এখন যাঁদের দেখছি/করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়

তিন

করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়

 জীবনসন্ধ্যায় কবি করুণানিধান লাভ করেছেন জগত্তারিণী পদক। পদক বা উপাধি দিয়ে প্রমাণিত করা যায় না কোন কবির শ্রেষ্ঠতা। তবে রসিকজনসমাজে কবি যে উপেক্ষিত হননি, এইটুকুই বোঝা যেতে পারে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একাধিক কবি ঐ পদক লাভ না ক’রেই ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন। এজন্যে তাঁদের উচ্চাসনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়নি, কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে আমাদের গুণগ্রাহিতারই অভাব।

 নেপোলিয়ন বোনাপার্ট’ অবজ্ঞাপ্রকাশ ক’রে বলেছিলেন, “ইংরেজরা হচ্ছে দোকানদারের জাত।” কিন্তু একসময়ে ইংলণ্ড ছিল কবিদের দেশ ব’লে বিখ্যাত। নেপোলিয়নের যুগে ফরাসীদেশে যে সব কবি ছিলেন, তাঁদের নাম আর শোনা যায় না। কিন্তু ইংলণ্ডের কাব্যকুঞ্জ মুখরিত হয়ে উঠেছিল (বার্ণস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, সাদে, ব্লেক, বাইরণ, শেলি ও কীটস প্রভৃতি) কবিদের কলসঙ্গীতে।

 ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাদেশও বরাবর কবিদের দেশ ব’লে স্বীকৃত হয়ে এসেছে। রাজ্যবিপ্লব বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের যুগেও বাঙালী কবিদের গান স্তব্ধ হয় নি। বাংলা দেশের শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভায় সর্বদাই শোনা যেত কাব্যগুঞ্জন। বাংলার উপরে যখন ইসলামের পূর্ণ-প্রভাব, তখনও বাংলার আকাশবাতাস পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বৈষ্ণব কবিদের বীণার ঝঙ্কারে। তারপর আবার পলাশীর প্রান্তরে হ’ল যখন আর এক বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয়, তখনও মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় কবিদের আসন শূন্য থাকে নি।

 ইংরেজ আমলের নূতন বাংলায় দেখি কবি ঈশ্বর গুপ্তকে। তাঁর আগেই কবি রামনিধি গুপ্ত কাব্যসঙ্গীত রচনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং কবিত্বের দিক দিয়ে তা ছিল ঈশ্বর গুপ্তের রচনার চেয়ে উচ্চতর। কিন্তু কেবল কবিরূপে নয়, সাহিত্যাচার্যরূপেই ঈশ্বর গুপ্ত অর্জন করেছিলেন সমধিক খ্যাতি। বিলাতে লেখক জনসনকে নিয়ে কেউ আজ মাথা ঘামায় না, কিন্তু সাহিত্যাচার্য ডাঃ জনসন হয়েছেন অক্ষয় যশের অধিকারী। ঈশ্বর গুপ্তও ঐ কারণেই অমর হয়ে থাকবেন। কেবল বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্র নয়, সে যুগের সমস্ত নবীন কবিদের উপরেই যে তাঁর প্রভাব ছিল, বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি থেকেই এটা আমরা জানতে পারি। তারপর একে একে দেখা দিলেন মাইকেল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রঙ্গলাল, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারবিহারীলাল চক্রবর্তীকামিনী রায় প্রভৃতি।

 এল গৌরবময় রবীন্দ্র-যুগ। কিন্তু এ-যুগে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলেও আরো যে-সব উচ্চশ্রেণীর কবির নাম করা যায়, তাঁদের মধ্যে প্রধান তিনজন হচ্ছেন দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়ালদ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সেইসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, গোবিন্দচন্দ্র দাস, রমণীমোহন ঘোষ, প্রমথনাথ রায় চৌধুরীরজনীকান্ত সেন প্রভৃতিকেও ভুললে চলবে না এবং বলা বাহুল্য, এই ফর্দ সম্পূর্ণ নয়; উল্লেখযোগ্য পুরুষ ও মহিলা কবি ছিলেন আরো কয়েকজন।

 তারপরেও ধারা ঠিক বজায় রইল। পূর্ববর্তী কবিদের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথকে গুরুর আসনে বসিয়ে দেখা দিলেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও শ্রীকরুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, শ্রীকুমুদরঞ্জন মল্লিক, শ্রীযতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, শ্রীকালিদাস রায় ও শ্রীমোহিতলাল মজুমদারও তাঁদের সমসাময়িক— দেখা দিয়েছেন কেউ কিছু আগে বা কেউ কিছু পরে। আসল কথা, বাঙালী কবিদের শোভাযাত্রা অব্যাহত হয়েই আছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

“শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা!
শত শত গীত-মুখরিত বন-বীথিকা।”

 করুণানিধান সম্বন্ধে একজন লিখেছেন: “ইনি পঞ্চকোট পাহাড়ের উপরে আদরা ষ্টেশনের কাছে ‘শৈলকুটীর’ নামে একটি আশ্রম নির্মাণ করেন। এইখানেই ইঁহার কবিতার প্রথম বিকাশ।”

 শৈল সানুদেশে অনন্ত নীলিমার তলায় নিরালা পর্ণকুটীর, চোখের সামনে হয়তো জাগত প্রান্তরবাহিনী রবিকরোজ্জ্বলা নটিনী তটিনী, শ্রবণে হয়তো ভেসে আসত বিজন কান্তারের অশ্রান্ত মর্মরসঙ্গীত। এই প্রাকৃতিক পটভূমিকার উপরে তরুণ কবির চিত্ত-শতদল ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে ওঠবারই কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় করুণানিধানের প্রথম জীবনের কোন খবরই আমি রাখি না, কারণ আমি ভূমিষ্ঠ হবার প্রায় এক যুগ আগেই তিনি দেখেছিলেন পৃথিবীর আলোক। পরে কবির সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম বটে, কিন্তু তিনি তাঁর পূর্বজীবনের কথা নিয়ে কোনদিন আমার সঙ্গে ঘুণাক্ষরেও আলোচনা করেন নি। এমন অনেক কবি ও লেখক দেখেছি, যাঁদের কাছে হচ্ছে নিজের কথাই পাঁচ কাহন। তাঁদের এই অশোভন আত্মপ্রকাশের অতি আগ্রহ যে শ্রোতাদের শ্রবণ-যন্ত্রকে উত্যক্ত ক’রে তুলছে, এটা উপলব্ধি করলেও তাঁরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন না। করুণানিধান এ দলের লোক নন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হয়, তিনি যেন নিজেকে একজন উঁচু দরের কবি ব’লেই জানেন না। বীণা তো জানে না, সে হচ্ছে স্বর্গীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা, সে কথা জানে কেবল বীণাবাদক। কবি করুণানিধানও হচ্ছেন বাণীর হাতের বীণাযন্ত্রের মত।

 যতদূর স্মরণ হয়, করুণানিধান যখন উদীয়মান, সত্যেন্দ্রনাথ তখনও কাব্যজগতে প্রকাশ্যভাবে দেখা দেন নি। তবে যতীন্দ্রমোহন বাগচী পরিচিত হয়েছিলেন তাঁর আগেই। সর্বপ্রথমে “বঙ্গমঙ্গল” নামে একখানি ছোট কবিতার বই পড়ে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় করুণানিধানের দিকে। রবীন্দ্রনাথের নব পর্যায়ের “বঙ্গদর্শন” তখনও বোধ হয় চলছিল। তারপর “প্রসাদী” (সে বইখানিও আকারে বড় নয়) পাঠ ক’রে আমি তাঁর ভক্ত হয়ে পড়লুম।

 মৃত্যুশয্যাশায়ী কবি রজনীকান্ত যখন রোগযন্ত্রণাগ্রস্ত দেহ থেকে নিজের চিত্তকে বিযুক্ত ক’রে অতুলনীয় কাব্যসাধনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেই সময়েই একদিন কবি মোহিতলালের সঙ্গে গিয়ে করুণানিধানের সঙ্গে পরিচিত হলুম। সে হচ্ছে ১৩১৬ কি ১৩১৭ সালের কথা। হেদুয়া পুষ্করিণীর দক্ষিণ দিকে ছিল স্বর্গীয় পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এডওয়ার্ড ইনষ্টিটিউশনের বাড়ী—স্কুলের অস্তিত্ব তখন ছিল কি ছিল না বলতে পারি না। দোতালার বারান্দায় হুঁকো নিয়ে উবু হয়ে ব’সে করুণানিধান ধূমপান করছিলেন। বয়সে তখন তিনি যৌবনসীমা পার হননি, কিন্তু বয়সোচিত কোন সৌখীনতার লক্ষণই তাঁর মধ্যে খুঁজে পেলুম না। শ্যামবর্ণ দীর্ঘ একহারা দেহ, পরনে ইস্ত্রিহীন ছিটের কোট ও আধময়লা কাপড়। মাথায় অযত্ন বিন্যস্ত চুল, মুখে দাড়ীগোঁফের ভিতর দিয়ে থেকে থেকে ফুটে ওঠে সরল, মিষ্ট, মৃদু হাসি। দৃষ্টি ও চেহারা অত্যন্ত নিরভিমান। কবি নয়, নিরীহ ও সাধারণ স্কুলমাষ্টারের চেহারা এবং কলকাতার সহরতলীতে তখন তিনি সত্য সত্যই কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদে বাহাল ছিলেন।

 এমন মানুষের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলতে বিলম্ব হয় না। তারপর তাঁর সঙ্গে দেখা হ’তে লাগল ঘন ঘন। কখনো অমূল্যবাবুর বাড়ীতে, কখনো তাঁর নিজের বাড়ীতে। দু-একবার তিনি আমার বাড়ীতেও এসে হাজির হয়েছেন। সর্বদাই আত্মভোলা ভাবুকের ভাব, অথচ দৃষ্টি দেখলে মনে হয় যেন তা অন্তর্মুখী, যেন তিনি মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোন হারিয়ে যাওয়া রূপের স্বপ্ন। তাঁর কবিতাগুলিই প্রমাণিত করবে, তিনি ছিলেন নিছক সৌন্দর্যের পূজারী, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দারিদ্র্য ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না। কেবল তাঁর জামাকাপড়ই অত্যন্ত স্থূল ও আটপৌরে ছিল না, তাঁর বসতবাড়ীতেও ছিল না সাজসজ্জা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোন বালাই। কিন্তু চিত্ত যার রূপগ্রাহী, ধূলিশয্যায় শয়ন ক’রেও সে দৃষ্টি নিবদ্ধ ক’রে রাখতে পারে উদার আকাশের নির্মল নীলিমার দিকে।

 করুণানিধানের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করেছি যে কতদিন, তার আর সংখ্যা হয় না। তিনি কেবল নির্বিরোধী ও কোনরকম দলাদলির বাইরে ছিলেন না, তাঁর মনও ছিল ঈর্ষা থেকে সম্পূর্ণ নির্মুক্ত। একদিনও তাঁকে অন্য কবির বিরুদ্ধে একটিমাত্র কথা বলতে শুনি নি, অধিকাংশ কবিই যে দুর্বলতা দমন করতে পারেন না।

 করুণানিধানের প্রথম জীবনের বন্ধু, স্বর্গীয় সাহিত্যিক চারুচন্দ্র মিত্র একদিন আমাকে বললেন, “করুণার কাছ থেকে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত কবি (তাঁর নাম এখানে করলুম না) তাঁর নূতন কবিতার খাতা পড়বার জন্যে চেয়ে নিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে খাতাখানা আবার ফিরে এল বটে, কিন্তু তাঁর রচনাগুলি ছাপা হবার আগেই দেখা গেল, সেই বিখ্যাত কবির নবপ্রকাশিত কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে করুণার নিজের উদ্ভাবিত সব বাক্য।” সাহিত্যক্ষেত্রে রচনাচৌর্যের দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। আমাকেও এজন্যে একাধিকবার বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়েছে, কিন্তু তবু আমি উচ্চবাচ্য করিনি এবং এ শিক্ষা লাভ করেছি আমি করণানিধানের কাছ থেকেই। ঐ বিখ্যাত কবি ছিলেন আমাদের দুজনেরই বন্ধু। কিন্তু করুণানিধানের নিজের মুখ থেকে তাঁর ঐ কবিবন্ধুর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই শ্রবণ করি নি।

 করুণানিধান কবিতা, তার আদর্শ বা তার রচনা-পদ্ধতি প্রভৃতি নিয়ে বড় বড় ও ভারি ভারি বচন আউড়ে কোনদিন আসর গরম করবার চেষ্টা করেন নি। ও-সব বিষয়ে তাঁর একান্ত মৌনব্রত দেখে যে কোন বাক্তি সন্দেহ করতে পারত যে, উচ্চশ্রেণীর কাব্যকলা সম্বন্ধে হয়তো তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁকে একান্তে পেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠের কাছে তরুণ শিক্ষার্থীর মত আমি কাব্যকলাকৌশল সম্বন্ধে যখন প্রশ্ন করতুম, তখন তিনি সে সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পারিতেন না এবং সেই সব উত্তরের মধ্যেই থাকত কবিতার আর্ট ও ছন্দ সম্বন্ধে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য। এইজন্যে আজও তাঁর কাছে আমার ঋণ স্বীকার করতে পারি অকুণ্ঠ কণ্ঠেই।

 এবং তিনি যে কত বড় কাব্যকলাবিদ, তাঁর কবিতাবলীর মধ্যেই আছে তার অজস্র প্রমাণ। “প্রসাদী”র পর যখন তাঁর নূতন কবিতার পুঁথি “ঝরাফুল” প্রকাশিত হ’ল, রসিকসমাজ তখনই পেলেন করুণানিধানের প্রতিভার প্রকৃত হদিস। তখনকার সাহিত্যিকদের মধ্যে রীতিমত সাড়া প’ড়ে গিয়েছিল। সেটা বোধ করি ১৩১৮ সাল। “ঝরাফুল” পাঠ ক’রে ধুরন্ধর কবিবর দেবেন্দ্রনাথ সেন মতপ্রকাশ করেছিলেনঃ

 “অমর কবি মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনা কাব্যের মত এ কাব্যখানি মাধুর্যে পরিপূর্ণ। কবির যেমন শব্দসম্পদ, তেমনই ভাববৈভব। কবি প্রকৃতি দেবীর অপূর্ব উপাসক। এ পূজায় কৃত্রিমতা নাই। মাতাল যেমন মদিরা পানে উন্মত্ত হইলে নিজ শরীরের প্রতি দৃষ্টি রাখে না, এ কবিও তেমনি প্রকৃতি-দেবীর সৌন্দর্যসুধা পান করিয়া বিভোর হইয়া যান— প্রকৃত সাধক-জনোচিত তন্ময়তা লাভ করেন। এই আত্মবিস্মৃতিই উচ্চ অঙ্গের কাব্যের একটি অপরিহার্য লক্ষণ। এইজন্যই কোন সুবিখ্যাত মহাত্মা বলিয়াছেন— “Oratory is heard, but Poetry is overheard.” * * এ কবিতাসন্দরী দর্শন দিবামাত্রই চিত্ত হরণ করে। ইহাকে দেখিলেই হৃদয়ে এক অননভূত আনন্দের উদয় হয়। এ মোহিনী আদিনারী Eve সুন্দরীর মত লাবণ্যবতী। প্রথম দর্শনে চিত্ত বিস্ময়ে অভিভূত হয়। ‘মহিলা’ কাব্যের কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মত বলিয়া উঠিতে ইচ্ছা করে—

এলোকেশে কে এল রূপসী?
কোন্ বনফুল, কোন গগনের শশী?”

 “ঝরাফুলে”র মালা শুকিয়ে যায় নি, সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসর পরে আজও তা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে চিত্ত পরিপূর্ণ হয়ে যায় সৌরভের গৌরবে। এই কাব্যগ্রন্থখানিই নিশ্চিতভাবে প্রতিপন্ন করলে যে, বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে করুণানিধানও হচ্ছেন অন্যতম। তারপর প্রকাশিত হয় তাঁর “শান্তিজল”, “ধানদুর্বা” ও “রবীন্দ্র-আরতি” প্রভৃতি। এগুলি তাঁর কণ্ঠহারের আরো কয়েকটি রত্ন।

 দেবেন্দ্রনাথ ঠিকই ধরেছেন। করুণানিধান হচ্ছেন “প্রকৃতিদেবীর অপূর্ব উপাসক। এ পূজার কৃত্রিমতা নাই।” প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে প্রত্যেক কবিই আকৃষ্ট হন অল্পবিস্তর মাত্রায়। কিন্তু সে আকর্ষণের মধ্যে আছে যথেষ্ট পার্থক্য। অনেকেই আর্টের কৃত্রিমতা দ্বারা স্বভাবকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলেন, স্বভাব হয় না স্বতঃস্ফূর্ত। এখানে স্বভাব বলতে আমি বোঝাতে চাই নিসর্গকেই। করুণানিধানের কাব্যে যে নিসর্গ-শোভা ফুটে ওঠে, তার মধ্যে পাওয়া যায় কবির স্বাভাবিক রক্তের টান ও নাড়ীর স্পন্দন। তাঁকেই বলি সত্যিকার স্বভাবকবি। এবং ছোটখাটো খুঁটিনাটির ভিতর দিয়ে বৃহত্তর প্রকৃতির শব্দস্পর্শ গন্ধ ও রূপরসছন্দ প্রকাশ করবার জন্যে তিনি ভাবুকের মত বেছে বেছে যে সব শব্দ উদ্ভাবন করেন, তার মধ্যেও থাকে খাঁটি কলাবিদের হাতের ছাপ। বাংলার কাব্যজগতে তাঁর মত নিসর্গ-চিত্রকর সুলভ নয়।

 কবিবর দেবেন্দ্রনাথ আত্মবিস্মৃতিকে উচ্চাঙ্গ কাব্যের অপরিহার্য লক্ষণ বলেছেন। কিন্তু কেবল কাব্যে নয়, করুণানিধানের ব্যক্তিগত জীবনেও যে আত্মবিস্মৃতির পরিচয় পাওয়া যায়, সাধারণের কাছে তা কৌতুকপ্রদ ব’লে মনে হ’তে পারে। কবির (এবং আমারও) বন্ধু পূর্বোক্ত চারুবাবু আর একদিন আমাকে বলেছিলেন, “করুণার কাণ্ডের কথা শুনেছেন? সেদিন দেখি সে আনমনার মত হেদোর চারিদিকে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে হেঁট হয়ে রাস্তা থেকে কি সব কুড়িয়ে নিচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখলুম তার কোটের পকেট রীতিমত ফুলে উঠেছে। পকেট হাতড়ে পাওয়া গেল একরাশ ঢিল, পাটকেল, নুড়ি।” এমন অবোধ শিশুর মত সরলতা বোধ হয় আর কোন বাঙালী কবির মধ্যে আবিষ্কার করা যাবে না।

 করুণানিধানের সঙ্গে দেখা হয়নি সুদীর্ঘকাল। কার্য থেকে অবসর নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন স্বগ্রাম শান্তিপুরে, তাঁর প্রিয় মুখ দেখবার সৌভাগ্য থেকে আমাদের বঞ্চিত ক’রে এবং ততোধিক দুঃখের বিষয় এই যে, জরাজর্জর হবার আগেই ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাঁর কাব্যরচনার প্রেরণা। পনেরো কি বিশ বৎসরের মধ্যে কদাচিৎ তাঁর দু-একটি রচনা চোখে পড়েছে, কিন্তু সেগুলির মধ্যে “ঝরাফুল” প্রণেতার শীলমোহর খুঁজে পাই নি। কবি আছেন, কিন্তু কবিতা নেই। দুর্ভাগ্য।