১৩৫৮ সালে দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় আমার এই চরিত্রগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হ’তে থাকে। চার বৎসর আগেকার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে পৃথিবীর নাট্যশালা থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, মোহিতলাল মজুমদার, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁদের জীবিতকালে ঐ গুণীদের যে ভাবে দেখেছি, সেইটুকুই প্রকাশ করতে চেয়েছি এই রচনাবলীর ভিতর দিয়ে। তাঁদের পরলোকগমনের পর এর মধ্যে আর কোন রদবদল করা হ’ল না। ইতি—
গ্রন্থকার
১৩৬২ সাল
ভূমিকা
গ্রন্থাকারে “যাঁদের দেখেছি” শীর্ষক আমার যে স্মৃতিমূলক নিবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছে, পাঠকসমাজে তা সাদরে গৃহীত হওয়াতে আনন্দলাভ করেছি। লিখিয়েদের লিখে সুখ পড়ুয়ারা খুসি হ’লেই। অন্ততঃ আমার এই ধারণা। অপরের অন্য ধারণা থাকতে পারে। কারণ বাংলাদেশে আজকাল এমন একাধিক লেখক দেখা দিয়েছেন, যাঁদের রচনা পাঠ করলে সন্দেহ হয়, স্টিফেন ম্যালার্মি ও পল ভ্যালারি প্রমুখ ফরাসী লেখকদের মত তাঁরাও নিজেদের মনগড়া আভিজাত্য রক্ষার জন্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে রাজি নন্। কিন্তু আমি অভিজাত সাহিত্যিক হ’তে পারব না কস্মিনকালেও। লোকপ্রিয়তার উপরে যে আমার লোভ আছে, বড় গলায় তা বলতে পারি অসঙ্কোচে। মনের ভাব ফোটাতে চাই সরল প্রাণের সহজ ভাষায়, লোকের হয়তো তাই ভালো লাগে। অবলম্বন করতে চাই সহজিয়া পদ্ধতি।
“যাঁদের দেখেছি”র মধ্যে ছিল আমার জীবনস্মৃতির সঙ্গে জড়িত এমন সব স্বর্গীয় সাহিত্যিক ও শিল্পীদের কাহিনী, যাঁরা সুদীর্ঘ চার যুগ ধ’রে বাংলাদেশে বিতরণ ক’রে গিয়েছেন আপন আপন প্রতিভা ও মনীষার দান। তাকে অর্ধ শতাব্দীর কলমের ছবির অ্যালবাম বলা যায়। কিন্তু সে অ্যালবামে তাঁদের ছবি নেই, আমাদের সৌভাগ্যক্রমে আজও যাঁরা মরজগতে বিদ্যমান। তাঁদেরও মধ্যে আছেন অতুলনীয় প্রতিভার বা প্রভূত শক্তির অধিকারী। তাঁদের নাম সবাই জানেন, গুণেরও পরিচয় সবাই পেয়েছেন, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কের অভাবে আসল দুষ্পাঠ্য দূর থেকে কেহই দেখতে পান না। অথচ তা দেখবার আগ্রহ আছে সকলেরই।
কিছুদিন আগে একখানি মাসিক কাগজে আমি লিখেছিলুম—একজন বিখ্যাত বিলাতী লেখক বলেছেন:
“Yes, each successive generation regrets the past: It is a strange human penchant to suppose that the past is better. Perhaps it was.”
এক এক বয়সে প্রত্যেক মানুষেরই মনের ধর্ম হয় ভিন্ন ভিন্ন রকম। নবীনের স্বধর্ম হচ্ছে ভবিষ্যতের উপরে নির্ভর করা, কারণ সংক্ষিপ্ত তার অতীতের ইতিহাস। কিন্তু প্রাচীনরা নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করতে চায় অতীতকেই, কারণ ম্লান তাদের ভবিষ্যতের আশার আলো।
অতি-প্রাচীন না হ’লেও আমি যে প্রাচীন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। আমাকেও অভিভূত করেছে প্রাচীনতার ধর্ম। হাতে কাজকর্ম না থাকলে ভবিষ্যৎ-চিন্তা করি না, মন ফিরে যায় অতীতের দিকে। স্মৃতির তপোবনে ব’সে ব’সে শুনি জীবনের ঝরাপাতার চির-সবুজ গান। পরে পরে কত মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে এক বৃহতী জনতা।
সেই জনতায় যাঁদের দেখা পাই তাঁদের সঙ্গে অতি-আধুনিক সাহিত্যিক ও শিল্পীদের অনেক কিছুই মেলে না। তাঁরা যেমন ক’রে ভাবের আদান-প্রদান করতেন, আলাপ-পরিচয় করতেন, সামাজিকতার মর্যাদা রক্ষা করতেন, আজকাল তা আর হয় না। উচ্চশ্রেণীর সাহিত্য-বৈঠক, যেখানে সর্বশ্রেণীর সাহিত্যিক ও শিল্পী আসন গ্রহণ ক’রে অসঙ্কোচে মতামত ব্যক্ত করবেন, তাও আজ পরিণত হয়েছে অতীত স্মৃতিতে। এখনো এখানে ওখানে কোন কোন ছোট ছোট ঘরোয়া বৈঠকের কথা শুনি—দু’-একটা বৈঠকে গিয়েছিও—কিন্তু তাদের ক্ষেত্র এমন সীমাবদ্ধ যে, আগেকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যই নয়। রবীন্দ্রনাথের “বিচিত্রা সভা”র কথা না তোলাই ভালো, কারণ তেমন বৈঠক বাংলাদেশে আর কেউ কখনো দেখেনি এবং ভবিষ্যতেও আর কেউ দেখবে কিনা সন্দেহ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ প্রভৃতির ভবনে গিয়েও যে অপূর্ব বৈঠকী আনন্দ উপভোগ ক’রে আসতুম, তেমন সুযোগ আজ কোথায়?
গত যুগে যমুনা, মর্মবাণী, মানসী, সংকল্প ও ভারতী প্রভৃতি পত্রিকাগুলির কার্যালয়ে পরম উপভোগ্য সাহিত্য-বৈঠকের আয়োজন হ’ত। “যমুনা” কাগজখানি ছিল ছোট, কিন্তু তার বৈঠক ছিল মস্ত বড়। কত দলের সাহিত্যিক সেখানে আসতেন, কত রকম মতবাদ প্রচার করতেন!
এই সব বৈঠকের দ্বারা কেবল সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন স্থাপিত হ’ত না, সেগুলির সাহায্যে নূতন নূতন সাহিত্যিকও তৈরি হয়ে উঠত। সেখানে প্রবীণরা করতেন নবীনদের পথনির্দেশ —এখন দেখা যায় উল্টো দিকটাই। আজকাল ভূয়োদর্শনের কোন মূল্য নেই, প্রবীণদের পথনির্দেশ করতে উদ্যত হয় নিতান্ত বালখিল্যরাও। কিম্বা তারা চায় প্রবীণদের একেবারে নস্যাৎ ক’রে দিতে। ক্ষুদে ক্ষুদে কুবিখ্যাত সব ওঁচা পত্রিকা, সম্পাদক ও লেখকদের হয়তো গোঁফ-দাড়ি কামাবার বয়স হয়নি, কিন্তু তারাও বাপের বয়সী স্বনামধন্য ব্যক্তিদের লক্ষ্য ক’রে যে সব ন্যক্কারজনক ভাষা ব্যবহার করতে সুরু করেছে, তাতে মনে হয়, গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যের যুগ আবার ফিরে আসছে। যাদের কাছে মানীর মান বা বয়সের খাতির থাকে না, তারা কোন বৈঠকেই বসবার অধিকারী নয়। আমাদের যৌবনকালে নবীন সাহিত্যিকরা পরম শ্রদ্ধা করতেন প্রাচীন সাহিত্যিকদের। এখানে শ্রদ্ধার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, প্রাচীনরা জল উঁচু বললে নবীনদেরও তা বলতে হবে। ধরুন জলধর সেনের কথা। তিনি ছিলেন আমাদের অনেকেরই পিতার বয়সী। তাঁর মতামত ও রচনার সঙ্গে আমাদের মনের সুর মিলত না, কিন্তু তবু কোন দিনই তাঁকে আক্রমণ করবার সুযোগ খুঁজিনি, নতমস্তকে বার বার তাঁর কাছে গিয়েছি, তাঁর সঙ্গে গল্প ক’রে এসেছি।
এখনকার অনেক কচি সাহিত্যিকদের মতামত শুনলে মনে হয়, যেন তাঁদের বিশ্বাস, বাংলা সাহিত্যের জন্ম হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে।পূর্ববর্তীরা কিছুই নন্, বড় জোর তাঁরা হাইফেনের সামিল। এঁদের লক্ষ্য ক’রেই সিস্লে হাড্ল্স্টোন লিখেছিলেনঃ
“The younger generation has been taught to despise the efforts of those who have gone before. In its own trivial way it sometimes discovers some small principle that the older men well knew, but which they put in its proper place in their system.”
এই শ্রেণীর নতুন সাহিত্যিকদের নিয়ে কোন বৈঠক গঠন সম্ভবপর নয়। তাই হয়তো একালে সাহিত্য-বৈঠকের অভাব হয়েছে। এখনকার মাসিক পত্রিকাগুলির কার্যালয়ে গেলে যে বিভিন্ন সাহিত্যিকের দর্শনলাভ হয় না, এমন কথা বলি না। অনেককেই তো দেখতে পাই, কিন্তু তাঁরা কাজের কথা বলেন, বড় জোর দুটো গালগল্প করেন, তারপর উঠে চ’লে যান। কোন বিষয় নিয়ে উচ্চতর আলোচনা করবার ইচ্ছা বা সুযোগ সেখানে নেই।
কলকাতার সর্বশেষের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-বৈঠক বসত “কল্লোল” কার্যালয়ে, যেখানে গিয়ে মন ও হাত পাকিয়েছেন শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্র, শ্রীঅচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও শ্রীবুদ্ধদেব বসু প্রভৃতি। “ভারতী” ও “কল্লোল” প্রভৃতি পত্রিকা এক এক দল শক্তিশালী ও নিজস্ব নূতন লেখক গঠন করেছিল। কিন্তু তারপর আর কোন পত্রিকার এমন সৌভাগ্য হয়েছে ব’লে মনে হয় না।
আমার বিশ্বাস, এরও অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে উপযোগী সাহিত্য-বৈঠকের অভাব। এক এক কাগজের সম্পাদক বা প্রধান লেখক যদি বেছে বেছে কয়েকজন আশাপ্রদ নূতন সাহিত্যযশাকাঙ্ক্ষী নির্বাচন ক’রে একটি গোষ্ঠী গঠন করেন এবং নিয়মিতভাবে তাঁদের বৈঠকে আহ্বান ক’রে খানিকটা ক’রে সময় সাহিত্য ও আর্ট নিয়ে আলোচনায় নিযুক্ত থাকতে পারেন, তাহ’লে নিশ্চয়ই সত্যিকার সাহিত্যিক তৈরি ক’রে তোলা যায়। অবশ্য এ-রকম প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করে প্রধান বৈঠকধারীর ব্যক্তিত্ব, ধৈর্য ও অভিজ্ঞতার উপরেই।
এই লেখক তৈরির চেষ্টা ও গুরুগিরির প্রথা বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বর্গ থেকেই দেখা যায়। ইংরেজ আমলে নতুন বাংলার প্রধান ও প্রথম কবিগুরু ছিলেন “সংবাদ প্রভাকর” সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত। তাঁর পত্রিকার কার্যালয় রীতিমত সাহিত্যের পাঠশালায় পরিণত হয়েছিল। সে যুগের নূতন লেখকরা তাঁর দিকে আকৃষ্ট না হয়ে পারতেন না,—এমনি ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব। নূতন লেখকদের উপদেশ দেবার জন্যে তিনি তাঁদের বাড়ীতেও গিয়ে হাজির হ’তেন। বঙ্কিম-সহোদর স্বর্গীয় পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শুনেছি, ঈশ্বর গুপ্ত প্রায়ই কাঁটালপাড়ায় গিয়ে তরুণ বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতেন। বঙ্কিমচন্দ্র নিজের মুখেই বলেছেনঃ “আর ঈশ্বর গুপ্তের নিজের কীর্তি ছাড়া প্রভাকরের শিক্ষানবীশদের একটা কীর্তি আছে। দেশের অনেকগুলি লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক প্রভাকরের শিক্ষানবীশ ছিলেন। বাবু রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় একজন। বাবু দীনবন্ধু মিত্র আর একজন। শুনিয়াছি, বাবু মনোমোহন বসু আর একজন। ইহার জন্যও বাঙ্গালার সাহিত্য প্রভাকরের নিকট ঋণী। আমি নিজে প্রভাকরের নিকট বিশেষ ঋণী। আমার প্রথম রচনাগুলি প্রভাকরে প্রকাশিত হয়। সে সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আমাকে বিশেষ উৎসাহ দান করেন। * * * যাহার কিছু রচনাশক্তি আছে, এমন সকল যুবককে তিনি বিশেষ উৎসাহ দিতেন। * * * কবিতা রচনার জন্য দীনবন্ধুকে, দ্বারকানাথ অধিকারীকে এবং আমাকে একবার প্রাইজ দেওয়াইয়াছিলেন। দ্বারকানাথ অধিকারী কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র—তিনিই প্রথম প্রাইজ পান।”
ঈশ্বর গুপ্তের গুরুর্গিরি যে ব্যর্থ হয়নি, সাহিত্যাচার্য বঙ্কিমচন্দ্র, নাট্যকার দীনবন্ধু, কবি রঙ্গলাল ও নাট্যকার মনোমোহনের বিভিন্ন বিভাগে বিখ্যাত কীর্তিগুলিই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। দ্বারকানাথ অধিকারী সাহিত্যজগতে বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেন নি, সম্ভবতঃ অকালেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।
হ্যাঁ, বৈঠক চাই, গুরু বা উপদেষ্টা চাই। বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু প্রমুখ প্রতিভাবানদেরও গুরুর দরকার হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও কবিবর বিহারীলালকে গুরুরূপে গ্রহণ করেছিলেন। তার উপরে নিজের পরিবারের মধ্যেও তিনি উপদেষ্টারূপে পেয়েছিলেন সাহিত্যিক অগ্রজদের এবং হাত মক্স করবার জন্যে পেয়েছিলেন নিজেদেরই “বালক” ও “ভারতী” পত্রিকা। স্বাধীন বাংলাদেশে এখন যে উচ্চশ্রেণীর লেখকের একান্ত অভাব হয়েছে, তার প্রধান কারণ, যে সব কচি ও কাঁচা সাদা কাগজকে লেখনীর দ্বারা কালিমালিপ্ত করছেন, তাঁরা গুরু ব’লে কারুকে মানতে নারাজ।
অতঃপর আমি একে একে যাঁদের আলেখ্য উপহার দেব, তাঁদের অধিকাংশই জীবন আরম্ভ করেছেন গত শতাব্দীর উত্তরার্ধে। তারপর “কল্লোলে”র যুগ পর্যন্ত এসে আমার ছবির খাতা মুড়ে তুলে রাখব। কেবল সাহিত্যিক নন, অন্যান্য শ্রেণীর গুণীদেরও মূর্তি আপনারা এই অ্যালবামের মধ্যে দেখতে পাবেন।
এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।