উভয় সঙ্কট/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
সেই দিন সন্ধ্যার পর আমার সেইদিনকার রিপোর্ট লইয়া বড় সাহেবের নিকট হাজির হইলাম। আমার রিপোর্ট পড়িয়া আর আমার বাচনিক সমস্ত কথা শুনিয়া আমি যে নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছি, বড় সাহেবের আর সে কথা জানিতে বাকি রহিল না। তিনি আমায় কহিলেন,—“দেখ, তুমি একজন এই বিভাগের যুবা কর্ম্মচারী। তোমার কার্য্যকলাপ দেখিয়া আমার মনে তোমার উপর অনেক আশা জন্মিয়াছে। এ কার্য্যে দুই একবার বিফল হইলে নিরুৎসাহ হইতে নাই। তুমি যত বিফল হইবে, ততই যেন তোমার উৎসাহ বাড়িতে থাকিবে, ততই এ কার্য্যে জেদ হইবে, তবে তুমি উন্নতি করিতে পারিবে। তুমি এই খুনের সম্বন্ধে যে মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছ, আমিও তাহা সম্পূর্ণ অনুমোদন করি। তোমার মনের সহিত আমারও মত ঠিক্ মিলিয়াছে বলিয়া আমি তোমার উপর এই কার্য্যের ভার দিয়াছি। অনেক পুরাতন ও বহুদর্শী কর্ম্মচারী সেই কারণ আমার উপর মনে মনে বিরক্ত হইয়াছে। এখনও অনুসন্ধানের অনেক বাকি আছে; তুমি ইহারই মধ্যে নিরুৎসাহ হইলে চলিবে কেন?”
খোদ বড় সাহেবের মুখে উপরোক্ত কথাগুলি শুনিয়া আমার মনে মনে বড় আহ্লাদ হইল এবং সে উৎসাহও যেন দ্বিগুণ হইয়া ফিরিয়া আসিল। আমি কহিলাম, “আমার প্রতি হুজুরের যখন এত অনুগ্রহ হইয়াছে, তখন আর আমি এ কার্য্যে নিরুৎসাহ হইব না। আসামীকে আমি সেই ঘটনার দিন মাত্র দেখিয়াছিলাম, তার পর আর দেখি নাই। আসামী নিজে তাহার কি পরিচয় দিয়াছে, সে কি সূত্রে সে রাত্রে সে বাড়ীতে আসিল; আর সে যদি খুন না করিয়া থাকে, তবে কে খুন করিল—সেই বা পিস্তল হাতে করিয়া খিড়কীর দরজায় দাঁড়াইয়াছিল কেন—এই সকল বিষয় সম্বন্ধে সে কি এজেহার দিয়াছে, সেই এজাহার দেখিলে আমি পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহে তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারি।”
আমার কথা শুনিয়া বড় সাহেব কহিলেন,—“তুমি বেশ কথা বলিয়াছ। সে এজাহার এখন এখানে নাই; কিন্তু কালই তাহার নকল তোমার নিকট পাঠান হইবে। আমি সে এজাহার ভাল করিয়া পড়িয়াছি। তুমি সে সম্বন্ধে একে একে প্রশ্ন করিলে যতদুর স্মরণ হয়, এখনই সে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি।”
আমার তখন প্রথম প্রশ্ন হইল,—“আসামীর নাম কি?”
বড়-সাহেব। আসামী বলে যে, তাহার নাম মহম্মদ আলি।
আমি। বাড়ী কোথায়?
বড় সাহেব। সিঙ্গাপুর—কিন্তু সিঙ্গাপুরেও তাহার কোন আত্মীয় স্বজন নাই। সেখানে সে যে হোটেলে চাকুরী করিত, এখন সে হোটেলও উঠিয়া গিয়াছে।
আমি। কলিকাতায় কতদিন আসিয়াছে?
বড় সাহেব। ঘটনার দিনের তিন দিন পূর্ব্বে।
আমি। কলিকাতায় কেন আসিল?
বড় সাহেব। চাকুরীর চেষ্টায়।
আমি। কি চাকুরী সে জানে?
বড় সাহেব। সে বলে, সিঙ্গাপুরের হোটেলে সে পাচকের চাকুরী করিত, সেই চাকুরীর চেষ্টাতেই সে এখানে আসিয়াছে।
আমি। হতব্যক্তির পরিচয় তাহার নিকট কোন পাইয়াছেন কি?
বড় সাহেব। না—সে সেই ঘটনার দিন ঐ বাড়ীতে প্রথম চাকুরী পাইয়াছিল। তাহার প্রভুর কোন পরিচয় সে জানে না।
আমি। আচ্ছা, ঘটনার দিনের তিনদিন পূর্ব্বে সে কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছায়, তাহা হইলে আর দুই দিন সে কোথায় ছিল?
বড় সাহেব। নীমুখান্সামার লেনের ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর বাড়ী।
আমি। অত দূরদেশ হইতে সে যখন কলিকাতায় আসিয়াছে, নিশ্চয়ই তাহার সঙ্গে কাপড়চোপড় প্রভৃতি কিছু না কিছু দ্রব্য ছিল, সে সকল সে কোথায় রাখিয়াছে?
বড় সাহেব। সেই ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর বাড়ী।
আমি। নীমুখান্সামার লেনের ফেরোজা বাড়ীওয়ালীর বাড়ীর নম্বর কত?
বড় সাহেব। সে কথা সে বলিতে পারে না।
আমি। নীমুখান্সামার লেন ত চাঁপাতলায়—দপ্তরীপাড়ার সন্নিকট। সেখানে কোন অনুসন্ধান করা হইয়াছিল কি?
বড় সাহেব। না—কে সে অনুসন্ধান করিবে? তোমার উপর যখন এ খুনের তদারকের ভার, তখন আমি আর কাহাকেও সে কার্য্যে পাঠাইতে পারি না।
আমি। এ খুন সম্বন্ধে সে কি বলে?
বড় সাহেব। সে ত খুন স্বীকার করে না—সে বলে, তাহার প্রভু আত্মহত্যা করিয়াছে।
আমি। সে আত্মহত্যার কারণ কিছু বলে?
বড় সাহেব। না—সে বলে, সেইদিন সে চাকুরী লইয়াছে, সুতরাং সে আত্মহত্যার কারণ কিরূপে জানিবে। সে যেভাবে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়াছিল, তাহাতে তাহাকে একজন সামান্য পাচক বলিয়া বিশ্বাস করা যাইতে পারে না। সে যে একজন বিদ্বান ও বুদ্ধিমান, তাহার উত্তরের কায়দা দেখিয়াই আমি বুঝিয়াছি। সে নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী—তোমার কথাই ঠিক্।
আমি। আচ্ছা, সে যদি নির্দ্দোষ, তবে যে সময় আমরা দরজা ভাঙ্গিয়া বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, আমাদের দেখিয়া সেরূপ ভাবে আমাদের দিকে পিস্তল তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিল কেন? এই সকল কথা স্পষ্ট বলিলেই ত হইত। আর আমি গিয়া পশ্চাৎদিক হইতে তাহাকে বাগাইয়া না ধরিলে, সে ত আমাদের সম্মুখেই ইন্স্পেক্টার সাহেবকে গুলি করিয়া মারিত।
বড় সাহেব। সে বলে—হঠাৎ তাহার সম্মুখে একটা আত্মহত্যা হওয়ায়, তখন তাহার মাথা খারাপ হইয়া যায়। সে কি করিয়াছে, তাহার জ্ঞান নাই। তবে ভয়ে সে পলাইবার চেষ্টা করে, আর আত্মরক্ষার জন্য তাহার আত্মহত্যাকারী প্রভুর পিস্তলটি সে হাতে করিয়া লয়—এইমাত্র তাহার স্মরণ আছে। আর কোন কথা তাহার স্মরণ নাই।
আমি। এই সকল এজাহার সে কি আপনার নিকট দিয়াছে?
বড় সাহেব। না—পুলিসের নিকট সে কোন এজাহার দেয় নাই। পীড়াপীড়ি করিলে স্পষ্ট বলিত, সে পুলিসের নিকট কোন এজাহার দিবে না। সে যে একজন আইনজ্ঞ পাকা বদমায়েস, তাহার কথাবার্ত্তার ধরণ দেখিয়াই বুঝিয়া ছিলাম। এ সকল এজাহার সে করোণারের প্রশ্নের উত্তরে দিয়াছিল, করোনার্স কোর্ট হইতে আমরা সে সকল এজাহরের নকল লইয়াছি। আর আমিও সে সময় সে স্থানে উপস্থিত ছিলাম।
আমার আর কোন কথা জানিবার আবশ্যক ছিল না, সুতরাং আমি সেদিনকার মত সাহেবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম। এ দিনও রাত্রে আমার নিদ্রা হইল না—নানা রকম চিন্তা আসিয়া মনের মধ্যে বড়ই উৎপাত করিতে লাগিল।