এখন যাঁদের দেখছি/গামা, হাসানবক্স, ছোট গামা
চার
গামা, হাসানবক্স, ছোট গামা
এবার আমরা প্রবেশ করব মল্লসভার মধ্যে। কিন্তু মাভৈঃ, আপনাদের কারুকে আমি ‘বীরমাটি’ মাখবার জন্যে আহ্বান করব না। ‘বীরমাটি’ কাকে বলে জানেন তো? আখড়ায় যে-মৃত্তিকাচূর্ণের উপরে দাঁড়িয়ে পালোয়ানেরা কুস্তি লড়ে। সেই মাটি গায়ে মর্দন করে যোদ্ধারাই।
স্রষ্টা আমার দেহখানিকে যৎপরোনাস্তি একহারা ক’রে গ’ড়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীতে। কিন্তু ভ্রমক্রমে আমার মনকে দেহের উপযোগী ক’রে গঠন করেন নি। শেষ পর্যন্ত মসীজীবী লেখক হয়েই জীবনসন্ধ্যায় বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হয়েছি বটে, কিন্তু আমার বুকের মধ্যে যে মনের মানুষটি বাস করে সকলের অগোচরে, চিরদিনই সে আসীন হ’তে চেয়েছে কাপালিকের বীরাসনে। সত্য বলছি, অত্যুক্তি নয়।
অবশ্য তালপাতার সেপাইরাও দিবাস্বপ্ন দেখে এবং পুরু, গদীর উপরে নিশ্চেষ্টভাবে তাকিয়া আঁকড়ে ব’সে দিগ্বিজয়ে যাত্রা করে। আমি কিন্তু কোনকালেই তাদের দলের লোক নই। ছেলেবেলা থেকেই নামজাদা ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট-হকি-ফুটবল খেলেছি, সাঁতার দিয়ে গঙ্গার এপার-ওপার হয়েছি, জিমনাষ্টিক নিয়ে মেতেছি, ‘গ্রিপডাম্বেল’ ও মুগুর ভেঁজেছি, ‘চেষ্ট-এক্সপ্যাণ্ডার’ ও ‘বার-বেল’ ব্যবহার করেছি এবং ডন-বৈঠক দিয়েছি। অর্থাৎ বলীদের মধ্যে একটা কেওকেটা হবার জন্যে চেষ্টার কোন ত্রুটিই করি নি। চোখের সামনেই ব্যায়াম ক’রে কত একহারা ছোকরা দেখতে দেখতে দোহারা, তারপর তেহারা হেয় উঠল, আমি কিন্তু বরাবরই হয়ে রইলাম মূর্তিমান ভদ্রলোকের-এককথার মত একেবারেই একহারা। নাট্যকার অমৃতলাল যাকে “ভীম ভবানী” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, বাল্যকালে বিদ্যালয়ে সে আমার সহপাঠী ছিল। সে তখনও আমার মত একহারা ছিল না বটে কিন্তু সেই দেহের তুলনায় পরে তার যে চেহারা হয়েছিল, তা অবিশ্বাস্য বলা যেতেও পারে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে মনে হ’ত যেন মাতঙ্গের পাশে পতঙ্গ।
বলবান লোকদের দেখবার জন্যে বরাবরই আমার মনের ভিতরে আছে উদগ্র আগ্রহ। বাল্যকাল থেকেই এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় নানা আখড়ায় কুস্তি লড়া দেখতে যেতুম। কোথাও দঙ্গলের ব্যবস্থা হয়েছে শুনলে সেখানে যাবার প্রলোভন কিছুতেই সংবরণ করতে পারতুম না। বহুকাল (অর্দ্ধ শতাব্দীরও) আগে কলকাতার মার্কাস স্কোয়ারে কাল্লুর সঙ্গে কিক্কর সিংয়ের কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়। তখন গামার নাম কেউ জানত না, কিন্তু কাল্লু ও কিক্কর ছিলেন ভারতবিখ্যাত। টিপে টিপে মায়ের পা ব্যথা ক’রে দিয়ে কত খোসামোদের ও অশ্রুত্যাগের পর যে সেই কুস্তি দেখবার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেছিলুম, তা আজও আমার স্মরণ আছে।
কিক্করের চেহারা ছিল যেমন কুৎসিত, তেমনি ভয়াবহ। মাথায় তিনি সাড়ে ছয় ফুটের চেয়ে কম উঁচু ছিলেন না এবং চওড়াতেও তাঁর দেহ ছিল যে কতখানি, বললে সে কথা কেউ বোধ হয় বিশ্বাস করবেন না (বিশেষজ্ঞের মুখে শুনেছি, তাঁর বুকের ছাতির মাপ ছিল আশী ইঞ্চি— যে কথা শুনলে স্যাণ্ডো সাহেবও নিশ্চয় বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারতেন না)। আমি অনেক বড় বড় পালোয়ান দেখেছি, কিন্তু লম্বায়-চওড়ায় তাঁদের কেউই কিক্কর সিংয়ের সমকক্ষ নন। কাল্লু ও ছিলেন বিপুলবপু, কিন্তু তাঁর বিপুলতা কিক্করের সামনে মোটেই দৃষ্টি আকর্ষণ করত না। কাল্লু যে কিক্করকে হারাতে পারবেন, দেখলে তা কিছুতেই মনে করা যেত না। বর্তমান নিবন্ধমালায় স্বর্গীয় গুণীদের নিয়ে আলোচনা করবার কথা নয়, অতএব আমি সে মল্লযুদ্ধের বর্ণনা দিতে চাই না। কেবল এইটুকুই ব’লে রাখলেই যথেষ্ট হবে যে, ডেভিডের কাছে গোলিয়াথের মত কাল্লুর কাছে কিক্করও হয়েছিলেন পরাভূত।
তার কয়েক বৎসর পরে মিনার্ভা রঙ্গমঞ্চের উপরে আমি যে মহাবলবান মানুষটিকে দেখি, বিশেষ কারণে এখানে তাঁর নাম উল্লেখযোগ্য। কারণ তাঁর কাছ থেকে প্রেরণা লাভ ক’রেই ভারতের দেশে দেশে—এমন কি বাংলাতেও শত শত যুবক দৈহিক শক্তিচর্চায় একান্তভাবে অবহিত হয়েছে। আমি রামমূর্তির কথা বলছি। তিনি শারীরিক শক্তির যে সব অভাবিত পরিচয় দিয়েছিলেন, সেদিন সকলেরই কাছে তা ইন্দ্রজালের মতই আশ্চর্য ব’লে মনে হয়েছিল। তারপরে অনেকেই তাঁর কয়েকটি খেলার নকল ক’রে নাম কিনেছেন ও কিনছেন বটে, কিন্তু তাঁর অধিকতর দূরূহ কয়েকটি খেলা আজও কেউ চেষ্টা ক’রেও আয়ত্তে আনতে পারেন নি। কারণ সে খেলাগুলির মধ্যে ফাঁকি বা প্যাঁচ ছিল না, রামমূর্তির মত অমিত শক্তির অধিকারী না হ’লে কারুরই সে সব খেলা দেখাবার সাধ্য হবে না। রামমূর্তির প্রদর্শনী ছিল কেবল বাহুবল দেখাবার জন্যে নয়, অর্থ উপার্জনের জন্যেও বটে। তাই কোন কোন খেলাতে তিনি দর্শকদের চমকে অভিভূত ক’রে দিতেন। কিন্তু যেখানে কৌশলের উপর থাকে প্রকৃত শক্তির প্রাধান্য, সেখানে রামমর্তি আজও অদ্বিতীয় হয়ে আছেন।
আমি বাল্যকালেও দেখেছি, কলকাতার বহু বনিয়াদী ধনীর বাড়ীতে ছিল স্থায়ী কুস্তির আখড়া। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সম্পদের জন্যে বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতেও ছিল পরিবারের ছেলেদের জন্যে নিয়মিত কুস্তি লড়বার ব্যবস্থা এবং কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথকেও কুস্তি লড়ার অভ্যাস করতে হ’ত। হয়তো সেইজন্যেই তিনি লাভ করেছিলেন অমন সুগঠিত পুরুষোচিত দেহ। তাঁর পিতামহ “প্রিন্স” দ্বারকানাথ ছিলেন সৌখীন কুস্তিগীর।
কিন্তু বাঙালী নিজেকে যতই সভ্য ও শিক্ষিত ব’লে ভাবতে শিখলে, ব্যায়াম ও কুস্তি প্রভৃতিকে ততই ঘৃণা করতে লাগল। তার ধারণা হ’ল, ও-সব হচ্ছে নিম্নশ্রেণীর নিরক্ষর ব্যক্তির ও ছোটলোকের কাজ। অথচ যে-দেশ থেকে সে লাভ করেছে আধুনিক শিক্ষা ও সভ্যতা, সেই প্রতীচ্যের উচ্চ-নীচ সর্বসাধারণের মধ্যে পুরুষোচিত ব্যায়াম ও খেলাধূলার লোকপ্রিয়তা যে কত বেশী, সেদিকে একবারও দৃষ্টিপাত করা দরকার মনে করেনি। সবল ইংরেজের কাছে দুর্বল বাঙালী প’ড়ে প’ড়ে মার খেত, তবু তার হুঁশ হ’ত না।
কিন্তু তারও ভিতরে ছিল যে একটা subconscious বা অব্যক্তচেতন মন, সেটা টের পাওয়া গিয়েছিল মোহনবাগান যেদিন ফুটবল খেলার মাঠে “শীল্ড ফাইন্যালে” প্রথম গোরার দলকে হারিয়ে দেয়। শত শত জ্বালাময়ী বক্তৃতাও যে বাঙালীর প্রাণে প্রেরণা সঞ্চার করতে পারে নি, একটি দিনের একটি মাত্র ঘটনায় তা হয়ে উঠল আশ্চর্যভাবে অতিশয় জাগ্রত। ইংরেজী সংবাদপত্রে সেই সময়ে এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিলঃ মোহনবাগানের বিজয়গৌরবে চারদিকে যখন সাড়া প’ড়ে গিয়েছে, তখন চৌরঙ্গীর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল দুই ব্যক্তি, তাদের একজন বাঙালী, আর একজন ইংরেজ। তারা পরস্পরের বন্ধু। বাঙালী পথিকটি বার বার এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ইংরেজ সঙ্গীটি জিজ্ঞাসা করে, “তোমার আজ এ কি হ’ল বলতো? তুমি আমাকে বার বার পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছ কেন?” বাঙালী জবাব দেয়, “দেখছ না, আজ আমাদের জাতিই যে এগিয়ে চলেছে।” কথাগুলি আমার এতই ভালো লেগেছিল যে আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি।
আজকাল বাতাস কিছু বদলেছে। কিছুকাল থেকে দেখছি বাঙালী যুবকরাও দেহচর্চায় মন দিয়েছে এবং ব্যায়ামের নানা বিভাগে দেখাচ্ছে অল্পবিস্তর পারদর্শিতা। আদর্শ দেহ গঠনে, পেশী শাসনে, ভারোত্তোলনে, মুষ্টিযুদ্ধে ও বাৎসরিক কুস্তি প্রতিযোগিতায় বাঙালী যুবকদের কৃতিত্বের কথা শুনে এই প্রাচীন বয়সেও আমি তরুণের মত উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কিন্তু এইখানেই যথেষ্ট হয়েছে ভেবে থামলে চলবে না—অগ্রসর হ’তে হবে, আরো অনেক দূর অগ্রসর হ’তে হবে, শাক্ত জাতি হিসাবে আমাদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে বিশ্বসভার মাঝখানে।
জ্ঞানে নয়, বিদ্যায় নয়, সভ্যতায় নয়, সংস্কৃতিতে নয়, কেবলমাত্র পশুশক্তির সাহায্যে ভারতবর্ষের উপরে প্রভুত্ব বিস্তার করেছিল মুসলমানরা। এবং আজ পর্যন্ত নিরক্ষর মুসলমানরাও কেবল দৈহিক শক্তিসাধনারই দ্বারা ভারতের অন্যান্য জাতিদের পিছনে ঠেলে শীর্ষস্থান অধিকার ক’রে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছে। আজ ভারতের তথা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মল্ল কে? গামা এবং তার ছোট ভাই ইমাম বক্স। গামার বয়স বোধ করি এখন সত্তরের উপরে এবং ইমামেরও ষাটের উপরে। কিন্তু এখনো গামা যে-কোন যুবক প্রতিদ্বন্দ্বীরও সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করতে প্রস্তুত। বলেছেন, “যে আমার ছোট ভাই ইমামকে হারাতে পারবে, তার সঙ্গেই আমি লড়তে রাজি আছি।” কিন্তু ভারত বা য়ুরোপের কোন মল্লই তাঁর এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহসী নয়। গামা অপরাজেয় হয়েই রইলেন। তাঁর আগে গোলাম পালোয়ানও ছিলেন এমনি অতুলনীয়।
কেবলই কি গামা ও ইমাম? তাঁদের ঠিক নীচের থাকেই যাঁরা আছেন—যেমন হামিদা, গুঙ্গা, হরবল্স সিং, সাহেবুদ্দীন ও ছোট গামা প্রভৃতি আরো অনেকে (এখানে অকারণে সকলের নাম ক’রে লাভ নেই, তাঁদের মধ্যে এক হরবন্স সিং ছাড়া আর সকলেই মুসলমান।
সেটা ১৯১৬ কি ১৯১৭ খৃস্টাব্দ আমার ঠিক মনে নেই। আমি তখন কাশীধামে। গামা তখন ইংলণ্ডে গিয়ে জন লেম ও বড় বিস্কো প্রভৃতি পাশ্চাত্যদেশের শীর্ষস্থানীয় পালোয়ানদের হারিয়ে পৃথিবীজোড়া উত্তেজনা সৃষ্টি ক’রে দেশে ফিরে এসেছেন। দুইজন স্থানীয় বন্ধুর সঙ্গে দশাশ্বমেধ ঘাটে যাবার বড় রাস্তায় ভ্রমণ করছি, হঠাৎ বন্ধুদের একজন বললেন, “ঐ দেখুন, গামা পালোয়ান যাচ্ছেন।”
সাগ্রহে তাকিয়ে দেখলুম। পথ দিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন লোক, সকলেরই চেহারা বলিষ্ঠ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন মধ্যমণির মত। মাথায় পাগড়ী, গায়ে চুড়ীদার পাঞ্জাবী, পরনে লুঙ্গি, পায়ে নাগরা জুতো—পোষাকে আছে রংবেরঙের বাহর। দাড়ী কামানো, মস্ত গোঁফ। দেহ অনাবৃত নয় বটে, কিন্তু বস্ত্রাবরণ ঠেলে তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে আসছে যেন একটা প্রবল শক্তির উচ্ছ্বাস। ভাবভঙ্গিও প্রকাশ করছে তাঁর বিশেষ বীর্যবত্তা। অসাধারণ চোখের দৃষ্টি ফুটিয়ে তোলে ব্যক্তিত্বকে। গামা চলে গেলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলুম। মন বললে, দেখলুম বটে এক পুরুষসিংহকে।
তার কয়েক বৎসর পরে গামাকে দেখি কলকাতায়। তারিখ সম্বন্ধে আমার একটা দুর্বলতা আছে। আমি বাল্যকালের সব কথাও হুবহু মনে রাখতে পারি, কিন্তু দশ-পনেরো বৎসর আগেকার কোন বিশেষ তারিখ স্মরণ করতে পারি না। তবে মনে হচ্ছে অন্ততঃ বত্রিশ বৎসর আগে কলকাতায় গড়ের মাঠে তাঁবু ফেলে মস্ত এক কুস্তি-প্রতিযোগিতা হয়েছিল। ভারতের নানা প্রদেশ থেকে এসেছিলেন নামজাদা পালোয়ানরা— কেউ কুস্তি লড়তে, কেউ কুস্তি দেখতে। আমি একদিন সেই কুস্তির আসরে গিয়েছিলুম, গামার সঙ্গে হাসান বক্সের প্রতিযোগিতা দেখবার জন্যে। কিন্তু স্মরণ হচ্ছে অন্যান্য পালোয়ানদের কুস্তি হয়েছিল একাধিক দিবস ধ’রে।
আমি যেদিন যাই, সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন স্বর্গত বন্ধুবর শ্রীশচন্দ্র গুহ। তিনি ছিলেন কেম্ব্রিজের বক্সিং-এ “হাফ-ব্লু”, পরে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে কিছুকাল প্র্যাকটিস ক’রে মালয়ে গিয়ে আইন ব্যবসায়ে যথেষ্ট নাম কেনেন এবং নেতাজীর “আই-এন-এ”র এক পদস্থ কর্মচারী হন। সেই অপরাধে ইংরেজরা তাঁকে বন্দী করে। পরে তিনি মুক্তিলাভ ক’রে আবার দেশে ফিরে আসেন। এই সেদিন তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
তাঁবুর ভিতরে বৃহতী জনতা। তার মধ্যে বাঙালী খুব কম, অধিকাংশই মুসলমান ও হিন্দুস্থানী- তারা চারিধারের গ্যালারি দখল ক’রে ব’সে হাটবাজারের সোরগোল তুলেছে। রাজ্যের পালোয়ান সেখানে এসে জুটেছেন, তাঁদের মধ্যে দেখলুম বন্ধুবর শ্রীযতীন্দ্র গুহ বা গোবরবাবুকেও। সেদিনকার কুস্তির বিচারক ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর।
প্রথম দুই-তিনটি কুস্তির পরেই শুনলুম এইবার হবে ভীম ভবানীর সঙ্গে ছোট গামার প্রতিযোগিতা। এই গামা হচ্ছেন প্রখ্যাত কাল্লু পালোয়ানের ছেলে। তিনি তখন সবে যৌবনে পা দিয়েছেন, দেহ রীতিমত তৈরি, তার কোথাও মেদবাহুল্য নেই। কুস্তির খানিক আগে থাকতেই তিনি একটা কাঠের থাম ধ’রে দেহকে গরম করবার জন্যে খুব স্ফূর্তির সঙ্গে ক্রমাগত বৈঠক দিতে সুরু করলেন।
তারপর ভীম ভবানীর সঙ্গে ছোট গামার কুস্তি আরম্ভ হ’ল। ভবানী বয়সেও বড় এবং তাঁর বিপুল দেহও অত্যন্ত গুরুভার— চটপটে ছোট গামাকে এঁটে উঠতে না পেরে তিনি নিলেন মাটি—অর্থাৎ আখড়ার উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। ছোট গামা বহুক্ষণ ধ’রে প্রাণপণ চেষ্টা ক’রেও এবং অনেক প্যাঁচ কষেও তাঁকে চিৎ করতে পারলেন না, তবু বিচারকের অদ্ভুত রায়ে সাব্যস্ত হ’ল, জয়লাভ করেছেন ছোট গামাই! মল্লযুদ্ধে চিরকালই মাটি নেওয়ার রীতি আছে এবং ভূপতিত প্রতিযোগীকে চিৎ করতে না পারলে কুস্তি হয় সমান সমান। মাটি নেওয়া কুস্তির অন্যতম প্যাঁচ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তারপর যুদ্ধস্থলে এসে দাঁড়ালেন মহামল্ল গামা এবং হাসান বক্স। আজ পর্যন্ত আমি অনেক বড় পালোয়ান দেখেছি, কিন্তু দৈহিক সৌন্দর্যে হাসান বক্সের কাছে তাঁদের সকলকেই হার মানতে হবে। সেই দেববাঞ্ছিত সুঠাম ও পরম সুন্দর দেহ একাধারে সুকুমার ও শক্তিদ্যোতক। নিখুঁত তাঁর মুখশ্রী। মুগ্ধ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়—যেন গ্রীক ভাস্করের গড়া আদর্শ পুরুষমূর্তি।
সেদিন গামার নগ্ন দেহও দেখলুম। যেমন বিরাট কবাট-বক্ষ, তেমনি পেশীবহুল বাহু, তেমনি বলিষ্ঠ ও অপূর্ব ঊরু। যেন মূর্তিমন্ত শক্তিমন্ত্র—তার চেয়ে বলীর মূর্তি কল্পনাতেও আনা যায় না।
হাসান বক্স যে একজন প্রথম শ্রেণীর ফাঁকায়ান, সে বিষয়ে কোনহ সন্দেহ নেই। কারণ তা নইলে তিনিও গামাকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস করতেন না এবং গামাও তাঁর সঙ্গে লড়তে রাজি হতেন না। হাসান বক্স ও গামার প্রতিযোগিতা একটা অত্যন্ত স্মরণীয় ও দর্শনীয় দৃশ্য ব’লেই সেদিন সেখানে অমন বিপুল জনসমাগম হয়েছিল।
কিন্তু গামা হচ্ছেন গামা, তাঁকে বোঝাতে হলে অন্য কোন উপমা ব্যবহার করা চলে না। পৃথিবীর অধিকাংশ প্রথম শ্রেণীর মল্ল তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে দুই-চার মিনিটের বেশী দাঁড়াতে পারেন নি। হাসান বক্স তবু তাঁর সঙ্গে খানিকক্ষণ যুঝলেন বটে, কিন্তু শেষ রাখতে পারলেন না। জয়ী হলেন গামাই।
সেই দিনই সেখানে দেখেছিলুম ভারতের আর এক অপরাজেয় মল্ল ইমান বক্সকে, যাঁর আসন গামার পরেই। অতি দীর্ঘ মূর্তি, অতি বলিষ্ঠ দেহ, হাতে প্রকাণ্ড একটি রূপোর গদা। তবু তাঁর দেহ উল্লেখযোগ্য নয় গামার মত।