এখন যাঁদের দেখছি/পরিচালক প্রবোধচন্দ্র গুহ

ছয়

পরিচালক প্রবোধচন্দ্র গ‍ুহ

 নট না হয়েও নাট্য-পরিচালনার দ্বারা অক্ষয় যশ অর্জন করা যায়। প্রমাণ, য়ুরোপের রাইনহার্ড সাহেব। বাংলাদেশেও এই বিভাগে দুজন লোক প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছেন। স্বর্গীয় মহেন্দ্রকুমার মিত্র ও শ্রীপ্রবোধচন্দ্র গ‍ুহ।

 মিনার্ভা থিয়েটার গৌরবের উচ্চশিখরে উঠেছিল মহেন্দ্রকুমারের পরিচালনাগ‍ুণে। গিরিশচন্দ্রের শেষ বয়সের সমস্ত বিখ্যাত নাটকই (বলিদান, সিরাজদ্দৌলা, মীরকাশিম, ছত্রপতি শিবাজী, শাস্তি কি শান্তি, শঙ্করাচার্য, অশোক, তপোবল ও গৃহলক্ষ্মী প্রভৃতি) মহেন্দ্রকুমারের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত হয়। দ্বিজেন্দ্রলালের দুর্গাদাস, নূরজাহান, সোরাব—রুস্তম, মেবার পতন, সাজাহান ও চন্দ্রগুপ্ত সম্বন্ধেও ঐ কথাই বলা যায়। সেই সময়েই দানীবাবুর নাট্যপ্রতিভা যতটা চরমে উঠতে পেরেছিল, আর কখনো তা পারেনি। গিরিশচন্দ্র যখন দানীবাবু এবং মিনার্ভার অধিকাংশ প্রখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে কোহিনূর থিয়েটারে চ’লে যান, তখন সকলেই মনে করেছিলেন, অতঃপর মিনার্ভা থিয়েটারের পতন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু মহেন্দ্রকুমার পরিচালিত মিনার্ভার প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হয়নি। এথেকেই স্পষ্ট বোঝা যাবে, কোন রঙ্গালয়ের পক্ষে শ্রেষ্ঠ নাটক ও শ্রেষ্ঠ অভিনেতার মত শ্রেষ্ঠ পরিচালকেরও প্রয়োজনীয়তাও কতখানি।

 প্রবোধচন্দ্র রঙ্গালয়ের সংস্রব ত্যাগ করেছেন অনেক দিন আগেই, কিন্তু এখনো নাট্যজগতের সকলেরই মুখে মুখে ফেরে তাঁর নাম। মহেন্দ্রকুমারের মত তিনিও নটও নন, নাট্যকারও নন। মহেন্দ্রকুমার ছিলেন হাইকোর্টের উকিল এবং তিনি ছিলেন ডাক বিভাগের পদস্থ কর্মচারী। কিন্তু দুইজনেরই নাট্যানুরাগ ছিল এমন প্রবল যে, নাট্যজগতে প্রবেশ না ক’রে থাকতে পারেননি এবং এই নাট্যানুরাগের ফলেই প্রবোধচন্দ্রকে শেষ পর্যন্ত সরকারি আপিসের সম্পর্ক পর্যন্ত ত্যাগ করতে হয়েছিল। তারপর থেকে নাট্যসাধনাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।

 প্রথমে তিনি স্টার থিয়েটারে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতা করেন। তারপর হন আর্ট থিয়েটার লিমিটেডের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা। সেই সময়ে “কর্ণার্জ্জুনে’র অভাবিত জনপ্রিয়তার জন্যে তিনি নিজেও দাবি করতে পারেন অনেক খানি প্রশংসাই। ১৩৩৬ সালে তিনি হন মনোমোহন থিয়েটারের মালিক ও পরিচালক। ওখানে তাঁর পরিচালনায় দুইখানি নাটক (“গৈরিক পতাকা” ও “কারাগার”) আশ্চর্য সাফল্য লাভ করে। তারপর তাঁর হাতেই গ’ড়ে ওঠে নূতন রঙ্গালয় “নাট্য-নিকেতন”। এখানেও বিক্রীর দিক দিয়ে সবচেয়ে স্মরণীয় নাটক হচ্ছে শচীন্দ্রনাথের “সিরাজদ্দৌলা”, যার জনপ্রিয়তা গিরিশচন্দ্রের “সিরাজদ্দৌলা”কেও ছাড়িয়ে উঠেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

 তাঁর কর্মকুশলতাকে অদ্ভুত বলা যেতেও পারে। এ সম্বন্ধে একটি গল্প শুনেছি। যখন তিনি আর্ট থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁর আর্থিক অবস্থা তখন ভালো ছিল না। একদিন তাঁর পকেটে আছে মাত্র কয়েক গণ্ডা পয়সা, তিনি “আজ একটা কিছু, করব”ই ব’লে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বেরিয়ে পড়েন। তারপর বাসায় যখন ফিরলেন, তখন তিনি মনোমোহন থিয়েটারের মালিক।

 ১৯১৯ খৃষ্টাব্দ। স্টার থিয়েটারে প্রায়ই অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতুম। সেই সময়েই প্রবোধচন্দ্রের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। কিন্তু সে আলাপ তখনও বন্ধুত্বে পরিণত হয়নি। দেখতুম একটি সুশ্রী যুবককে, দুই হাত তাঁর কাজে জোড়া, মুখ কিন্তু মুখর। সর্বদাই কর্মে ব্যস্ত এবং কাজ করতে করতে সর্বদাই মিষ্টমুখে সকলের সঙ্গে গল্প করতে প্রস্তুত। লাট্টুর মত সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু হাতেরও কামাই নেই, মুখেরও কামাই নেই। এই হলেন প্রবোধচন্দ্র। আজ বৃদ্ধ হয়েছেন বটে, কিন্তু স্বভাব তাঁর বদলায়নি। কর্মতৎপরতাও ক্ষুন্ন হয়নি। আলস্য তাঁকে আক্রমণ করতে পারে না। কাজ, কাজ, সর্বদাই কাজ চাই। একাই হ’তে চান একশো।

 শিশিরকুমার নিজের সম্প্রদায় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন। আমরাও সবান্ধবে যোগ দিলুম তাঁর সঙ্গে। ফলে স্টার থিয়েটারে আমাদের যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, কারণ ওখানকার আর্ট সম্প্রদায় প্রতিযোগী শিশির-সম্প্রদায়কে প্রীতির চক্ষে দেখতেন না। আমরা প্রকাশ করলুম সাপ্তাহিক “নাচঘর” পত্রিকা, তার পাতায় থাকত শিশিরকুমারের গ‍ুণপনার পরিচয়। স্টার থিয়েটারের অনুগত ছিল আর একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা, সে নিয়মিতভাবে আমাদের বির‍ুদ্ধে বিষোদ্গার করত; এবং তাকে যে উৎসাহিত করতেন প্রবোধচন্দ্রই, মনে মনে আমি এই সন্দেহ পোষণ করতুম। কাজেই আমার মন যে তাঁর প্রতি অল্পবিস্তর বির‍ূপ হয়ে উঠেছিল, এ কথা অস্বীকার করব না।

 তারপর কয়েক বৎসর কেটে যায়। কিছুদিনের জন্যে রঙ্গালয়ের একঘেয়ে প্রতিবেশ আর ভালো লাগে না, বাড়িতে একান্তে ব’সে সাহিত্যচর্চা করি। সেই সময়েই প্রবোধচন্দ্র নিয়েছেন মনোমোহন থিয়েটারের ভার।

 এক সকালে বৈঠকখানায় ব’সে খবরের কাগজ পড়ছি, হঠাৎ কণ্ঠস্বর শুনলুম―“চলুন”।

 মুখে তুলে দেখি, সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গীয় অভিনেতা সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার বালক বয়স থেকেই তাকে আমি চিনতুম। গোবরবাবুর আখড়ায় কুস্তি ল’ড়ে বপুখানি তার বিপুল হয়ে ওঠে। তারপর কুস্তি ছেড়ে থিয়েটারে ঢোকে। বুদ্ধি কিছু মোটা, কতকটা গোঁয়ার-গোবিন্দ মানুষ।

 সতীশ আবার বললে, “চলুন।”

 আমি বললুম, “চলুন মানে? কোথায় যাব?”

 সতীশ বললে, “মনোমোহন থিয়েটারে। আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে প্রবোধবাবু আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

 বললুম, “আমি যাব না। আমার আর থিয়েটার ভালো লাগে না।”

 সতীশ চোখ পাকিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললে, “যাবেন না কি, আপনাকে যেতেই হবে। প্রবোধবাবু, ব’লে দিয়েছেন, আপনি যেতে না চাইলে আপনাকে যেন কোলে ক’রে তুলে নিয়ে আসা হয়।”

 বুঝলুম ষণ্ডামার্ক সতীশের সঙ্গে বেশী কথা কাটাকাটি ক’রে লাভ নেই। আমাকে কোলে তুলে নিতে তাকে একটুও বেগ পেতে হবে না এবং সে দৃশ্য হবে দশজনের পক্ষে যথেষ্ট হাস্যকর। অতএব গেলাম তার সঙ্গেই।

 প্রবোধবাবুকে বললুম, “আচ্ছা চ্যালাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন যা হোক, একেবারে নাছোড়বান্দা।”

 তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “সতীশ যখন গিয়েছে, তখন যে তোমাকে আসতে হবেই, এ আমি জানতুম।”

 —“কিন্তু ব্যাপার কি? হঠাৎ আমাকে স্মরণ করেছেন কেন?”

 —“জানো তো, এখানকার ভার নিয়েছি আমি। উপর-উপরি দু’খানা বই খুলতে হবে—“জাহাঙ্গীর” আর “মহ‍ুয়া”। নজরুল গান লিখছে। তোমাকে দিতে হবে নাচ। ‘না’ বললে চলবে না।”

 তাই হ’ল। ‘না’ বলা চলল না। আবার থিয়েটার বাঁধলে মায়ার বাঁধনে। এ আনন্দের বটে, কিন্তু সাহিত্যচর্চার পক্ষে সুবিধাজনক নয়। আর্টের সেবা করছি ব’লে মনকে প্রবোধ দিয়েছি, কিন্তু ক্ষুণ্ণ হয়েছে সাহিত্যচর্চা।

 তারই কয়েক বৎসর আগে শিশিরকুমারের অনুরোধে “বসন্তলীলা”, “সীতা” ও “হাসুনো হানা” পালার জন্যে কয়েকটি গান রচনা করেছিলুম বটে, কিন্তু তারপর অনেককাল পর্যন্ত থিয়েটারের জন্যে আর কোন গান বাঁধিনি। কিন্তু এখন থেকে প্রবোধচন্দ্র আমার উপরে দিতে লাগলেন গানের পর গানের বরাত। যতদিন তিনি রঙ্গালয়ের সম্পর্কে ছিলেন, ততদিন ধ’রেই কত নাট্যকারের কত নাটকের জন্যে রাশি রাশি কত যে গান রচনা (এবং সেই সঙ্গে নৃত্য পরিকল্পনা) করেছি, সে হিসাব আর আমার মনে নেই। তবে এইটুকু অনায়াসেই বলতে পারি, নবযুগের আর কোন কবিই রঙ্গালয়ের জন্যে আমার মত এত বেশী গান রচনা করেননি।

 ঐ মনোমোহন থিয়েটার থেকেই প্রবোধচন্দ্রের সঙ্গে আমি অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। অনেক দিনই দিবারাত্র একসঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছি—একসঙ্গে কাজ করা, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, একসঙ্গে শোয়া-বসা। দুজনেই পরস্পরকে ভালো ক’রে চিনতে পেরেছি। এবং ঐ মনোমোহন থিয়েটারেই নাট্যপরিচালনায় তাঁর অদ্ভুত কৃতিত্বের সঙ্গে ভালো ক’রে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছি। তিনি কেবল নাটক নির্বাচন করতেন না, তার পরিবর্তন, পরিবর্জন ও পরিবর্ধনেরও ভার গ্রহণ করতেন। তারপর দৃশ্যপট, সাজপোশাক ও মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা, আলোক-নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিতভাবে মহলা দেবারও ভার থাকত তাঁর উপরে। নাচ, গান ও সুরের উপযোগিতার দিকেও থাকত তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। রঙ্গালয়ে তাবৎ ব্যাপার নিয়ে বিশেষরূপে মস্তিষ্কচালনা করতেন একমাত্র তিনিই। রঙ্গালয়ে একখানি পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ করবার জন্যে যে কি বিপুল পরিশ্রম ও চিন্তাশীলতার প্রয়োজন হয়, বাইরের কেউ তা কল্পনাতেও উপলব্ধি করতে পারবেন না। নট-নটী, দৃশ্য-পরিকল্পক, নৃত্যবিদ, গীতি-রচয়িতা, সুরশিল্পী, আলোকনিয়ন্তা ও নাট্যকার আপন আপন বিশেষ বিভাগ নিয়েই অবহিত হয়ে থাকেন বটে, কিন্তু একটি মূল ভাব ফুটিয়ে তোলবার জন্যে প্রত্যেককে অবিচ্ছিন্নভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিণামের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে পরিচালককে অনন্যসাধারণ সংগঠন-শক্তির পরিচয় দিতে হয়। ভাবুক, কবি, সমালোচক এবং বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্পীর বিশেষত্ব সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জ্ঞান না থাকলে কেহই হ’তে পারেন না সার্থক পরিচালক। কেবল বাছা বাছা রসিকের নয়; তাঁকে রাখতে হয় জনসাধারণের মনের খবরও।

 প্রবোধচন্দ্র সম্বন্ধে আগেই বলেছি, তিনি যেন একাই একশো। তাঁর অসাধারণ কর্মদক্ষতা ও শ্রমশক্তি দেখে বারংবার বিস্মিত না হয়ে পারিনি। নূতন নাটক প্রস্তুত করবার সময়ে দৈনন্দিন জীবনের অন্য কোন কথাই তাঁর মনে থাকত না, স্নানাহার ভুলে তিনি একটানা কাজ ক’রে যেতেন সতেরো—আঠারো ঘণ্টা ধ’রে। নিজেই কখনো তুলি ধ’রে দৃশ্যপটের উপরে বর্ণলেপনে নিযুক্ত হয়েছেন, কখনো কাঁচি ধরে সাজপোশাক তৈরি করেছেন, আবার সে-সব ফেলে ছুটে গিয়েছেন মহলার আসরে, অভিনেতাদের নির্দেশ দিতে দিতে লক্ষ্য করেছেন নাটকের মধ্যে নূতন কি পরিবর্তনের দরকার, আবার আমার কাছে এসে নাচ দেখতে দেখতে জানিয়েছেন, আমি তাঁর মনের ভাব ধরতে পারিনি, নাচের কোন কোন অংশ বদলে দিলে ভালো হয় এবং তারপরেই হয়তো সুরকার বা আলোকনিয়ন্তাকে নিয়ে পড়েছেন। কাজের পরে কাজ, এক কাজের পরে আর এক কাজ, কিন্তু মুখে তবু শ্রান্তি বা বিরক্তির একটু লক্ষণ নেই, হাসতে হাসতে সকলকেই করছেন সাদর সম্ভাষণ; এবং এই কাজের ভিড়ের মধ্যে অন্য ব্যাপারও আছে—তাঁর কাছে যা আনন্দকর, কিন্তু আর কার‍ুর পক্ষে উপসর্গ। সবাইকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতেও বড় ভালোবাসেন। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে দৌড়ে চ’লে যাচ্ছেন রান্নাঘরের ভিতরে, সেখানে মস্ত হাঁড়ায় চড়েছে মাংস, খানিকক্ষণ হাতা নেড়ে আবার দ্রুতপদে ফিরে আসছেন নূতন কোন কাজ করবার জন্যে। সত্য বলছি, এমন আমুদে কাজের মানুষ আমি আর দেখিনি।