এখন যাঁদের দেখছি/শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
চব্বিশ
শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
অনেককেই তো দেখলুম—কবি, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, চিত্রকর, ঐতিহাসিক, গায়ক-গায়িকা, নট-নটী, নর্তক—এমন কি মল্ল পর্যন্ত। কিন্তু আধুনিক কোন নাট্যকারের সঙ্গে এখনো পাঠকদের পরিচিত করা হয়নি।
বাংলা নাট্যজগতে স্মরণীয় অবদান রেখে গিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু, মনোমোহন বসু, রবীন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ ও অমৃতলাল। প্রথমোক্ত দুইজনকে কখনো চোখে দেখবারও সৌভাগ্য হয়নি। বাকি কয়েকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছি এবং তাঁদের কথা নিয়ে অন্যত্র আলোচনাও করেছি।
এটা বাংলা দেশের জল-বাতাসের গুণ কি না জানি না, কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য ক’রে বিস্মিত হ’তে হয়। এখানে নানা বিভাগে যাঁদের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়, বরণীয় ও অতুলনীয়, তাঁরা আত্মপ্রকাশ করেছেন প্রথম দিকেই। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা পরে পরে পেয়েছি যে সব শক্তিধরকে, আজ তাঁদের সঙ্গে তুলনা করবার মত মানুষ গোটা বাংলা দেশ খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তুলনা করব কি, বাংলার রাজনীতি আজ প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছে বললেও চলে। কথাসাহিত্যেও আমরা পরে পরে পেয়েছি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে। আধুনিক কথা-সাহিত্যিকদেরও লেখনী প্রসব করছে কাঁড়ি কাঁড়ি রচনা, কিন্তু সেগুলি ধারে কাটে না ভারে কাটে সে কথা ‘বুঝ নর যে জান সন্ধান’! চিত্রকলার ক্ষেত্রে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল ও যামিনী রায় প্রভৃতিকে সমসাময়িক বলতে পারি। কিন্তু তার পরেই বাংলা চিত্রশিল্পের ধারা হয়ে পড়েছে ক্ষীয়মাণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর উত্তরার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত বাগ্মিতার জন্যে বাংলা দেশ ছিল বিখ্যাত। কিন্তু এখন? কেশবচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ ও বিপিনচন্দ্র প্রভৃতির বাগবৈদগ্ধের কথা ছেড়েই দি, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ ও অমৃতলাল বসুর মত বৈঠকী-সংলাপ জমিয়ে তুলতে পারেন, এমন লোকও আজ দুর্লভ। আরো নানা বিভাগের কথা তোলা যেতে পারে, কিন্তু পুঁথি না বাড়িয়ে কেবল নাট্য-বিভাগের দিকেই দৃষ্টিপাত করা যাক।
এদেশে আমরা যাঁদের প্রথম শ্রেণীর নাট্যকার বলে মনে করি, তাঁদের কেহই আধুনিক যুগের মানুষ নন। সাধারণ বাংলা রঙ্গালয়ে নবযুগ আসবার আগেই তাঁদের দান ফুরিয়ে গিয়েছিল। শিশিরকুমারের আবির্ভাবের পরেও ক্ষীরোদপ্রসাদ কিছুদিন লেখনী চালনা করেছিলেন বটে, কিন্তু তার আগে থেকেই তাঁর শক্তি হয়ে পড়েছিল যথেষ্ট রিক্ত। “আলমগীর” অবলম্বন ক’রেই শিশিরকুমার দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ও-নাটকখানি বিখ্যাত হয়েছে নাটকত্বের জন্যে নয়, শিশিরকুমারের অভিনয়গুণেই। আসলে গিরিশচন্দ্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা নাটকের স্বর্ণযুগ অতীত হয়ে গিয়েছিল। শিশিরকুমারের “নাট্যমন্দির” যখন চলছে, তখন অমৃতলাল দুষ্পাঠ্য” নামে একখানি উৎকৃষ্ট নাটক আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ও-রকম একটি কি দুটি রচনা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই।
গিরিশোত্তর যুগ হচ্ছে বাংলা নাট্যজগতের অন্ধ-যুগ। শিশিরকুমারের আবির্ভাবের আগে এক যুগের মধ্যে একজনমাত্র উল্লেখযোগ্য নূতন অভিনেতার দেখা পাওয়া যায় নি; এবং সাড়া পাওয়া যায় নি একজনমাত্র প্রথম শ্রেণীর নতুন নাট্যকারেরও। এ সময়ে নাটক রচনা করে সুপরিচিত হয়েছিলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়, নিশিকান্ত বসু, শ্রীসুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীদাশরথি মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত তিনজন ছিলেন প্রায় তুল্যমূল্য। তাঁদের রচনাও ছিল অপেক্ষাকৃত উন্নত। নির্মলশিবেরও কোন কোন রচনা হয়েছিল সহনীয়। বাকি তিনজন ছিলেন সবচেয়ে লোকপ্রিয় এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর। তাঁদের নাটকে ছিল না কোন মহৎ ভাব বা নিজম্ব রচনাভঙ্গি। কিন্তু হেটো দর্শকদের গ্রাম্য মনোবৃত্তিকে উত্তেজিত করবার কৌশল আয়ত্তে এনে তাঁরা বাজার একেবারে দখল ক’রে ফেলেছিলেন। কৌতূহলী হয়ে সাহস সঞ্চয় ক’রে এঁদের তিনজনেরই এক-একখানি নাটকের অভিনয় আমি দেখতে গিয়েছিলুম, কিন্তু তারপরেই আমার কৌতূহল দস্তুরমত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তেমন সব ওঁচা রচনাও যে রঙ্গালয়ের মালিকের সামনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার খুলে দিতে পারে, সে জ্ঞান আমার ছিল না। তারপরে বহু রাত্রেই রঙ্গালয়ের নেপথ্যে উপস্থিত ছিলুম। মঞ্চের উপরে “বঙ্গে বর্গী” প্রভৃতির অভিনয় চলেছে, কিন্তু কোনদিনই প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বসবার আগ্রহ হয় নি।
কিন্তু কেবল রাবিসের পর রাবিসের দ্বারা কতদিন একটা জাতির চিত্ত আচ্ছন্ন ক’রে রাখা যায়? দিনে দিনে লোকের চোখ ফুটতে লাগল। প্রেক্ষাগারে শিক্ষিত দর্শকের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ শ্রেণীর পালার চাহিদা কমে এল। বোধ করি নাট্যকারের জনপ্রিয়তা দেখেই শিশিরকুমারও এই দলের একজনের একটি পালা মঞ্চস্থ করেছিলেন। কিন্তু দর্শকরা তখন সচেতন হয়ে উঠেছে। শিশিরকুমারের প্রতিভাও পালাটিকে দীর্ঘায়ু করতে পারে নি।
“বঙ্গে বর্গী” ও “মোগল-পাঠান” প্রভৃতি নাটকের আসর মাটি হ’ল বটে, কিন্তু নূতন যুগের নূতন নাট্যকারের সাড়া পাওয়া গেল না। অপরেশচন্দ্র, বরদাপ্রসন্ন ও ভূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগ দিলেন যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, ও’রা সকলেই প্রায় সমশ্রেণীর নাট্যকার। এই সময়ে একাধিক রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাথের কয়েকখানি নাটক উপরউপরি অভিনীত হয়। “চিরকুমার সভা”, “শোধবোধ”, “পরিত্রাণ”, “বিসর্জন” ও “শেষরক্ষা” প্রভৃতি। তার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের “গৃহদাহ”, “ষোড়শী”। গিরিশোত্তর যুগে এই সময়ে প্রথম রঙ্গালয়ে নাটকের মান বেড়ে ওঠে।
শ্রীমন্মথ রায়ও প্রবেশ করলেন নাট্যজগতে। তাঁর ভাষা ও রচনাভঙ্গি প্রশংসনীয় হ’লেও তাঁর নাটকীয় বিষয়বস্তু ছিল না আধুনিক। ডাঃ শ্রীনরেশচন্দ্র সেনগুপ্তও একাধিকবার নাট্যজগতে দেখা দিয়েও শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকলেন না। কবি শ্রীজলধর চট্টোপাধ্যায়ও নাট্যকাররূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। এসেছিলেন আরো কেউ কেউ, কিন্তু আসর বেশীদিন রাখতে পারেন নি।
বাংলা নাটকের যখন শোচনীয় দুরবস্থা, সেই কুখ্যাত ‘মনোমোহন’ আমলেই এখানে নূতন নাট্যকার রচিত নবযুগের উপযোগী প্রথম নাটক অভিনীত হয় ১৯২২ খৃষ্টাব্দে। ম্যাডানদের রঙ্গালয়ে খোলা হয় স্বর্গীয় সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের “মুক্তার মুক্তি”। কিন্তু একে শিশিরকুমারকে সদ্য হারিয়ে ম্যাডানদের রঙ্গালয় তখন গৌরবচ্যুত হয়ে পড়েছে, তার উপরে “বঙ্গে বর্গী” ও “মোগল-পাঠানে”র কোলাহলে নাট্যজগৎ এমন পরিপূর্ণ হয়েছিল যে, এই চমৎকার পালাটির দিকে লোকের দৃষ্টি ভালো ক’রে আকৃষ্ট হয় নি। মণিলালের মধ্যে সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তিনি অকালেই পরলোকগমন করেন।
এখানে আধুনিক যুগোপযোগী দ্বিতীয় নাটক হচ্ছে শ্রীশচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের “রক্তকমল”। চিত্রজগতে সুপরিচিত স্বর্গীয় অনাদিনাথ বসু যখন মনোমোহন থিয়েটারের ভার গ্রহণ করেছেন, সেই সময়েই সেখানে এই পালাটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকখানি আমার ভালো লেগেছিল এবং নাট্যমার্গ ত্যাগ না করলে শচীন্দ্রনাথ যে এ বিভাগে স্মরণীয় অবদান রেখে যাবেন, এটাও মনে মনে বুঝতে পেরেছিলুম।
শচীন্দ্রনাথ যখন সাপ্তাহিক “বিজলী” পত্রিকার সম্পাদক এবং আমি তার নিয়মিত লেখক, সেই সময়েই আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলুম। কিন্তু সে কেবল মৌখিক পরিচয়। তখন তিনি ছিলেন সাংবাদিক। নাট্যজগৎ যে তাঁর কাছ থেকে কিছু আশা করতে পারে, একথা আমি জানতুম না এবং তিনি নিজেও বোধ হয় জানতেন না।
যতদূর মনে পড়ছে, সুলিখিত ও সুঅভিনীত হ’লেও এবং প্রশংসা অর্জন ক’রেও “রক্তকমল” উচিতমত অর্থ অর্জন করতে পারে নি। তখনকার দিনে নাটক আকারে মস্ত এবং ওজনে গুরুভার না হ’লে জনসাধারণের চিত্তরোচক হ’ত না। সামাজিক নাটকের একেলে ভঙ্গিও বোধ করি দর্শকদের ভালো লাগত না। এই কারণে শচীন্দ্রনাথের আরো কোন কোন উৎকৃষ্ট রচনা লোকপ্রিয় হয় নি। যেমন “ঝড়ের রাতে” ও “জননী”। বাঙালী দর্শকদের এই অদ্ভুত মনের ভাব আজও পরিবর্তিত হয় নি। এই সেদিনেও “শ্রীরঙ্গমে” অভিনীত পরম উপাদেয় সামাজিক নাটক “পরিচয়” রসিকজনদের খুশি ক’রেও সাধারণ দর্শকদের অভিনন্দন পায় নি। আমাদের জনসাধারণের মন বুড়িয়ে পড়েছে। তারা আজও চলতে চায় সেকেলে বাঁধা রাস্তা ধ’রে, নতুন পথে পা বাড়াতে ভরসা করে না।
কিছুদিন পরে মনোমোহন থিয়েটারের পরিচালক ও মালিক হলেন বন্ধুবর শ্রীপ্রবোধচন্দ্র গুহ। প্রথমেই খুললেন শ্রীমণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের “জাহাঙ্গীর” এবং তারপর শ্রীমন্মথ রায়ের “মহুয়া”। আমাকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলেন তাঁর রঙ্গালয়ে নৃত্যপরিকল্পনার জন্যে। শচীন্দ্রনাথও সেখানে নিয়মিতভাবে আনাগোনা করতেন এবং অল্পকালের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে উঠল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
তারপর সেখানে শচীন্দ্রনাথের “গৈরিক পতাকা” খোলবার আয়োজন হয়। প্রথমে আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল, গিরিশচন্দ্রের “ছত্রপতি”র পর শিবাজীকে অবলম্বন করে রচিত আর কোন নাটক দর্শকরা গ্রহণ করবে কি না? কিন্তু পাণ্ডুলিপি পাঠ ক’রে সে সন্দেহ দূর হ’ল। যদিও নাটকখানি পুরাতন আদর্শেই রচিত, তবু তার আখ্যানে নতুনত্ব ও চরিত্রচিত্রণে নিপুণতা ও ভাষায় বিষয়োপযোগী দৃঢ়তা এবং গাম্ভীর্যের পরিচয় পেলুম যথেষ্ট।
পালাটি মঞ্চস্থ করবার জন্যে প্রবোধবাবু প্রচুর পরিশ্রম, অর্থব্যয় ও আয়োজন করেছিলেন। গান রচনা ও নৃত্য পরিকল্পনার ভার পড়েছিল আমার উপর (এবং কোন কোন গানে সুরও দিয়েছিলুম আমি)। তারপর থেকে “নাট্য-নিকেতনে” অভিনীত শচীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নাটকেই আমাকে ঐ দুটি কর্তব্য পালন করতে হয়েছে। যেন একটা বাঁধা-ধরা নিয়ম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, শচীন্দ্রনাথের লেখনী নূতন নাটক প্রসব করলেই গান লিখতে ও নাচ দিতে হবে আমাকেই।
তোড়জোড় দেখেই অনুমান করতে পেরেছিলুম, “গৈরিক পতাকা” মন্দ চলবে না। তবে খুব একটা বড় কিছুর আশা করি নি। কিন্তু পালাটি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করলে, সেটা আমরা কেহই কল্পনাতেও আনতে পারি নি। ঐ বাড়ীতেই “সীতা” খোলা হয় এবং তার অসামান্য লোকপ্রিয়তার কথা কারুর কাছেই অবিদিত নেই। কিন্তু “গৈরিক পতাকা” দেখবার জন্যে প্রথম কয়েক রাত্রে প্রেক্ষাগৃহে যে মহতী জনতা সমাগত হয়েছিল, তার নিবিড়তা ছিল “সীতা”র চেয়েও বেশী। বিডন ষ্ট্রীট দিয়ে খানিকক্ষণের জন্যে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেত এবং ভিড় সামলাবার জন্যে পুলিসবাহিনী মোতায়েন রাখতে হ’ত। জনতাকে নিয়মিত করবার জন্যে রঙ্গালয়ের অঙ্গনেও বাঁশের বেড়া বাঁধতে হয়েছিল।
“গৈরিক পতাকা” শচীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ রচনা নয়। তিনি তার চেয়ে ভালো একাধিক নাটক রচনা করেছেন। তার গঠন ও আবেদনও অল্পবিস্তর মামুলী। হয়তো সেইটেই তার কাজে লেগে গিয়েছে। আগেই ইঙ্গিতে বলেছি, এদেশী দর্শকদের মন আজও অতিআধুনিক বাস্তব নাটকের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঠে নি। নবযুগেও এখানে যে সব নাটক (কর্ণার্জুন, সীতা, আত্মদর্শন, দিগ্বিজয়ী ও গৈরিক পতাকা) সবচেয়ে লোকপ্রিয় হয়েছে, তার কোনখানিরই রচনাপদ্ধতি আধুনিক নয়। “কিন্নরী”র মত নিম্নশ্রেণীর নাটকেরও পুনরভিনয় দেখবার জন্যে আজও বাংলা রঙ্গালয়ে ভিড় ভেঙে পড়ে।
প্রায় পঁচিশ বৎসর আগে খোলা হয়েছিল “গৈরিক পতাকা”, কিন্তু আজও লোকে তাকে দেখতে চায়। অভিনয়ের দিক দিয়ে, নাচ-গানের দিক দিয়ে এবং সাজপোশাক ও দৃশ্যপটাদির দিক দিয়ে “গৈরিক পতাকা” তার পূর্বগৌরব হারিয়ে ফেলেছে, তবু এখনো বিভিন্ন রঙ্গালয়ে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে।
নাট্য-সমালোচকরা যখন তখন দাবি করেন—নূতন যুগের জন্যে চাই নূতন আদর্শের নাটক। কিন্তু তাঁদের সে দাবি মিটবে কেমন ক’রে? দাবিদারদের কথামত কাজ করতে গেলে রঙ্গালয়ের পর রঙ্গালয়ে নিবে যাবে সাঁঝের বাতি—যেমন নিবে গিয়েছিল “নাট্যমন্দিরে”, রবীন্দ্রনাথের “তপতী” খুলে।
শচীন্দ্রনাথ নূতন যুগের উপযোগী নূতন আদর্শের নাটক রচনা করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ “ঝড়ের রাতে”র নাম করতে পারি। পরিকল্পনা, সংলাপের ভাষা, ভাববৈচিত্র্য, চরিত্রচিত্রণ ও আখ্যানবস্তু প্রভৃতি সব দিকেই নাট্যকারের বিশেষ মুনশীয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীও সম্পূর্ণ আধুনিক। শ্রীসতু সেন দৃশ্য পরিকল্পনাতেও প্রভূত আধুনিকতা প্রকাশ করেছিলেন এবং স্বর্গীয় রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী ও নীহারবালা প্রভৃতির অভিনয়ও হয়েছিল অনবদ্য। তবু নাটকখানি বেশীদিন চলেনি। তাঁর “জননী” সম্বন্ধেও ঐ কথা। আরো দুই-তিনখানি নাটকেও শক্তির পরিচয় দিয়েও দর্শকদের হৃদয় হরণ করতে না পেরে, অবশেষে তিনি পুরাতন পদ্ধতিতেই রচনা করলেন “সিরাজদৌলা” এবং সঙ্গে সঙ্গে সার্থক হ’ল তাঁর পরিশ্রম। নাবালক সিরাজের ভূমিকায় বৃদ্ধ নির্মলেন্দু, তাও লোকের চোখে বিসদৃশ ঠেকল না, রাত্রির পর রাত্রি প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল বিপুল জনতায়। “গৈরিক পতাকা”র মত “সিরাজদৌলা”রও পুনরভিনয়ের আয়োজন হয় বিভিন্ন রঙ্গালয়ে। শচীন্দ্রনাথের সমগ্র নাটকাবলীর মধ্যে এই দুটি পালাই যেন প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাঁর যে সব নাটক উচ্চতর শ্রেণীর, তা প্রায় অবজ্ঞাত বা উপেক্ষিত হয়ে আছে। বাঙালী নাট্যকারদের কপাল এমনি পাথরচাপা।
শচীন্দ্রনাথ কেবল বাংলা নাটকে আধুনিকতা ও নব যুগধর্মের পুরোধা নন, বর্তমান কালের প্রধান নাট্যকার ব’লে পরিচিত করতে গেলে তাঁর ছাড়া আর কারুর নাম মনে ওঠে না।