এখন যাঁদের দেখছি/প্রযোজক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলী

ষোলো

প্রয়োজক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলী

 যাঁরা সশরীরে দেখা দেন রঙ্গমঞ্চে ও ছবির পর্দার গায়ে, তাঁদের অনেকের কথা নিয়েই আলোচনা করেছি। কিন্তু যাঁরা যবনিকার অন্তরালে আত্মগোপন ক’রে জনসাধারণের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করেন, এবারে এমন একজন কৃতী শিল্পরসিকের সঙ্গে আপনাদের পরিচয়সাধন ক’রে দিতে চাই।

 বাংলাদেশে গোড়ার দিকে যাঁরা চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ সুগম ক’রে দিয়েছিলেন, প্রিয়নাথ গাঙ্গুলী হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বাংলা সিনেমার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে থাকবে চিরদিনই। প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে যখন বাংলা ছবির জন্ম হয়নি, চিত্রব্যবসায়ী ম্যাডান যখন ছোট ছোট বিলাতী ছবি নিয়েই কারবার চালান, প্রিয়বাবু তখন ছিলেন ঐ সম্প্রদায়ের বৈতনিক কর্মচারী। তারপর ম্যাডানরা যখন বাংলা ছবি তোলার ব্যবসা ফেঁদে বসলেন, তখন তিনি হয়ে দাঁড়ালেন তাঁদের ডানহাতের মত। সেই নির্বাক যুগে চিত্রপরিচালক রূপেও তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

 আজকাল তো দেখছি ভুইফোঁড় পরিচালকের যুগ চলছে। বর্ষার আগাছার মত পরিচালক দেখা দেন দিকে দিকে। দু’দিন আগেও যাঁরা ছিলেন নামগোত্রহীন অচেনা কোথাকার কে, হঠাৎ তাঁরা উড়ে এসে জুড়ে বসেন চিত্রজগতের সবচেয়ে দায়িত্বপূর্ণ কর্মীর আসন দখল ক’রে। কিন্তু বর্ষা ফুরোয়, আগাছা শুকোয় এবং তারপর হয়ে যায় নিশ্চিহ্ন। এই সব কাল-কা-যোগীর পাল্লায় প’ড়ে হাল-বাংলার চলচ্ছবির অবস্থা ক্রমশই সঙীন হয়ে উঠছে।

 অনেকে পুঁথিগত বিদ্যার জোরে পরিচালকের আসন অধিকার করতে চান। বিলাতী সিনেমার টেকনিক ও কার্যপ্রণালী নিয়ে কেতাব লেখা হয়েছে রাশি রাশি, রাম-শ্যামও সস্তার বাজার থেকে তা খরিদ করতে পারে। সেই সব মুখস্থ ক’রে তোতাপাখীর মত বড় বড় বুলি আওড়াতে শিখেই অনেক আরসোলা-জাতীয় ব্যক্তি নিজেদের পক্ষী-জাতীয় জীব ব’লে মনে করেন।

 কিন্তু সেই সব বিজাতীয় শিল্পনির্দেশ অনুসারে চ’লে যাঁরা বাংলা ছবির কাজ চালাতে চান, বাধা পেতে হয় তাঁদের পদে পদেই। বাংলা স্টুডিয়োর আবহ হচ্ছে একেবারে অন্যরকম। যেমন ইংরেজী ব্যাকরণ শিখে সংস্কৃত রচনাবলীতে দখল জন্মায় না, তেমনি বিলাতী সিনেমার পুঁথিগত টেকনিক আয়ত্ত ক’রে কেউ বাংলা ছবির কাজও চালাতে পারবেন না। এখানকার স্টুডিয়োর অবস্থা ও কার্য পদ্ধতি, কর্মী ও শিল্পীদের ধাত বা মনের গড়ন, ছবির বিষয়বস্তু এবং দর্শকদের রুচি ও প্রকৃতি একেবারেই স্বতন্ত্র। বিদেশী পুঁথি থেকে লব্ধ ‘থিয়োরেটিক্যাল’ বা সূত্রাত্মক জ্ঞান এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজে লাগে না।

 সূত্রাত্মক জ্ঞান নয়, পদে পদে অগ্রসর হয়ে বা বাধা পেয়ে এবং হাতে-নাতে কাজ করবার দুর্লভ সুযোগ গ্রহণ ক’রে প্রিয়বাবু অর্জন করেছিলেন ‘প্র্যাকটিক্যাল’ বা ব্যবহারিক জ্ঞান। শিশু বাংলা ছবির লালনভার পেয়ে তাঁর বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষার পর পরীক্ষা ক’রে তিনি যে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, এখন এদেশে আর কারুর তা আছে ব’লে মনে হয় না। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্র বা নৃত্য প্রভৃতি হচ্ছে ব্যক্তিগত আর্ট। ও-সব ক্ষেত্রে শিল্পীরা কোন ‘থিয়োরি’ বা সূত্র নিয়ে নিজে নিজেই একান্তে ব’সে পরীক্ষা করতে পারেন। কিন্তু চলচ্চিত্র হচ্ছে এমন একটি আর্ট, যা নানা শ্রেণীর বহু শিল্পী ও কর্মীর সঙ্ঘবদ্ধ সহযোগিতা লাভ না করলে সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হয়ে উঠতে পারে না; পরিচালককে করতে হয় বহুজনের মুখাপেক্ষা। এইজন্যেই সূত্রাত্মক জ্ঞানের চেয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানই তাঁর পক্ষে বেশী কাজ করে।

 ম্যাডান কোম্পানী এক সময়ে জুড়ি চালাতে চেয়েছিলেন—চিত্রাভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চাভিনয়। ছবির মুলুকে তাঁদের ব্যবসায় একচেটে হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সাধারণ নাট্যজগতে তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত স্থায়িত্ব লাভ করেনি। তবু শেষোক্ত ক্ষেত্রে ম্যাডানদের কর্মতৎপরতা বাংলা নাট্যকলার ধারাকে বাহিত করেছিল প্রশস্ততর নূতন এক খাতে। বর্তমান কালের নাট্যাচার্য শিশিরকুমার সাধারণ রঙ্গালয়ে যোগদান করেন তাঁদেরই আমন্ত্রণে এবং তাঁরাই এনেছিলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ীকেও। সেই সময়ে ম্যাডানদের রঙ্গালয়ের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন প্রিয়বাবুই। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।

 প্রথম যেদিন তাঁকে দেখি, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করবার সুযোগ হয়নি। ১৯২২ খৃষ্টাব্দের কথা। শিশিরকুমার সাধারণ রঙ্গালয়ে আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই জনসাধারণের কাছ থেকে অতুলনীয় অভিনন্দন লাভ করলেন দেখে মিনার্ভা থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী স্বর্গীয় বন্ধুবর উপেন্দ্রকুমার মিত্রও যুগোপযোগী কোন নূতন ও শক্তিশালী অভিনেতাকে নিজের সম্প্রদায়ভুক্ত করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সেই সময়ে সৌখীন নাট্যজগতে শ্রীনরেশচন্দ্র মিত্রের খুব ডাকনাম। আমি তখনও তাঁর অভিনয় দেখিনি বটে, কিন্তু কারুর কারুর মুখে শুনতুম, শিল্পী হিসাবে তিনি নাকি শিশিরকুমারেরও চেয়ে শ্রেষ্ঠ। উপেনবাবুর কানেও বোধ করি এমনি কোন কথা উঠেছিল। একদিন তিনি আমার বাড়ীতে এসে অনুরোধ করলেন, নরেশচন্দ্রকে মিনার্ভা থিয়েটারে নিয়ে আসবার জন্যে।

 আমি তখন নরেশচন্দ্রকে চিনতুম না, তাই স্বর্গীয় নাট্যশিল্পী রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় নরেশচন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত হলুম এবং তাঁর কাছে উপস্থিত করলুম উপেনবাবুর প্রস্তাব। নরেশচন্দ্র তখনি রাজী হয়ে গেলেন।

 কিন্তু ম্যাডানরা যে শিশিরকুমারের সঙ্গে নরেশচন্দ্রকেও নিজেদের দলে টানবার জন্যে চেষ্টা করছেন, তখন পর্যন্ত এ কথা আমি জানতুম না। যেদিন উপেনবাবুদের সঙ্গে নরেশচন্দ্রের বন্দোবস্ত পাকা হয়ে যাবার কথা, ঠিক সেইদিনই হস্তদন্তের মত প্রিয়বাবু মিনার্ভা থিয়েটারে এসে উপস্থিত। তিনি অনেক বোঝালেন, কিন্তু নরেশচন্দ্র কিছুতেই বোঝ মানলেন না। তিনি মিনার্ভা থিয়েটারেই যোগদান করলেন।

 কিছুদিন পরে শিশিরকুমার আবার ডুব মারলেন। ম্যাডানদের রঙ্গালয়ে তাঁর বদলে দেখা দিতে লাগলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী। ওখানে খোলা হ’ল স্বর্গীয় বন্ধুবর মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের “মুক্তার মুক্তি” নাটিকা। সেই সূত্রে প্রায় প্রত্যহই আমি ওখানে যাতায়াত করতুম। প্রিয়বাবু তখনও সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক—এক সঙ্গে তিনি সিনেমার ও থিয়েটারের কার্য পরিচালনা করেন। সেই সময়েই তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

 নাট্যকার হবার লোভে বা কোন থিয়েটারের জন্যে নয়, স্বর্গত কবিবন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুরোধে ভিক্টর হুগোকে অবলম্বন ক’রে আমি একখানি নাটক রচনা করি। রচনাটি আমার বন্ধুদের ভালো লেগেছিল। প্রিয়বাবু সেই নাটকখানি ম্যাডানদের রঙ্গালয়ে মঞ্চস্থ করবার জন্যে তোড়জোড় করতে লাগলেন। নটনটীদের সামনে বসে নাটকখানি আমি পাঠ ক’রে শোনালুম। ভূমিকালিপি পর্যন্ত বিলি হয়ে গেল—কিন্তু ঐ পর্যন্ত।

 ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ তখন ওখানকার বৈতনিক বাঁধা নাট্যকার। তিনি থাকতে ওখানে আর কারুর নাটক অভিনীত হয়, এটা তাঁর মনঃপূত হ’ল না, তিনি বালকের মত কাতর হয়ে পড়লেন। আমিও প্রাচীন নাট্যকারের মনে ব্যথা দিতে চাইলাম না, মনোনীত নাটক তুলে নিয়ে আমি চ’লে এলুম।

 তার কিছুদিন পরে ম্যাডানদের রঙ্গালয় উঠে গেল। প্রিয়বাবু আবার চলচ্চিত্র নিয়ে নিযুক্ত হয়ে রইলেন। কয়েক বৎসর তাঁর সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। কিন্তু তাঁর কার্যকলাপের সব খবর পেতুম। কয়েকখানি নির্বাক চিত্র তুলে তিনি যখন ম্যাডানদের সম্প্রদায় ছেড়ে দিয়ে ইষ্ট ইণ্ডিয়া ফিল্ম সম্প্রদায়ে যোগদান করেন, ছবি তখন কথক হয়ে উঠেছে। প্রিয়বাবুর পরিচালনায় ওঠে “যমুনাপুলিনে” চিত্র। তারপর তিনি গঠন করেন নিজস্ব চিত্রসম্প্রদায়—“ইণ্ডিয়া ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিজ”। পরে তার নাম হয় “কালী ফিল্ম”।

 তারপর ওখানে যখন তিনকড়ি চক্রবর্তীর পরিচালনায় “ঋণমুক্তি” ছবি উঠছে, প্রিয়বাবু সেই সময়ে আবার আমাকে স্মরণ করলেন। বললেন, ঋণমুক্তির জন্যে আপনাকে গান রচনা আর নৃত্য পরিকল্পনা করতে হবে।” তাঁর কথা রাখলুম। কালী ফিল্মের অবস্থা তখন বিশেষ উন্নত নয়। নতুন সম্প্রদায়, আধুনিক কালের উপযোগী স্টুডিয়ো তখনও নির্মিত হয়নি, কৃত্রিম আলোক ব্যবহার করবার উপায় নেই, নানা দিকে নানা অসুবিধার মধ্যে ছবি তুলতে হয়। তবু “ঋণমুক্তি” ছবি হিসাবে মন্দ হয়নি।

 তার কিছুদিন পরে প্রিয়বাবু হঠাৎ একদিন আমার বাড়ীতে এসে উপস্থিত। বললেন, “হেমেন্দ্রবাবু, আপনার ‘মণিকাঞ্চন’ উপন্যাস অবলম্বন ক’রে আমি একখানি ছবি তুলতে চাই। চিত্রনাট্যও আমি লিখে ফেলেছি।” দুজনেই দুজনের পুরাতন বন্ধু। দেনাপাওনা বা ‘কণ্ট্রাক্টে’র কোন কথাই উঠল না, ছবি তোলা শুরু হয়ে গেল। ব’লে রাখি, কাগজে-কলমে লেখাপড়া না ক’রেও আমি ঠকিনি এবং তিনিও ঠকেননি, কারণ ঐ ছবি যখন “তরুণী” নামে বাজারে বেরোয়, তখন তার চাহিদা হয়েছিল বিস্ময়কর। শুনতে পাই, কালী ফিল্মের আর কোন ছবিই “তরুণী”র মত টাকা আনতে পারেনি।

 প্রিয়বাবু আগে ছিলেন পরিচালক, পরে হন প্রয়োজক। কিন্তু তাঁর মস্ত গুণ এই যে, কারুর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না ক’রেও প্রত্যেক বিভাগের কর্মিগণকে তিনি যথানির্দিষ্ট পথে চালনা করতে পারেন। আমার মতে শ্রেষ্ঠ প্রয়োগকর্তার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, তাঁর আদেশকে শোনায় অনুরোধের মত, তাই তিনি ‘হাঁ’ বললে কেউ ‘না’ বলতে পারে না। এই হিসাবে প্রিয়বাবু হচ্ছেন একজন শ্রেষ্ঠ প্রয়োজক তথা পরিচালক।

 প্রিয়বাবু প্রিয়ংবদ, দেহ দীর্ঘ, সুগঠিত ও পুরুষোচিত— দশজনের ভিতর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর নম্রতায় ও সৌজন্যে প্রীত হয় সকলেই। কালী ফিল্ম স্টুডিয়োয় শিল্প সংক্রান্ত কর্তব্য নিয়ে আমাকে বহুদিন নিযুক্ত থাকতে হয়েছে— কোন কোন দিন ষোলো-সতেরো ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছে আন্দাজও করতে পারিনি। প্রিয়বাবুদের কাছ থেকে বরাবরই লাভ করেছি বন্ধুজনসুলভ মিষ্ট ব্যবহার এবং আদরযত্ন। কালী ফিল্মে আমরা ছিলুম একটি সুখী পরিবারের মত। কাজের খাতিরে আমাকে আরো কয়েকটি স্টুডিয়োর সংস্রবে আসতে হয়েছে, কিন্তু আর কোথাও গিয়ে বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিনি। কোন কোন কচি ও কাঁচা প্রযোজক ও পরিচালককেও দস্তুরমত এক-একটি চীজ্ ব’লে মনে হয়েছে। চিত্রজগতে প্রিয়বাবুর পিছনে রয়েছে কত বৎসরের অভিজ্ঞতা, কিন্তু কোনদিনই তাঁর মধ্যে আমি হাম-বড়া ভাব লক্ষ্য করিনি। নতুন কোন suggestion বা ইঙ্গিত দিলে তৎক্ষণাৎ তিনি তা গ্রহণ করেছেন। এমনি সব নানা কারণে আমাদের চিত্রজগতে প্রিয়বাবুকে আমি একজন অসাধারণ লোক ব’লেই মনে করি।