এখন যাঁদের দেখছি/যামিনী রায়
পাঁচ
যামিনী রায়
লোকসাহিত্য, লোকশিল্প, লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্য প্রভৃতির মধ্যে যে স্বাভাবিক সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য থাকে, উচ্চশিক্ষিতদের দৃষ্টি প্রায়ই তার দিকে আকৃষ্ট হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে এক-একজন সত্যদ্রষ্টা কলাবিদ যখন সেই সব নিত্যদৃষ্ট ব্যাপারের ভিতর থেকেই অদৃষ্টপূর্ব সুষমা আবিষ্কার ক’রে তুলে ধরেন সকলের চোখের সামনে, তখন আমাদের বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না।
নিরক্ষর গেঁয়ো কবির বাঁধা একটি গান শুনুন:
“যা রে কোকিলা তুই,
আমার প্রাণপতি গেছে যে দেশে।
এমন ক’রে জ্বালাতন
করিস্ নে আর নিত্যি এসে।
শুনে তোর কুহুস্বর
উসকে ওঠে পরাণ আমার,
প্রাণপতি মোর গেছে গাঙের পার,
তুই ছাড়্গে তথা কুহুস্বর।”
এ হচ্ছে আকাটা হীরার মত। শিক্ষিত কারিকর একেই মেজে ঘ’ষে ক’রে তুলতে পারেন অত্যন্ত অসাধারণ।
লোকসাহিত্যের দিকে রবীন্দ্রনাথ বহুকাল পূর্বেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এবং তারপর লোকসঙ্গীতও যে কি বিচিত্র সৌন্দর্যের খনি, সুরকার রবীন্দ্রনাথ তারও উজ্জ্বল প্রমাণ দিতে বাকি রাখেন নি। আগে যে সব সুর হেটো বা মেঠো ব’লে শিক্ষিতদের গানের বৈঠকে ঠাঁই পেত না, তিনি সেইগুলিকেই এমন সুকৌশলে ব্যবহার ক’রে জাতে তুলে নিয়েছেন যে, বিদ্বজ্জনদের মনের প্রত্যেক ভাব তারা ব্যক্ত করতে পারে অনায়াসেই। কেবল তাই নয়। মার্গসঙ্গীতের যে সব রাগরাগিণী আগে নিজেদের কৌলীন্যগর্ব বজায় রাখবার জন্যে লোকসাধারণের পথ মাড়াতে রাজি হ’ত না, তিনি তাদেরই ধ’রে মেঠো ভাটিয়ালী ও বাউল প্রভৃতি চল্তি সুরের সঙ্গে মিলিয়ে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে সৃষ্টি ক’রে গিয়েছেন অপূর্ব সৌন্দর্যলোক।
নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর বলেছেন, “Everything is Folk!” তাঁর মতে, ভারতের মত লোকনৃত্যের বিপুল ভাণ্ডার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। যথার্থ গুণীর হাতে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হ’লে লোকনৃত্যও অনন্যসাধারণ হয়ে উচ্চশ্রেণীর রূপরসিকদেরও আনন্দ বিধান করতে পারে। উদয়শঙ্করের এই মত যে অভ্রান্ত, তাঁর দ্বারা পরিকল্পিত গ্রাম্য উৎসব ঘেসেড়া, ভীল, বিদায়ী ও রাসলীলা প্রভৃতি নৃত্য দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না।
দরিদ্ররা ধনপতি হ’লে পূর্ব-দারিদ্র্যের কথা ভুলে যায়, নিজেদের উচ্চতর শ্রেণীর লোক ব'লে মনে করে। তাদের বংশধররা আবার আরো উঁচু ধাপে উঠে নিজেদের অভিজাত ব’লে ভাবতে থাকে এবং জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত তুলে দিতে চায়। সকল শ্রেণীর শিল্পই ছিল আগে লোকশিল্প। কবিতা, গান, নাচ ও ছবির জন্ম হয় লোকসাধারণের মধ্যেই। তারপর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আর্ট ভুলে যায় নিজের শৈশবের কথা, লোকসাধারণের ধারণার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে সগর্বে প্রচার করে—আমি অভিজ্ঞ, আমি বড়লোক, আমি ছোটলোকের খেলনা নই।
দশ হাজার বৎসর আগে ফ্রান্স ও স্পেন ছিল অসভ্য। কিন্তু তখনকার শিল্পীরা গিরিগুহার দেওয়ালে যে সব ছবি এঁকে রেখেছিল, বর্তমান যুগের মানুষরাও তা দেখে অবাক হয়ে যায়। তারপর যুগে যুগে চিত্রকলা যাত্রা করেছে বিভিন্ন পথে, নিজেকে আবদ্ধ করেছে নানা বিধিবিধানের বন্ধনে, আদিম স্বাভাবিকতা হারিয়ে হরেক রকম ‘ইজম্’-এর দাসত্ব ক’রে হ’তে চেয়েছে বিচিত্র, হ’তে চেয়েছে লোকসাধারণের পক্ষে দুর্বোধ
কিন্তু আজও পৃথিবীর যেখানে যেখানে অসভ্য জাতিরা আদিম মানুষদের মত জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, সেখানকার শিল্পীরা কাজ করে, ছবি আঁকে সেই দশ হাজার বৎসর আগেকার পদ্ধতিতেই। কাল হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘বুসম্যান’রা আধুনিক যুগেরই লোক। কিন্তু তাদের আঁকা ছবি দেখলে মনে পড়বে সেই দশ হাজার বৎসর আগেকার শিল্পীদেরই কাজ—কি রেখায়, কি বর্ণে, কি পরিকল্পনায়। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের আধুনিক বংশধরদের দ্বারা অঙ্কিত চিত্র সম্বন্ধেও প্রায় ঐ কথাই বলা যায়।
পাশ্চাত্য দেশের একাধিক অতি-আধুনিক শিল্পী ফিরে যেতে চাইছেন আবার প্রাগৈতিহাসিক যুগের দিকে। ফোর্ড ম্যাডক্স ব্রাউন, হোলম্যান হাণ্ট ও রোসেটি প্রভৃতি ঊনবিংশ শতাব্দীর কয়েকজন চিত্রকরের দৃষ্টি ছিল যেমন রাফাএল প্রভৃতির পূর্ববর্তী যুগের দিকে, এঁরাও তেমনি আকৃষ্ট হয়েছেন দশ হাজার বৎসর আগেকার শিল্পীদের দ্বারা। তাই এঁদের হাতের কাজে খুঁজে পাওয়া যায় আদিম শিল্পের প্রভাব। হয়তো এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সার্বজনীন হবে না এবং হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না চলমান মেঘের ছায়ার মত এই সাময়িক রেওয়াজ, তবু আদিম কালের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকতা যে আকৃষ্ট করেছে অতি-আধুনিকদেরও, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। কেবল আদিম ছবি কেন, শিশুদের আঁকা যে সব ছবি দেখলে আগে আমাদের কাকের ছানা বকের ছানার কথা স্মরণ হ’ত, তার ভিতরেও এঁরা পাচ্ছেন নূতন নূতন সৌন্দর্যের সন্ধান।
আমাদের দেশেও প্রকাশ পাচ্ছে একটা নূতন দৃষ্টিভঙ্গি।
ছেলেবেলায় যখন গুরুজনদের সঙ্গে কালীঘাটে যেতুম এবং চিত্রকলার ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতুম না, তখন আমাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করত সেখানকার পটুয়ারা। তাদের কর্মশালার প্রান্তে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী ও বিস্মিত চোখে নিরীক্ষণ করতুম পটয়াদের হাতের কাজ। নিজের মনে তারা এঁকে যেত ছবির পর ছবি, কেমন নিশ্চিত হাতে রেখার পর রেখা টেনে, কত অবলীলাক্রমে। অধিকাংশই ছিল গার্হস্থ্য ছবি, লোকে হেলাভরে বলত কালীঘাটের পট। সেগুলিকে কেউ আর্টের নিদর্শন ব'লে গ্রহণ করত না এবং তাদের ক্রেতাও ছিল না শিক্ষিত ভদ্রলোকরা। কিন্তু আজ উচ্চশ্রেণীর রূপরসিকদের মুখেও তাদের প্রশংসা শোনা যায় এবং ঘটা ক’রে কালীঘাটের পটের প্রদর্শনী খুললে তা দেখবার জন্যে মনীষীরাও আগ্রহ প্রকাশ করেন। আগে আমরা যাদের তাচ্ছিল্য করে ‘পোটো’ ব’লে ডাকতুম, আজ তাদের শিল্পী ব’লে স্বীকার করতেও আমরা নারাজ নই। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে বৈ কি। আর তা বদলাচ্ছে ব’লেই আজ শিল্পী যামিনী রায় পেয়েছেন অসংখ্য সমঝদার।
কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি সহজে বা অকারণে বদলায় না, তা পরিবর্তিত হ’তে পারে প্রতিভার প্রভাবেই। অনেকদিন আগে থেকেই বাংলা দেশে সচিত্র প্রাচীন পুঁথি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়ে আসছে, সেই সব পটের সঙ্গে আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিরা ছিলেন সুপরিচিত। তাদের বিষয়বস্তু, তুলির লিখন এবং পরিকল্পনা কালীঘাটের পটের চেয়ে যথেষ্ট উন্নত হ’লেও তা দেখে কারুর মনে জাগেনি কোন সম্ভাবনার ইঙ্গিত। সংস্কৃত ভাষারও চেয়ে সে সব ছবির ভাষা ছিল অধিকতর মৃত। তা দেখে পরিতৃপ্ত হ’ত নয়নমন, ঐ পর্যন্ত। বাউল বা মেঠো সুর শুনেও আমাদের মন নাড়া পেয়েছে, কিন্তু তবু তাদের মুখনাড়া খেতে হয়েছে উপেক্ষণীয় লোকসঙ্গীত ব’লে এবং বৈঠকী ওস্তাদরাও দিতেন না তাদের পাত্তা। তাদের উচ্চাসনে তুলে পঙ্ক্তিভুক্ত করার জন্যে দরকার হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মত সরস্বতীর বরপুত্রকে।
বাংলা দেশে বড় বড় শিল্পীর অভাব ছিল না, কিন্তু প্রাচীন বাংলার ঘরোয়া পট রচনা পদ্ধতি অবলম্বন ক’রে যে বর্তমান কালেও যুগোপযোগী উচ্চশ্রেণীর কলাবস্তু প্রস্তুত করা যেতে পারে, এটা দেখবার মত দৃষ্টিশক্তির অভাব ছিল যথেষ্ট। আমাদের শিল্পীরা যখন প্রতীচ্যের নানাবিধ “ইজম”-এর দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, যামিনী রায় তখন রূপলক্ষ্মীর মূর্তি গঠনের জন্যে উপকরণ সংগ্রহে নিযুক্ত হলেন গৌড় বাংলার নিজস্ব ঐশ্বর্য-ভাণ্ডারে। কিন্তু তিনিও একেবারে নিজের পথ কেটে নিতে পারেন নি। প্রথম প্রথম তিনিও এমন সব ছবি এঁকেছিলেন, যাদের ভিতর থেকে আবিষ্কার করা যায় পাশ্চাত্য প্রভাব, চৈনিক প্রভাব বা অন্য কোন প্রভাব। তারপর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেল কেন জানি না; হয়তো বঙ্গকুললক্ষ্মী মাইকেলের মত তাঁকেও স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন:
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে।”
শিল্পী যামিনী রায়ের অপরূপ রেখাকাব্যগুলি বাংলার খাঁটি প্রাণপদার্থ দিয়ে গড়া। তার মধ্যে “বহু যুগের ওপার থেকে” ভেসে আসে সাবেক বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ এবং সেই সঙ্গে পাওয়া যায় হাল বাংলার পরিচিত প্রাণের ছন্দ। নব নব পরিকল্পনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে রসরূপের যে নির্মল আনন্দ, কোথাও কোন বিজাতীয় মনোবৃত্তির এতটুকু ছোঁয়া করতে পারে না তাকে পরিম্লান। নিশ্চিত হাতের টানে আঁকা চিত্রার্পিত ও লীলায়িত রেখার সমারোহের মধ্যে সর্বত্রই অনুভব করা যায় ভাবসাধক শিল্পীর মনের গভীর নিষ্ঠা। এই বিকৃত ও অধঃপতিত অতিসভ্যতার যুগে পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে লালিতপালিত হয়েও নব্য বাংলার এক শিল্পী ঠাকুরঘরে ঢুকে ইষ্টদেবীর গঙ্গোদকে ধোয়া পূজাবেদীর শুচিশুভ্রতা এমনভাবে রক্ষা করতে পেরেছেন দেখে মনে জাগে চরম বিস্ময়ের সঙ্গে পরম পুলক।
পথ ঠিক হয়ে গেল—সে পথের শেষ নেই। জীবন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আর্ট অনন্ত। শিল্পী যামিনী রায় সাধনমার্গে অগ্রসর হলেন এবং এখনো অগ্রসর হচ্ছেন। হালে “মাসিক বসুমতী”তে তাঁর আঁকা “বাঙলায় দূর্ভিক্ষ” নামে ছবির প্রতিলিপি প্রকাশিত হয়েছে। একটি মাত্র কঙ্কালসার মূর্তি বা অন্য কোন মর্মন্তুদ বীভৎস দৃশ্য নেই। অত্যন্ত সহজ প্রতীকের সাহায্যে নিরন্ন গৃহস্থবাড়ীর অরন্ধনের কথা বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিছুকাল আগে তাঁর চিত্রশালায় গিয়েছিলুম। দেখলুম তিনি এক অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে পরীক্ষায় নিযুক্ত হয়েছেন।
স্বর্গীয় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিউবিষ্টদের পদ্ধতির সাহায়্য নিয়ে কয়েকখানি ছবি এঁকেছেন। সেই সব ছবি দেখে বিখ্যাত রূপরসিক ডক্টর এইচ্ কজিন্স মতপ্রকাশ করেছিলেন, যে দেশে কিউবিজমের জন্ম সেই য়রোপের শিল্পীরাও তেমন চমৎকার ছবি আঁকতে পারেন না। তার কারণ, গগনেন্দ্রনাথ নকলিয়ার কর্তব্য পালন করেন নি। প্রতিভাবান ভারতীয় শিল্পীর হাতে এসে রূপান্তর গ্রহণ করেছিল য়ুরোপীয় পদ্ধতি।
কলকাতার বড়দিনের মরশুমে চিত্র-প্রদর্শনী খোলা হয়। গত তিন চার বৎসরের প্রদর্শনী দেখে মনে ধারণা হয়, বাংলার অতিআধুনিক চিত্রকলা ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। শিল্পীর পর শিল্পী পাশ্চাত্য সব ‘ইজম’ নিয়ে প্রমত্ত হয়ে উঠেছেন, কিন্তু তা পরিপাক করতে পারেন নি একেবারেই। ফলে সে সব উদ্ভট ছবি পাশ্চাত্য “ইজম”-এর ব্যর্থ ও নিরর্থক অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। প্রাচ্যে বা প্রতীচ্যে কোথাও তাদের ঠাঁই নেই।
এখন যামিনী রায়ের নূতন পরীক্ষার কথা বলি। য়ুরোপের মধ্যযুগের ধুরন্ধর চিত্রকররা খৃষ্টের জীবনীমূলক অজস্র ছবি এঁকেছেন। খৃষ্টধর্ম সম্পর্কীয় সেই সব নরনারীর মূর্তিকে যামিনী রায় এঁকে দেখিয়েছেন বাংলার নিজস্ব পটরচনাপদ্ধতিতে। শিল্পী নকল বা প্রভাবের ধার ধারেন নি, দেখাতে চেয়েছেন দেশী পদ্ধতিতে বিদেশী মানুষদের। বাংলার পটশিল্পে খৃষ্টদেব ও মেরী মাতা! শিল্পী অসঙ্গতির মধ্যেই অন্বেষণ করেছেন সঙ্গতির ছন্দ। প্রাচীনকালে গান্ধারের ভারতীয় ভাস্কররাও বৃদ্ধদেবের মূর্তি গড়বার সময়ে এই রকম চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা গ্রীক প্রভাব থেকে মুক্ত হ’তে পারে নি।
যামিনী রায় একাধিকবার বাংলা রঙ্গালয়ের দৃশ্য-পরিকল্পকের কার্যভার গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তিনি বাংলার পটপদ্ধতি বর্জন করেন নি। বাংলার পট হচ্ছে প্রধানতঃ আলঙ্কারিক আর্ট। তাই রঙ্গমঞ্চের উপরেও তার মধ্যে হয়নি ছন্দঃপাত।
শিল্পী যামিনী রায় আজ হয়েছেন যশম্বী। কেবল স্বদেশী বিদেশী বহু প্রখ্যাত রূপরসিকের অভিনন্দন নয়, লক্ষ্মীলাভও করেছেন। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত তাঁর যাত্রাপথ হয়নি কুসমাস্তৃত। তাঁর রেখায় লেখা কবিতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে বটে, কিন্তু অনেক সময়েই তাঁর আর্ট হয় Abstract, তিনি প্রকাশ করতে চান অমূর্তকে, দৃষ্টান্তস্বরূপ পূর্বকথিত “বাংলায় দুর্ভিক্ষ” ছবিখানির উল্লেখ করতে পারি। ওর মধ্যে চিন্তাশীলতা থাকতে পারে, কিন্তু জনসাধারণ অমূর্ত শিল্প নিয়ে মস্তক ঘর্মাক্ত করতে প্রস্তুত নয়। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি আমার বাড়ীতে তাঁর আঁকা চিত্রাবলী দেখে সেগুলির সার্থকতা সম্বন্ধে প্রচুর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আমি সাধ্যমত তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়েছে ব’লে মনে হয় না। সেই জন্যেই বহুকাল পর্যন্ত তিনি অর্থকর লোকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন নি।
তিনি আমার দীর্ঘকালের বন্ধু, তাঁকে জানি ঘনিষ্ঠভাবেই। সময়ে সময়ে তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে দারুণ অর্থকষ্ট। দারিদ্র্য অপমানকর নয় বটে, কিন্তু বহু শিল্পীর পক্ষেই মারাত্মক। শিল্পী যামিনী রায় বিনা অভিযোগে মৌনমুখে এই দারিদ্র্য-জ্বালা সহ্য করেছেন, তবু নিজের পদ্ধতি ছেড়ে অন্য কোন লোকপ্রিয় পদ্ধতি গ্রহণ করেন নি, কলালক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেয়েই পরিতুষ্ট ছিলেন। অবশেষে জয়লাভ করেছে প্রতিভাই। যে লক্ষ্মীদেবীর হাতে থাকে ঝাঁপি আর পায়ের তলায় থাকে পেচক, অবশেষে তাঁরও মুখ হয়েছে প্রসন্ন।