উভয় সঙ্কট/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
ভগ্নহৃদয়ে ও বিষণ্ণমনে থানায় ফিরিয়া আসিলাম। থানায় আসিয়া শুনিলাম, গত রাত্রে ভোরের সময় রাস্তায় একজন মাতালকে প্রেপ্তার করা হইয়াছিল, কিন্তু পুলিসকোর্টে লইয়া যাইবার সময় কেহ তাহাকে দেখিতে পায় নাই। সে পলাতক হইয়াছে। যদিও আসামী বিশেষ কোন গুরুতর অপরাধী নয় বটে, কিন্তু থানার ভিতর হইতে পলায়ন করাতে একটা মহা হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছিল। তখন সে আসামীর চেহারা কিরূপ, এই কথা লইয়া অনেক তর্ক বিতর্ক হইতেছে শুনিলাম। সেই সকল তর্ক বিতর্কের কথা শুনিয়া আমার মনে কেমন একটা খট্কা লাগিল। দুই চারিকথা প্রশ্ন করিয়া যাহা জানিতে পারিলাম, তাহাতে আক্কেল গুড়ুম হইয়া গেল! যে ব্যক্তি দত্তবাবুদের বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, আর যে গতরাত্র সেই খুনের বাড়ী হইতে একজন স্ত্রীলোককে সঙ্গে লইয়া খিদিরপুরে পলাইয়া যায়, এই পলাতক আসামীও সেই ব্যক্তি! তখন কে যেন আমার কানে কানে বলিয়া দিল—সে পলাতক আসামী বাস্তবিক মাতাল ছিল না, মাতালের ভাণ করিয়া থানার হাজতে আসিবার জন্য ধরা দিয়াছিল, তার পর নিজের কাজ উদ্ধার করিয়া চলিয়া গিয়াছে। সে মাতাল আসামীর সহিত খুনী আসামীর সাক্ষাৎ যে হয় নাই, সে কথা কেহ বলিতে পারিল না। আর যে পাহারওয়ালা সেই মাতালকে থানায় ধরিয়া আনে, তাহাকে প্রশ্ন করিয়া জানিলাম যে, সে ব্যক্তির মুখে কোনরূপ মদের গন্ধ সে পায় নাই, তবে রাস্তায় বড়ই মাতলামী করিতে ছিল বলিয়া তাহাকে ধরিয়া আনা হয়।
তখন আমার মনে আর কোন সন্দেহই রহিল না, আমি নিশ্চয় করিলাম—সেই পলাতক আসামী নিশ্চয়ই খুনী আসামীর লোক। সেই খুনী আসামীর জন্য মেছুয়াবাজার দত্তবাবুদের বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সেই খুনী আসামীর স্ত্রীলোককে উদ্ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে। সে স্ত্রীলোক যে গত রাত্রে নিরাপদ স্থলে পৌঁছিয়াছে, বোধ হয়, সেই সংবাদ খুনী আসামীকে দিবরা জন্য মাতালের ভাণ করিয়া থানায় পর্য্যন্ত আসিয়াছিল।
সে ব্যাটার কি সাহস! এই ঘটনায় এই খুনী আসামী যে এক জন ছদ্মবেশী বড় লোক, সে কথা আমার মনে আরো দৃঢ় বিশ্বাস হইয়া গেল। তখন আমি থানার ইন্স্পেক্টার সাহেবকে সেই সকল কথা কহিলাম। কিন্তু এই সকল প্রমাণ সত্ত্বেও তিনি আমার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন এবং আমার উপর নানারূপ বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সুতরাং সে সাহেবের নিকট আমি আর থৈ পাইলাম না। আমি সে স্থান হইতে সরিয়া পড়িলাম।
তখন সন্ধ্যা হইবার আর অধিক বিলম্ব নাই। সুতরাং আমাদের ডিটেক্টিভ পুলিস আফিসে আসিয়া সেই দিনকার রিপোর্ট লিখিতে বসিলাম। এক ঘণ্টার মধ্যে সে রিপোর্ট লেখা শেষ হইলে আমি সেই রিপোর্ট লইয়া বড় সাহেবের নিকট চলিলাম। কারণ প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় দৈনিক রিপোর্ট লইয়া বড় সাহেবের সহিত আমার সাক্ষাৎ করিবার হুকুম ছিল।
আমি যখন বড় সাহেবের নিকট পৌঁছিলাম, তখন অপর কোন একজন পুলিস-কর্ম্মচারী তাঁহার কামরার মধ্যে ছিলেন, সুতরাং আমায় কিছুক্ষণ বাহিরে অপেক্ষা করিতে হইল। সে কর্ম্মচারী বাহির হইয়া আসিলে আমি কামরার মধ্যে গিয়া সাহেবকে এক লম্বা সেলাম দিলাম। সাহেব যেন আমারই অপেক্ষায় ছিলেন, এইরূপ ভাব প্রকাশ করিয়া আমায় আগ্রহের সহিত কহিলেন—“তোমার সংবাদ কি?”
আমি মুখে কোন কথা না বলিয়া আমার লিখিত রিপোর্টখানি সাহেবের সম্মুখে ধরিলাম। সাহেব বিশেষ মনোযোগের সহিত আমার রিপোর্ট পাঠ করিতে লাগিলেন। পাঠকালীন তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম—তিনি আমার কার্য্যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছেন। রিপোর্ট পাঠ শেষ হইলে তিনি আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন,—“তোমার অনুমানই যে ঠিক, সে বিষয়ে আমার আর কোন সন্দেহ নাই। এখন এই খুনের ভিতর যে একটা ভয়ঙ্কর রহস্য রহিয়াছে, একথা আমার মনেও দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়াছে। তুমি সে রহস্য ভেদ করিতে পারিলে, আমি তোমার বিশেষরূপ পদোন্নতি করিয়া দিব। এরূপ রহস্যজনক খুন সচরাচর ঘটে না, সুতরাং তুমি কৃতকার্য্য হইতে পারিলে, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করিতে পারিবে।”
আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “হুজুরের অধীনে এত বড় বড় উপযুক্ত কর্ম্মচারী থাকিতে, আমার উপর এই খুনের তদারকের ভার দিয়া হুজুর আমার প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। এখন আমিও যে হুজুরের সে অনুগ্রহের অনুপযুক্ত নই, সে প্রমাণ প্রাণপণে দিতে চেষ্টা করিব।”
সাহেব তখন হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “এরূপ কার্য্যে দুই একবার অকৃতকার্য্য হইয়া নিরুৎসাহ হইতে নাই। যে নিরুৎসাহ হইল, তাহার দ্বারা কখন কোন কার্য্যের আশা করা যায় না। এবার কোন্ পথে অনুসন্ধান চালাইতে ইচ্ছা কর?”,
আমি বিনীতভাবে কহিলাম, “হুজুর যে পথে চালাইবেন, আমি সেই পথে চলিব।”
বড় সাহেব কহিলেন, “তোমার কিরূপ মৎলব জানিতে ইচ্ছা করি।”
আমি তখন সাহস করিয়া বলিলাম, “যদি সে হীরার ইয়ারিংটা আমায় দেন, তবে আমি একবার তাহার মালিকের অনুসন্ধান করিতে পারি।”
সাহেব। কিরূপে অনুসন্ধান করিবে?
আমি। সেরূপ মূল্যবান ইয়ারিং নিশ্চয় কোন সাহেববাড়ীর বড় দোকানে প্রস্তুত হইয়াছে। আর যেখানে প্রস্তুত হইয়াছে, তাহারা নিশ্চয়ই ইহা দেখিলে চিনিতে পারিবে। কারণ এত বড় হীরা ও পান্না সাধারণ হীরা পান্না নহে। প্রস্তুতকারীকে জানিতে পারিলে, এরূপ বহুমূল্য ইয়ারিং যাঁহার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তাঁহাকে জানিতে আর অধিক বিলম্ব হইবে না।
বড় সাহেব আমার প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হইয়া আমায় সেই ইয়ারিং বাহির করিয়া দিলেন। তখন রাত্রি হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং সে সময় সে অনুসন্ধান আর হইতে পারে না বলিয়া আমি আমর আড্ডায় ফিরিয়া আসিলাম। রাত্রে আর নিদ্রা হইল না, মনে মনে উচ্চ একটা প্রকাণ্ড অট্টালিকা বানাইতে লাগিলাম, আর কতক্ষণে রাত্রি প্রভাত হয়, সেই অপেক্ষায় রহিলাম।