আমি বড় সাহেবকে তাহা দেখাইলাম। আর সে পায়ের দাগ যে স্ত্রীলোকের, সে কথাও কহিলাম। সাহেব একবার ভাল করিয়া সে পায়ের দাগ দেখিলেন, কিন্তু কোন মতামত প্রকাশ করিলেন না। তার পর আমি সেই পায়ের দাগ ধরিয়া বরাবর গিয়া যে স্থলে অপর পায়ের দাগ আরম্ভ হইয়াছে, তাহাও সাহেবকে দেখাইলাম। আর সে পায়ের দাগ যে পুরুষের, সে কথাও কহিলাম। তার পর মাঠ পার হইয়া বস্তীর গলি দিয়া বড় রাস্তা পর্য্যন্ত সাহেবদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম। সে রাস্তায় যে গাড়ীর চাকার দাগ ছিল, তাহাও বড় সাহেবকে দেখাইলাম। এই সময় বড় সাহেব কহিলেন, “পলাতকেরা যে গাড়ী করিয়া গিয়াছে, এ কথা কিরূপে স্থির করিলে বল? মাত্র গাড়ীর চাকার দাগ দেখিয়া সে কথা কিরূপে বিশ্বাস করা যাইতে পারে?”
আমি তখন উত্তর করিলাম, “এই দেখুন, গাড়ীখানা দক্ষিণ দিক হইতে উত্তর দিকে আসিতেছিল, হঠাৎ এই গলির মোড়ে আসিয়াই মোড় ঘুরিয়া পুনরায় দক্ষিণ দিকে চলিয়া গিয়াছে। অবশ্য এ আমার অনুমান মাত্র। তবে এরূপ অনুমান করিবার কারণ এই যে, এরূপ বস্তীতে কেহ গাড়ী করিয়া আসা সম্ভব নয়। আর রাত্রে জল-ঝড়ের পরে এ গাড়ী এখান হইতে না যাইলে, রাস্তায় এরূপ চাকার দাগ হওয়া কখনই সম্ভব হইতে পারে না। আর একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যখন সঙ্গে ছিল, তখন তাহাদের এরূপ প্রকাশ্য রাস্তায় হাঁটিয়া যাওয়া অপেক্ষা গাড়ী করিয়া যাওয়াই সম্ভব।”
সাহেব আমার এ উত্তরের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কথা কহিলেন না; কিন্তু এই সময় ইন স্পেক্টার সাহেব কহিলেন, “বাবুর কল্পনাশক্তির প্রশংসা করা যাইতে পারে।”
যেরূপ বিদ্রূপস্বরে একথা বলা হইল, তাহাতে আমি বড়ই অপ্রস্তুত হইলাম। তবে আমার বিশ্বাসমতে আমি এই সকল কথা বলিয়াছি, এই কারণ, আমার মনে কোন কষ্ট হইল না। সাহেবকে এই সকল কথা বলা আমার কর্ত্তব্য মনে করিয়া সেই কর্ত্তব্যকর্ম্মের অনুরোধেই বলিয়া ফেলিয়াছি। বড় সাহেব অনেক ক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। তার পর আমায় কহিলেন, “তুমি এ খুনের তদন্ত করিবার ভার সইতে পার?”
আমি। আপনার অনুমতি হইলে আমি প্রস্তুত আছি।
বড় সাহেব। আমি এ কার্য্যের ভার তোমার উপরই অর্পণ করিলাম। কিন্তু দেখিও, খুব সাবধান—তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের আশাভরসা সমস্তই এই কার্য্যের সফলতার উপর নির্ভর করিতেছে। আসামী ধৃত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহার বিপক্ষে কোন প্রমাণ নাই—আর সে নিজের পরিচয় পর্য্যন্ত দিতেছে না, সুতরাং তোমার কাজ বড় গুরুতর।
আমি বিনীতভাবে কহিলাম, “মানুষের যাহা সাধ্য—সে পক্ষে এ অধীনের কোন ত্রুটী হইবে না, আপনি সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন।”
বড় সাহেব। তুমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় আমার সহিত একবার করিয়া সাক্ষাৎ করিবে, দৈনিক রিপোর্ট অপেক্ষা তোমার বাচনিক প্রত্যেক দিনের ঘটনা অমি শুনিতে ইচ্ছা করি।
আমি। হুজুরের হুকুম অনুযায়ী আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় হুজুরের সহিত সাক্ষাৎ করিব।
বড় সাহেব। এ কার্য্যে তোমার সাহায্যকারী আর কাহাকে চাও, আমায় বল?
“আপাততঃ এই কেনারাম জমাদারকে পাইলে যথেষ্ট হইবে, তবে ডিটেক্টিভ বিভাগের অন্য কাহাকেও আবশ্যক হইলে আমি হুজুরকে জানাইব।”
এই কথা বলিয়া আমি আমার কেনারাম দাদাকে দেখাইয়া দিলাম। আমার এই প্রার্থনায় বড় সাহেব যেন কিছু বিস্মিত হইয়া একবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন, তার পর কহিলেন, ‘আচ্ছা, তোমার যেরূপ অভিপ্রায় তাহাই হউক।”
এই কথা বলিয়া ইন্স্পেক্টার সাহেবের উপর লাস চালান দিবার ভার দিয়া বড় সাহেব চলিয়া গেলেন। বড় সাহেব চলিয়া গেলে পর, ইন্স্পেক্টার সাহেব আমায় কহিলেন, “বাবু, আপনার মস্তিষ্ক খারাপ হইয়া গিয়াছে। এ খুনী মোকদ্দমার তদারক অপেক্ষা এখনই নিজের চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, নহিলে শীঘ্রই গোল বাড়ীতে গিয়া বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে।”
সাহেবের এই অযাচিত উপদেশের দরুণ তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়া আমি কেনারাম দাদাকে সঙ্গে লইয়া থানায় আসিলাম।