এখন যাঁদের দেখছি/আমাদের দল
সাতাশ
আমাদের দল
সে আজ তেতাল্লিশ বৎসর আগেকার কথা। আমাদের যে নিজস্ব দলটি সর্বপ্রথমে গ’ড়ে উঠেছিল শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শ্রীঅমল হোম, শ্রীচারুচন্দ্র রায় ও শ্রীসুধীরচন্দ্র সরকার প্রভৃতিকে নিয়ে, তাঁরা প্রত্যেকেই আজ সাহিত্য ও ললিত কলার বিভিন্ন বিভাগে খ্যাতিলাভ করেছেন—এমন ব্যাপার সচরাচর দেখা যায় না। এত্থেকেই প্রমাণিত হবে, আমাদের সেই বন্ধুসভার কোন সভ্যই কেবল সাময়িক খেয়ালে মেতে সাহিত্য ও শিল্পকে অবলম্বন করেননি, চিত্তের মধ্যে একান্ত নিষ্ঠা নিয়ে এবং সাহিত্য ও শিল্পের উচ্চাদর্শের দিকে অবিচলিত দৃষ্টি রেখেই তাঁরা অগ্রসর হ’তে চেয়েছিলেন সাধনামার্গে।
আমি যখন সাহিত্যক্ষেত্রে হাতমক্স করছি, স্বর্গীয় নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের সম্পাদনায় তখন “জাহ্নবী” নামে একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পরে কাগজখানি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর স্বর্গীয় সুধাকৃষ্ণ বাগচী আবার নব পর্যায়ের “জাহ্নবী” প্রকাশ করতে থাকেন এবং তাঁর পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লেখনীচালনা করবার জন্যে আমাকে আহ্বান করেন। নামে সুধাকৃষ্ণই “জাহ্নবি”র সম্পাদক হ’লেন বটে, কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল না সম্পাদকের উপযোগী মনীষা। সেই সময়ে পত্রিকা সম্পাদনার ভার গ্রহণ করলেন প্রভাত, অমল, সুধীর ও প্রেমাঙ্কুর প্রভৃতি। প্রত্যেকেই তরুণ, আমার চেয়ে বয়সে কিছু ছোট এবং প্রভাত, অমল ও সুধীর তখনও বিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন যাপন করছেন। কিন্তু সেই বয়সেই তাঁরা প’ড়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যের আবর্তে। বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার চেয়ে সাহিত্যজগতের লেখা এবং পড়ার দিকেই তাঁদের ঝোঁক ছিল বেশী।
“জাহ্নবী” ছোট কাগজ। এবং তার কার্যালয় ও আমাদের বৈঠকও আয়তনে বড় ছিল না। কিন্তু সেখানে প্রত্যহ যে সব বিষয় নিয়ে (কখনো কখনো উত্তপ্ত) আলোচনা চলত, তার মধ্যে থাকত এদেশী এবং বিদেশী সাহিত্য ও শিল্পের তাবৎ বিভাগ।
বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে তখন রবীন্দ্রনাথ, দিজেন্দ্রলাল, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর সুপ্রতিষ্ঠিত লেখকদের ভূরি ভূরি দানের অভাব ছিল না এবং রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের মধ্যে থেকেই নূতন যুগের তিনজন কবিও—যতীন্দ্রমোহন, সত্যেন্দ্রনাথ ও করুণানিধান—ধীরে ধীরে আরোহণ করছিলেন খ্যাতির সোপানে। কিন্তু নূতেন যগের মান রাখতে পারেন এমন একজন প্রতিভাবান কথাশিল্পীর অভাব অনভব করতেন সকলেই। সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত থেকে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস রচনার জন্যে অবসর পেতেন অল্প-যদিও অন্যান্য বিভাগের মত কথাসাহিত্য-ক্ষেত্রেও তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান শিল্পী এবং সে গৌরব থেকে আজও কেউ তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেননি। লোকসাধারণের মানসক্ষধা নিবৃত্তির পক্ষে তাঁর দান অমৃতায়মান হ’লেও চাহিদা হিসাবে অপ্রচুর ছিল। মন বলত— “আরো চাই, আরো।” কিন্তু কত দিক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাত জোড়া, একান্তভাবে একদিক নিয়ে নিযুক্ত থাকবার সময় তাঁর কই?
ঠিক এই সময়েই “যমুনা” পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ্যভাবে দেখা দিলেন শরৎচন্দ্র। ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হ’তে লাগল “রামের সুমতি”, “চন্দ্রনাথ”, “পথনির্দেশ” ও “বিন্দর ছেলে” প্রভৃতি বড় গল্প ও উপন্যাস। তার কয়েক বৎসর আগে (১৩১৪ সালে) “ভারতী” পত্রিকায় “বড়দিদি” নামে শরৎচন্দ্রের একটি পরাতন রচনা প্রকাশিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁর অজ্ঞাতসারেই। সুতরাং অনায়াসেই বলা যেতে পারে যে, “ভারতী”র পৃষ্ঠায় শরৎচন্দ্র প্রথম আত্মপ্রকাশ করেননি।
এর অল্পদিন পরেই “যমুনা”র কর্ণধার স্বর্গীয় ফণীন্দ্রনাথ পাল পত্রিকা সম্পাদনায় সাহায্য করবার জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ করলেন। আমিও গিয়ে হাজির হলুম “যমনা”র বৈঠকে। তারপর আমাদের দলের বাকি কয়জনও আসন পাতলেন সেই আসরেই। তারপর রুমেই আমাদের দল বৃহত্তর হয়ে উঠতে লাগল। কারণ “যমুনা”র মজলিসে ওঠা-বসা করতেন স্বর্গীয় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বর্গীয় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বর্গীয় রসময় লাহা, স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বর্গীয় মোহিতলাল মজুমদার, শ্রীউপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্রীসৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক। তারপর নৈবেদ্যের উপরে চূড়া সন্দেশের মত “যমুনা”র আসরে এসে আসীন হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিছুকাল পরে আমাদের দল পুষ্ট হয়ে উঠল অধিকতর। দলের নূতন বৈঠক বসতে লাগল “ভারতী” কার্যালয়ে। আগেকার কেহই দলছাড়া তো হলেনই না, উপরন্তু প্রমথ চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র সেন, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, সুকুমার রায়চৌধুরী, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণধন চট্টোপাধ্যায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি স্বর্গীয় মনীষিগণও শোভাবর্ধন করতেন আমাদের দলের মধ্যে। আসতেন ভাষাতত্ত্ববিদ্ শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কবি শ্রীনরেন্দ্র দেব ও নজরুল ইসলাম। আসতেন চিত্রশিল্পী শ্রীঅসিতকুমার হালদার ও শ্রীদেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী এবং নাট্যাচার্য শ্রীশিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং স্বর্গীয় নাট্যশিল্পী রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায় ও নির্মলেন্দু লাহিড়ী। মোট কথা, তখন আমাদের দলের মত শক্তিশালী বৃহৎ ও বিখ্যাত দল বাংলা দেশের আর কোথাও ছিল না এবং তারপর আজ পর্যন্ত তেমন দল আর গঠিত হয়নি। চুম্বকের দিকে যেমন লৌহের আকর্ষণ অবশ্যম্ভাবী, আমাদের সেই দলের দিকে তেমনি আকৃষ্ট হ’ত সর্বশ্রেণীর সাহিত্যিক ও শিল্পীর দৃষ্টি। সেখানে আসন লাভ করবার জন্যে সকলেই আগ্রহ প্রকাশ করতেন, কিন্তু সে সৌভাগ্য লাভের সুযোগ পেতেন না সকলেই।
যশস্বী সাহিত্যিক শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় বয়সে যখন অতি তরুণ ছিলেন, তাঁর তখনকার মনের কথা তিনি এইভাবে ব্যক্ত করেছেনঃ “(ভারতীর) ইলেকট্রিক চায়ের কেটলীর চারিদিকে যে সাহিত্য-পরিবার গড়িয়া উঠে, বাংলা সাহিত্যের জীবনে তাহা একটি নূতন সাহিত্যিক অনুভূতি আনিয়া দিয়াছে। * * * আমি জানি একটি কিশোর মনে “ভারতী”র এই সঙ্ঘ কি সুন্দর পরিকল্পনার খোরাক জোগাইত! প্রয়োজনবাদের সাগরের মধ্যে সেই সঙ্গটুকু সুন্দরের মন্দির বলিয়া মনে হইত। একদল লোক—একই অনুভূতি তাহাদের, একই সাধনা তাহাদের, একই প্রতিবন্ধক তাহাদের, একই মৈত্রীর বন্ধনে বন্ধ। বাংলার সাহিত্যজীবনে এই মৈত্রী-সাধনার যে কতখানি প্রয়োজন তাহা যাঁহারা বাংলা-সাহিত্যের ভিতরের সহিত সামান্য পরিচিত তাঁহারাই বুঝিতে পারিবেন। ”
আমাদের দলের পরে সাহিত্যসমাজে উল্লেখযোগ্য আর একটিমাত্র নূতন দল আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তা হচ্ছে “কল্লোলে”র দল। আমাদের দলের তুলনায় তা অনেক ছোট হ’লেও উল্লেখযোগ্য, কারণ তার ভিতর থেকে দেখা দিয়েছেন কয়েকজন নূতন ও শক্তিশালী সাহিত্যিক। যে দল নূতন সাহিত্যিক গড়তে পারে না, তার সার্থকতা অল্প। আমাদের দল কোনদিনই গতানুগতিক ছিল না। ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে তা অভিনন্দন দিতে পারত। সেইজন্যেই আমাদের দলেরও কয়েকজন “কল্লোল” পত্রিকার লেখকশ্রেণীভুক্ত হ’তে ইতস্ততঃ করেননি। পরে যথাসময়ে “কল্লোলে”র দল নিয়েও আলোচনা করব।
কিন্তু আমাদের দল আর নেই। দলের অধিকাংশই আজ স্বর্গত। “যাঁদের দেখেছি” শীর্ষক প্রবন্ধমালায় তাঁদের অনেকেরই কথা নিয়ে আলোচনা করেছি। বাকি যাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আজও বিদ্যমান আছেন তাঁরাও হয়েছেন জরাগ্রস্ত, যৌবনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা থেকে বঞ্চিত; দূরে দূরে বিক্ষিপ্ত হয়ে জীবনযুদ্ধে নিযুক্ত থেকে কেউ আর কারুর খবর বড় রাখতে পারেন না, হয়তো সমুজ্জ্বল অতীতের স্বপ্ন দেখেই পরিতৃপ্ত হয়ে থাকেন। তাঁদেরও কয়েকজনের কথা বর্তমান নিবন্ধমালায় আলোচিত হয়েছে। কিন্তু আরো কারুর কারুর কথা এখনো বলা হয়নি। সেই কথা ব’লে আমাদের দলের প্রসঙ্গ শেষ করব।
“জাহ্নবী” কার্যালয়ে আমাদের দল গড়ে ওঠবার কয়েক বৎসর আগেই শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমার বয়স তখন ষোলো-সতেরোর বেশী হবে না। প্রভাতের আরো কম। আমি তখন কোন কোন ছোট কাগজের লেখক এবং আমার রচিত একখানি ক্ষুদ্র পুস্তিকাও যন্ত্রস্থ হয়েছে—নাম তার “আমাদের জাতীয় ভাব।” বঙ্গবিভাগের পরে সারা দেশে তখন সুরু হয়েছে প্রবল স্বদেশী আন্দোলন এবং তখনকার অধিকাংশ যুবকের মত আমিও সেই আন্দোলনে মেতে উঠেছি। তখন সরকারী বাগানগুলিতে বৃটিশ-সিংহকে বাক্যবন্দুকের বুলেটের দ্বারা ঘায়েল করবার জন্যে প্রতিদিন বৈকালেই অগণ্য সভার আয়োজন করা হ’ত এবং আর সকলকার মত আমিও ছিলুম সে সব সভার একজন নিয়মিত শ্রোতা।
বিডন বাগানে টহলরাম নামে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের নেতৃত্বে প্রত্যহই হ’ত সভার অধিবেশন। তিনি বাংলা জানতেন না, কিন্তু ইংরেজীতে “Curzon and Curzonians"-এর বিরুদ্ধে যে সব গরম গরম বচন ঝাড়তেন, জনসাধারণের পক্ষে সেগুলি হ’ত অত্যন্ত শ্রবণরোচক। টহলরামের পর সেখানে আরো কেউ কেউ বক্তৃতা দিতেন এবং তাঁদের মধ্যে প্রভাত ছিলেন অন্যতম। বয়সে তখন তাঁকে কিশোর বলাই চলত, কিন্তু সেই বয়সেই তাঁর মুখের উপরে বিরাজ করত দাড়িগোঁফের গভীর অরণ্য। এবং সেই বয়সেই তিনি জনসভায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন অকুতোভয়ে।
কেমন ক’রে আমরা দু’জনেই যে দু’জনের দিকে আকৃষ্ট হলুম তা আর স্মরণে আসে না। তবে এইটুকু আমার মনে আছে যে, আমার রচিত পুস্তিকাখানি তিনি সভার শ্রোতাদের মধ্যে হাতে হাতে বিক্রয় করবার ভার নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি, কারণ টহলরাম হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে সমস্ত ভেস্তে দিলেন। কারুর কারুর মুখে শুনলুম, তিনি ছিলেন ইংরেজদের গপ্তচর। সম্ভবতঃ মিথ্যা গুজব।
কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রভাতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে। কখনো টহলরামের বাসায় তাঁদের কার্যালয়ে গিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে গল্প ক’রে আসতুম এবং কখনো তিনি এসে দেখা দিতেন আমার পাথুরেঘাটার বাড়ীতে।
তারপর “জাহ্নবী” কার্যালয়ে গিয়ে প্রভাতের আরো কোন কোন বিশেষত্বের সঙ্গে পরিচিত হলুম। অল্প বয়সেই তিনি সমসাময়িক পাশ্চাত্য সাহিত্যকে রাখতে পেরেছিলেন নিজের নখদর্পণে। তিনি ছিলেন প্রায় সর্বদর্শী, প্রেমাঙ্কুর তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন “সবজান্তা লরেন্স।” কি সাহিত্য, কি ললিতকলা, কি রাজনীতি, কি ইতিহাস, কি নাট্যশিল্প, কি খেলাধূলো, প্রত্যেক বিভাগেই নূতন নূতন তথ্য সংগ্রহের জন্যে তাঁর আগ্রহ ছিল উদগ্র। তর্ক এবং গলাবাজিতেও তিনি যে কি-রকম তুখড় ছিলেন, শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থীর প্রসঙ্গে আগেই দিয়েছি তার অল্পবিস্তর নমুনা।
বাংলাদেশে যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে একজন অদ্বিতীয় লেখক আত্মপ্রকাশ করেছেন, “জাহ্নবী” কার্যালয়ে এসে এ খবর সর্বপ্রথমে দেন প্রভাতচন্দ্রই। সে সময়ে এই সংবাদ দিকে দিকে প্রচার করবার জন্যে প্রভাতের যে বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করেছি তাও উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদারের কাছে গিয়ে তিনি শরৎচন্দ্রের রচনা পাঠ ক’রে শুনিয়ে আসেন। বিস্মিত ও মুগ্ধ বিজয়চন্দ্র সেই অভাবিত আবিষ্কারের সংবাদ জানান কবিবর ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালকে এবং তিনিও শরৎচন্দ্রের অসাধারণ রচনাচাতুর্যের পরিচয় পেয়ে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন। প্রভাতচন্দ্র প্রভৃতির মৌখিক বিজ্ঞাপনের মহিমাতেই শরৎচন্দ্রের নাম প্রায় বিদ্যুৎ গতিতেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু প্রভাতচন্দ্র চিরদিনই মুখফোড়। যত বড় লোকই হোন, কারুর যুক্তিহীন উক্তিই তিনি সহ্য করতে একান্ত নারাজ। আমি যখন মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত “মর্মবাণী” পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, সেই সময়ে তাঁর কার্যালয়ে ব’সে শরৎচন্দ্র একদিন বললেন, “রবীন্দ্রনাথ “ঘরে-বাইরে” লিখেছেন। তোমরা দেখে নিও, আমি এবারে যে উপন্যাস লিখব, “ঘরে-বাইরে”র চেয়ে ওজনে তা একটাও কম হবে না।”
প্রভাতচন্দ্র অমনি তাঁর মুখের উপরে ব’লে বসলেন, “সবুজ পত্রে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস এখনো শেষ হয়নি, আর আপনার উপন্যাস এখনো লেখাই হয়নি। তবু, এমন কথা আপনি কি ক’রে বলছেন!” শরৎচন্দ্র কোন যুৎসই জবাব দিতে পারলেন না এবং তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীও সফল হয়নি। তাঁর পরের উপন্যাসের নাম “গৃহদাহ”। তা “ঘরে-বাইরে”র সমকক্ষ হ’তেও পারেনি, বরং তার মধ্যে আছে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা চিত্রিত একটি বিখ্যাত চরিত্রের স্পষ্ট অনুকরণ। শরৎচন্দ্র একখানি পত্রে নিজেই সেই অনুকরণকে চুরির নামান্তর ব’লে স্বীকার করেছেন!
আমি বরাবরই লক্ষ্য ক’রে এসেছি, উচ্চশ্রেণীর সাংবাদিক ও সম্পাদকের যে সব গুণ থাকা উচিত, প্রভাতচন্দ্রের মধ্যে ছিল তা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত তিনি নিজের উপযোগী ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করবার সুযোগ পাননি, নানা বৈঠকে লক্ষ্যহীনের মত বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ও তর্কাতর্কি ক’রে এবং কাঁড়ি কাঁড়ি বই পড়ে জীবনের দীর্ঘকাল কাটিয়ে দিয়েছেন। তারপর পরিণত বয়সে “আনন্দবাজার পত্রিকা”র সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম হয়ে সাংবাদিকের কাজ সুরু করেন এবং তারপর দৈনিক “ভারতে”র সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হন। তিনি বিশেষ যোগ্যতার সঙ্গেই নিজের কর্তব্যপালন করেছিলেন। কিন্তু পরে “ভারত' নিষিদ্ধ পত্রিকায় পরিণত ও তার অস্তিত্ব বিলপ্ত হয়। বোধ করি পত্রিকা সম্পর্কীয় কোন কারণের জন্যেই কিছুকাল তাঁকে কারাবরণ ও করতে হয়।
রাজনীতি নিয়ে তিনি কিশোর বয়স থেকেই মাথা ঘামিয়ে এসেছেন এবং প্রাচীন বয়সে বিধান সভার সভ্যপদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচন-দ্বন্দ্বেও যোগদান করেছেন।
আজও প্রভাতচন্দ্রের প্রকৃতি, কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি একটুও পরিবর্তিত হয়নি। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হয়, তাঁর দুর্দান্ত আকার, এলোমেলো পাকা চুল ও ঘন দাড়িগোঁফের মধ্যে ফিরিয়ে পাই সেই নবীন ও পরাতন প্রভাতচন্দ্রকেই।