ঋষি রবীন্দ্রনাথ/১
( ১ )
প্রথম প্রশ্নটিই প্রথমে গ্রহণ করা যাইতেছে—ব্রহ্মজ্ঞানে বা ব্রহ্মবিদ্যায় রবীন্দ্রনাথের অধিকার ছিল কিনা। শাস্ত্র এবং আচার্যগণ বলেন যে, ব্রহ্মজিজ্ঞাসা এবং ব্রহ্মবিদ্যার জন্য বিশেষ অধিকার আবশ্যক করে। কি সে বিশেষ অধিকার?
ব্রহ্মসূত্রের প্রথম সূত্রটির ভাষ্যেই আচার্য শঙ্কর এই অধিকারী প্রশ্নের উত্তর দিয়াছেন। অধিকার-বিচারে তিনি বলিয়াছেন — নিত্যানিত্যবস্তু বিবেক, ঐহিক ও পারত্রিক ভোগের প্রতি বৈরাগ্য, ষট-সম্পত্তি (শম = বহিরিন্দ্রিয় সংযম, দম = অন্তরিন্দ্রিয়-নিগ্রহ, তিতিক্ষা = শীতোষ্ণ ক্ষুধাতৃষ্ণা ইত্যাদি দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতা, উপরতি = বিষয়ানুভব হইতে ইন্দ্রিয়গণের বিরতি, সমাধান = আত্মতত্বের ধ্যান এবং শ্রদ্ধা = গুরু ও শাস্ত্রবাক্যে সম্যক্ শ্রদ্ধা) এবং মুমুক্ষুত্ব (মোক্ষের নিমিত্ত তীব্র ইচ্ছা) এই সকল যাঁহার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তিনিই শুধু, ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসার অধিকারী।
কোনরূপ বিশ্লেষণ না করিয়াই বলা চলে যে, আচার্য শঙ্করের নির্দিষ্ট এই অধিকার-বিচারে রবীন্দ্রনাথ কদাচ অধিকারী পুরুষ বলিয়া বিবেচিত হইতে পারেন না। বিবেক, বৈরাগ্য, ষট-সম্পত্তি এবং মুমুক্ষুত্ব বহু ও দীর্ঘ সাধনার পরেই সাধকের প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে। বহু বা দীর্ঘ কোন সাধনাতে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসুর অধিকারসমূহ অর্জন করিয়াছেন, ইহার কোন প্রমাণ নাই। কাজেই, আচার্য শঙ্করের বিচারে রবীন্দ্রনাথ অধিকারী পুরুষ নহেন, ইহাই সিদ্ধান্ত।
কিন্তু ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা এবং ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন, এমন পুরুষের দৃষ্টান্ত বিরল নহে। রবীন্দ্রনাথ সেই বিরল পুরুষদেরই অন্যতম, তিনি ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকার লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এখন প্রশ্ন হইবে, তাহার প্রমাণ কি? সেই প্রমাণই অতঃপর অনুসন্ধান করা যাইতেছে। সে-প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের বাল্যজীবনেই পাওয়া যাইবে।
রবীন্দ্রনাথের যখন পৈতা হয়, তখন তাঁহার বয়স এগারো কি বারো হইবে। পৈতার পরে একদিনের একটি ঘটনা সম্বন্ধে তাঁহার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে তিনি লিখিয়াছেন, “একদিনের কথা মনে পড়ে—আমাদের পড়িবার ঘরে শান-বাঁধানো মেজের এক কোণে বসিয়া গায়ত্রী জপ করিতে করিতে সহসা আমার দুই চোখ ভরিয়া জল পড়িতে লাগিল।” বলা বাহুল্য, ব্রহ্মগায়ত্রীর অর্থ ও তত্ত্ব উপলব্ধির বয়স বা অবস্থা সেটা নহে, মনীষা এবং প্রতিভা তাঁহার যত প্রচুরই হউক না কেন। রবীন্দ্রনাথ তাই ঘটনাটির ব্যাখ্যা এইভাবে করিয়াছেন, “মানুষের অন্তরের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে সম্পূর্ণ না বুঝিলেও যাহার চলে।”
ইহা গেল রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ব্যাখ্যা বা অনুমান। এখন দেখা যাক যে, এই উপলব্ধিটিকে বা ঘটনাটিকে শাস্ত্রের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলে কি পাওয়া যায়।
‘যোগসূত্র’ নামক পাতঞ্জল দর্শনের কৈবল্য পাদে একটি সূত্র রহিয়াছে, “বিশেষদর্শিন আত্মভাব-ভাবনা-বিনিবৃত্তি॥” সূত্রটির সরল অর্থ—“চিত্ত হইতে আত্মাকে যিনি পৃথকরূপে দর্শন করিয়াছেন, তাঁহার আর আত্মভাবনা কিছু থাকে না।” ভগবান বেদব্যাস এই সূত্রটির ভাষ্য করিয়াছেন— “যেমন বর্ষাকালে তৃণাঙ্কুরের উদ্গম দেখিয়া তাহার বীজ মূত্তিকায় থাকা প্রমাণ হয়, তদ্রূপ মোক্ষমার্গের বিবরণ শ্রবণে যে ব্যক্তির শরীরের রোমাঞ্চিত হইতে ও অশ্রুপতন হইতে দেখা যায়, তাঁহাতে আত্মসাক্ষাৎকারের বীজ বর্তমান আছে এবং তাঁহার মোক্ষোৎপাদক কর্মসকল ফলোন্মুখ হইয়াছে, এইরূপ অনুমান করা যায়: আত্মবিষয়ে ভাবনা তাঁহার স্বভাবতঃই প্রবর্তিত হয়।”
যোগদর্শন এবং ভগবান বেদব্যাসের কথিত লক্ষণটি এই ক্ষেত্রে অনুসরণ করিলে দেখা যাইবে যে, এগারো বৎসরের বালক রবীন্দ্রনাথের গায়ত্রী-জপে অশ্রুপতনের অর্থ হইল— আত্ম বা ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের বীজটি লইয়াই রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার মোক্ষোৎপাদক কর্ম সকল ফলোন্মুখ হইয়াছে।
এই কারণেই আচার্য শঙ্করের কথিত বিবেক, বৈরাগ্যাদি প্রতিষ্ঠার পথে অধিকারী হইবার জন্য রবীন্দ্রনাথের কোনরূপ সাধনার প্রয়োজনই হয় নাই। ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের বীজ লইয়া যিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার সম্পর্কে অধিকারের প্রশ্নই উঠে না। ব্রহ্মজ্ঞান লইয়া তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাহা বীজাকারে বা কুঁড়ির মতই ভিতরে রহিয়াছে; কালক্রমে স্বভাবধর্মে তাহা আপনা হইতেই পূর্ণ প্রকাশিত বা প্রস্ফুটিত হইবার অপেক্ষা মাত্র।
আত্মসাক্ষাৎকারের বীজটি লইয়া রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়াই বালককালে তিনি এমন নির্জনতা-প্রিয়, নিঃসঙ্গ, একক-স্বভাবের হইয়াছিলেন। পাঁচ-ছয় বৎসরের বালককালের নিজের একটি সন্ধ্যাকালীন চিত্র তিনি এইভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন দেখা যায়, “এই নিস্তব্ধ-প্রায় জগতের মধ্যে আমি ছিলুম এক কোণের মানুষ, লাজুক, নীরব, নিশ্চঞ্চল।”
আর একটু, বড় হইয়া নিজের এই একই চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন—“সে হচ্ছে একটি বালক, সে কুনো, সে একলা, সে একঘরে, তার খেলা নিজের মনে।” নিজের বাল্যজীবনকে রবীন্দ্রনাথ এই কয়টি কথার মধ্যে ধরিয়া দিয়া গিয়াছেন,, “আমি ইস্কুল-পালানো ছেলে, পরীক্ষা দেইনি, পাস করিনি, মাষ্টার আমার ভাবীকালের সম্বন্ধে হতাশ্বাস। ইস্কুল ঘরের বাইরে যে অবকাশটা বাধাহীন, সেইখানে আমার মন হা-ঘরেদের মত বেরিয়ে পড়েছিল।”
অন্তরগর্ভে যে ব্রহ্মবীজ তিনি জন্ম হইতেই ধারণ ও বহন করিতেছিলেন তাহারই প্রভাব তাঁহার বালককালের এই চরিত্রে ও স্বভাবে পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে। এইজন্যই কাহাকেও গাছের পাতা ছিঁড়িতে দেখিলে ছয়-সাত বৎসরের বালক রবীন্দ্রনাথ এমন মর্মবেদনা অনুভব করিতেন, এই কারণেই ছয়-সাত বৎসরের বালক বাড়ীর ছাদে উঠিয়া আকাশের দূর দিগন্তের দিকে চাহিয়া উদাসী ও আনমনা হইয়া যাইতেন।
বীজমাত্রেরই পুষ্টি, পূর্ণতা এবং প্রকাশের জন্য অনুকূল ক্ষেত্রের প্রয়োজন। ঊষর মরুভূমিতে ভালো বীজও ব্যর্থ, আবার দুর্বল বীজও রসের জোরে কঠিন পাথর ঠেলিয়া আকাশের আলোকে ডালপালা মেলিয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ব্রহ্মবীজটি কিরূপে পরিবেশ বা প্রতিবেশ প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহার একটু সংবাদ লওয়া আবশ্যক।
এগারো বারো বৎসরের পূর্বোক্ত ঘটনার কয়েকদিন পরেই বালক রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখিতে পাই হিমালয়ে, পিতা মহর্ষির সঙ্গে তিনি হিমালয়-ভ্রমণে আসিয়াছেন। ইহা রবীন্দ্রনাথের জীবনে আকস্মিক বা অর্থহীন ঘটনামাত্র নহে: যাঁহার ইঙ্গিতে সর্বকিছু নিয়ন্ত্রিত, তাঁহারই অদৃশ্য নির্দেশে এই সময়ে ঋষি বালকের এই হিমালয়ে আগমন। হিমালয় শিবভূমি, হিমালয় যোগভূমি এবং হিমালয় ভারতের মুনি-ঋষি-দেবতার অনন্তসঞ্চিত তপস্যার পাষাণঘন মূর্তি— ব্রহ্মবীজের পোষণ ও পূর্ণতার ইহাই শ্রেষ্ঠতম পরিবেশ। এই শিবভূমির অদৃশ্য মহাযোগীর হস্তধৃত কমণ্ডলুর জলে এই ব্রহ্মবীজের অভিষেক-স্নান আবশ্যক, তাই অদৃশ্যের আমোঘ আকর্ষণে রবীন্দ্রনাথের এখানে না আসিয়া উপায় ছিল না। ভারতের সনাতন তপোভূমি “যেন কোন্ পূর্বজন্মের পরিচয়ে আমাকে কোলে করিয়া লইল।”—হিমালয়ে আসিয়া ইহাই রবীন্দ্রনাথের মনোভাব।
রবীন্দ্রনাথ তাঁহার আত্মজীবনীতে বলিয়াছেন যে, এখানে আসিবার পর পিতা মহর্ষি গীতার মনোমত শ্লোকগুলি চিহ্নিত করিয়া দিয়াছিলেন এবং সেগুলি “বাংলা অনুবাদ সহ আমাকে কপি করিতে দিয়াছিলেন।” সর্বোপনিষদ দোহন করা গীতার অমৃতরস হইল এখানে বালক রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক পানীয়। তারপর তিনি বলিয়াছেন, হিমালয়ে বসিয়া “আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশী বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম।” হিমালয়ের আসনে উপবিষ্ট হইয়া এযুগের ঋষিকবি এইভাবেই আদিকবির নিকট কাব্যদীক্ষা গ্রহণ করিয়াছেন। সর্বশেষে তিনি বলিয়াছেন, “প্রায় প্রতিদিনই বিশুদ্ধ উচ্চারণে অনর্গল আবৃত্তি করেছি উপনিষদের শ্লোক।”
ভিতরে ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের বীজ, স্থান ব্রহ্মভূমি হিমালয়, সঙ্গে পিতা মহর্ষি এবং উপনিষদের ব্রহ্মমন্ত্রআবৃত্তি নিত্যকর্ম, বীজের পরিপোষণের পক্ষে শ্রেষ্ঠতম পরিবেশই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত দেখা যাইতেছে। কাজেই তাঁহার ‘মোক্ষোৎপাদক কর্ম সকল’ একটু বিশেষ দ্রুততার সহিতই ফলোন্মুখ হইয়াছে, ইহাও দেখা যাইবে।