এখন যাঁদের দেখছি/অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কেবল তুলি ধ’রে ছবি আঁকা নয়, কলম ধ’রেও ছবি আঁকা। এটি হচ্ছে অবনীন্দ্রনাথেরই শিল্পীমনের বিশেষত্ব। শব্দচিত্রাঙ্কনে তাঁর এই চমৎকার নৈপুণ্যের দিকে সমালোচকদের মধ্যে সর্বপ্রথমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বোধ হয় “সাহিত্য” সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। লেখকরূপে ও চিত্রকররূপে অবনীন্দ্রনাথ একই কর্তব্য পালন করেন। ছবিকার হয়েও তিনি যেমন লেখাকে ভুলতে পারেন নি, লেখক হয়েও তেমনি ভুলতে পারেন নি ছবিকে। পৃথিবীর আরো কোন কোন বড় চিত্রকর লেখনী ধারণ করেছেন, কিন্তু তাঁদের কারুর রচনায় এ বিশেষত্বটি লক্ষ্য করি নি।
লেখকরূপে ও চিত্রকররূপে অবনীন্দ্রনাথকে জেনেছি বাল্যকাল থেকেই। সে সময়ে এদেশে উচ্চশ্রেণীর বাল্যপাঠ্য পুস্তকের অভাব ছিল অত্যন্ত। বয়স্ক লিখিয়েরা মাথা ঘামাতেন কেবল বয়স্ক পড়ুয়াদের জন্যেই, কিংবা শিশুদের জন্যে বড় জোর লিখতেন পাঠশালার কেতাব। শিশুদের চিত্তরঞ্জন করবার ভার নিতেন ঠাকুমাদিদিমার দল। কিন্তু শিশুরা যখন কৈশোরে গিয়ে উপস্থিত হ’ত, তখন বয়সগুণে অধিকতর বেড়ে উঠত তাদের মনের ক্ষুধা, অথচ তারা খোরাক সংগ্রহ করবার সুযোগ পেত না। সে বয়সে তাদের মনের উপরে রেখাপাত করতে পারত না শিশুভুলানো ছড়া ও রূপকথা। এই অভাব মোচন করবার জন্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথও গোড়া থেকেই লেখনী ধারণ করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের “ক্ষীরের পাতুল” ও রূপকথা বটে, কিন্তু যে উচ্চশ্রেণীর লিপিকুশলতার গুণে রূপকথাও একসঙ্গে নাবালক ও সাবালকদের উপযোগী হয়ে ওঠে, ওর মধ্যে আছে সেই বিশেষ গুণটি। সেইজন্যে কিশোর বয়সে তা পাঠ ক’রে মুগ্ধ হতুম আমরা। তারপর তিনি বলতে সুরু, করলেন “রাজকাহিনী”। কাহিনীগুলি প্রকাশিত হ’ত বড়দের পত্রিকা “ভারতী”তে, কিন্তু ছোটরাও তা সাগ্রহে পাঠ করত এবং পড়ে আনন্দলাভ করত বড়দেরও চেয়ে বেশী। সুরেশচন্দ্র সমাজপতিকে আকৃষ্ট করেছিল এই “রাজকাহিনী”রই শব্দচিত্রগুলি। অবনীন্দ্রনাথের “ভূতপত্রীর দেশে”ও যেখানে-সেখানে পাওয়া যাবে অপূর্ব শব্দচিত্র, সেগুলি ভুলিয়ে দেয় ছেলে-বুড়ো সবাইকেই।
অবনীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনার বিস্তৃত সমালোচনা করবার জায়গা এখানে নেই। লিখেছেন তিনি অনেক: গল্প, কাহিনী, নক্সা, হাস্যনাট্য, ছড়া এবং প্রবন্ধ প্রভৃতি। প্রত্যেক বিভাগেই আছে তাঁর বিশিষ্ট হাতের বিশদ ছাপ। তাঁর নাম না ব’লে তাঁর যে কোন রচনা অন্যান্য লেখকদের রচনাস্তূপের মধ্যে স্থাপন করলেও তাকে খুঁজে বার করা যেতে পারে অতিশয় অনায়াসেই— এমনি স্বকীয় তাঁর রচনাভঙ্গি। সে ভঙ্গি অননুকরণীয়। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের রচনাভঙ্গি অননুকরণ ক’রে অনেকে অল্পবিস্তর সার্থকতা লাভ করেছেন, কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের লিখন-পদ্ধতির নকল করবার সাহস কারুর হবে ব’লে মনে হয় না।
ছেলেবেলায় “সাধনা” পত্রিকায় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রতিলিপি দেখি সর্বপ্রথমে। ছবিগুলি মুদ্রিত হ’ত শিলাক্ষরে (লিথোগ্রাফ)। রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং তাই অবলম্বন ক’রে ছবি। আমাদের খুব ভালো লাগত। কিন্তু তাদের ভিতরে পরবর্তী যুগের অবনীন্দ্রনাথের সুপরিচিত চিত্রাঙ্কন-পদ্ধতি কেউ আবিষ্কার করতে পারবেন না। প্রথম জীবনে তিনি য়ুরোপীয় পদ্ধতিতেই চিত্রাঙ্কন করতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং শিক্ষা পেয়েছিলেন ইতালীয় শিল্পী গিলহার্ডি ও ইংরেজ শিল্পী পামারের কাছে। অবনীন্দ্রনাথের তখনকার আঁকা ছবি তাঁর বাড়ীতে এখনো রক্ষিত আছে।
প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুস্তকাগারে একখানি পুঁথির মধ্যে মোগল যুগের ছবি দেখে হঠাৎ তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করেন, তাঁর চোখ ফিরে আসে বিদেশ থেকে স্বদেশের দিকে। কিছুদিন ধ’রে চলে ভারতীয় শিল্পসম্পদ নিয়ে নাড়াচাড়া। প্রাচ্য চিত্রকলা পদ্ধতিতে “কৃষ্ণলীলা” অবলম্বন ক’রে এঁকে ফেললেন কয়েকখানি ছবি। সেগুলি দেখে শিক্ষক পামার চমৎকৃত হয়ে বললেন, “তোমার শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে, আর তোমাকে কিছু শেখাবার নেই।” অবনীন্দ্রনাথ নিজের পথ নিজেই কেটে নিলেন। ভারত-শিল্পের নবজন্মের সূচনা হ’ল।
তারপর কেমন ক’রে অবনীন্দ্রনাথের প্রতিভা-প্রসাদাৎ নবযুগের ভারত-শিল্প বাংলাদেশে প্রথম আত্মপ্রকাশ ক’রে বিশাল ভারতবর্ষে আপন বিজয় পতাকা উত্তোলন করে, তা নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করতে চাই না, কারণ অবনীন্দ্রনাথের জীবনী বা ভারতশিল্পের ইতিহাস রচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবেই তাঁকে দেখতে ও দেখাতে চেষ্টা করব।
সাল-তারিখ মনে নেই, তবে কলকাতার সরকারী চিত্র-বিদ্যালয়ে তখনও প্রাচ্য চিত্রকলা শেখাবার ব্যবস্থা হয় নি এবং তার সঙ্গে তখনও সংযুক্ত ছিল একটি আর্ট গ্যালারি। সে সময়ে শ্রেষ্ঠ চিত্র বলতে আমরা বুঝতুম য়ুরোপীয় চিত্রই। ঐ আর্ট গ্যালারির মধ্যে য়ুরোপীয় শিল্পীদের আঁকা অনেক ছবি সাজানো ছিল—এমন কি রাফাএলের পর্যন্ত (যদিও তা মূল ছবি নয়)। একদিন সেখানে ছবি দেখতে গিয়েছি। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর সেই অসংখ্য বিলাতী ছবির ভিড়ের মধ্যে আচম্বিতে এক কোণে আবিষ্কার করলুম জলীয় রঙে আঁকা কয়েকখানি অভাবিত ছবি। সেগুলি হচ্ছে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা মেঘদূত-চিত্রাবলী। একসঙ্গে সচকিত হয়ে উঠল আমার চোখ আর মন। প্রত্যেকখানি ছবি আকারে একরত্তি, সেখানে রক্ষিত ঢাউস ঢাউস বিলাতী ছবি ছেড়ে লোকের চোখ হয়তো তাদের দিকে ফিরতেই চাইত না, কারণ তারা কেবল আকারেই এতটুকু নয়, তাদের মধ্যে ছিল না পাশ্চাত্য বর্ণ-বৈচিত্র্য এবং ঐশ্বর্যের বাহুল্যও। তবু কিন্তু তাদের দেখে আমি একেবারে অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলুম। আমার সামনে খুলে গেল যেন এক অজানা সৌন্দর্যলোকের বন্ধ দরজা। মন সবিস্ময়ে ব’লে উঠল, যে অচিন সুন্দরকে দেখবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এখানে আসি নি, অকস্মাৎ সে নিজেই এসে আমার কাছে ধরা দিল!
আজকের দর্শকরা হয়তো ঐ ছবিগুলি দেখে আমার মতন অত বেশী অভিভূত হবেন না। কারণ বহুকাল ধ’রে অসংখ্য দেশী ছবি নিয়ে অনশীলন ক’রে চক্ষু তাঁদের অনেকটা শিক্ষিত হ’য়ে উঠেছে। কিন্তু আমি তখন ছিলুম সম্পর্ণরূপে বিলাতী ছবি দেখতেই অভ্যস্ত, এমন কি য়ুরোপীয় পদ্ধতিতে চিত্রবিদ্যা শেখবার জন্যে সরকারি আর্ট স্কুলে ছাত্ররূপে যোগদানও করেছি। কাজেই ছবিগুলি আমার কাছে এনে দিলে নূতন আবিষ্কারের বার্তা। সেইদিন থেকেই আমি হয়ে পড়লুম অবনীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত।
মানুষটিকে চোখে দেখবার সাধ হ’ল এবং সুযোগও মিলল অনতিবিলম্বেই। খবর পেলাম, অবনীন্দ্রনাথদের ভবনে শিল্প-সম্পর্কীয় এক সভার অধিবেশন হবে। যথাসময়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলুম। অবনীন্দ্রনাথকে দেখলুম। শান্ত, মিষ্ট মুখ। সহজ সরল ভাব, কোন রকম ভঙ্গি নেই। ভালো লাগল মানুষটিকে।
সভায় বউবাজার চিত্র-বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ (তাঁর নাম কি মম্মথবাবু?) বক্তৃতা দিতে উঠে অবনীন্দ্রনাথের গুণগ্রামের পরিচয় দিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীও (ইউ রায়) দু-চার কথা বললেন। শুনলুম ওঁরা একটি শিল্প-সম্পর্কীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করতে চান এবং রবীন্দ্রনাথ তার নামকরণ করেছেন “কলা-সংসদ”। কিন্তু তারপর কি হয়েছিল জানি না, তবে “কলা-সংসদ” সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য শুনতে পাই নি।
তারপর কিছুদিন যায়। “প্রবাসী” ও “ভারতী” পত্রিকায় প্রকাশিত হ’তে লাগল অবনীন্দ্রনাথের ছবির পর ছবি। অনেককে তারা করলে আনন্দিত। এবং অনেককে আবার ক’রে তুললে দস্তুরমত ক্রুদ্ধ; বিলাতী শিক্ষাগুণে তাঁরা এমন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে, ঘরের ছেলে হয়েও ঘরোয়া রূপের মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারলেন না। যে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি অবনীন্দ্রনাথের রচনার শব্দচিত্রগুলি দেখে প্রশংসা করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথের আঁকা প্রত্যেক চিত্রই যেন তাঁর চোখের বালি হয়ে উঠল। তিনি প্রথম শ্রেণীর চিত্র-সমালোচক (যা তিনি ছিলেন না) সেজে বারংবার উষ্মা প্রকাশ ও ব্যঙ্গবাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। গালিগালাজ যাদের পেশার মত, এমন আরো বহু ব্যক্তি যোগদান করলে সুরেশচন্দ্রের দলে। বাজার হ’য়ে উঠল সরগরম।
কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন “যোগাসনে লীন যোগীবরে”র মত—নিন্দা-প্রশংসায় সমান অটল। ঐ সব আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁর মুখে ছিল না কোন প্রতিবাদ। তরঙ্গের ধারাবাহিক প্রহার চিরদিনই নিশ্চল ও নিস্তব্ধ হয়ে সহ্য করতে পারে সাগরশৈল। তিনি আত্মগত হয়ে বাস করতে লাগলেন নিজের পরিকল্পনার জগতে। দিনে দিনে নব নব রূপ সৃষ্টি ক’রে ভরিয়ে তুলতে লাগলেন রসজ্ঞ বিদ্বজ্জনদের চিত্ত।
মাঝে মাঝে তুলি ছেড়ে কলম ধরেন, যাদের অননুসন্ধিৎসু মন জানতে চায়, বুঝতে চায়, তাদের জানাতে এবং বোঝাতে ললিতকলার আদর্শ ও গুপ্তকথা। তাঁর সেই প্রবন্ধগুলিও প্রাচ্য চিত্রকলার রহস্যোদ্ঘাটনের পক্ষে অল্প সাহায্য করে নি। গঠন করলেন ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েণ্টাল আর্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে দেশীয় চিত্র সম্বন্ধে লোকসাধারণের চিত্তকে সচেতন ও শিক্ষিত ক’রে তোলবার জন্যে বাৎসরিক ছবির মেলা বসাবার ব্যবস্থা করা হ’ল। ওদিকে গভর্নমেণ্ট আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষের আসরে আসীন হয়ে তিনি তৈরি ক’রে তুলতে লাগলেন দলে দলে নূতন শিল্পী। ফল যা হয়েছে তা সর্বজনবিদিত। তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা বাংলার জমিতে যে বাক্যবিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, তা কোন ফলই প্রসব করতে পারে নি। জয় হয়েছে অবনীন্দ্রনাথেরই।
অবনীন্দ্রনাথের বিজয়গৌরব কেবল ভারতে নয়, স্বীকৃত হয়েছে ভারতের বাইরেও। কিন্তু যেখানে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত বাধে এবং পরস্পরবিরোধী আদর্শ দুটি সমান্তরাল রেখার মত থেকে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হ’তে নারাজ হয়, সেখানে অপ্রীতিকর দৃশ্যের অবতারণা অবশ্যম্ভাবী।
ভারতবর্ষে প্রধানতঃ দুই শ্রেণীর শিল্পীর প্রভাব দেখা গিয়েছে। একদল কলকাতা চিত্র-বিদ্যালয়ের অনাগামী, আর একদল হচ্ছে বোম্বাই আর্ট স্কুলে শিক্ষিত। হ্যাভেল সাহেব ও অবনীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে আসবার আগে কলকাতার সরকারী চিত্র-বিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে রকম শিক্ষালাভ ক’রে বেরিয়ে আসত, বোম্বাইয়ের শিল্পীদের দৌড় তার চেয়ে বেশী ছিল না। তাঁদের আর্ট পাশ্চাত্য আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে চেষ্টা করত (এবং এখনো করছে) ভারতবর্ষকে প্রকাশ করতে। এই বর্ণসঙ্কর বা দোআঁশলা আর্ট সৃষ্টি করতে পারে বড় জোর রবি বর্মা বা ধুরন্ধরের মত শিল্পীকে। রবি বর্মার ছবিতে যে মানুষগলি দেখা যায়, তাদের প্রত্যেকেরই ভাবভঙ্গি দস্তুরমত থিয়েটারি। তাঁর “গঙ্গাবতরণ” নামে জনপ্রিয় চিত্রে হিন্দুদের পৌরাণিক দেবতা মহাদেবের যে ভঙ্গিবিশিষ্ট মূর্তি দেখি, সাজপোষাক পরিবর্তন করতে পারলে অনায়াসে তিনি বিলাতী সাহেবে পরিণত হ’তে পারেন। আগে একাধিক বাঙালী শিল্পীও এই শ্রেণীর ছবি এঁকেছেন, তাদের কিছু, কিছু, নমুনা আজও বাজারে দুর্লভ নয়।
কিন্তু হ্যাভেল সাহেব ও অবনীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার পদ্ধতি যখন বাঙলার বাইরেও সাগ্রহে অবলম্বিত হ’তে লাগল এবং নন্দলাল বসু প্রমুখ অসাধারণ শিল্পীর প্রভাব যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল, বোম্বাইয়ের শিল্পীদের অবস্থা হয়ে পড়ল তখন নিতান্ত অসহায়ের মত। বোম্বাই স্কুল অফ আর্টের ভূতপূর্ব পরিচালক গ্লাডস্টোন সলোমন বাংলা পদ্ধতির সেই অগ্রগতি সহ্য করতে পারেন নি। প্রায় ঊনিশ বৎসর আগে “Essays on Mogul Art” নামে একখানি গ্রন্থ প্রকাশ ক’রে তিনি হ্যাভেল সাহেব, অবনীন্দ্রনাথ ও বাংলার পদ্ধতির বিরুদ্ধে করেছিলেন প্রভূত বিষোদ্গার। তবু বাতাসের গতি ফিরল না দেখে অল্পকাল আগেও আবার তিনি তর্জন-গর্জন (বা অরণ্যে রোদন) করতে ছাড়েন নি। কিন্তু বৃথা এ সব চেষ্টা! যে ঘুমিয়ে পড়েছে তাকে জোর ক’রে আবার জাগানো যায়, কিন্তু যে জেগে উঠেছে তাকে জোর ক’রে আবার ঘুম পাড়ানো সম্ভবপর নয়।
এখন অবনীন্দ্রনাথের জীবনের সন্ধ্যাকাল। দিনের কাজ তাঁর ফুরিয়ে গিয়েছে, বেলা-শেষের কর্ম শ্রান্ত বিহঙ্গের মত বিশ্রাম গ্রহণের জন্যে তিনি ফিরে এসেছেন নিজের নীড়ে। একান্তে বসে স্বপ্ন দেখেন,গত জীবনের সার্থক স্বপ্ন। তাঁর পায়ের তলায় গিয়ে বসলে আমাদেরও মনে আবার জেগে ওঠে অতীতের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কত দিনের স্মৃতি, কত আনন্দময় মূহুর্ত, কত বিচিত্র রসালাপ!