এখন যাঁদের দেখছি/অসিতকুমার হালদার
এগারো
অসিত কুমার হালদার
১৩১৬ কি ১৩১৭ সালের কথা। আমি তখন “ভারতী” প্রভৃতি পত্রিকার লেখক। একদিন “ভারতী” সম্পাদিকা ও বঙ্কিম যুগের সর্বপ্রধান মহিলা লেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবীর সানি পার্কের বাড়ির বৈঠকখানায় ব’সে আছি এবং তাঁর সঙ্গে কথোপকথন করছি, এমন সময়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন বোধ হয় আমরই সমবয়সী একটি তরুণ যুবক। গৌরবর্ণ, সৌম্যমুখ, একহারা দীর্ঘ দেহ। চেহারায় আছে মনীষা ও সংস্কৃতির ছাপ, সহজেই তা দৃষ্টি করে আকৃষ্ট।
স্বর্ণকুমারী দেবী বললেন, “এর নাম অসিতকুমার হালদার, আমাদেরই আত্মীয়।” পরিচয়ের পর হ’ল গল্পসল্প। সাহিত্যের প্রসঙ্গ, চিত্রকলার প্রসঙ্গ। তাঁর মৌখিক আলাপ এবং হাসিখুসিমাখা মুখ ভালো লাগল।
তারপরেও স্বর্ণকুমারী দেবীর ভবনে অসিতকুমারের সঙ্গে দেখা এবং আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং সেই সময়েই পাকা হয়ে গিয়েছে আমদের বন্ধুত্বের বনিয়াদ। বন্ধুত্ব লাভের সুসময় হচ্ছে প্রথম যৌবন। মানুষের বয়স যত বাড়ে, স্বার্থের সংঘাতে দশজনের সঙ্গে যতই মনান্তর ও মতান্তর হ’তে থাকে, নরচরিত্রের মহানুভবতা সম্বন্ধে ততই সে সন্দিহান হয়ে ওঠে। রাম তখন শ্যামকে সহজে বিশ্বাস করতে প্রস্তুত হয় না। তাই পরিণত বয়সের বন্ধুত্বের মধ্যে সরলতার মাত্রা থাকে অল্প। প্রথম পরিচয়ের পর দুই পক্ষই পরস্পরকে ভালো ক’রে না বাজিয়ে গ্রহণ করতে পারে না। প্রথম দর্শনেই প্রেম হবার সুযোগ থাকে মানুষের যৌবনকালেই।
সেটা ছিল বাংলা চিত্রকলার “রেনেসাঁস” বা নবজন্মের যুগ। তার আগেও বাঙালীরা কি ছবি আঁকতেন না? আঁকতেন বৈ কি, খুব আঁকতেন। কিন্তু যে বিলাতী পদ্ধতি তাঁদের ধাতে সইত না, তাইতেই শিক্ষিত হয়ে তাঁরা কেবল পাশ্চাত্য শিল্পীদের অনুসরণ করতেন পদে পদে। সেই প্রাণহীন অনুকরণের মধ্যে থাকত না কলালক্ষ্মীর কোন আশীর্বাদই। আগে শ্রেষ্ঠ চিত্রকর ব’লে শশীকুমার হেশের ছিল খুব নামডাক। তিনিই হচ্ছেন য়ুরোপে শিক্ষিত প্রথম বাঙালী চিত্রকর, বোধ করি ইতালীতেই গিয়ে ছবি আঁকা শিখে এসেছিলেন। প্রতিমূর্তি চিত্রণে তাঁর দক্ষতা ছিল। কিন্তু তাঁর নিজের ধারণা অনুসারে আঁকা সাধারণ ছবি আমি দেখেছি। আঁকতেন তিনি শিক্ষিত নিপুণ হাতেই, কিন্তু কল্পনাকে উল্লেখযোগ্য রূপ দিতে পারতেন না। তাই নিখুঁত অঙ্কনপদ্ধতিও বাঁচিয়ে রাখতে পারে নি তাঁর নামকে, আজ কয়জন লোক তাঁকে চেনে? ছবি যতই বাস্তব হোক, দেশের মাটীর সঙ্গে যোগ না রাখতে পারলে তাকে অস্বাভাবিক ব’লে মনে হবেই। বিলাতী চিত্রপদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষিত হয়েও অবনীন্দ্রনাথ ঐ সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যথাসময়েই। নিজ বাসভূমে পরবাসীর মত তিনি থাকতে পারলেন না, আবিষ্কার করলেন প্রাচ্য চিত্রকলাপদ্ধতি, উপহার দিলেন স্বদেশী সৌন্দর্যের সম্পদ। সেই সময়ে তিনি ও নন্দলাল বসু প্রমুখ তাঁর শিষ্যবর্গ নবজীবনের প্রেরণায় প্রবুদ্ধ হয়ে আপন আপন স্বাধীন পরিকল্পনা অনুসারে পরিবেশন করতে লাগলেন নব নব রসরূপ। অসিতকুমার হালদার হচ্ছেন অবনীন্দ্রনাথেরই অন্যতম শিষ্য।
কিন্তু উঠল বিষম সোরগোল। বিলাতী ছাপমারা বোতলে সস্তা দেশী মত খেতে অভ্যাস ক’রে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যাদের রুচি, তারা ছেড়ে কথা কইতে রাজি হ’ল না। প্রাচ্য পদ্ধতিতে আঁকা ছবিগুলির প্রতিলিপি প্রকাশিত হ’ত প্রধানতঃ “প্রবাসী” ও “ভারতী”তে। বিরুদ্ধ দলের মুখপাত্র ছিলেন “সাহিত্য” সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, হঠাৎ রাতারাতি শিল্পসমালোচক সেজে প্রাচ্য চিত্রকলার শিল্পীদের নিয়ে আবোল তাবোল বকতে শুরু করে দিলেন। বলা বাহুল্য আমি ছিলাম প্রাচ্য শিল্পের পক্ষেই এবং তার প্রসঙ্গ নিয়ে সে সময়ে প্রভূত কালিকলম ব্যবহার করতেও ছাড়িনি এবং প্রাচ্য চিত্রকলার একজন উদীয়মান শিল্পী ব’লেই অধিকতর আকৃষ্ট হয়েছিলুম অসিতকুমারের দিকে।
তারপর কেটে গেল কয়েকটা বৎসর। সুকিয়া (এখন কৈলাস বোস) স্ট্রীটে নব পর্যায়ের “ভারতী” পত্রিকার কার্যালয়ে গড়ে উঠল আমাদের নূতন আস্তানা। তখন আমাদের মন ও বয়স পরিণত হয়েছে বটে, কিন্তু সে সময়েও আমাদের সকলকেই সর্বদাই সমাচ্ছন্ন ক’রে রাখত কাব্য ও ললিতকলার কল্পলোক। মুখ্য আলোচনার বিষয়ই ছিল আর্ট ও সাহিত্য, এবং সে আলোচনায় সাগ্রহে যোগ দিতেন অসিতকুমারও। দিনে দিনে বেড়ে উঠতে লাগল আমাদের সৌহার্দ্য।
“ভারতী”র আস্তানা কেবল সাহিত্যিকদের আকর্ষণ করত না, সেখানে ওঠা-বসা করতেন অনেক বিখ্যাত গায়ক, অভিনেতা ও চিত্রকরও। শেষোক্তদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের কথা আগেই বলেছি, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে আসতেন অসিতকুমার, শ্রীদেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী ও শ্রীচারুচন্দ্র রায় প্রভৃতি। এমন বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্পী—সমাগম আমি আর কোন সাহিত্যবৈঠকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। এমন কি ব্যঙ্গরঙ্গরসে বিখ্যাত স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন গোস্বামী একদিন এসে আমাকে বললেন, “হেমেন্দ্র, তোমাদের আস্তানায় গিয়ে আমি কীর্তন শুনিয়ে আসতে চাই।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কি কীর্তন চিদ্দা? হাসির কীর্তন?”
তিনি বললেন, “না হে ভায়া, না। গম্ভীর কীর্তন, করুণকীর্তন। যে কীর্তন শুনে ভাবুক লোকে কাঁদে। ব্যবস্থা করতে পারো?”
চিত্তরঞ্জনকে আমরা সবাই নানা বৈঠকে কৌতুকাভিনয় করতে দেখেছি। শিশিরকুমারের “নাট্যমন্দিরে”ও তিনি অভিনয় করেছেন এবং চলচ্চিত্রেও দেখা দিয়েছেন হাস্যরসাত্মক নানা ভূমিকায়। কিন্তু কীর্তনিয়ার রূপে তাঁর পরিচয় জানে না জনসাধারণ, আমিও জানতুম না তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও।
“ভারতী” কার্যালয়ের তিনতলায় বড় ঘরে মেঝের উপরে শতরঞ্জি ও চাদর বিছিয়ে আসর প্রস্তুত করা হ’ল, আমন্ত্রণ করা হ’ল অনেক লোককে। নির্দিষ্ট দিনে সাত-আটজন সহকারী ও বাদ্যভাণ্ড নিয়ে চিত্তরঞ্জন এলেন এবং ঘণ্টা দুই ধ’রে সকলকে শুনিয়ে দিলেন রীতিমত কীর্তনগান। সে হচ্ছে উপভোগ্য সঙ্গীত।
“ভারতী”র সে আসর ছিল উচ্চশ্রেণীর বিদ্বজ্জনসভা, তাই তার দিকে ঝুঁকতেন নানা শ্রেণীর শিল্পী। সভ্যদের মধ্যে যে কয়জন আজও ইহঁলোকে বিদ্যমান আছেন, তার অভাব একান্তভাবে অনুভব করেন তাঁরা সকলেই। এই নষ্টনীড়ের কথা স্মরণ ক’রেই প্রায় দুই যুগ আগে অসিতকুমার (তিনি তখন লক্ষ্নৌয়ের সরকারি চিত্রবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ) আমাকে একখানি পত্রে লিখেছিলেন: “হেমেন, তোমার চিঠিখানি পেয়ে ভারি আনন্দ হ’ল। আমাদের দলের মধ্যে তোমার সহৃদয়তার গর্ব আমরা বরাবরই ক’রে থাকি। কলকাতায় যাই, কিন্তু মনে হয় যেন ডানা ভাঙা—বাসা থেকেও বাসা নেই। আমাদের সেই নীড়ের কথা কি কখনো ভোলা যায়?”
অসিতকুমার ছবি এঁকেছেন প্রধানতঃ প্রাচ্য চিত্রকলাপদ্ধতি অনুসারেই। তিনি যে অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য, তাঁর ছবি দেখলেই এ কথা বোঝা যায়, যদিও তাঁর নিজস্ব ‘ষ্টাইল’টকুও ধরতে বিলম্ব হয় না। বর্তমানের চেয়ে অতীতের ঐতিহ্যের দিকেই তাঁর দৃষ্টি অধিকতর জাগ্রত, কেবল তাঁর কেন, প্রাচ্য চিত্রকলার অধিকাংশ শিল্পী সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়।
প্রাচ্য চিত্রকলাপদ্ধতিকে আজকাল ইংরেজীতে “বেঙ্গল স্কুল” ব’লে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বেঙ্গল স্কুলের নাম শুনলেই কতিপয় অবাঙালী শিল্প-সমালোচকের মাথা গরম হ’তে শুরু করে। সম্প্রতি পত্রান্তরে শ্রীরমণ নামে এক দক্ষিণী ভদ্রলোক ফতোয়া দিয়েছেনঃ “তথাকথিত বেঙ্গল স্কুলের প্রতিষ্ঠা বাংলা দেশেই হয়েছিল বটে, কিন্তু তার শিল্পীদের সকলেই বাংলা দেশের লোক নন।” এই অর্থহীন উক্তির দ্বারা ভদ্রলোক কি বোঝাতে চেয়েছেন, বুঝতে পারি নি। বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীরা বাংলা দেশের ভিতরেই থাকুন আর বাইরেই থাকুন কিংবা তাঁরা জাতে অবাঙালী হোন, তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ তাঁদের একই গোষ্ঠীভুক্ত ব’লেই মনে করতে হবে। তাঁরা একই আদর্শে অনুপ্রাণিত, একই সাধনমন্ত্রে দীক্ষিত। এই ধারা চ’লে আসছে বেঙ্গল স্কুলের জন্মের পর থেকেই। অবনীন্দ্রনাথের কাছে মানুষ হয়েছিলেন যে সব শিল্পী, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অবাঙালীও। অবনীন্দ্রনাথের শিষ্যরাও (নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মুকুল দে ও দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী প্রভৃতি) বাংলা দেশের ভিতরে এবং বাহিরে নানা চিত্রবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আরো কত অবাঙালী ছাত্রকে তৈরি ক’রে তুলেছেন, তার সংখ্যা আমার জানা নেই। কিন্তু তাঁরা বাংলা দেশের বাইরেই থাকুন, কিংবা অবাঙালীই হউন, তাঁদেরও বলতে হবে বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীই। “বেঙ্গল স্কুল প্রাদেশিক নয়, জাতীয় স্কুল।” শ্রীরমণের এ উক্তির মধ্যে নেই কিছুমাত্র নূতনত্ব, কারণ এটাও সর্বসম্মত। বেঙ্গল স্কুল ভারতের সর্বত্র যে জাতীয় শিল্পের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে, তারই ফলভোগ করছি আমরা সকলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে।
শ্রীরমণ আরো বলেন, বাংলা চিত্রকলা (অর্থাৎ বেঙ্গল স্কুল) আজ নাকি বন্ধ্যা, তার অবস্থা বদ্ধ জলাশয়ের মত। আমার মতে এখনো একথা বলবার সময় হয়নি, কারণ এখনো নন্দলাল, অসিতকুমার ও দেবীপ্রসাদ প্রভৃতি শিল্পীরা তুলিকা ত্যাগ করেন নি, যদিও এ সত্য অস্বীকার্য নয় যে তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে কয়েকজন খেয়ালের মাথায় বিপথে গিয়ে আবার নব নব উদ্ভট পাশ্চাত্য “ইজ্মে”র মোহে আচ্ছন্ন হ’তে চাইছেন। কিন্তু তাঁদের নাম বেঙ্গল স্কুলের অন্তর্গত করা যায় না এবং তাঁদের কেউ যদি এখানে শিক্ষালাভ ক’রেও থাকেন, তবে আজ তাঁকে বলতে হবে, বেঙ্গল স্কুলের নাম- কাটা ছেলে।
আর এক কথা। সকল আর্টের ক্ষেত্রেই যুগে যুগে বদলে যায় পদ্ধতির পর পদ্ধতি। চিত্রকলাতেও প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত কত পদ্ধতির জন্ম ও প্রাধান্য হয়েছে তা বর্ণনা করতে গেলে আর একটি স্বতন্ত্র ও বৃহৎ প্রবন্ধ রচনা করতে হয়। কিন্তু কোন পদ্ধতিই ব্যর্থ হয়নি। ইমপ্রেসানিজম্ বা কিউবিজম্ প্রভৃতি আসরে দেখা দিয়েছে ব’লে কি রাফায়েল, মিকেলাঞ্জেলো ও দ্য ভিঞ্চি প্রভৃতির প্রতিভা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে? “বাংলা চিত্রকলা আজ বন্ধ্যা”, একথা বলা বিমূঢ়তা। আজ তা সুফলাই হোক আর অফলাই হোক, তার গৌরব অক্ষয় হয়েই থাকবে। মতিভ্রান্ত ভারতীয় চিত্রকলার দৃষ্টিকে সে ঘরমুখো করতে পেরেছে, এই তার প্রধান গৌরব। প্রথম জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই সে একদল শক্তিশালী, সৃষ্টিক্ষম শিল্পী গঠন করতে পেরেছে, এই তার আর এক গৌরব। তারপর ভারতের দিকে দিকে প্রত্যন্তপ্রদেশ পর্যন্ত আজ সে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, এই তার আরো একটি গৌরব। এই সব কারণে বাংলা চিত্রকলাপদ্ধতি চিরদিনই অতুলনীয় হয়ে থাকবে।
বাংলা চিত্রকলার নবজাগরণের যুগে যে কয়েকজন শিল্পী অগ্রনেতারূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, অসিতকুমার হচ্ছেন তাঁদেরই অন্যতম। কিন্তু তাঁর হাতে কেবল তুলিই চলে না, কলমও চলে অবাধগতিতে। তাঁর গদ্যও আসে, পদ্যও আসে। অল্পদিন হ’ল তিনি কালিদাসের “মেঘদূত” ও “ঋতুসংহার”-এর সচিত্র কাব্যানুবাদ প্রকাশ করেছেন—একাধারে দেখেছি তাঁর কবি ও চিত্রকর রূপ। সুমিষ্ট কবিতা, বিচিত্র চিত্র। এত ভালো লেগেছিল যে, “দৈনিক বসুমতী”তে সুদীর্ঘ সমালোচনার দ্বারা তাঁকে করেছিলুম অভিনন্দিত। কিন্তু চিত্রবিদ্যালয়ের গুরুতর কর্তব্যভার নিয়ে তাঁকে নিযুক্ত হয়ে থাকতে হয়, ইচ্ছামত সাহিত্যচর্চার অবকাশ তিনি পান না। তাই দুঃখ ক’রে আমাকে লিখেছিলেনঃ “সময় আমার বড়ই কম, তাই সাহিত্যচর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তবু চিরকালের অভ্যাস কি ছাড়া যায়? তাই কখনো-সখনো বেরিয়ে পড়ে এক-আধটা লেখা।”
তাঁর সাকিন লক্ষ্নৌ, আমি আসীন কলকাতায়। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ কেটে গেছে, তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কালে-ভদ্রে হয়েছে পত্রালাপ। একখানি পত্রে তিনি আশা দিয়েছিলেন: “এবার কলকাতায় গেলে তোমার সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ ছাড়ব না।”
শুনলুম, একদিন তিনি দেখা করতে এসেও ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তখন বাড়ির বাইরে। দেখা হয়নি।
তার কয়েক বৎসর পরে প্রখ্যাত প্রমোদ-পরিবেশক স্বর্গীয় হরেন ঘোষের আস্তানায় অভাবিতভাবে হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর দিকে তাকিয়েই আমার দৃষ্টি হয়ে উঠল সচকিত। স্মৃতির পটে আঁকা আছে যুবক অসিতের ছবি, আর এ অসিত যে বৃদ্ধ—এমন চেহারা দেখবার কল্পনা মনে জাগেনি। ঋজু দেহ নত, কেশে জরার শুভ্রতা, বলিরেখাযুক্ত দেহের ত্বক। আমাকেও দেখে তাঁর মনে নিশ্চয়ই অনুরূপ ভাবের উদয় হয়েছিল। “এই নরদেহ।”