একেই কি বলে সভ্যতা?/প্রথম অঙ্ক/প্রথম গর্ভাঙ্ক
(প্রহসন)।
প্রথমাঙ্ক।
প্রথম গর্ভাঙ্ক
নবকুমার বাবুর গৃহ।
নবকুমার এবং কালীনাথ বাবু—আসীন।কালী। বল কি?
নব। আর ভাই বল্বো কি। কর্ত্তা এত দিনের পর বৃন্দাবন হতে ফিরে এসেছেন। এখন আমার আর বাড়ী থেকে বেরনো ভার।
কালী। কি সর্ব্বনাশ; তবে এখন এর উপায় কি?
নব। আর উপায় কি? সভাটা দেখচি এবলিশ্ কত্ত্যে হলো।
কালী। বাঃ, তুমি পাগল হলে না কি? এমন সভা কি কেউ কখন এবলিশ্ কর্যে থাকে? এত তুফানে নৌকা বাঁচিয়ে এনে, ঘাটে এসে কি হাল্ ছেড়ে দেওয়া উচিত? যখন আমাদের সবস্ক্রিপ্সন্ লিস্ট অতি পুয়র ছিল, তখন আমরা নিজে থেকে টাকা দিয়ে সভাটি সেভ্ করেছিলেম্, এখন—
নব। আরে ও সব্ কি আমি আর জানিনে, যে তুমি আমাকে আবার নতুন করে বল্তে এলে? তা আমি কি ভাই সাধ করে সভা উঠয়ে দিতে চাচ্চি? কিন্তু করি কি? কর্ত্ত এখন কেমন হয়েচেন যে দশ মিনিট্ যদি আমি বাড়ী ছাড়া হই তা হলে তখনি তত্ত্ব করেন। তা ভাই, আমার কি এখন সেথায় এটেণ্ড দেবার উপায় আছে। (দীর্ঘ নিশ্বাস)
কালী। কি উৎপাৎ! তোমার কথা শুনে, ভাই, গলাটা একবারে যেন শুখিয়ে উঠ্লো। ওহে নব, বলি কিছু আছে?
নব। হষ্! অত চেঁচিয়ে কথা কয়ো না, বোধ করি একটা ব্রাণ্ডি আছে।
কালি (সহর্ষে) জষ্ট দি থিং। তা আনো না দেখি।
নব। রসে দেখ্চি। (চতুর্দ্দিগ অবলোকন করিয়া) কর্ত্তা বোধ করি এখনো বাড়ীর ভিতর থেকে বেরোন্ নি। (উচ্চস্বরে) ওরে বোদে।
নেপথ্যে। আজ্ঞে যাই।
কালী। আজ রাত্রে কিন্তু, ভাই, একবার তোমাকে যেতেই হবে। (স্বগত) হাঃ, এ বুড়ো বেটা কি অকালের বাদল হয়ে আমাদের প্লেজর নষ্ট কত্ত্যে এলো? এই নব আমাদের সদ্দার, আর মনি ম্যাটারে এই বিশেষ সাহায্য করে; এ ছাড়্লে যে আমাদের সর্ব্বনাশ হবে, তার সন্দেহ নাই।
(বোদের প্রবেশ।)
নব। কর্ত্তা কোথায় রে?
বৈদ্য। আজ্ঞে দাদাবাবু, তিনি এখন বাড়ীর ভিতর থেকে বেরোন্ নি।
নব। তবে সেই বোতল্টা আর একটা গ্লাশ্ শীঘ্র করে আন্ তো।
কালী ভাল নব, তোমাদের কর্ত্তা কি খুব বৈষ্ণব হে?
নব। (দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) ও দুঃখের কথা ভাই আর কেন জিজ্ঞাস কর? বোধ করি কল্কাতায় আর এমন ভক্ত দুটী নাই।
(বোতল ইত্যাদি লইয়া বোদের পুনঃপ্রবেশ)।
কালী। এদিকে দে।
নব। শীঘ্র নেও ভাই, এখন আর সে রাবণও নাই, সে সোণার লঙ্কাও নাই।
কালী। না থাক্লে তো বোয়ে গেল কি! এ তে আছে? (বোতল প্রদর্শন)। হা, হা, হা! (মদ্যপান)।
নব। আরে করো কি, আবার?
কালী। রসো ভাই, আরো একটুখানি খেয়ে নি। দেখ, যে গুড্ জেনেরেল হয়, সে কি সুযোগ পেলে তার গ্যেরিসনে প্রোবিজন্ জমাতে কশুর করে? হা, হা, হা। (পুনর্ম্মদ্যপান)।
নব। (বোদের প্রতি) বোতল্ আর গ্লাশটা নিয়ে যা, আর শীগ্গীর গোটকতক্ পান নিয়ে আয়।
কালী! এখন চল ভাই, তোমাদের কর্ত্তার সঙ্গে একবার দেখা করা যাগ্গে। আজ কিন্তু তোমাকে যেতেই হবে, আজ্ তোমাকে কোন্ শালা ছেড়ে যাবে।
নব। তোমার পায়ে পড়ি, ভাই, একটু আস্তে আস্তে কথা কও।
(পান লইয়া বোদের পুনঃ প্রবেশ)।
কালী। দে, এ দিকে দে।
নেপথ্যে। ও বৈদ্যনাথ।
নব। এই যে কর্ত্তা বাইরে আস্চেন। নেও আর একটা পান নেও।
কালী। আমি ভাই পান তো খেতে চাইনে, আমি পান কত্ত্যে চাই। সে যাহউক তবে চল মা, কর্ত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি গিয়ে।
নব। (সহাস্য বদনে) তোমার, ভাই, আর অতো ক্লেশ স্বীকার কত্তে হবে না। কর্ত্তা তোমার গাড়ী দরোজায় দেখ্লেই আপনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন এখন।
কালী। বল কি? আই সে, তোমার চাকর বেটাকে, ভাই, আর একটু ব্রাণ্ডি দিতে বলো তো; আমার গলাটা আবার যেন শুখয়ে উঠ্ছে।
নর। কি সর্ব্বনাশ! এমনিই দেখছি তোমার একটু যেন নেশা হয়েছে; আবার খাবে?
কালী। আচ্ছা, তবে থাকুক্। ভাল, কর্ত্তা এখানে এলে কি বল্বো বল দেখি?
নব। আর বল্বে কি? একট প্রণাম করে আপনার পরিচয় দিও।
কালী। কি পরিচয় দেবো বলে দেখি, ভাই? তোমাদের কর্ত্তাকে কি বলবো যে আমি বিএরের—মুখটি—স্বকৃতভঙ্গ—সোণাগাছিতে আমার শত শ্বশুর—না না শ্বশুর নয়—শত শাশুড়ির আলয়, আর উইল্সনের আখড়ায় নিত্য মহাপ্রসাদ পাই—হা, হা, হা!
নব। আঃ, মিছে তামাসা ছেড়ে দেও, এখন সত্তি কি বল্বে বল দেখি? এক কর্ম্ম কর, কোন একটা মস্ত বৈষ্ণব ফ্যামিলির নাম ঠাওরাতে পার? তা হলে আর কথাটি কইতে হয় না।
কালী। তা পার্বো না কেন? তবে একটু মাটি দেও, উড়ে বেয়ারাদের মতন নাকে তিলক কেটে আগে সাধু হয়ে বসি।
নব। না হে না। (চিন্তা করিয়া) গরাণহাটার কোন্ ঘোষ না পরম বৈষ্ণর ছিল?—তার নাম তোমার মনে আছে?—ঐ যে যার ছেলে আমাদের সঙ্গে এক ক্লাশে পড়্তো?
কালী। আমি ভাই গরাণহাটার প্যারী আর তার ছুকরি বিন্দি ছাড় আর কাকেও চিনি না।
নব। কোন্ প্যারী হে?
কালী। আরে, গোদা প্যারী। সে কি? তুমি কি গোদা প্যারীকে চেন না? ভাই, একদিন আমি আর মদন যে তার বাড়ীতে যেয়ে কত মজা করেছিলেম তার আর কি বল্বো। সে যাক্, এখন কি বল্বো তাই ঠাওরাও।
নব। (চিন্তা করিয়া) হাঁ—হয়েছে। দেখ, কালী, তোমার কে একজন খুড়ো পরম বৈষ্ণব ছিলেন্ না? যিনি বৃন্দাবনে গিয়ে মরেন্।
কালী। হাঁ, একটা ওল্ড ফুল ছিল বটে, তার নাম কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ।
নব। তবে বেশ হয়েছে। তুমি তাঁরি পরিচয় দিও, বাপের নামটা চেপে যাও।
কালী। হা, হা, হা!
নব। দুর পাগল, হাসিস্ কেন?
কালী। হা, হা, হা! ভাল ত যেন হলো, এখন বৈঞ্চব বেটাদের দুই এক খানা পুঁথির নাম তো না শিখলে নয়।
নব। তবেই যে সার্লে। আমি তো সে বিষয়ে পরম পণ্ডিত। রসো দেখি। (চিন্তা করিয়া) শ্রীমদ্ভগব্দগীতা—গীত গোবিন্দ—
কালী! গীত কি?
নব! জয়দেবের গীত গোবিন্দ।
কালী। ধর—শ্রীমতী ভগবতীর গীত, আর-বিন্দাদূতীর গীত—
নব। হা, হা, হা! ভায়ার কি চমৎকার মেমরি।
কালী। কেন, কেন?
নব। হষ্! কর্ত্তা আস্ছেন। দেখ, ভাই, যেন একটা বেস করে প্রণাম করো।
(কর্ত্তা মহাশয়ের প্রবেশ।)
কালী। (প্রণাম)
কর্ত্তা। চিরজীবী হও বাপু, তোমার নাম কি?
কালী। আজ্ঞে, আমার নাম শ্রীকালীনাথ দাস ঘোষ। মহাশয়, আপনি—৺কষ্ণপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়কে বোধ করি জান্তেন। আমি তারি ভ্রাতুষ্পুত্র—
কর্ত্তা। কোন্ কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ?
কালী। আজ্ঞে, বাঁশবেড়ের—
কর্ত্তা। হাঁ, হাঁ, হাঁ। তুমি স্বর্গীয় কষ্ণপ্রসাদ ঘোষজ মহাশয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র, যিনি শ্রীবৃন্দাবনধাম প্রাপ্ত হন্।
কালী। আজ্ঞে হাঁ।
কর্ত্তা। বেঁচে থাক, বাপু। বসো। (সকলের উপবেশন)। তুমি এখন কি কর, বাপু?
কালী। অজ্ঞে, কলেজে নবকুমার বাবুর সঙ্গে এক ক্লাশে পড়া হয়েছিল, এক্ষণে কর্ম্ম কাজের চেষ্টা করা হচ্যে।
কর্ত্তা। বেশ বাপু! তোমার স্বর্গীয় খুড়া মহাশয় আমার পরম মিত্র চিলেন্। বাবা, আমি তোমার সম্পর্কে জ্যেঠা হই, তা জান?
কালী। আজ্ঞে।
কর্ত্তা। (স্বগত) আহা, ছেলেটি দেখতে শুনতে ও যেমন, আর তেমনি সুশীল। আর না হবেই বা কেন? কৃষ্ণপ্রসাদের ভ্রাতুষ্পুত্র কি না?
কালী। জ্যেঠা মহাশয়, আজ্ নবকুমার দাদাকে আমার সঙ্গে একবার যেতে আজ্ঞা করুন্—
কর্ত্তা। কেন বাপু, তোমরা কোথায় যাবে?
কালী। আজ্ঞে আমাদের জ্ঞানতরঙ্গিণী নামে একটা সভা আছে সেখানে আজ্ মিটীং হবে।
কর্ত্তা। কি সভা বল্লে বাপু?
কালী। আজ্ঞে জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা।
কর্ত্তা। সে সভায় কি হয়?
কালী। আজ্ঞে, আমাদের কলেজে থেকে কেবল ইংরাজী চর্চ্চা হয়েছিল, তা আমাদের জাতীয় ভাষা তো কিঞ্চিৎ জানা চাই তাই এই সভাটি সংস্কৃতবিদ্যা আলোচনাব জন্যে সংস্থাপন করেছি। আমরা প্রতি শনিবার এই সভায় একত্র হয়ে ধর্ম্মশাস্ত্রের আন্দোলন করি।
কর্ত্তা। তা বেশ কর। (স্বগত) আহা, কষ্ণপ্রসাদের ভ্রাতুষ্পুত্র কি না! আর এ নবকুমারেরও তো আমার ঔরসে জন্ম। (প্রকাশে) তোমাদের শিক্ষক কে বাপু?
কালী। আজ্ঞে, কেন রাম রণচম্পতি মহাশয়, যিনি সংস্কুত কালেজের প্রধান অধ্যাপক—
কর্ত্তা। ভাল, বাপু, তোমরা কোন্ সকল পুস্তক অধ্যয়ন কর, বল দেখি?
কালী। (স্বগত) আ মলো! এতক্ষণের পর দেখ্ছি সাল্লে। (প্রকাশে) আজ্ঞে—শ্রীমতী ভগবতীর গীত আর—বোপ্দেবের বিন্দাদূতী।
কর্ত্তা! কি বল্লে, বাপু?
নব। আজ্ঞে, উনি বল্ছেন শ্রীমদ্ভগবদীতা আর জয়দেবের গীতগোবিন্দ।
কর্ত্তা। জয়দেব? আহা, হা, কবিকুল-তিলক, ভক্তিরস-সাগর।
কালী। জ্যেঠা মহাশয়, যদি আজ্ঞে হয় তবে এক্ষণে আমরা বিদায় হই।
কর্ত্তা। কেন, বেলা দেখ্ছি এখনো পাঁচটা বাজে নি, ত। তোমরা বাপু, এত সকালে যাবে কেন?
কালী। আজ্ঞে, আমরা সকাল সকাল কর্ম্ম নির্ব্বাহ করবো বলে সকালে যেতে চাই, অধিক রাত্রি জাগ্লে পাছে বেমো টেমো হয়, এই ভয়ে সকালে মীট্ করি।
কর্ত্তা। তোমাদের সভাটা কোথায়, বাপু?
কালী। আজ্ঞে, সীক্দার পাড়ার গলিতে।
কর্ত্তা। আচ্ছা বাপু, তবে এসো গে। দেখো যেন অধিক রাত্রি করো না।
নব এবং কালী। আজ্ঞে না।
কর্ত্তা। (স্বগত) এই কলিকাতা সহর বিষম ঠাঁই, তাতে করে ছেলেটিকে কি এক্লা পাঠ্য়ে ভাল কল্যেম্? (চিন্তা করিয়া) একবার বাবাজীকে পাঠ্য়ে দি না কেন, দেখে আসুক ব্যাপারটাই কি? আমার মনে যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে যে নবকে যেতে দিয়ে ভাল করি নাই।