এখন যাঁদের দেখছি/বাঙালী মল্লের অভিযান
পনেরো
বাঙালী মল্লের অভিযান
লাইট-হেভি ওয়েটে পৃথিবীজেতা পদবী লাভ করার মানেই হচ্ছে অসামান্য সম্মানের অধিকারী হওয়া, কারণ সমগ্র পৃথিবীর প্রথম বা সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লের পরেই লাইট-হেভি ওয়েটের আসন। গামা থেকে আরম্ভ ক’রে আর কোন ভারতীয় মল্লই এই প্রতিযোগিতায় যোগ দেবার সুযোগ গ্রহণ করেন নি। গামা কেবল ইংলণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লরপে “জনবুল বেল্টে”র অধিকারী হয়েছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে একমাত্র গোবরবাবুই ঐ পদবী লাভ করতে পেরেছেন। যে বাংলাদেশে দুই যুগ আগে উচ্চশ্রেণীর কুস্তিগীর ছিল দুর্লভ, সেই সময়েই গোবরবাবু অভাবিত ভাবে প্রমাণিত করেছিলেন যে, কেবল জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ললিতকলার ক্ষেত্রে নয়, বীরাচারীর কর্তব্যপালনেও সকলের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ব্যাঘ্রভূমি বঙ্গভূমির সন্তান।
ফুটবল খেলার মাঠে মোহনবাগান প্রথম “শীল্ড” বিজয়ী হয়ে অর্জন করেছে চিরস্মরণীয় কীর্তি। মোহনবাগানের সম্মানকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ না ক’রেই বলতে পারি, ফুটবলের মাঠে জয়লাভ করা যায় প্রধানত ক্রীড়ানৈপুণ্যের জন্যেই। তার নিরিখ নির্ণীত হয় যদি শারীরিক শক্তি হিসাবে, তাহ’লে এখনো কোন বাঙালী দলই কোন নিম্নতর শ্রেণীর ইংরেজ দলের জয়পতাকাকেও নমিত করতে পারবে কিনা সন্দেহ! তার উপরে আমরা নিম্নতর শ্রেণীর ইংরেজ দলকে হারাতে পারি স্বদেশে ব’সেই। খাস বিলাতে গিয়ে সেখানকার প্রথম শ্রেণীর পেশাদার দলকে হারাতে পারে, ভারতবর্ষে এমন ফুটবল খেলোয়াড়ের দল বোধ করি আজ পর্যন্ত গঠিত হয়নি।
গোবরবাবুর পক্ষে সবচেয়ে শ্লাঘনীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, তাঁর সম্বল ছিল কাট-কৌশলের সঙ্গে অমিত দৈহিক শক্তি। উপরন্তু সাত সাগরের পারে বিদেশ-বিভূঁয়ে সিংহের বিবরে গিয়ে তিনি পরাস্ত ক’রে এসেছেন পশুরাজকে। কৃষ্ণাঙ্গ-বিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গদের স্বদেশে গিয়ে সেখানকার শ্রেষ্ঠদের বাহুবলে হারিয়ে দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদন করবেন বাংলার এক ছেলে, এটা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার।
আগেই বলেছি, পাঞ্জাবকেশরী গামা অতুলনীয় ও ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পালোয়ান হ’লেও, পাশ্চাত্য দেশ তাঁর শক্তি সম্বন্ধে সম্যকরূপে পরিচিত নয়। কারণ তিনি সেখানকার উল্লেখযোগ্য দুইজনের বেশী পালোয়ানের (ডাঃ রোলার ও বিস্কো) সঙ্গে কুস্তি লড়েননি। আর গোবরবাবু পাশ্চাত্য দেশে গিয়ে সেখানকার সর্বশ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ পালোয়ানদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধ’রে শক্তিপরীক্ষা করেছেন।
জো স্টেচার হেভি ওয়েটে পৃথিবীজয়ী হয়েছিল দুইবার (১৯১৬ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত; এবং ১৯২০)। বিস্কোও দুইবার ঐ উপাধি লাভ করেছিল। গোবরবাবুর সঙ্গে তাদের লড়াই হয় একাধিকবার। কখনো জিতেছেন গোবরবাবু, কখনো জিতেছে তারা। জিম লণ্ডস্ ও সনেনবার্গও পরে হয়েছিল পৃথিবীজয়ী। প্রথম ব্যক্তি গোবরবাবুর সঙ্গে সমান সমান হয়েছিল এবং শেষোক্ত ব্যক্তি হেরে গিয়েছিল তাঁর কাছে। এ ছাড়া আরো যে কত নামজাদা শ্বেতাঙ্গ পালোয়ান গোবরবাবুর পাল্লায় পড়ে ভূমিচুম্বন করেছিল, এখানে তার ফর্দ দাখিল করবার জায়গা নেই। মোট কথা, এত বেশী শ্বেতাঙ্গ পালোয়ানের গর্ব খর্ব করতে পারেননি আর কোন ভারতীয় মল্ল।
অ্যাড স্যাল্টেলকে হারাবার পর আমেরিকায় স্ট্র্যাঙ্গলার লুইস ছাড়া গোবরবাবুর যোগ্য আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। সুতরাং গোবরবাবু তাকেই যুদ্ধে আহ্বান করলেন। কিন্তু তাঁর সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি; অক্ষমতার জন্যে নয়, বিচারকের সমূহ অবিচারে। কালোর অদ্বিতীয়তা যখনই প্রমাণিত হবার উপক্রম হয়, ধলোরা এমনি সব উপায়েই মান বাঁচাবার চেষ্টা করে।
তার আর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, জ্যাক জনসন বনাম জেস উইলার্ডের মুষ্টিযুদ্ধে। কালা আদমী পৃথিবীজেতার আসনে অটলভাবে উপবিষ্ট, এর জন্যে শ্বেতাঙ্গদের মনস্তাপের অবধি ছিল না। তাই আগেই বলেছি, গুপ্তহত্যার ভয় দেখিয়ে জনসনকে হার মানতে বাধ্য করা হয়েছিল, নইলে উইলার্ডের মত যোদ্ধা তাঁর পাশে দাঁড়াবারও যোগ্য ছিল না। উইলার্ড যখনই দ্বিতীয় ও মধ্যম শ্রেণীর যোদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তখনই পরাজিত হয়েছেন। গানবোট স্মিথ কখনো পৃথিবীজেতা হ’তে পারেননি। জনসনের সামনে গেলে তাঁর অবস্থা হ’ত হয়তো তোপের মুখে উড়ে যাবার মত। তাঁর আর উইলার্ডের দেহের ওজন ছিল যথাক্রমে ১৮৫ ও ২৫০ পাউণ্ড এবং দেহের দীর্ঘতা ছিল যথাক্রমে ৫ ফুট এগারো ইঞ্চি এবং ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি। তবু উইলার্ড জিততে পারেননি। টম ম্যাক্মোহন এক সাধারণ যোদ্ধার কাছেও তিনি হেরে গিয়েছিলেন। এমন একটা বাজে লোকের কাছেও শ্বেতাঙ্গদের মান রক্ষার জন্যে জনসন হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। উইলার্ড পরে জ্যাক ডেম্পসি ও লুইস ফির্পোর সামনেও দাঁড়াতে পারেননি, অথচ জনসন তারপর বহু যোদ্ধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক বারেই জয়ী হয়েছেন। এমনকি জনসনের বয়স যখন তেতাল্লিশ বৎসর, তখন তাঁর চেয়ে বয়সে সতেরো বছরের ছোট হোমার স্মিথও তাঁর কাছে পরাজয় স্বীকার করেছিলেন।
গোবরবাবু ভারতবর্ষে প্রকাশ্যভাবে একবার মাত্র কুস্তি প্রতিযোগিতায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেবারেও বিচার–প্রহসন হয়নি বটে, কিন্তু হয়েছিল বিচার-বিভ্রাট। সে কথা পরে বলব।
আমেরিকায় কুস্তি প্রতিযোগিতা লোকপ্রিয় হয়েছে ১৮৭০ খৃষ্টাব্দ থেকে। কিন্তু সেখানকার পেশাদার কুস্তিগীররা টাকার লোভে প্রায়ই কৃত্রিম যুদ্ধের (বা Mock fight) ব্যবস্থা করত ব’লে কুস্তির প্রতি লোকে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিল। বর্তমান শতাব্দীতে কুস্তির মান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বটে, কিন্তু ১৯২২ খৃষ্টাব্দে আমেরিকার স্ট্র্যাঙ্গলার লুইসের “পৃথিবীজেতা” উপাধি লাভের পর থেকেই মল্লযুদ্ধের দিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় সকলের দৃষ্টি।
ডাঃ বি এফ রোলারের পেশা হচ্ছে ডাক্তারী, কিন্তু মল্লযুদ্ধেও তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছেন। শুনেছি অল্পকালের জন্যে তিনি “পৃথিবীজেতা” উপাধি লাভ করেছিলেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতরূপে কিছু বলতে পারি না। তবে তিনি প্রথম শ্রেণীর যোদ্ধা ছিলেন ব’লেই গামার সঙ্গে তাঁর কুস্তি হয়েছিল, অবশ্য সে প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যান। স্ট্র্যাঙ্গলার লুইসও উঠতি বয়সে একবার তাঁর কাছে হেরেছিলেন।
ডাঃ রোলার বলেন, “ফ্রাঙ্ক গচ (তিনি “পৃথিবীজেতা” উপাধি বজায় থাকতে থাকতেই পূর্ণ গৌরবে অবসর নিয়েছিলেন) একজন মহামল্ল ছিলেন বটে কিন্তু আমার বিশ্বাস, তাঁর পূর্ণ গৌরবের যুগেও বর্তমান কালের দুই-তিনজন কুস্তিগীর তাঁকে হারিয়ে দিতে পারতেন। গচ্ যখন নাম কিনেছিলেন, তখনকার কুস্তিগীররা ছিলেন মধ্যম শ্রেণীর। স্ট্র্যাঙ্গলার লুইস গচের চেয়ে বলবান আর ওজনে ভারি এবং চাতুর্যে ও গতির ক্ষিপ্রতায় তিনি গচের চেয়ে কম যান না। হাতের প্যাঁচের (head-lock) দ্বারা তিনি গচ্কে পরাজিত করতে পারতেন।”
লুইসের মাথার উচ্চতা ছিল ছয় ফুট। উঠতি বয়সে যখন তিনি ডাঃ রোলার প্রভৃতির দ্বারা পরাজিত হয়েছিলেন, তখন তাঁর দেহের ওজন ছিল মাত্র ১৭৫ পাউণ্ড। কিন্তু যখন গোবরবাবুর সম্মুখবর্তী হন, তখন ছিলেন দস্তুরমত গুরুভার। গোবরবাবুরও দেহ বিরাট—যেমন দৈর্ঘ্যে (বোধ করি তিনি ছয় ফুটের চেয়ে মাথায় উঁচু), তেমনি প্রস্থে।
লুইসের সবচেয়ে বড় প্যাঁচ ছিল “হেড-লক”। অন্যান্য পালোয়ানরা নিজেদের মাথা এগিয়ে দিয়ে তাঁকে তা অভ্যাস করবার সুযোগ দিতে সম্মত হ’ত না, কারণ সে প্যাঁচ কষলে মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসত। লুইস তাই কতকগুলো কাঠের নরমুণ্ড তৈরি করিয়ে নিয়েছিল—সেগুলোর ভিতর হ’ত ফাঁপা। দুভাগ করা ফাঁপা মাথার ভিতরে থাকত খুব জোরালো স্প্রিং— যেমন থাকে স্যাণ্ডোর গ্রিপ ডাম্বেলের ভিতরে। বাহুর চাপ দিয়ে স্প্রিংয়ের বিরুদ্ধে কাঠের মাথার দুই অংশ এক করতে গেলে দরকার হ’ত একজন মহাবলবান ব্যক্তির চূড়ান্ত শারীরিক শক্তি। এই প্যাঁচ অভ্যাস করতে করতে লুইসের বাহুর কতকগুলো পেশী অসাধারণ স্ফূর্তিলাভ করেছিল।
কিন্তু ভারতীয় পালোয়ানদেরও মানসিক তূণে সঞ্চিত আছে অসংখ্য মারাত্মক প্যাঁচ, বিলাতী কুস্তিগীররা তার খবর রাখে না। এইজন্যেই গামা ও ইমামবক্স প্রমুখ পালোয়ানদের পাল্লায় প’ড়ে ডাঃ রোলার, বিস্কো ও জন লেম প্রভৃতি বিলাতী যোদ্ধারা কয়েক মিনিটের মধ্যেই হয়েছিলেন পপাত ধরণীতলে। সুতরাং লুইসের “হেড-লকে”র নামে শ্বেতাঙ্গ কুস্তিগীরদের হৃদ্কম্প হ’লেও গোবরবাবুর ভয়ের কারণ ছিল না।
লুইসের সঙ্গে গোবরবাবুর কুস্তি শুরু হ’ল। লুইস ভেবেছিল তার “হেড-লকে”র বিষম ধাক্কা সহ্য করতে পারবেন না গোবরবাবু। কিন্তু তাঁর ভ্রম ভাঙতে দেরি লাগল না। খানিকক্ষণ কুস্তির পর সে গোবরবাবুকে একবার চিত করতে পারল বটে, কিন্তু তাকেও হ’তে হ’ল চিতপাত। গতবারেই বলেছি, পাশ্চাত্য দেশে তিনবার (সময়ে সময়ে পাঁচবারও) কুস্তি লড়বার পর হার-জিত সাব্যস্ত হয়। দুইবারের পর লুইস ও গোবরবাবু, হ’লেন সমান সমান। তৃতীয়বারে যে চিত হবে, হার মানতে হবে তাকেই।
কিন্তু প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তৃতীয়বার অবতীর্ণ হয়েই লুইস নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল, গোবরবাবু বড় সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বী নন, তাঁর কাছে তার হারবার সম্ভাবনা আছে যথেষ্ট। প্রতিযোগীদের কেউ যখন নিয়মবিরুদ্ধ অন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় তখনই বোঝা যায়, নিজের সক্ষমতা সম্বন্ধে তার মনে জেগেছে সন্দেহ। তাই গোবরবাবুকে কিছুতেই এঁটে উঠতে না পেরে বহুকাল আগে ইংরেজ কুস্তিগীর জিমি ইসেন যা করেছিল, লুইসও তাই করলে —অর্থাৎ কুস্তি ছেড়ে বক্সিংয়ের আশ্রয় নিলে। গোবরবাবুকে করলে সে মুষ্ট্যাঘাত! যেমন অন্যায়কারী যোদ্ধা, তেমনি অসাধু বিচারক। কৃষ্ণাঙ্গের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধেও ন্যায়সঙ্গত, এইটেই হচ্ছে পাশ্চাত্য বিধান। কারণ জিমি ইসেন ঘুষি মারলেও বিচারক “ফাউল” করেছে ব’লে তাকে বসিয়ে দেননি, লুইস ও মুষ্টি ব্যবহার ক’রে পরাজিত ব’লে স্বীকৃত হয় নি—মল্লযুদ্ধের আইন অনুসারে যা হওয়া উচিত।
বিচারক দেখেও কিছু দেখলেন না বটে, কিন্তু গোবরবাবু এতটা ব্যভিচার মুখে বুঁজে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি যখন কুস্তি থামিয়ে বিচারকের দিকে ফিরে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেন, লুইস তখন পিছনদিক থেকে এসে তাঁর পা ধ’রে প্রচণ্ড এক টান মারলে। অতর্কিতে এমন অভাবিত ভাবে আক্রান্ত হয়ে গোবরবাবু মাটির উপরে আছড়ে পড়লেন এবং মাথায় পাটাতনের চোট লেগে তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হ’য়ে গেলেন।
বিচারক লুইসকেই জয়ী ব’লে মেনে প্রমাণিত করলেন, পাশ্চাত্য দেশেও কাজীর বিচার হয়। এইজন্যেই আমি বলেছিলুম, যেখানে বর্ণবিদ্বেষ প্রবল, সেখানে বিচারের আশা থাকে না বললেই চলে।
লুইসের সঙ্গে গোবরবাবুকে আর কুস্তি লড়বার সুযোগ দেওয়া হয় নি। কাজেই তিনি লাইট-হেভি ওয়েটে পৃথিবীজেতা কুস্তিগীরের পদে বহাল থেকেই স্বদেশে প্রত্যাগমন করলেন। এই পদের মর্যাদা রক্ষা করবার জন্যে আর তিনি সাগরপারে পাড়ি দেন নি বটে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশ থেকেও কেউ এসে তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান ক’রে ঐ পদবী কেড়ে নিতে পারে নি। তাঁর “পৃথিবীজেতা” ব’লে সম্মান অক্ষুন্নই আছে।
গোবরবাবু কলকাতায় আবার নিজের বৈঠকে এসে জাঁকিয়ে বসলেন। তাঁর ঘরে আবার আরম্ভ হ’ল আমাদের আনন্দ-সম্মিলন। পুরাতন দিনের গল্প, আমেরিকার গল্প, ললিতকলার গল্প, গানবাজনাও বাদ পড়ল না।
তারপরই গোবরবাবু বড় গামাকে প্রতিযোগিতায় আহ্বান ক’রে চারিদিকে জাগিয়ে তুললেন এক বিশেষ উত্তেজনা। পাঞ্জাবকেশরী নামে বিখ্যাত গামা, পৃথিবীর বড় বড় পালোয়ানরাও যাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভরসা পায় না! একটু চমকিত হলুম বটে, কিন্তু গোবরবাবুর উপরে আমাদের বিশ্বাসের অভাব ছিল না। নিজের ও বড় গামার শক্তি-সামর্থ্য না বুঝে হঠকারীর মত নিশ্চয় তিনি প্রতিযোগিতায় অগ্রসর হবেন না।
শিবনারায়ণ দাসের গলিতে বরাটবাড়ীর পিছনকার অঙ্গনে কুস্তির এক সুবিস্তৃত আখড়া তৈরী করা হ’ল। নিয়মিতভাবে কুস্তি অভ্যাস করবার জন্যে গোবরবাবু পশ্চিম থেকে আনালেন গুট্টা সিং নামে এক বিখ্যাত পালোয়ানকে। দিনে দিনে তাঁর দেহ অধিকতর তৈরি হয়ে এমন সুগঠিত হয়ে উঠল, দেখে আমাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। বাঙালীর তেমন পুরুষসিংহ মূর্তি আমি আর দেখি নি।
ওয়েলিংটন স্কোয়ারে প্রকাণ্ড এক মণ্ডপ প্রস্তুত হ’তে লাগল। কাগজে যখন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এবং মণ্ডপের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন সার্থক হ’ল সেই প্রবাদবাক্য—“মানুষ গড়ে, ভগবান ভাঙেন”! হঠাৎ দারুণ ডিপথিরিয়া রোগে গোবরবাবু একেবারে শয্যাগত হয়ে পড়লেন, তারপর দীর্ঘকাল ধরে তাঁর প্রাণ নিয়ে টানাটানি। বড় গামার সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা আর হ’ল না। আয়োজন-পর্বেই গোবরবাবুর বহু সহস্র টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল —সবই হ’ল ভস্মে ঘৃতাহুতির মত।
তারপর ১৯২৯ খৃস্টাব্দে গোবরবাবুর সঙ্গে ছোট গামার যখন কুস্তি হয়, তখন ছোট গামা যুবক ও তিনি বয়সে প্রৌঢ়। সে কুস্তি দেখবার সুযোগ আমার হয় নি। কিন্তু ভারতীয় ব্যায়াম ও মল্লযুদ্ধ সম্বন্ধে একজন শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ শচীন্দ্র মজুমদার যা বলেছেন, এইখানে আমি সে-কথাগুলি উদ্ধৃত ক’রে দিলুম:
“আমার মনে হয় গোবরবাবুর প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছিল। কুস্তির একটা বাঁধাধরা নিয়ম আছে যে লড়তে লড়তে আখড়ার সীমানায় গিয়ে পড়লে বিচারক কুস্তি ক্ষণিকের জন্যে বন্ধ ক’রে প্রতিদ্বন্দ্বীদের আখড়ার মাঝখানে এসে লড়তে হুকুম দেবেন। নূতন ক’রে লড়বার সময়ে পূর্বে যে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থা থেকে কুস্তি আরম্ভ হবে। গোবরবাবু ও ছোট গামা যখন সীমানার দড়ির উপর গিয়ে পড়লেন, বিচারক তাঁদের আখড়ার মাঝে আসতে হকুম দিলেন। গোবরবাবু প্রতিপক্ষকে ছাড়লেন বটে কিন্তু প্রতিপক্ষ হুকুম অগ্রাহ্য ক’রে গোবরকে চিত করে দিলেন। দর্শকগণ গামার জয় জয়কার ক’রে উঠল এবং বিচারকও ভড়কে গিয়ে তাদের সমর্থন করেন। এ-ধরণের বিচার একাধিকবার কলকাতায় দেখা গেছে।...... বিচারকের দোষে একজনের চেষ্টা বিফল হ’লে আপসোস করবার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়।”
ছোট গামা কলকাতায় এসে দুইবার কুস্তি লড়েছিলেন বাঙালী মল্লের সঙ্গে এবং দুইবারই জয়ী ব’লে সাব্যস্ত হয়েছিলেন বিচারবিভ্রাটের ফলে। টীকা অনাবশ্যক।
গোবরবাবুর অসাধারণ শারীরিক শক্তি সম্পর্কীয় কয়েকটি চিত্তাকর্ষক গল্প আমি জানি। কিন্তু পুঁথি বেড়ে যাচ্ছে, অতএব এইখানেই রুদ্ধ হ’ল আমার লেখনীর গতি।