এখন যাঁদের দেখছি/ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছাব্বিশ

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

 হেদুয়া পুষ্করিণীর দক্ষিণ দিকে একটি বিদ্যালয় ছিল, নাম এডওয়ার্ড ইনষ্টিটিউসন। ছাত্ররা সেখানে নানা ভাষা সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করতেন। এ শ্রেণীর বিদ্যালয়ের জন্যে ও-রকম বিলাতী নাম বেছে নেওয়া হয়েছিল কেন জানি না। বোধহয় তখনকার রেওয়াজই ছিল তাই। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত স্বদেশভক্ত বাঙালীরাও কোন কিছুর নাম রাখার সময়ে মাতৃভাষার কথা ভুলে যেতেন। বেসরকারি বিদ্যালয়, সভা-সমিতি, রঙ্গালয়, মণিহারী দোকান,—এমন কি ব্যবসায় সংক্রান্ত ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলিও বিলাতী নামধারণ ক’রে গর্ব অনুভব করত। কেবল বাংলা সাহিত্য নিয়ে যেখানকার কারবার, সেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদও ইংরেজী নামের আশ্রয়েই প্রথমে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অধিকন্তু বাঙালী হিন্দুর ছেলেরও নাম রাখা হয়েছে—রিপনচন্দ্র। ঐ নাম ছিল আমার এক বাল্যবন্ধুর। এ রকম রেওয়াজ এখনো একেবারে লুপ্ত হয়ে যায় নি। এই হাস্যকর রেওয়াজ নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা যায়, কিন্তু আপাততঃ ধামাচাপা থাক্, সে-সব কথা ।

 পূর্বোক্ত এডওয়ার্ড ইনষ্টিটিউসনের অধ্যক্ষ ছিলেন বছ ভাষাবিদ্ পণ্ডিত স্বর্গীয় অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। বহ দিনের মেলামেশার ফলে তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউসনের খোলা ছাদে বা ঘরের ভিতরে বসত অমূল্যবাবর বৈঠক। সে বৈঠক ছিল পরম উপভোগ্য। সেখানে এসে পরস্পরের সঙ্গে সদালাপ করতেন নবীন ও প্রবীণ বহু সাহিত্যিক এবং সাহিত্যরসিক। যেমন প্রভুপাদ অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী, অক্ষয়কুমার বড়াল, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র মিত্র, ব্যোমকেশ মুস্তোফী, ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরো অনেকে। আমার তখন উঠতি বয়স, মাসিক সাহিত্য ক্ষেত্রে লেখনী চালনা ক’রে নাম হয়েছে অল্পস্বল্প এবং মশগুল হয়ে আছি সাহিত্যের নেশায়। প্রতিদিন সূর্যাস্তের পরেই সাহিত্যসংলাপে যোগ দেবার জন্যে সাগ্রহে পদচালনা করতুম অমূল্যবাবর বৈঠকের দিকে।

 সে সময়ে আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রের আবহ ছিল অন্যরকম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখনও “যমুনা”র মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেননি, সুতরাং রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিক ব’লে আর কারুর নাম করবার উপায় ছিল না বটে, কিন্তু ছোট গল্পের বাজার সরগরম ক’রে রেখেছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। ভালো কবিতার অপ্রতুলতা ছিল না কিছুমাত্র। পূর্ণোদ্যমে একসঙ্গে চলছে রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গোবিন্দচন্দ্র দাস, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকরুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির লেখনী। এখনকার চেয়ে তখনকার বাংলা সাহিত্যই কাব্যসম্পদে ছিল অধিকতর সমৃদ্ধ। জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধবৈচিত্র্যের দিক দিয়েও আধুনিক বাংলা সাহিত্য অপেক্ষাকৃত দরিদ্র হয়ে পড়েছে ব’লে মনে হয়। মাসিক পত্রিকাগলির মধ্যে প্রধান ছিল “ভারতী”, “সাহিত্য” ও “প্রবাসী”।

 তবে একটা কথা এখানে বলতে পারি। গড়পড়তা হিসাবে মনে হয়, এখনকার সাহিত্যিক তথা সাংবাদিকদের ভাষা আগেকার চেয়ে উন্নত ও তৈরি হয়ে উঠেছে।

 সে সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল আমাদের সাহিত্যজগতে একাধিক অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। তিনি সচীৎকারে ঘোষণা করলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অর্থহীন ও দুর্নীতিদুষ্ট। অভিযোগ যেমন আকস্মিক তেমনি অভাবিত। সাহিত্যসমাজে জাগ্রত হ’ল উত্তপ্ত উত্তেজনা। দেখা দিলে দুটো দল। রবীন্দ্রনাথ নিজে কোন প্রতিবাদ করলেন না বটে, কিন্তু তাঁর ভক্তরা রেগে আগুন হয়ে উঠলেন। দ্বিজেন্দ্রভক্তরাও আর একটি দল পাকিয়ে বসলেন। এই দুই দলের কথা কাটাকাটি ও মাতামাতির ঢেউ তখনকার সাহিত্য-বৈঠকগুলিকেও যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। প্রতিদিনই আমাদের কাণে উঠত নূতন নূতন গুজব ও অম্লমধুর সন্দেশ। অবশেষে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রহসন “আনন্দ-বিদায়ে”র প্রথমাভিনয় রাত্রে নাট্যকার জনসাধারণের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে ধিক্কৃত হন এবং তারপর থেকে ঐ অশোভন আন্দোলনে ক্রমেই মন্দা প’ড়ে আসে।

 স্বর্গীয় নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের একখানি ছোট পত্রিকা ছিল, নাম “জাহ্নবী”। প্রথম বৎসরে আমি তার গ্রাহক ছিলুম। সেই সূত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমি নলিনীবাবার সঙ্গে পরিচিত হই। তারপর নলিনীবাবুর অনুরোধে “জাহ্নবী” পরিচালনায় আমি তাঁকে কিছু কিছু সাহায্য করতে থাকি এবং “জাহ্নবী”র জন্যে রচনা সংগ্রহ করতে গিয়েই সর্বপ্রথম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দেবেন্দ্রনাথ সেন, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ও রসময় লাহা প্রভৃতি তখনকার সুপরিচিত লেখকগণের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপনের সুযোগ পাই। তাঁরা কেউ লেখা দিয়েছিলেন, কেউ দেননি, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে চেনাশুনো হয়ে গেল, এইটুকুই ছিল আমার লাভ। তবে “জাহ্নবী”র জন্যে দ্বারে দ্বারে ধরণা দিতে বেশী দিন আমার ভালো লাগেনি, তার সঙ্গে আমার সংস্রব ছিল মাত্র এক বৎসরকাল।

 তার কতকাল পরে মনে নেই, হঠাৎ একদিন অমূল্যবাবুর বৈঠকে নলিনীবাবুর সঙ্গে এসে হাজির হলেন তরুণ ব্রজেন্দ্রনাথ। তারপর একদিন নয়, আরো কোন কোন দিন ওঁদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলুম এবং আমার বুঝতে বিলম্ব হ’ল না যে, ব্রজেন্দ্রনাথের দ্বারা নলিনীবাবু আমার অভাব পূরণ করে নিয়েছেন। তফাত খালি এই, নলিনীবাবুর সঙ্গে আমার যখন আলাপ হয়, তখন আমি অন্যান্য পত্রিকারও লেখক, কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ হাতমক্স সুরু করেন “জাহ্নবী”তেই। এবং ঐ পত্রিকাতেই তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। অতএব বলতে হবে যে, সাহিত্যক্ষেত্রে ব্রজেন্দ্রনাথের প্রথম পথপ্রদর্শক হচ্ছেন নলিনীবাবুই।

 সে সময়ে মাসিকপত্রের সম্পাদকদের কর্তব্য ছিল অনেকটা মধ্যস্থ বা দালালের মত। ছোট-ছোটদের তো কথাই নেই, অনেক বড় বড় পত্রিকাওয়ালাও লেখার জন্য পারিশ্রমিক দিতেন না বা দিতে পারতেন না। এবং তখনকার মাসিক সাহিত্যের অধিকাংশ প্রখ্যাত লেখকেরও রচনা ছিল না অর্থকরী। সম্পাদকরা রচনা নির্বাচন করতেন না, বেছে বেছে করতেন নামজাদা লেখক নির্বাচন। তারপর দরকার হ’ত কাকুতি, উপরোধ, চাটুবাক্য এবং বারংবার তাগাদা। লেখকদের উপরোধে ঢেঁকি গিলতে হ’ত অবশেষে। রচনা সংগ্রাহকদের হ’তে হ’ত দস্তুরমত নাছোড়বান্দা। ব্রজেন্দ্রনাথ বোধ করি এই শ্রেণীরই সংগ্রাহক ছিলেন। কারণ কবিবর দেবেন্দ্রনাথ সেন “জাহ্নবী”র জন্যে একটি কবিতা রচনা ক’রে তার নাম দিয়েছিলেন “ব্রজেন্দ্রডাকাত”। যতদূর মনে পড়ে, কবিতাটি ছিল দ্ব্যর্থভাবব্যঞ্জক।

 তারপর ব্রজেন্দ্রনাথ নিয়মিতরূপে দেখা দিতে লাগলেন অমূল্যবাবুর বৈঠকে। রচনা করতে লাগলেন ঐতিহাসিক প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ। অমূল্যবাবুর উপদিষ্ট প্রণালী অনুসারেই তিনি কাজ করতে লাগলেন। কতকগুলি প্রবন্ধ সংগ্রহ ক’রে “বাঙ্গলার বেগম” নামে একখানি পুস্তকও প্রকাশ করলেন। তাঁর অনুরোধে ঐ পুস্তকের জন্যে একখানি ইংরেজী ঐতিহাসিক পত্রিকার চিত্র অবলম্বন ক’রে আমি একখানি ছবি এ’কে দিয়েছিলুম ব’লে স্মরণ হচ্ছে।

 নিজেকে উচিতমত তৈরি ক’রে তোলবার জন্যে তাঁর ছিল বিপুল আগ্রহ এবং প্রভূত প্রযত্ন। সে সময়ে বাংলা দেশে এমন কয়েকজন লেখক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতেন যাঁদের মতামতই কেবল একদেশদর্শী হ’ত না, যাদের অনুসন্ধিৎসাও ছিল না বিশেষ প্রবল। আমি ঐতিহাসিক নই, ইতিহাসের শিক্ষার্থী মাত্র—ইংরেজীতে যাকে বলে novice। কিন্তু আমিও এখনকার একাধিক নামজাদা লেখকের রচনার মধ্যে ঐতিহাসিক গলদ আবিষ্কার করতে পারি ভূরি পরিমাণেই।

 অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় একজন ভালো ঐতিহাসিক, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁরও মধ্যে সব সময়ে সত্যকার ঐতিহাসিকের উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গী ও অপক্ষপাতিত্ব দেখতে পাওয়া যায় না। সিরাজদ্দৌলার চরিত্রের কালো দিকটার উপরে চূণকাম করবার কোন চেষ্টাই করতে তিনি বাকি রাখেননি। তারপর পল্লবিত ভাষা, অশোভন উচ্ছ্বস এবং দুর্বল সমালোচনাশক্তি প্রভৃতির জন্যে অধিকাংশ বাঙালী লেখকই বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে ইতিহাস রচনা করতে পারেন নি। সম্ভবতঃ এই সব ত্রুটিবিচ্যুতি উপলব্ধি ক’রেই ব্রজেন্দ্রনাথ শিষ্যের মত এমন দুইজন কীর্তিমানের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, বাঙালী ঐতিহাসিকদের মধ্যে যাঁরা শীর্ষস্থান অধিকার ক’রে আছেন। তাঁরা হচ্ছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্যর শ্রীযদুনাথ সরকার। বিশেষ ক’রে শেষোক্ত গুণীর দ্বারাই তিনি হয়েছেন অধিকতর প্রভাবান্বিত। স্যর যদুনাথের নির্দেশ তাঁর কাছে হয়েছে গরুবাক্যের সামিল। তিনি সাধন-পথে কোন কাজ আধাখেঁচড়া অবস্থায় রেখে দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে চাননি, তিনি অগ্রসর হয়েছেন দীর্ঘকাল ধ’রে ধীরে ধীরে, অটল ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে। হংসশাবকরা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সন্তরণে দক্ষ হয়, অনেক স্বভাবকবি নিরক্ষর হয়েও কবিতা রচনা করতে পারেন এবং গায়কও যে সা-রে-গা-মা ও রাগরাগিণী না চিনেও প্রথম শ্রেণীর ওস্তাদদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন স্বর্গীয় মৈজুদ্দীন খাঁ। কিন্তু কেউ ঐতিহাসিক হ’তে পারেন না সহসা বা দুই-চার-দিনের মধ্যে অবলীলাক্রমে। নাবালক অবস্থা থেকে সাবালক অবস্থায় যেতে দরকার হয় তাঁর দীর্ঘকাল এবং পোড়াতে হয় প্রচুর কাঠখড়।

 লেখক হন দুই শ্রেণীর। যাঁদের দৃষ্টি এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে এবং যাঁদের দৃষ্টি বর্তমান থেকে পিছিয়ে যায় অতীতের দিকে। প্রথমোক্ত লেখকরা কল্পনা বা অনুমানের সাহায্যে ভবিষ্যৎকে দেখতে চান। শেষোক্ত শ্রেণীর লেখকরা কল্পনার কাছ থেকে কোন সাহায্যই লাভ করেন না, পৃথিবীতে এর আগে যে-সব ঘটনা সত্য সত্যই ঘটেছে ও ঘটনাস্থলে দেখা দিয়েছে যে সব পাত্র-পাত্রী, তাঁরা বলতে পারেন কেবল তাঁদেরই কথা এবং তাঁদেরই বলি আমরা ঐতিহাসিক।

 কিন্তু যাঁরা পুরাবৃত্ত নিয়ে আলোচনা করেন, ব্রজেন্দ্রনাথ আর নেই—তাঁদের দলে। এখন সাহিত্য-জীবনের প্রথম যুগে তাঁরও ঝোঁক ছিল ঐ শ্রেণীর ইতিহাস রচনার দিকে, কিন্তু মোড় ঘুরে তিনি পদার্পণ করেছেন নূতন এক পথে, অনেকেই যা দেখেও দেখেননি বা দেখা দরকার মনে করেন নি। সুদূর অতীতের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে এখানে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ধুরন্ধরগণ। এবং মোগল যুগের উপরে সমুজ্জ্বল “সার্চ–লাইট” ফেলেছেন স্যর যদনাথ সরকার প্রমুখ পণ্ডিতগণ।

 কিন্তু হাতের কাছে থাকলেও যে-সময়ের অসংখ্য তথ্য ছিল আমাদের নাগালের বাইরে, সেই ঊনিশ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক প্রভূত মালমসলা সেকালের দুষ্প্রাপ্য সংবাদপত্রের 'ফাইল' থেকে উদ্ধার ক’রে ব্রজেন্দ্রনাথ কৃতজ্ঞ করেছেন বাঙালী জনসাধারণকে।

 আন্দাজ চুয়াল্লিশ বৎসর আগে “সংবাদ–প্রভাকর” প্রভৃতি বাংলা দেশের পুরাতন সংবাদপত্রের 'ফাইল' দেখবার জন্য অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলুম। তিনি আমাকে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে একটি নির্জন ঘরে ব’সে পরাতন পত্রিকাগুলি পাঠ করবার সুযোগ ক’রে দিয়েছিলেন। সেই সময়েই প্রথমে উপলব্ধি করতে পেরেছিলু’ম যে, আমাদের পুরাতন সংবাদপত্রগুলির 'ফাইল' ঘাঁটলে কত লপ্তে রত্ন উদ্ধার করা যায়! তখন স্বর্গীয় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় একখানি সাহিত্য-সম্পর্কীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হ’ত, নাম তার “প্রবাহিনী”। “সংবাদ প্রভাকরের 'ফাইল' অবলম্বন ক’রে সেই পত্রিকায় ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্য–পাঠশালা” নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলুম। তাইতে আমি দেখিয়েছিলুম, বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু, প্রভৃতি শীর্ষস্থানীয়দের রচনা প্রকাশ ক’রে ঈশ্বর গপ্ত কি ভাবে উপদেশ দিয়ে তাঁদের পথনির্দেশ করেছেন! পরাতন সংবাদপত্রের 'ফাইল' থেকে অরো কিছু কিছু তথ্য আমি নিজের খাতায় টুকে রেখেছিলুম, কিন্তু সে সব নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাই নি। সে ছিল আমার সাময়িক খেয়াল, দু’ দিন পরেই ভুলে গিয়েছিলুম।

 কিন্তু আগেই বলেছি, ব্রজেন্দ্রনাথ একজন অনুসন্ধিৎসু ও অধ্যবসায়ী লেখক। খামখেয়ালের বশবর্তী হয়ে কোন কাজে হাত দেন না, নিষ্ঠাবান ব্রতচারীর মত গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত একাত ভাবে নিযুক্ত থেকে ব্রত উদ্‌যাপন না ক’রে তিনি ক্ষান্ত হন না। তাঁর ঐকান্তিকতাই জয়যক্ত করেছে তাঁর প্রচেষ্টাকে।

 কেবল “সংবাদপত্রে সেকালের কথা” নয়, প্রাচীন সংবাদপত্রের 'ফাইলে’র সাহায্যে তিনি যে “বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস” সঙ্কলন করেছেন, সেখানিও পরম উপাদেয় গ্রন্থ। প্রচুর বাগাড়ম্বর ক’রে যাঁরা এই শ্রেণীর মস্ত মস্ত গ্রন্থ রচনা করেন, সেগুলির তুলনায় এই একখানি পুস্তক ভারে না কাটলেও ধারে কাটবে নিশ্চিতরূপেই।

 তারপর তাঁর “সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা” হচ্ছে আর এক বিচিত্র ও অমূল্য নিধি। এদেশে পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের বা কবিদের জীবনী সংগ্রহের জন্যে সর্বপ্রথম উদ্যোক্তা হচ্ছেন কবিবর ঈশ্বর গুপ্ত। তার পরে বারে বারে এই শ্রেণীর কাজে হাত দিয়েছেন আরো বহু ব্যক্তি: কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথের মত আর কেহই এমন নিখুঁতভাবে কর্তব্য পালন করতে পারেন নি। তাঁর চরিত-মাল্যে ইতিমধ্যেই শতাধিক পুষ্প গ্রথিত হয়ে গিয়েছে এবং এখনও চলছে তার গ্রন্থনকার্য। এও হবে ব্রজেন্দ্রনাথের আর এক অবিস্মরণীয় অবদান।

 বজেন্দ্রনাথকে ১৯৫১-৫২ খৃষ্টাব্দের রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার দান ক’রে কর্তৃপক্ষ যথার্থ গুণগ্রাহিতারই পরিচয় দিয়েছেন। আমার পুরস্কার দেবার সামর্থ্য নেই, পুরাতন বন্ধুকে উপহার দিতে পারি কেবল আন্তরিক অভিনন্দন।