উভয় সঙ্কট/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 পরদিন বেলা দশটার সময় আহারাদি করিয়া আমরা সেই ইয়ারিং লইয়া বাহির হইলাম। কলিকাতায় যে সকল ইংরাজ বণিকদিগের জুয়েলারী দোকান আছে, একে একে সেই সকল দোকানে সেই ইয়ারিং দেখাইতে লাগিলাম। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল—এই ইয়ারিং এই দোকানে প্রস্তুত হইয়াছে কি না? কিন্তু আমার সে প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কোন দোকানেই পাইলাম না। শেষে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হইল—এইরূপ ইয়ারিং আর একটা প্রস্তুত করিতে কত ব্যয় হইবে? সে প্রশ্নের উত্তরে কেহ বলিল,—আড়াই হাজার টাকা, কেহ বলিল,—দুই হাজার টাকা। দুই হাজারের কমে কেহ আর এইরূপ আর একটী ইয়ারিং প্রস্তুত করিয়া দিতে রাজী হইল না। তখন আমি বুঝিলাম, এই ইয়ারিং জোড়ার দাম চারি হাজার হইতে পাঁচ হাজার টাকা পর্য্যন্ত হইবে। এরূপ মূল্যবান ইয়ারিং নিশ্চয়ই কোন সম্ভ্রান্ত বংশীয় স্ত্রীলোকের হইবে—এই কথা আমার মনে একবারে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়া গেল। কিন্তু সে বংশ যে কোন বংশ, তাহা জানিতে না পারিলে আর আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে না। তখন বেলা তিনটা বাজিয়া গিয়াছে, কিন্তু তথাপি আমি নিরুৎসাহ হই নাই। আমার সঙ্গে কেনারাম দাদাও ছিলেন, তিনি ত আমার উপর চটিয়া লাল। তাঁহাকে সান্ত্বনা করাও আমার এক কাজের মধ্যে দাঁড়াইল। এদিকে তাঁহাকে ফিরিয়া যাইতে বলিলেও কেনারাম দাদা রাজী নহেন, আমি কেনারাম দাদাকে লইয়া তখন এক মুস্কিলে পড়িলাম।

 অবশেষে বেলা চারিটার সময় আমরা বস্পার্ড কোম্পানির দোকানে উপস্থিত হইলাম। দোকানের একজন সাহেব কর্ম্মচারী সেই ইয়ারিং দেখিয়াই কহিলেন,—সে ইয়ারিং তাহারাই প্রস্তুত করিয়াছে। আমি যেন তখন একবারে স্বর্গ হাত বাড়াইয়া পাইলাম। তৎক্ষণাৎ আমি আমার পরিচয় দিয়া কহিলাম, “এই ইয়ারিং কেহ হারাইয়াছে, যাহার ইয়ারিং তাহাকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিবার ভার আমার উপর হইয়াছে, আপনারা কাহার জন্য এই ইয়ারিং প্রস্তুত করিয়াছিলেন—সে সন্ধান পাইলে আমি বিশেষ বাধিত হইব।”

 সাহেব তখন আমায় একটা ঘরের মধ্যে লইয়া গেলেন। সেই ঘরের টেবিলের উপর অনেক হিসাবপত্রের খাতাপত্র প্রভৃতি সাজান রহিয়াছে দেখিলাম। তাহাদের মধ্য হইতে একখানি খাতা বাহির করিয়া সাহেব উল্টাইয়া পাল্টাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর কহিলেন, “এ ইয়ারিং বিবি ইসাবেলার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল।”

 আমি। কতদিন পূর্ব্বে এ ইয়ারিং প্রস্তুত হয়?

 সাহেব। প্রায় দুই বৎসর অতীত হইল—এই ইয়ারিং প্রস্তুত হইয়াছে।

 আমি। এই ইয়ারিং জোড়া কত টাকায় আপনারা বিক্রয় করিয়াছিলেন?

 সাহেব। চারিহাজার তিনশত বাহান্ন টাকায়।

 আমি। বিবি ইসাবেলার ঠিকানা কোথায় বলিতে পারেন কি?

 সাহেব। তখন ছিল—৩২ নং এজ্‌রা স্ট্রীট। এখন সেইখানেই তিনি আছেন কি না, সে সংবাদ আমরা কিছুই বলিতে পারি না।

 আমি সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়া এবং তাঁহাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া, সে স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সে দোকান হইতে বাহির হইয়াই আমি কেনারাম দাদাকে একখানি গাড়ী ডাকিতে কহিলাম। সৌভাগ্যক্রমে সম্মুখেই একখানা গাড়ী পাওয়া গেল। সেই গাড়ীতে চড়িয়াই আমি গাড়োয়ানকে দ্রুতগতিতে এজরা স্ট্রীটে যাইতে কহিলাম। ৩২ নং এজ্‌রা স্ট্রীটে গিয়া অনুসন্ধানে জানিলাম আজ প্রায় এক বৎসর হইল—বিবি ইসাবেলার মৃত্যু হইয়াছে। মৃত্যুর পর তাহার একজন উত্তরাধিকারী আসিয়া বিবির সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি নীলামে বিক্রয় করিয়া সে টাকা লইয়া গিয়াছে। আরো অনুসন্ধানে জানিলাম—বিবির জুয়েলারি গহনা না কি সেই নীলামে বিক্রয় হয়। তখন বড় আশায় নৈরাশ হইলাম। কে নীলাম করিয়াছিল, কেই বা সেই নীলমে এই ইয়ারিং জোড়া খরিদ করিয়াছিল, এই সকল অনুসন্ধানে বাহির করা বড় সহজ কথা নহে, সুতরাং আমি এইবার বড়ই নিরুৎসাহ হইয়া পড়িলাম। তখন বেলা ছিল, সেই কারণ থানায় ফিরিয়া না গিয়া, আমি কলিকাতার প্রধান প্রধান নীলামকারকের নিকট সেই সন্ধানে ঘুরিলাম; কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। তখন অগত্যা ভগ্নমনোরথ হইয়া থানায় ফিরিলাম।