এখন যাঁদের দেখছি/জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী
এক
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী
কলম নিয়ে বসেছিলাম বর্তমানের ছবি আঁকতে। কিন্তু কাগজে কালির আঁচড় পড়বার আগেই দেখি, মনের পটে স্মৃতিদেবী নতুন ক'রে আঁকতে সুরু ক'রে দিয়েছেন একখানি পুরাতন ছবি। তবে পুরাতন হ'লেও সে ছবি চিরনূতন।
ব্যক্তিত্বের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, মনুষ্যবিশেষের স্বাতন্ত্র্য। এক একখানি বাড়ীর ভিতরেও থাকে এমনি বিশেষ বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। সহরে দেখতে পাওয়া যায় হাজার হাজার বাড়ী এবং তাদের প্রত্যেকেরই ভিতরে থাকে কিছু না কিছু পার্থক্য। এই পার্থক্য এতই সাধারণ যে, তার মধ্যে বিশেষ কোন স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করা যায় না।
কিন্তু এক একখানি বাড়ী অসাধারণ হয়ে ওঠে এক একজন মহামনা মহামানুষকে অঙ্কে ধারণ করে। সেই মনস্বীদের ব্যক্তিত্বের স্মৃতি বহন ক'রে ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে গড়া বাড়ীগুলিও হয় স্বাতন্ত্র্যে অনন্যসাধারণ। হয় যদি তা পর্ণকুটীর, সবাই রাজপ্রাসাদ ফেলে তাকে দেখতে ছোটে বিপুল আগ্রহে। এই জন্যেই দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়ী, বেলুড় মঠ এবং মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র প্রভৃতির বাসভবন আকৃষ্ট করে বৃহতী জনতাকে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী!
উত্তরে দক্ষিণে পশ্চিমে তিনটি সংকীর্ণ, নোংরা গলি এবং পূর্বদিকে একটি গণ্ডগোল-ভরা বাজার। এরই মাঝখানে অভিজাত পল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী নিজের জন্যে রচনা ক'রে নিয়েছে অপূর্ব এক স্বাতন্ত্র্য্য, বিচিত্র এক প্রতিবেশ। আজ তার নূতন গৌরব করবার কিছুই নেই, কিন্তু তার প্রভূত পূর্বগৌরব তাকে এমন গরীয়ান, এমন অতুলনীয় ক'রে রেখেছে যে, এখনো তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মন হয়ে ওঠে শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ। সে হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক, সে হচ্ছে সমগ্র দেশের শিল্পী ও সাহিত্যিকগণের প্রধান তীর্থ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের ধর্মে, আমাদের সমাজে, আমাদের জাতীয় জীবনে যাঁরা নতন রূপ ও নূতন আদর্শ এনেছেন, ঐখানেই তাঁরা প্রথম পৃথিবীর আলোক দেখেছেন, ঐখানেই তাঁরা লালিত-পালিত হয়েছেন এবং ঐখানেই তাঁরা দুনিয়ার পাট তুলে দিয়ে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ঐ বাড়ীর ঘরে ঘরে দিকে দিকে ছড়ানো আছে অসাধারণ মানষদের পদরেণু।
এইজন্যে বিদেশীরাও কলকাতায় এলে ঠাকুরবাড়ীতে আসবার প্রলোভন সংবরণ করতে পারতেন না। কেবল সাহিত্যক্ষেত্রে নয়, চিত্রকলার ক্ষেত্রেও আত্মপ্রকাশ করেছেন ঠাকুরবাড়ীর যতগুলি সন্তান, বাংলাদেশে আর কোন পরিবারে তা দেখা যায় না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও সুনয়নী দেবী এবং এখনকার উদীয়মানদের মধ্যে সুভো ঠাকুর। যাঁরা ভিতরকার খবর রাখেন তাঁরাই জানেন, ঠাকুর পরিবারভুক্ত প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তিরই মধ্যে আছে সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ। তাঁরা ইচ্ছা করলেই লেখক বা শিল্পী হ'তে পারতেন, কিন্তু যে কারণেই হোক তাঁদের সে ইচ্ছা হয়নি।
নতুন বাংলার সঙ্গীতও জন্মলাভ করেছে ঠাকুরবাড়ীর মধ্যেই। বাঙালী হচ্ছে কাব্যপ্রিয় ভাবুক জাতি। গানে সুরের ঐশ্বর্যের সঙ্গে সে লাভ করতে চায় কথার সৌন্দর্যও। কথাকে নামমাত্র সার ক'রে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকরা যখন সুর ও তালের 'ব্যাকরণ' নিয়ে তাল-ঠোকাঠুকি করছে, বাংলাদেশের লোকসাধারণ তখন একান্ত প্রাণে উপভোগ করছে রামপ্রসাদের গীতাবলী, বাউল-সঙ্গীত ও কীর্তনে বৈষ্ণব পদাবলী প্রভৃতি। যে সব গান সুরের সাহায্যে কথার ভাবকেই মর্যাদা দিতে চায়, আমাদের কাছে তাদেরই আদর বেশী। বাংলাদেশের মেঠো বা ভাটিয়ালী গানও কাব্যরসে বঞ্চিত নয়। নব্য বাংলার বিদ্বজ্জনদের চিত্ত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভিন্নভাবাপন্ন হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁদের মনের ভিতরেও স্বাভাবিক নিয়মেই থাকে খাঁটি বাঙালীর সহজাত সংস্কার। তাঁদের বৈঠকথানায় বা ড্রয়িংরুমে বাংলার সেকেলে গানগুলি প্রবেশ করবার পথ খুঁজে পেত না, কিন্তু ওস্তাদী তানা-না-নাও সহ্য করতে তাঁরা ছিলেন নিতান্ত নারাজ। এই দোটানার মধ্যে দুই কূল রাখবার ব্যবস্থা করলেন ঠাকুরবাড়ীর সঙ্গীতাচার্য। আধুনিক যুগের উপযোগী উচ্চতর ও সুক্ষতর কাব্যকথাকে ফুটিয়ে তোলা হ’তে লাগল এমন সব সুরের সংমিশ্রণে, যার মধ্যে আছে একাধারে মার্গসঙ্গীত, বাউল-সঙ্গীত, কীর্তন-সঙ্গীত ও লোক-সঙ্গীতের বিশেষত্ব। এই নতুন পদ্ধতিতে গায়ক কোথাও কথার গতিরোধ ক’রে অযথা দীর্ঘ তান ছাড়বার সুযোগ পান না এবং কবিও কোথাও সুরকে অবহেলা না ক’রে তার সাহায্যেই কথার ভাবকে উচিতমত প্রকাশ করবার চেষ্টা করেন। আজ সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গিয়েছে এই নূতন পদ্ধতির বাংলা গান এবং এ গান উপভোগ করতে পারেন উচ্চশিক্ষিতদের সঙ্গে অল্পশিক্ষিত শ্রোতারাও।
সাহিত্যকলা, চিত্রকলা ও সঙ্গীতকলার পরে আসে নাট্যকলার কথা। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রনায়কদের সঙ্গে দেখি ঠাকুরবাড়ীর গুণিগণকে। যে কয়েকটি সৌখীন বাংলা রঙ্গালয়ের আদর্শে এদেশে সাধারণ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর রঙ্গালয় হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম। গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি ছিলেন তার প্রধান কর্মী। তারপরেও ঠাকুরবাড়ীর সন্তানদের মধ্যে নাট্যকলার ধারা ছিল সমান অব্যাহত। অভিনেতারূপে দেখা দেন রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথ প্রভৃতি আরো অনেকেই। মধ্য যৌবন থেকেই দেখছি, ঠাকুরবাড়ী থেকে প্রায় প্রতি বৎসরেই এক বা একাধিক নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে আসছে। আজ রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ পরলোকে। কিন্তু আজও রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ীর ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন; প্রায়ই এখানে ওখানে নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। নাট্য-জগতেও ঠাকুর পরিবারের তুলনা নেই।
আর একটি উল্লেখযোগ্য কথা। আমার বোধ হয়, কলকাতা সহরে সর্বপ্রথমে মহিলা নিয়ে অভিনয়ের প্রথা প্রবর্তিত হয় ঠাকুরবাড়ীর রঙ্গমঞ্চেই। অভিনেয় নাটিকা ছিল “বাল্মীকি প্রতিভা”।
নৃত্য যে একটি নির্দোষ আর্ট এবং শিক্ষিত ও ভদ্র পুরুষ আর মহিলারা যে অম্লানবদনে নাচের আসরে যোগ দিতে পারেন, বাংলা- দেশে এ বাণী অসঙ্কোচে প্রথম প্রচার করেন ঠাকুরবাড়ীর রবীন্দ্রনাথই। তিনি কেবল প্রচার করেই ক্ষান্ত হননি, নিজে হাতে ধরে ছেলেমেয়েদের নামিয়েছিলেন নাচের আসরে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা নৃত্যকলা জাতে উঠল তাঁর হাতের পবিত্র স্পর্শে।
অলিগলির দ্বারা পরিবেষ্টিত বটে জোড়াসাঁকোর এই ঠাকুরবাড়ী, কিন্তু তার ফটক পার হ’লেই সংকীর্ণতার কোন চিহ্নই আর নজরে পড়ে না। সামনেই প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, তারপর ত্রিতল অট্টালিকার ভিতরেও আর একটি বড় অঙ্গন। বামদিকে রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রাভবন, তারও পশ্চিম দিকে আবার খানিকটা খোলা জমি। ডান দিকে গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথদের মস্ত বাড়ী, তার দক্ষিণে একটি নাতিবৃহৎ উদ্যানে ফুলগাছের চারা ও বড় বড় গাছের ভিড়। ধূলিমলিন অলিগলির ইট-কাঠের শুষ্কতার মাঝখানে একখানি জীবত নিসর্গ চিত্র- তৃণহরিৎ ক্ষেত্র, ফুলগাছের কেয়ারি, শ্যামলতার মর্মর সঙ্গীত। দখিনা বাতাস বয়, কুড়ি-ফোটার খবর আসে, জেগে ওঠে গানের পাখীরা।
ঠাকুরবাড়ী আজও জোড়াসাঁকোয় দাঁড়িয়ে অতীতের স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু সে বাগান আর নেই। মরু-মুল্লুকের মারোয়াড়ী এসে তার বেদরদী হাত দিয়ে লপ্ত করেছে সেই ধ্বনিময়, গন্ধময়, বর্ণময় স্বপ্ননীড়খানি। আর নেই সেই ফল-ঝরা ঘাসের বিছানা, সবুজের মর্মর-ভাষা, গীতকারী বিহঙ্গদের আত্মনিবেদন।
মাইকেলের রাবণ বলেছিল, “কুসমিত নাট্যশালাসম ছিল মম পুরী।” আগে ঠাকুরবাড়ীও ছিল তাই। কখনো পুরাতন বাড়ীর ভিতরে, কখনো রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রাভবনে, কখনো অবনীন্দ্রনাথদের মহলে বসত অভিনয়ের বা গানের বা নাচের বা কাব্যপাঠের আসর। বাংলার শিক্ষিত সমাজে নৃত্যকলা যখন অভিনন্দিত হয়নি, ঠাকুরবাড়ীতে এসে তখনও নাচ দেখিয়ে গিয়েছেন জাপানের সেরা নর্তকী তেঙ্কোয়া এবং স্বর্গীয় শিল্পী যতীন্দ্রনাথ বসু। “ফাল্গুনী” নাট্যাভিনয়েও আমাদের সামনে এসে নৃত্যচঞ্চল মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, অন্ধ বাউলের ভূমিকায়।
কলকাতায় গানের মালা গেঁথে রবীন্দ্রনাথ ঋতু-উৎসবও সুরু করেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীতেই। বিচিত্রা-ভবনের পশ্চিমদিকে খোলা জমির উপরে বৃহৎ পটমণ্ডপ বেঁধে আসরে বহু শ্রোতার জন্যে স্থান সংকুলান করা হয়েছিল। বহু গায়ক, গায়িকা ও যন্ত্রী সেই উৎসবে যোগদান করেছিলেন। সেটা বর্ষা কি বসন্ত ঋতুর পালা, তা আর স্মরণ হচ্ছে না, তবে জলসা যে রীতিমত জ’মে উঠেছিল, একথা বেশ মনে আছে। ঋতুর জন্যে এমন দল বেঁধে ঘটা ক’রে পার্বণের আয়োজন, এদেশে এটা ছিল তখন অভিনব ব্যাপার। কেবল দোলযাত্রায় এখানে রং ছুঁড়ে হৈ হৈ ক’রে হোলীর গান গেয়ে মাতামাতি হড়োহুড়ি করা হয় বটে। কিন্তু সে হচ্ছে নিতান্ত প্রাকৃতজনদের উৎসব, ললিতকলাপ্রিয় শিক্ষিতদের প্রাণ তাতে সাড়া দেয় না।
নাচ-গান-অভিনয় বা কাব্যপাঠের আসর না বসলেও বিভিন্ন অনষ্ঠানের অভাব হ’ত না। তখন বসত গল্প ও সংলাপের বৈঠক এবং সেখানে এসে সমবেত হতেন বাংলাদেশের বিদ্বজ্জনসমাজের বাছা-বাছা বিখ্যাত ব্যক্তিগণ, তাঁদের নামের দীর্ঘ ফর্দ এখানে দাখিল করা অসম্ভব। এমনি সব বৈঠকের আয়োজন করা ঠাকুরবাড়ীর চিরদিনের বিশেষত্ব। আমরা যখন ভূমিষ্ঠ হইনি, তখনও ঠাকুরবাড়ীর বৈঠকের শোভাবর্ধন ক’রে যেতেন দেশের যত পুণ্যশ্লোক ব্যক্তিগণ। ঈশ্বর গুপ্ত থেকে সুরু ক’রে প্রায় প্রত্যেক জ্ঞানী ও গুণী বাঙালী এখানে এসে ওঠা-বসা ক’রে গিয়েছেন। ঠাকুরদের এই প্রাচীন বাসভবনকে যে Historic বা ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাড়ী ব’লে গণ্য করা যায় সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। সারা কলকাতা সহরে এর চেয়ে গরিমাময় বাড়ী নেই আর একখানিও।
তখনকার সেই আনন্দ-সম্মিলনের দিনে প্রায়ই আমরা অবনীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে উপস্থিত হতুম। কখনো তাঁকে পেতুম দোতালার সুপ্রশস্ত বৈঠকখানায়, কখনো বা পেতুম দক্ষিণের দীর্ঘ বারান্দা বা দরদালানে। সেখানকার ছবি মনের ভিতরে খুব স্পষ্ট। প্রায়ই গিয়ে দেখতুম, বাগানের দিকে মুখ ক’রে গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ তিন সহোদর ব’সে আছেন তিনখানি আরামআসনে। গগনেন্দ্রনাথ হয়তো কোন বিলাতী পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন, সমরেন্দ্রনাথ হয়তো কোন নাতি কি নাতিনীকে আদর করেছেন এবং অবনীন্দ্রনাথ পটের উপরে তুলিকা চালনায় নিযুক্ত। তারপর ছবি আঁকতে আঁকতেই আমাদের সঙ্গে আলাপ করতেন। একবার চোখ তুলে কথা বলেন, আবার চোখ নামিয়ে পটের উপরে বুলিয়ে যান তুলি। আলাপের সঙ্গে কলার কাজ।
ভেঙে গিয়েছে আজ ঠাকুরবাড়ীর সকল আনন্দের হাট। বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে ব’লে সে বাড়ীর ভিতরে আর প্রবেশ করি না। ঠাকুরবাড়ী আজ নিরালা, নিস্তব্ধ।