(৩)

 রবীন্দ্রনাথের আঠারো-ঊনিশ বৎসর বয়সের প্রথম উপলব্ধির মধ্যে দুইটি বিশেষ-দর্শন লক্ষিত হয়—ব্রহ্মের জ্যোতিরূপ এবং জগতের আনন্দরূপ। কিন্তু এই উপলব্ধিটি যেমন অকস্মাৎ আসিয়াছিল, কিছু কাল পরে তেমনি অকস্মাৎ অন্তর্হিত হইয়াছে; দৃষ্টির উপর হইতে যে পর্দা সরিয়া গিয়াছিল, তাহা আবার যথাস্থানে নামিয়া আসিয়াছে। উপলব্ধিটি বিবরণের উপসংহার রবীন্দ্রনাথ এইভাবে করিয়াছেন,—

 “জগতের আনন্দরূপের উপর তখনো যবনিকা পড়িয়া গেল না। .... . কিছু কাল আমার এইরূপ আত্মহারা আনন্দের অবস্থা ছিল। পরিচয় পাইয়াছি, কিন্তু আর দেখা পাই না। রত্ন দেখিতেছিলাম, হঠাৎ তাহা বন্ধ হইল এখন কৌটা দেখিতেছি। কিন্তু কৌটার উপরকার কারুকার্য যতই থাক, তাহাকে আর শূন্য কৌটামাত্র বলিয়া ভ্রম করিবার আশঙ্কা রহিল না।”

 আত্মার জ্যোতিরূপ এবং জগতের আনন্দরূপ যিনি দেখিয়াছেন, তাঁহার দৃষ্টিতে আবার আবরণ নামে কেমন করিয়া?

 প্রশ্নটির উত্তরে প্রথমে মনে রাখিতে হইবে যে, ব্রহ্মদর্শন আর ব্রাহ্মীস্থিতি এক বস্তু নয়। ব্রহ্মজ্যোতিদর্শন হইলেই ব্রহ্মজ্যোতিতে প্রতিষ্ঠা হয় না, আত্মসাক্ষাৎকার হইলেই স্ব-স্বরূপে স্থিতি লাভ হয় না। ব্রহ্মদর্শন বা আত্মদর্শনের অর্থ হইল জ্ঞানলাভ। যোগসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি এবং যোগবাশিষ্ঠ্যে মহর্ষি বশিষ্ঠ জ্ঞানের সপ্তভূমির কথা বলিয়াছেন। এই জ্ঞানভূমি একটির পর একটি ক্রমে ক্রমে জয় করিয়া জ্ঞানের সপ্তম ভূমিতে যিনি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, কেবল তাঁহারই দৃষ্টি হইতে আচ্ছাদন চির-অপসৃত হয়, কেবল তাঁহারই দৃষ্টি নিত্য মুক্ত।

 রবীন্দ্রনাথ বিশেষ কোন সাধন-পন্থা অনুসরণ করিয়া একটির পর একটি প্রজ্ঞাভূমি জয় করিয়া অবশেষে আত্মজ্যোতি দর্শন করেন নাই। কাজেই সপ্তম ভূমির প্রজ্ঞা জ্যোতি অকস্মাৎ উদ্ভাসিত হইলেও সে-ভূমি তাঁহার লব্ধ ভূমি হয় নাই। তাই দৃষ্টিতে আবার পূর্বের আচ্ছাদন নামিয়া আসিয়াছে।

 যোগসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি আরও বলিয়াছেন, ‘যে যোগীর চিত্ত বিবেকপথে কৈবল্যের দিকে প্রবাহিত হইয়াছে ছিদ্র পাইলে তাহার চিত্তও পূর্ব সংস্কারসমূহে আচ্ছন্ন হয়।’ সাধনায় যাঁহার সম্প্রজ্ঞাত সমাধি সিদ্ধ হইয়াছে, সেই উচ্চ-সাধক সম্বন্ধেই এই উক্তি যোগসূত্রে করা হইয়াছে।

 আর রবীন্দ্রনাথের আত্মজ্যোতিদর্শন বিনা সাধনে এবং অকস্মাৎ ঘটিয়াছে, কাজেই তাঁহার চিত্ত অবিদ্যাদি ক্লেশ ও পূর্ব সংস্কারসমূহ হইতে এত সহজে এবং এত সত্বর কখনো মুক্ত হইতে পারে না, তাহা সাধনা সাপেক্ষ। এই কারণেই ব্রহ্মজ্যোতি রবীন্দ্রনাথের নিজেকে ও জগৎকে দেখাইয়া দিয়া আবার অন্তর্হিত হইয়াছে এবং রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে আবার পূর্বের আবরণ নামিয়া আসিয়াছে।

 দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসদেবের একটি উক্তি এই সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য, তিনি বলিয়াছেন যে, এমন গাছও আছে, যার আগে ফল পরে ফুল। অর্থাৎ, আগে সিদ্ধি পরে সাধনা, এমন দৃষ্টান্ত বিরল নহে, ইহাই তিনি বলিয়াছেন। পরমহংসদেবের নিজের জীবনই সেই দৃষ্টান্ত।

 বয়স তখন তাঁহার দশ কি এগারো, একদিন পাশের আনুড় গ্রামে বিশালাক্ষী দেবীকে দেখিতে চলিয়াছেন, মাঠের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছেন, এমন সময়ে দেখিতে পান যে আকাশে বক উড়িয়া চলিয়াছে। দেখিয়াই তিনি সংজ্ঞা হারাইয়া মাটিতে পড়িয়া যান, তখন তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া বাড়ীতে আনা হয়। পরবর্তীকালে নিজেই তিনি এই ঘটনার কথায় বলিয়াছেন, “দশ-এগারো বছরের সময় দেশে বিশালাক্ষী দেখতে গিয়ে মাঠে অবস্থা হয়। কি দেখলাম!—একেবারে বাহ্যশূন্য।”

 অকস্মাৎ চৈতন্যের মহাকাশটি ভিতরে উদ্ঘাটিত হইয়া গিয়াছিল এবং সেই আকাশেই তিনি ধাবমান বলাকা শ্রেণীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে, উপনিষদেও ব্রহ্মের এক নাম বলা হইয়াছে—আকাশ। পরমহংসদেব অন্যত্র বলিয়াছেন যে, সেদিন তিনি ব্রহ্মজ্যোতিই দর্শন করিয়াছিলেন। ইহাই পরমহংস— দেবের প্রথম ব্রহ্মজ্যোতি-দর্শন এবং রবীন্দ্রনাথের ন্যায় তাঁহারও নিকটে ব্রহ্ম তাঁহার জ্যোতিরূপই প্রথম অনাবৃত করিয়াছিলেন দেখা যায়।

 পুরাণে দেবর্ষি নারদের প্রথম উপলব্ধির যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাহার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হইবে।

 বাল্যকালে একদিন অকস্মাৎ নারদের দৃষ্টির সম্মুখে ভগবান নিজেকে প্রকাশ করেন এবং পরমুহূর্তে অদৃশ্য হন। নারদ তখন ব্যাকুল হইয়া কাঁদিয়া কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে থাকেন, “তুমি কোথায়?” অদৃশ্য আকাশ হইতে উত্তর আসিল, “আমি নিজেই তোমাকে দেখা দিয়াছি, এখন তুমি আমাকে খুঁজিয়া বাহির কর।” নারদ কাঁদিয়া বলিলেন, “এজগতে সব কিছুকেই দেখিতেছি, কিন্তু তোমাকে তো কোথাও দেখি না। কেমনে এ জগতকে পার হইয়া তোমাকে আমি কোথায় খুঁজিয়া বাহির করিব?”

 এবার অদৃশ্য আকাশের আশ্বাসবাণী নারদ শুনিতে পাইলেন, “হে নারদ, আমি যাঁহাকে স্পর্শ করি, তাঁহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখে, সে-শক্তি আমার সৃষ্ট জগতের নাই; আমি যাঁহাকে দেখা দেই, সংসারের সাধ্য কি তাঁহার দৃষ্টি হইতে আমাকে দীর্ঘকাল আড়াল করিয়া রাখে।”

 দেবর্ষি নারদ এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়ের প্রথম উপলব্ধির সাদৃশ্যে এত স্পষ্ট যে, তাহা বিশ্লেষণ করিয়া বুঝাইবার আবশ্যক করে না। নারদ আশ্বাসবাণী শুনিয়াছিলেন যে, ব্রহ্ম যাঁহাকে স্পর্শ করেন, জগৎ-সংসার আর তাঁহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে না। অর্থাৎ, তাঁহার দৃষ্টিতে তখন জগৎ আর জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বা শেষ নহে, নিজের অতীত এক সত্তাতেই যে জগৎ ধৃত, এই সত্য তাঁহার দৃষ্টিতে সর্বদাই উদঘাটিত থাকে।

 আর রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই কথাটিই অন্যভাবে বলিয়াছেন।

 “পরিচয় পাইয়াছি কিন্তু আর দেখা পাই না। রত্ন দেখিতেছিলাম, হঠাৎ তাহা বন্ধ হইয়া গেল এখন কৌটা দেখিতেছি। কৌটার উপরকার কারুকার্য যতই থাক, তাহাকে আর কেবল শূন্য কৌটামাত্র বলিয়া ভ্রম করিবার আশঙ্কা রহিল না।”

 কৌটা বলিতে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশিত এই জগৎ-সংসারকেই বুঝাইয়াছেন এবং ইহার অন্তরালে বা অতীতে যিনি অদৃশ্য রহিয়াছেন, তাঁহাকেই বলিয়াছেন কোঁটার অভ্যন্তরে রত্ন এবং তাঁহার সম্বন্ধেই বিস্মৃতি বা ভ্রমের আশঙ্কা হইতে তিনি মুক্ত হইয়াছেন, প্রথমদর্শনের পরে এই দৃঢ় আত্মঘোষণাই তিনি করিয়াছেন। গীতাতেও শ্রীভগবান বলিয়াছেন, “স্বল্পমপ্যস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ”— তাঁহার সামান্যতম দর্শনস্পর্শনই জীবকে মহৎ ভয় অর্থাৎ সংসারবন্ধন হইতে ত্রাণ করিয়া থাকে॥

 এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ এত জোর দিয়া বলিতে পারিয়াছেন যে, “ভ্রমের আশঙ্কা হইতে” তিনি চিরকালের জন্য ত্রাণ পাইয়াছেন।

 পরমহংসদেব আগে ফল পরে ফুল, অর্থাৎ আগে প্রাপ্তি পরে সাধনার কথা বলিয়াছেন। দেবর্ষি নারদের আখ্যানেও আগে ভগবানকে দেখা পরে তাঁহাকে খোঁজার কথা আছে। ব্রহ্মের কোনরূপ প্রকাশ যাহাদের জীবনে প্রথমে হয়, তাঁহাদের জীবনে সাধনা স্বভাব-নিয়মে আপনা হইতেই হইয়া থাকে। যাঁহাকে পলকের জন্য দেখা পাওয়া গিয়াছে, তাঁহাকে পাইবার জন্য তখন একটা তীব্র ব্যাকুলতা সর্বক্ষণ সাধকের অন্তরে নদীধারার মত বহমান থাকে। এই তীব্র ব্যকুলতাই একটির পর একটি সাধনার স্তর বা ঘাট পার করিয়া সাধককে আগাইয়া লইয়া চলে। যিনি গুহাহিত, যিনি অন্তর্যামী, তিনি হৃদয়ের আবরণ সরাইয়া দেখা দিয়াছিলেন, সেই অন্তরবাসী ‘অন্তর্যামী অমৃত আত্মা’-কে তখন হৃদয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত অহর্নিশি চলিতে থাকে এবং ইহারই নাম সাধনা।

 এই সাধনা রবীন্দ্রনাথকেও করিতে হইয়াছিল। আসলে রবীন্দ্রনাথকে দিয়া এ সাধনা করাইয়া লওয়া হইয়াছিল, পরবর্তী কালের ঘটনা এবং উপলব্ধিসমূহ হইতে তাহার প্রমাণ আমরা যথাস্থানে দেখিতে পাইব।

 পূর্বেই মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্র এবং ব্যাসভাষ্যের নির্দিষ্ট লক্ষণ অনুসরণ করিয়া আমরা দেখিতে পাইয়াছি যে, রবীন্দ্রনাথ আত্মসাক্ষাৎকারের বীজটি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এই আত্মসাক্ষাৎকারের বীজটি ভিতরে ছিল বলিয়াই রবীন্দ্রনাথকে কোন স্বতন্ত্র বা বিশেষ সাধনা করিতে হয় নাই; সেই বীজটির ক্রমঃপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মনের যে অবস্থা বা পরিবর্তন ঘটিতে থাকে, তাহাই ভাষান্তরে একটির পর একটি সাধন অবস্থার স্তর অতিক্রম করা, অথবা একটির পর একটি জ্ঞানভূমি বা সাধনভূমি লব্ধ হওয়া।

 নিজের উপলব্ধির প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী জীবনে উপনিষদের একটি মন্ত্র বহুবার উল্লেখ করিয়াছেন। মন্ত্রটি কঠ ও মুণ্ডক উভয় উপনিষদে দৃষ্ট হইয়া থাকে, তাহা এই,—

 “নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন। যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুত্বে তনুং স্বাম”—এই ব্রহ্মকে বহু সাধ্যায় অর্থাৎ বেদপাঠ সহায়ে, অথবা মেধা বা ধারণাশক্তি সহায়ে, কিম্বা বহু শাস্ত্র শ্রবণের দ্বারাও জানা যায় না। যাঁহাকে ইনি বরণ করেন অর্থাৎ কৃপা করেন, তাঁহারই নিকট এই ব্রহন স্বীয় রূপ প্রকাশ করেন॥

 ব্রহ্মই রবীন্দ্রনাথকে বরণ করিয়াছিলেন, ব্রহ্মের সেই প্রকাশই পরে ব্রহ্ম আকর্ষণে পরিণত হয় এবং এই আকর্ষণই রবীন্দ্রনাথকে যে পথে আগাইয়া লইয়াছিল, সেই পথের নাম বা বিবরণই সাধনা। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ নিজে এই অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন—

 “সাধকেরা আপনারাই বলিয়াছেন তাঁহাকে পাইবার ‘পথ ন মেধয়া ন বহনা এভেন’। অর্থাৎ, এটা কোনমতেই পঠন-পাঠনের ব্যাপার নহে। কিন্তু কেমন করিয়া সাধকেরা এই পূর্ণতার উপলব্ধিতে উপনীত হইয়াছেন, তাহা আজ পর্যন্ত কোন মহাপুরুষ আমাদিগকে বলিয়া দিতে পারেন নাই। তাঁহারা কেবল বলেন, বেদাহমেতম্, আমি জানিয়াছি, আমি পাইয়াছি। কেমন করিয়া যে তাঁহারা ইঁহাকে জানেন, সে অভিজ্ঞতা এতই অন্তরতম যে, তাহা তাঁহাদের নিজেদেরই গোচর নহে।”

 রবীন্দ্রনাথকেও যে সাধনা করিতে হইয়াছিল, তাহা যথাস্থানেই আলোচ্য। আপাতত দৃষ্টান্ত বা প্রমাণ হিসাবে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতেছে, রাণী চন্দ এবং মৈত্রেয়ী দেবী উভয়ের গ্রন্থেই এই ঘটনাটির উল্লেখ আছে।

 একদিন রাত্রে রবীন্দ্রনাথকে হঠাৎ বিছায় কামড় দেয়। ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন যে, বৃশ্চিক দংশনে কিরূপ জ্বালা হইয়া থাকে। অসহ্য যন্ত্রনায় রবীন্দ্রনাথও অস্থির হইয়া উঠেন, কিন্তু গৃহের সকলেই নিদ্রিত: তাঁহার যন্ত্রণার জন্য আর সকলের ঘুম ভাঙ্গিবে, এই চিন্তাও রবীন্দ্রনাথের ভদ্রমনের পক্ষে অসহ্য, ফলে ঔষধের কোন ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হয় নাই।

 এই অবস্থায় হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে প্রশ্ন জাগে— আচ্ছা বিছার কামড়ের এই ব্যথা কে ভোগ করিতেছে? মনেই উত্তর আসিল-দেহধারী রবীন্দ্রনাথ নামক যে-ব্যক্তি, তাঁহারই এই ব্যথা, আসল আমির তো কোন ব্যথা থাকিতে পারে না। এই চিন্তা বা বোধের ফল কি হইল, তাহা রবীন্দ্রনাথের স্বমুখেই শোনা যাক, তিনি বলিয়াছেন,—

 “যে দেহধারী কষ্ট পাচ্ছে সে আমি নয়—হঠাৎ মনে হোল যেন কী রকম একটা যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল সে মুহূর্তে যত চেতনা।”

 সামান্য বিশ্লেষণেই বুঝা যায় যে, দেহ হইতে মনকে তথা চৈতন্যকে রবীন্দ্রনাথ সরাইয়া লইয়াছিলেন, তাই অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণার কোন বোধই আর তাঁহার ছিল না। ইহা কেমন করিয়া সম্ভব হয়? উত্তরে তিনি বলিয়াছেন —

 “যেন কী রকম একটা যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।”

 কাহার সঙ্গে কাহার যোগসূত্র ছিন্ন হইল? দেহের সঙ্গে দেহী বা দেহধারীর। এই যোগসূত্রটি কি, যাহা ছিন্ন হইয়াছে? দেহ বোধ বা দেহ চৈতন্যই সেই যোগসূত্র। এই বোধ কাহার থাকে না? যে মৃত, যে মূর্ছাতুর সংজ্ঞাহারা, যে গভীর সুষুপ্ত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ জাগ্রত ছিলেন, সজ্ঞানেই তিনি দেহ হইতে আলাদা হইয়াছিলেন।

 শাস্ত্রেও দেখা যায় যে, মহর্ষি অষ্টাবক্র রাজর্ষি জনককে বলিয়াছেন—

“যদি দেহ পৃথক কৃত্বা চিতি বিশ্রাম্য তিষ্ঠসি।
অধুনৈব সুখী শান্তো বন্ধমুক্ত ভবিষ্যসি॥”

 দেহ হইতে পৃথক হইয়া চিত্তে বিশ্রাম লাভ যে করিতে পারে, তাহারই পরম সুখ, শান্তি ও বন্ধনমুক্তি ঘটিয়া থাকে॥

 ইচ্ছা করিলেই কেহ কখনো নিজেকে নিজের দেহ হইতে পৃথক করিতে পারে না, এ শক্তি যোগসিদ্ধ পুরুষদের পক্ষেই সম্ভবপর। কিন্তু উল্লিখিত ঘটনায় দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিজ দেহ হইতে পৃথক করিবার কৌশল জানিতেন। এই কৌশলেরই নাম যোগ এবং এ যোগ কদাচ সাধনা ব্যতীত কাহারও আয়ত্তগত হয় না।

 আর একটি ঘটনারও উল্লেখ করা যাইতেছে; মৈত্রেয়ী দেবী ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’—গ্রন্থে ঘটনাটির বিশদ বিবরণ দিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন প্রায় আশি। ব্যাপারটি সংক্ষেপে এই—

 সন্ধ্যার পরে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বাড়ীর সকলে সমবেত হইয়াছেন, স্বয়ং কবি একটির পর একটি নিজের কবিতা পাঠ করিয়া শুনাইতেছেন ব্যাখ্যা করিতেছেন, নিজের বহু গান একটির পর একটি গাহিয়া শুনাইতেছেন, ইহার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা-তামাসারও অজস্র পরিবেশন চলিয়াছে, আনন্দ ও তৃপ্তিরসে তিনি সকলের হৃদয়পাত্র সেদিন কানায় কানায় ভরিয়া তুলিয়াছিলেন।

 বহুক্ষণ হয় এই আনন্দ আসর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, এক সময়ে গৃহকর্ত্রী (লেখিকা) ফিরিয়া আসিয়া দেখিতে পান যে, রবীন্দ্রনাথ একা চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। কিন্তু এ কোন্ রবীন্দ্রনাথ! ইনিই কি কিছু পূর্বে কবিতায় গানে হাস্যে উচ্ছ্বল হইয়া উঠিয়াছিলেন? একেবারে অপরিচিত এক রবীন্দ্রনাথ, ইনি যেন এ জগতের কেহ নহেন।

 কথাটা গৃহকর্ত্রী অতি সন্তর্পণে এবং সভয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলেন,—“আপনি যখন চুপ করে বসেছিলেন, তখন আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলুম।...... মনে হয় না আপনি আমাদের কেউ।”

 উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন,

 “সত্যি কথাই বলব, আমি তোমাদের কেউ নই। ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম, চিরদিন মনে মনে আমি উদাসী। তাই একদিন লিখেছিলুম— আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী। এ কিন্তু একটা কবিত্বের কথা মাত্র নয়। লোকে মনে করে, এটা কবির একটা মুডমাত্র। কিন্তু তা ঠিক নয়। এ আমার জীবনের একটা গভীরতম সত্য যে, আমি সুদূরের পিয়াসী।”

 এখানে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে বলিয়াছেন, “ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম।”

 নির্মম মানে নিষ্ঠুর নয়, নির্মম মানে মমতাশূন্য, নিরাসক্ত ও বন্ধন শূন্য। ভিতরের সেই নির্মম নিরাসক্ত মনের নির্জন গুহায় তিনি সরিয়া গিয়াছিলেন বলিয়াই তাঁহাকে সেদিন এজগতের লোক বলিয়া মনে হয় নাই, অত্যন্ত অপরিচিত অতি-দূরের মানুষ মনে হইয়াছে।

 এখন আমাদের জিজ্ঞাস্য, মনের ঐ মুক্ত-ভিতরটিতে কি ইচ্ছা হইলেই যাওয়া যায়, না সকলেই যাইতে পারে? বহু সাধনায় ও অভ্যাসে মনের ঐ নিরাসক্ত ভূমি লব্ধ হইয়া থাকে। মনের ঐ ভূমিতে যাঁহার যাতায়াত আছে, অথবা মনের ঐ ভূমির যিনি বাসিন্দা, তিনিই বলিতে পারেন “আমি তোমাদের কেহ নই. আমি সুদূরের।”

 আত্মা যেমন দেহে থাকিয়াও দেহের অংশ নহে, সূর্যের আলো যেমন জগতের সর্বকিছুর উপর পড়িয়াও জগতের নহে, এই অবস্থানও তদ্রূপ। দেহে থাকিয়াও এই দেহাতীত বা বিদেহী স্থিতি সিদ্ধ সাধকেরই হইয়া থাকে। আর সাধনা ব্যতীত এ-সিদ্ধি আসে না। রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত চিত্র বা অবস্থা তাঁহার জীবনের আড়ালে সঙ্গোপনে গূঢ় এক সাধনারই সিদ্ধির পরিচায়ক বা চিহ্ন।