এখন যাঁদের দেখছি/স্যর যদুনাথ সরকার
দুই
স্যর যদুনাথ সরকার
ভারতবাসীরা ইতিহাস রচনার জন্যে খ্যাতিলাভ করেনি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস দুর্লভ। মুসলমানরা এদেশে এসে ইতিহাস রচনার দিকে দৃষ্টিপাত করেন বটে এবং তাঁদের দেখাদেখি অল্প কয়েকজন হিন্দুও কিছু কিছু ঐতিহাসিক রচনা রেখে গিয়েছেন। কিন্তু সে রচনাগুলি প্রায়ই নির্ভরযোগ্য ব’লে বিবেচিত হয় না।
এদেশে নিয়মিতভাবে ইতিহাস রচনার সূত্রপাত করেন পাশ্চাত্য লেখকরাই। যদিও সে সব হচ্ছে বিজেতার লিখিত বিজিত দেশের ইতিহাস, তবু তাদের মধ্যে পাওয়া যায় অল্পবিস্তর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং প্রচুর মূল্যবান তথ্য। এবং এ কথা বললেও ভুল বলা হবে না যে, বাঙালীরা ইতিহাস রচনা করতে শিখেছে ইংরেজদের কাছ থেকেই।
বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম গুরু বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের দিকে বাঙালীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তাঁর যুগেই বাঙালী লেখকরা বিশেষভাবে ইতিহাস রচনায় নিযুক্ত হন। কিন্তু আমাদের ইতিহাস রচনার প্রাথমিক প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য হয়েছিল ব’লে মনে হয় না। অনেকেরই সম্বল ছিল কেবল ইংরেজদের লিখিত ইতিহাস। অনেকের রচনা হচ্ছে অনুবাদ। অনেকে স্বাধীন চিন্তাশক্তির পরিচয় দিতে পারেন নি। অনেকের ভিতরে ছিল না সত্যকার ঐতিহাসিকসুলভ মনোবৃত্তি। অনেকে নন নিরপেক্ষ সমালোচক। অনেকে বিনা বা অল্প পরিশ্রমেই হ’তে চাইতেন ঐতিহাসিক।
বঙ্কিমোত্তর যুগে বাংলার ঐতিহাসিক সাহিত্য ধীরে ধীরে উন্নত হ’তে লাগল। কিন্তু সে উন্নতিকেও সর্বতোভাবে আশাপ্রদ বলা যায় না। সে সময়েও এমন ঐতিহাসিক ছিলেন, যিনি মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত ও গুপ্তবংশীয় চন্দ্রগুপ্তকে অভিন্ন ব্যক্তি ব’লে মনে করেছেন। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের নাম সুপরিচিত, কিন্তু তিনি ইতিহাস রচনায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন নি এবং তাঁর রচনাও ভূরি ভূরি ভ্রমপ্রমাদে পরিপূর্ণ। তাঁর সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের নাম, কারণ মৌলিক গবেষণা করবার যথেষ্ট শক্তি তাঁর ছিল। কিন্তু সময়ে সময়ে তিনিও পরস্পরবিরোধী তথ্যগুলি ওজন ক’রে নিজের মত গঠন করতেন না; আগে একটি বিশেষ মত খাড়া ক’রে তার স্বপক্ষেই তথ্যের পর তথ্য সংগ্রহ ক’রে যেতেন, “সিরাজদৌলা” গ্রন্থে তার একাধিক প্রমাণ আছে। সিরাজদৌলা চরিত্রের কালো দিকটা সাদা ক’রে দেখাবার জন্যে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। এমন একদেশদর্শিতা ঐতিহাসিকের পক্ষে অশোভন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বাঙলার ইতিহাস” একখানি মূল্যবান গ্রন্থ বটে, কিন্তু তার মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের প্রাধান্য আছে ব’লে সাধারণ পাঠকের পক্ষে তা সুখপাঠ্য হয় না। কেবল রাশি রাশি সাল-তারিখ, মুদ্রা, শিলা বা তাম্রলিপির মধ্যে প’ড়ে পাঠকের মন দিশাহারা হয়ে ওঠে, আখ্যানবস্তু খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্য কথা বলতে কি, আমাদের মাতৃভাষায় আজ পর্যন্ত নিখুঁত ইতিহাস রচিত হয় নি।
মাতৃভাষায় যা হয় নি, ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে একজন বাঙালী ঐতিহাসিকের দ্বারা সেই দূরূহ কার্যটি সম্পাদিত হয়েছে। স্যর যদুনাথ সরকার হচ্ছেন বাংলা দেশের প্রথম ঐতিহাসিক, যিনি কেবল স্তূপীকৃত, রসহীন প্রমাণপঞ্জীর মধ্যে ছুটোছুটি করতে চান নি, কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর শিল্পীর মত সব রকম তথ্যই সংগ্রহ ক’রে এমন এক অপূর্ব রূপ দিয়েছেন যা একাধারে নিরপেক্ষ সমালোচনা এবং ইতিহাস এবং প্রামাণিক কথা-সাহিত্য। তিনি অলঙ্কারবহুল পল্লবিত ভাষা পরিহার ক’রেও রচনাকে নিরতিশয় সরস ক’রে তুলতে পারেন। বিস্ময়কর তাঁর সংযম। ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে এমনভাবে তিনি নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন, মন চমৎকৃত না হয়ে পারে না। কল্পনার সাহায্যে ঔপন্যাসিক করেন চরিত্র সৃষ্টি, তাঁর চরিত্র সৃষ্ট হয় বাস্তব ঘটনা অবলম্বন ক’রে। তাঁর পরিকল্পনার ইন্দ্রজালে ইতিহাসের মানুষগুলি বহু যুগের ওপার হ’তে আবার জীবন্ত মূর্তি ধারণ ক’রে ফিরে এসে দাঁড়ায় বর্তমান কালে। তাঁর ইতিহাস-গ্রন্থাবলীর মধ্যে পাওয়া যায় কত উপন্যাস, কত নাটক ও কত গাথার উপাদান।
অদ্ভুত কর্মী পুরুষ এই স্যর যদুনাথ। তাঁর ধৈর্য, পরিশ্রম ও অনুসন্ধিৎসা সত্য সত্যই অসাধারণ। মোগল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের ইতিহাস রচনা করতে কেটে গিয়েছে তাঁর পঞ্চাশ বৎসর। এই কাজে তাঁকে ইংরেজী, ফরাসী, পার্সী, সংস্কৃত, হিন্দী ও মারাঠী ভাষা থেকে অসংখ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছে। এ সম্বন্ধে আর কোন ঐতিহাসিকই এমন বিপুল পরিশ্রম স্বীকার করেন নি। মোগল সাম্রাজ্যের বিশেষজ্ঞ হিসাবে ভারতে তিনি অদ্বিতীয়।
কিন্তু ঐতিহাসিক কেবল পরিশ্রমী হ’লেই চলে না। মুটের মত গলদঘর্ম হয়ে খাটবার লোকের অভাব হয় না। ঐতিহাসিককে তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে করতে হয় গভীরভাবে মস্তিষ্কচালনা। রীতিমত মাথা খাটিয়ে সংগৃহীত তথ্যগুলিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারলে ব্যর্থ হয় সমস্ত পরিশ্রম। তথ্যের থাকে দুটি দিক— স্বপক্ষে ও বিপক্ষে। এই দুটি দিক দিয়ে তথ্যগুলিকে ওজন ক’রে দেখতে হয়—এখানে ঐতিহাসিককে হ’তে হবে প্রথম শ্রেণীর অনপেক্ষ সমালোচক। অ্যাবট সাহেব ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পক্ষপাতী জীবনীকার। কিন্তু তাঁর লিখিত বিশাল গ্রন্থের মধ্যে প্রকৃত নেপোলিয়নকে দেখতে পাওয়া যায় না। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ও সিরাজ-জীবনী রচনা করেছেন সিরাজের বিরুদ্ধে যে-সব ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়, সে দিকে না তাকিয়েই। কিন্তু স্যর যদুনাথ এ শ্রেণীর ঐতিহাসিক নন। তাঁর প্রকাণ্ড গ্রন্থ “ঔরংজেবের ইতিহাস” ও শিবাজীর জীবনচরিত পাঠ করলেই সকলে বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন, প্রত্যেক ঐতিহাসিক চরিত্রকেই তিনি চারিদিক থেকে দেখতে চেষ্টা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। তিনি কোন তথ্য ব্যবহার করেছেন গুণ দেখাবার জন্যে এবং দোষ দেখাবার জন্য ব্যবহার করেছেন কোন তথ্য। আবার বহু তথ্যকে পরিত্যাগ করেছেন। লোভনীয় হ’লেও অবিশ্বাস্য বলে।
স্যর যদুনাথের সমগ্র জীবন কেটে গিয়েছে শিক্ষাব্রত ও ইতিহাস-চর্চার ভিতর দিয়ে। রাজসাহী জেলায় ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। বাইশ বৎসর বয়সে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে এম–এ পরীক্ষা দেন এবং সর্বপ্রথম স্থান অধিকার ক’রে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। লাভ করেন সুবর্ণ পদক ও বৃত্তি। তারপর প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ ক’রে কলকাতায়, পাটনায়, বেনারসে ও কটকে বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস-চ্যান্সেলারের পদে অধিষ্ঠিত হন।
অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে ঐতিহাসিক সাধনা। ছাত্রজীবন সাঙ্গ ক’রেই সর্বপ্রথমে রচনা করেন টিপু সুলতান সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রবন্ধ। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর আরো অনেক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বপ্রথম স্মরণীয় দান হচ্ছে পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত “ঔরংজেবের ইতিহাস”। এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে সাজাহানের অর্ধেক রাজত্বকালের ও ঔরংজেবের সমগ্র জীবনকালের কথা। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে আছে সাজাহানের রাজত্বকাল ও উত্তরাধিকারের জন্যে যুদ্ধ। তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে ১৬৫৮ থেকে ১৬৮১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর ভারতের কথা। চতুর্থ খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে ১৬৪৪ থেকে ১৬৮৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের কথা। পঞ্চম খণ্ড ঔরংজেবের শেষজীবন নিয়ে রচিত হয়। ঐ গ্রন্থ পাঠ ক’রে ঐতিহাসিক বেভারিজ সাহেব তাঁকে “বাঙালী গিবন” ব’লে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি “শিবাজী ও তাঁর যুগ” রচনা ক’রে পেয়েছিলেন বোম্বাইয়ের রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্যর জেমস ক্যাম্পবেল সুবর্ণ পদক। “মোগল সাম্রাজ্যের নিম্নগতি ও পতন” হচ্ছে তাঁর আর একখানি বিরাট গ্রন্থ। এছাড়া তিনি আরো কয়েকখানি উপভোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে আরভিনের “লেটার মোগলস” (দই খণ্ড), “হিষ্ট্রি অব বেঙ্গল” (দ্বিতীয় খণ্ড) ও “আইন-ই-আকবরি”। তাঁর রচিত বাংলা প্রবন্ধও আছে, তবে সংখ্যায় সেগুলি বেশী নয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইংরেজীতে তিনি রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি রচনা ভাষান্তরিত করেছেন। তাঁর ইংরেজী রচনা সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে। আজ তাঁর বয়স তিরাশী বৎসর। কিন্তু আজও তাঁর মনীষা, মস্তিষ্ক চালনার শক্তি ও কর্ম তৎপরতা অটুট আছে। চিরদিনই তিনি মৌলিক গবেষণার পক্ষপাতী। বয়স হয়েছে ব’লে অলস হয়ে বসে থাকতে ভালোবাসেন না। এখন গত ষাট—বাষট্টি বৎসরের ঐতিহাসিক গবেষণা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে আছেন।
আমাদের অধিকাংশ ঐতিহাসিক টেবিলের সামনে চেয়ারাসীন হয়ে পুঁথিপত্রের মধ্যেই কালযাপন করেন। কিন্তু যে যে দেশের ইতিহাস বা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলবেন, স্যর যুদনাথ স্বয়ং বার বার সেই সব দেশে গিয়ে স্বচক্ষে ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করলে নিশ্চিন্ত হ’তে পারেন না। মহারাষ্ট্র প্রদেশে গিয়েছেন উপর উপরি পঞ্চাশবার। ঔরংজেব যেখানে যেখানে গিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়েছেন, বার বার সেই সব স্থান নিজের চোখে দেখে এসেছেন। এই রকম দেশভ্রমণের ফলে তাঁর দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে বহু নূতন নূতন তথ্য। নানা জায়গা থেকে তিনি সংগ্রহ ক’রে এনেছেন ঔরংজেব ও তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের পাঁচ হাজার পত্র।
যাঁরা সস্তায় কিস্তিমাৎ ক’রে নাম কিনতে চান, তাঁদের উপরে স্যর যদুনাথের কিছুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দুই-চারখানা ইংরেজী কেতাব প’ড়ে যা হোক কিছু একটা খাড়া ক’রে দিলেই চলে না। তিনি জীবনব্যাপী সাধনা করেছেন হঠযোগীর মত। মাত্র দুই তিনটি পংক্তির জন্যে তাঁকে রাশি রাশি প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়েছে, হয়েতো কেটে গিয়েছে দিনের পর দিন। যত দিন না নিজের ধারণা সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, ততদিন গভীর চিন্তায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে। লোকপ্রিয়তা অর্জন করবার জন্যে কোনদিন তিনি সত্যকে বিকৃত বা অতিরঞ্জিত করতে যাননি। অথচ যা করেছেন, সহানুভূতির সঙ্গেই করেছেন, কোনরকম বিরুদ্ধ ভাবের আশ্রয় নেননি।
১৯১৫ খৃষ্টাব্দ। মহারাজাধিরাজ বিজয়চাঁদ মহাতাবের আমন্ত্রণে সে বৎসরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনীর অধিবেশন হয় বর্ধমানে। সাহিত্য সম্মিলনীতে এত ঘটা আর কখনো দেখিনি। এই রেশনের ও দূর্ভিক্ষের যুগে সেদিনকার রাজকীয় ভূরিভোজনের আয়োজনকে গতজন্মের স্বপ্ন ব’লে মনে হয়। সে রকম সব খাবারও আর তৈরি হয় না এবং সে রকম সব খাবার খাওয়াবার শক্তি বা সুযোগও আজ আর কারুর নেই। সম্মিলনীর প্রধান সভাপতি ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতিহাস শাখায় সভাপতিত্ব করেছিলেন স্যর যদুনাথ সরকার। তাঁর সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হয় সেইখানেই। স্যর যদুনাথ বাংলা ভাষায় একটি অভিভাষণ পাঠ করেছিলেন। তাঁর বাংলা রচনা তাঁর ইংরেজীর মত চোস্ত ও মধুর না হ’লেও প্রাঞ্জল।
তারপর তাঁর সঙ্গে বার বার দেখা হয়েছে এম. সি. সরকার এণ্ড সন্সের পুস্তকালয়ে। ওরা তাঁর প্রকাশক ও আত্মীয়। অল্পস্বল্প আলাপও করেছি মাঝে মাঝে। মৃদুভাষী মানুষ তিনি, প্রকৃতি গম্ভীর ব’লে মনে হয়। কোন রকম “পোজ” বা ভঙ্গিধারণের চেষ্টা নেই। চেহারা ও সাজপোষাক এত সাদাসিদা যে, কেউ বুঝতেই পারে না তিনি কত বড় পণ্ডিত ও অনন্যসাধারণ মানুষ। জনতার ভিতরে তিনি অনায়াসেই হারিয়ে যেতে পারেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আলাপ করলে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব অনুভব করা যায়।
প্রাচীন বয়সে নিয়তির কাছ থেকে তিনি সদয় ব্যবহার লাভ করেন নি। তাঁর চার পুত্র, ছয় কন্যা। তাঁদের মধ্যে বর্তমান আছেন কেবল তিনটি মেয়ে, একটি ছেলে। একটি মেয়ে বিলাতে পড়তে গিয়ে অজ্ঞাত কারণে আত্মঘাতী হন এবং তার কিছুকাল পরেই কলকাতার গত দাঙ্গার সময়ে তাঁর এক পুত্র আততায়ীর হস্তে মারা পড়েন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এবং মাথার উপরে কিঞ্চিদধিক আশী বৎসরের ভার নিয়েও স্যর যদুনাথ ভেঙে পড়েন নি, অবিচল ভাবে সহ্য করেছেন এই সব চরম দুর্ভাগ্যের আঘাত।