এখন যাঁদের দেখছি/ইন্দুবালা
পঁচিশ
ইন্দুবালা
সমাজ-বহির্ভূত সমাজে যে সব কন্যা জন্মগ্রহণ করে, সঙ্গীতের দিকে তারা আকৃষ্ট হয়ে আসছে বোধ হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই। অন্ততঃ ঐতিহাসিকরা যখন যবনিকা তুলে সেকেলে পৃথিবীকে দেখাতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই আমাদের চোখে পড়ে এমন এক শ্রেণীর নারী দেহকে পণ্যে পরিণত করেছে ব’লেই যারা বিখ্যাত হয়নি, যাদের খ্যাতির আসল কারণ হচ্ছে সঙ্গীত, কাব্য, নৃত্য এবং অন্যান্য কলাবিদ্যায় পারদর্শিতা। প্রমাণ গ্রীক যুগের সিন্ধিয়া, ন্যাথাইনা, লেইস, থেইস, ফিলিস ও ফ্রাইন এবং রোম্যান যুগের হিস্পালা ও থিয়োডোরা প্রভৃতি একাধারে সুখ্যাত ও কুখ্যাত নারীগণ। তাঁদের মরদেহ কবে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সাহিত্যে, ইতিহাসে ও শিল্পে অক্ষয় হয়ে আছে তাঁদের গুণাবলীর অমর স্মৃতি।
আমাদের রামায়ণ ও মহাভারতেও বারংবার উল্লিখিত হয়েছে এই শ্রেণীর নারীদের কথা এবং ইন্দ্রসভার বিখ্যাত কলাবতী অপ্সরাদেরও এই শ্রেণীর মধ্যে গণ্য করা যায়। গণিকা আজ ঘৃণ্য নামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আগে পতিতা বেশ্যা বলতে গণিকা বোঝাত না, সত্যকার গণিকা ছিল উচ্চতর শ্রেণীর জীব, এবং সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্রী। বাৎস্যায়নের কামসূত্রের তৃতীয় পরিচ্ছেদের বর্ণনা পাঠ করলে জানা যায়, চৌষট্টি কলায় দখল না থাকলে কেউ গণিকা নাম গ্রহণ করতে পারে না। কেবল দৈহিক সৌন্দর্যের জন্যে নয়, মনীষা এবং সর্ববিধ কলাবিদ্যায় দক্ষতার জন্যে গণিকারা জনসমাজে লাভ করে রীতিমত উচ্চাসন এবং রাজারাজড়ারা ও দেশ-বিখ্যাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ তাদের দেন অভিনন্দন। তারা হচ্ছে সকলের চোখের ধ্রুবতারা।
ভরতও তাঁর নাট্যশাস্ত্রে বলেছেন, গণিকাকে হতে হবে চৌষট্টি কলায় (এবং বিশেষ করে নৃত্য-গীতে), জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও সাহিত্যে অভিজ্ঞ।
একালের কেউ কি বলতে পারেন, “আমার ছেলের জন্যে গণিকার মত বউ ঘরে আনব?” কিতু “ললিতবিস্তরে” (লেফম্যানের সংস্করণে) দেখি, রাজা শুদ্ধোধন বলছেন, যুবরাজ সিদ্ধার্থের জন্যে আমি এমন এক বধূ চাই, যে গণিকার মত সকল রকম কলাবিদ্যায় নৈপুণ্য প্রকাশ করতে পারবে।
প্রাচীন ভারতের সিরিমা, সুলাশা, বাসবদত্তা, শ্যামা, পদ্মাবতী, অর্ধকাশী ও অম্বাপালী প্রভৃতি গণিকার নাম সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে আছে। কোন কোন গণিকা ভগবান বুদ্ধদেবেরও করুণা লাভ করতে পেরেছিলেন। অম্বাপালী কবিরূপেও বিখ্যাত। বৌদ্ধ “থেরীগাথা”র মধ্যে আজও তাঁর রচনার অস্তিত্ব আছে।
কেবল প্রাচীনকালে নয়, আধুনিক সভ্যতা যখন বিলক্ষণ শুচিবায়ু গ্রস্ত হয়ে উঠেছে সেই সপ্তদশ শতাব্দীর ফ্রান্সেও দেখি মেরিয়ন ডি লোম ও নিন ডি লেনক্লোস প্রভৃতি বহু গণিকার বাড়ি হয়ে উঠেছে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও বিদ্বজ্জনদের তীর্থের মত। সকলে সেখানে প্রকাশ্যে যাতায়াত করলেও নিন্দিত হতেন না। নিনন ছিলেন গুণী ও গুণগ্রাহী। বালক ভলতারের সঙ্গে আলাপ ক’রে খুশি হয়ে তিনি কেতাব কেনবার জন্যে তাকে অর্থদান করেছিলেন। অমন যে ‘পিউরিটান’ কবি টেনিসন, তিনিও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করবার জন্যে ফ্রান্সে গিয়ে এক বিখ্যাত গণিকার বাড়ী বেছে নিতে ইতস্ততঃ করেননি।
আসল কথা, গণিকা হ’লেই কেউ অস্পৃশ্য জীবে পরিণত হয় না; মানুষ করে গুণের আদর। চরিত্রহীন ব’লে কেউ ভিলন, ভার্লেন, বাইরণ ও অস্কার ওয়াইল্ডকে দূরে পরিহার করেনি, বিশ্ব শ্রদ্ধাভরে প্রণত হয় তাঁদের কবিখ্যাতির সামনে। প্রত্যেক শ্রেণীর শিল্পীর সম্বন্ধেই এই কথা খাটে। আমরা নীরত্যাগী ও ক্ষীরগ্রাহী মরালের মত দোষ বর্জন ক’রে তাঁদের গুণ গ্রহণ করি।
বাংলা দেশে আগে সঙ্গীতনিপুণা ব’লে ভদ্রমহিলাদের বিশেষ খ্যাতি ছিল না। সঙ্গীত বিভাগের ভার গ্রহণ করেছিলেন সমাজবহির্ভূত সমাজেরই কন্যাগণ। বাড়ীতে বসেও উচ্চ শ্রেণীর গান শুনতে হ’লে ধনীরা করতেন বাইজীদের আমন্ত্রণ। মধ্যবিত্ত ব্যক্তিগণ অতটা উচ্চে উঠতে পারতেন না, বাড়ীর কোন ক্রিয়াকর্মের সময়ে তাঁরা বায়না দিতেন খেমটাওয়ালীদের। আজকাল ভদ্র পরিবারে নাচগানের রেওয়াজ খুব বেড়েছে ব’লে বাইজী এবং খেমটাওয়ালীদের পসার একরকম নেই বললেও চলে। কিন্তু আমাদের বাল্যকালেও তাদের প্রভাব ছিল রীতিমত বাড়ন্ত।
চল্লিশ বৎসর আগেও ভদ্রমহিলাদের মধ্যে ছিল না গায়িকা ব’লে সুপ্রতিষ্ঠ হবার চেষ্টা। উপরন্তু এমন চেষ্টা সমাজপতিদের সমর্থনও লাভ করত না। ধনীদের অন্তঃপুরে কিছু কিছু সৌখীন গানবাজনার চর্চা যে ছিল না, এ কথা বলতে পারি না। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। সে খবর জনসাধারণের কাছে গিয়ে পৌঁছত না। চল্লিশ—পঞ্চাশ বৎসর আগেকার কোন প্রখ্যাত মহিলা গায়িকার নাম কেউ জানে না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভগ্নী স্বর্গীয়া অমলা দাশ প্রথম যখন গ্রামোফোনে গান দেন, তখন সেই অভাবিত ব্যাপারে চারিদিকে জেগেছিল বিস্ময়ের সাড়া। তারও অনেক পরে যখন কলকাতায় বেতারে গানের আসর বসে, তখনও গোড়ার দিকে মহিলারা গান গাইবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। সবাক চলচ্চিত্র সম্বন্ধেও ঐ কথাই বলা যায়।
সে যুগে গানের আসর রেখেছিলেন শ্রেণীবিশেষের নারীরাই। গহরজান ও মালকাজান প্রভৃতির কথা এখানে ধর্তব্য নয়, কারণ তাঁরা বাঙালী ছিলেন না। কিন্তু বাঙালী গায়িকাদেরও মধ্যে অনেকে কিনেছিলেন দেশজোড়া নাম। যেমন শ্রীজান, যাদুমণি ও বিনোদিনী প্রভৃতি। যাদুমণির গান আমি শুনেছি, তাঁর গলা ও গাইবার রীতি ছিল চমৎকার। গ্রামোফোনের পুরাতন রেকর্ডে বিনোদিনীর গান এখনো শোনবার সুযোগ আছে। একালের অধিকাংশ মহিলা গায়িকার মত তাঁর গলায় নাকী সুরের উৎপাত ছিল না। তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর গায়িকা। ভরাট, মিষ্ট গলা,— নীচু থেকে উঁচু পর্দায় সমান করতবের কায়দা দেখাতে পারতেন। তাঁর মত গায়িকা আজও দুর্লভ। তাঁর মৃত্যুর পরে রেকর্ডের গানে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন স্বর্গীয়া কৃষ্ণভাবিনী। তাঁর আসরের গানও আমি শুনেছি। বড় দরদ ছিল তাঁর গলায়।
কোহিনূর থিয়েটার তখন চলছে কি উঠে গেছে ঠিক স্মরণ হচ্ছে না, কিন্তু ঐ রঙ্গমঞ্চেই একটি জলসায় দুইজন বাঙালী গায়িকার গান আমার খুব ভালো লেগেছিল। তাঁরা হচ্ছেন হীরাবাঈ ও ইন্দুবালা, দু’জনেরই ছিল বয়স কাঁচা, কিন্তু গলা পাকা।
হীরাবাঈও আজ খুব নাম করতে পারতেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্যে দীর্ঘকাল ধ’রে তাঁকে গানের আসরের বাইরে থাকতে হয়েছিল। তবে তাঁর গাইবার শক্তি যে অটুট ছিল, ষোলো–সতেরো বৎসর আগে হিন্দুস্থান রেকর্ডে আমার রচিত একটি গান গেয়ে তিনি তা প্রমাণিত করেছিলেন।
আগে এদেশে বড় বড় গায়ক-গায়িকার অভাব ছিল না বটে, কিন্তু তাঁদের মুখে যে-সব বাংলা গান শুনতুম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রচনা হিসাবে সেগুলি ছিল নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে লালচাঁদ বড়াল, গহরজান, বিনোদিনী ও কৃষ্ণভাবিনী প্রভৃতির বাংলা গানের রেকর্ডগুলি শুনলেই। কিন্তু সেই সব কুলিখিত গানের বাজে কথাগুলি নিয়েই তখনকার শিল্পীরা সৃষ্টি করতেন সুরের সুরধুনী। সেদিন কোহিনূর রঙ্গমঞ্চে ইন্দুবালাও ঐ শ্রেণীর বাংলা গানই গেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে পেয়েছিলুম আমি সুরের ইন্দ্রজাল। সুস্পষ্ট উচ্চারণ, জোরালো গলা, মেয়েলি ঢং বা নাকী সুর নেই। সুরচিত, কবিত্বপূর্ণ গান পেলে তিনি যে উচ্চতর শ্রেণীর সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারবেন, এমন ধারণা আমার হয়েছিল।
আমার সে ধারণা যে ভ্রান্ত নয়, সেটা প্রমাণিত হ’ল আরো কয়েক বৎসর পরে। বোধ করি ছত্রিশ কি সাঁইত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। রেকর্ডে ইন্দুবালার গলায় কবি শ্রীকুমুদরঞ্জন মল্লিক রচিত একটি গান (“ওরে মাঝী, তরী হেথা”) শূনে একেবারে অভিভূত হয়ে গেলুম। কাব্যের সৌন্দর্য ও সুরের ঐশ্বর্য এমন নিপুণভাবে যিনি এক সঙ্গে পরিবেশন করতে পারেন, শিল্পী হিসাবে নিশ্চয়ই তিনি অনন্যসাধারণ। বুঝলুম কোহিনূর রঙ্গমঞ্চের জলসায় যে উদীয়মানা গায়িকাকে প্রথম দেখেছিলুম, আজ তিনি পূর্ণ গৌরবে সমুদিত হয়েছেন। “উজ্জল ভবিষ্যৎ” যে তাঁর করতলগত হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমার মনে আর কিছুমাত্র সন্দেহ রইল না। সেই একটিমাত্র গানের জন্যেই তাঁর লোকপ্রিয়তা উঠল চরমে।
তারপর তাঁর কণ্ঠে শুনেছি কত রকমের গীত—হিন্দী বা উর্দু গান, নজরুল ইসলামের গজল, রামপ্রসাদী গান ও থিয়েটারি গান প্রভৃতি, কিন্তু সর্বশ্রেণীর সঙ্গীতেই স্বকীয় রস ও ভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে তাঁর অমৃতায়মান কণ্ঠ।
আজকাল ঘরে ঘরে শোনা যায় রেডিয়োর গান। আমার তো প্রায়ই বেতারের গান শুনলে গায়ে আসে জ্বর। বেতারে মেয়েরাই কেবল নাকী সুর ধরেন না, অধিকাংশ পুরুষই যে-গলায় গান শোনান, তা কতকটা কান্নারই সামিল। কিন্তু ইন্দুবালার মেয়ে-গলায় আছে পুরুষোলি ভাব এবং ব্যক্তিগতভাবেই তাঁর পরিচয় পেয়ে বুঝেছি, ইন্দুবালার মধ্যে আছে অল্পবিস্তর “Tom-boy” এর বিশেষত্ব। হয়তো এই জন্যেই সৌখীন ও পেশাদার নাট্য-সম্প্রদায়ে তিনি বিভিন্ন পুরুষ ভূমিকায় প্রচুর দক্ষতা প্রকাশ করতে পেরেছেন। “বিষবৃক্ষ” পালায় দেবেন দত্তের ভূমিকায় গান গেয়ে ও অভিনয় ক’রে তিনি যথেষ্ট নাম কিনেছেন। মনোমোহন থিয়েটারে (“জাহাঙ্গীর” নাটকে) একটি পুরুষ ভূমিকায় তাঁকে যে-রকম লাফ-ঝাঁপ মারতে দেখেছিলুম, আর কোন মেয়ের পক্ষে তা সম্ভবপর ব’লে মনে হয় না।
তার আগেই ঐখানে অভিনীত হয়েছিল শ্রীশচীন্দ্রনাথ সেন গুপ্তের “রক্তকমল” নাটক। তার মধ্যে ছিল নজরুল ইসলাম রচিত গীতাবলী। অভিনয়ের মাঝে মাঝে এক একটি খণ্ড দৃশ্যে কয়েকটি গান গাইবার ভার পেয়েছিলেন ইন্দুবালা। গত তিন যুগের মধ্যে বাংলা রঙ্গালয়ে তেমন উচ্চশ্রেণীর গান আমি শুনিনি। শচীন্দ্রনাথের সুলিখিত নাটকের অভিনয়ও হয়েছিল উল্লেখযোগ্য। তবু সমগ্র নাট্যাভিনয়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাধান্য লাভ করেছিল মূল নাটক থেকে বিচ্ছিন্ন ভূমিকায় ইন্দুবালার সেই গানগুলিই।
লোকে বলে, ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠস্বর না থাকলে কেউ হ’তে পারে না শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতবিশারদ। সুকণ্ঠ ভগবানদত্ত বটে, কিন্তু সেই কণ্ঠকে শিক্ষিত ও মার্জিত করবার জন্যে দরকার হয় কঠোর সঙ্গীত সাধনা। স্বর্গীয় দুষ্পাঠ্যমত বিস্ময়জনক গায়ক ভারতীয় সঙ্গীতজগতে আর কখনো জন্মগ্রহণ করেন নি। সঙ্গীতে তাঁর ছিল অশিক্ষিতপটুত্ব। তিনি নিয়মিতভাবে কণ্ঠসাধনা করেন নি, রাগরাগিণী চিনতেন না, কিন্তু যে কোন বড় ওস্তাদের গান কানে শুনে নিজের কণ্ঠে প্রকাশ করতে পারতেন। হয়তো তিনি ছিলেন জাতিস্মর, তাই তাঁর কাজে লেগেছিল পূর্বজন্মের সঙ্গীত সাধনা। এ ছাড়া তাঁর আশ্চর্য শক্তির আর কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু সুকণ্ঠী ইন্দুবালা গায়িকা হননি এমন দৈবী মায়ার লীলায়। তিনি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করেছেন সৎগুরুর অধীনে থেকে দীর্ঘকালব্যাপী সাধনার দ্বারা। তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন প্রসিদ্ধ ওস্তাদ গৌরীশঙ্কর। এই সঙ্গীতবিদের কাছে আগেকার আরো অনেকে শিক্ষালাভ ক’রে যশস্বী হয়েছিলেন। তারপর গহরজান, এলাহি বক্স ও জমীরুদ্দীন খাঁ প্রভৃতি তাঁকে গান শেখাবার ভার গ্রহণ করেন। সুতরাং ইন্দুবালার সঙ্গীতকুশলতা যে সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একথা জোর ক’রেই বলা চলে।
স্বর্গীয় ওস্তাদ জমীরুদ্দীন খাঁ ছিলেন আমার বিশেষ বন্ধু ও স্নেহভাজন। তাঁরও ফরমাসে মাঝে মাঝে আমাকে গান রচনা করতে হয়েছে এবং তার পরিবর্তে তিনি আমাকে শুনিয়েছেন অসংখ্য সঙ্গীত। যখন-তখন অযাচিতভাবে আমার বাড়ীতে এসে হাজির হয়েছেন এবং প্রায়ই শেষ-রাত্রি পর্যন্ত অশ্রান্তভাবে গেয়ে গিয়েছেন গানের পর গান। সব রকম গানই তিনি গাইতে পারতেন, কিন্তু বিশেষ ক’রে ঠুংরি গানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। সুরকার হিসাবে নজরুল ইসলামও তাঁর কাছে ঋণী। জমীরুদ্দীনের মুখে প্রায়ই ইন্দুবালার সুখ্যাতি শুনতুম। বাংলা দেশের গায়িকাদের মধ্যে ইন্দুবালার শক্তির উপরে ছিল তাঁর অটুট আস্থা।
সেকালের অনেক নটী এবং গায়িকা ছিলেন নিরক্ষর বা অশিক্ষিত। কোন কোন গায়ক এবং বিখ্যাত অভিনেতা পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষারও গর্ব করতে পারতেন না। কিন্তু সেকালের মেয়ে হ’লেও ইন্দুবালার মন ছিল লেখাপড়ায়। অল্প বয়সেই ডবল প্রমোশন পেয়ে তিনি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হয়তো সেই জন্যেই শুদ্ধতা লাভ করেছে তাঁর বাণী।