এখন যাঁদের দেখছি/নজরুল জন্মদিন স্মরণে

ছত্রিশ

নজরুলের জন্মদিন স্মরণে

 স্নেহাস্পদ নজরুল ইসলাম চুয়ান্নো বৎসরে পা দিয়েছেন। কিন্তু বহু বৎসর আগেই রুদ্ধ হয়েছে তাঁর সাহিত্যজীবনের গতি। কবির পক্ষে এর চেয়ে চরম দূর্ভাগ্য আর কিছু নেই। জীবন্ত তরু, কিন্তু ফলন্ত নয়।

 আর একটা বড় দুঃখের কথা হচ্ছে এইঃ নজরুলের লেখনী আর কবিতা প্রসব করে না বটে, কিন্তু তিনি যে কবি, এ বোধশক্তি আজও হারিয়ে ফেলেন নি। এবারের জন্মদিনে কোন ভক্ত তাঁর স্বাক্ষর প্রার্থনা করেছিলেন। নজরুল তাঁর খাতায় এই ব’লে নাম সই করেন— “চিরকবি কাজী নজরুল ইসলাম”। এই স্বাক্ষরের আড়ালে আছে যাতনার ইতিহাস।

 শিল্পীর পক্ষে এই অবস্থা অত্যন্ত মর্মস্তুদ। অতুলনীয় চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পক্ষাঘাত রোগের আক্রমণে তাঁরও হয়েছিল এই অবস্থা। ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সৃষ্টি করার কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে সেটা ছিল অতিশয় পীড়াদায়ক। একদিন তাঁর ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের বাসভবনে দ্বিতলের প্রশস্ত অলিন্দে ব’সে আছি এবং তিনিও তাঁর কারুকাজ করা আসনে আসীন হয়ে নীরবে রোগযন্ত্রণা সহ্য করছেন। হঠাৎ আমার দিকে কাতর দৃষ্টি তুলে অবনীন্দ্রনাথ মৃদু, ক্লিষ্ট কণ্ঠে বললেন, “বড় কষ্ট, হেমেন্দ্র। আঁকতে চাই, আঁকতে পারি না; লিখতে চাই, লিখতে পারি না।”

 একদিন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তাঁর এবং অন্যান্য সকলেরই অজ্ঞাতসারে কালব্যাধি তখনই তাঁর দেহের মধ্যে শিকড় বিস্তার করেছিল। ভিতরে ভিতরে কি সর্বনাশের আয়োজন হচ্ছে, তিনি সেটা ঠিক উপলব্ধি করতে না পারলেও, তখনই শুকিয়ে গিয়েছিল তাঁর রচনার উৎস। সেই সময়ে আমি ছিলুম এক পত্রিকার ("দীপালী”) সম্পাদক। নিজের কাগজের জন্যে শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে একটি রচনা প্রার্থনা করলুম। আমি নিশ্চিতরূপেই জানতুম, আমার আরজি মঞ্জর হবে, কারণ তিনি আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। আগেও তাঁর কাছ থেকে লেখা চেয়েছি এবং পেয়েছি। কিন্তু সেবারে আমার প্রার্থনা শুনে অত্যন্ত করুণ স্বরে তিনি বললেন, “ভাই হেমেন্দ্র, বিশ্বাস কর, আমি আর লিখতে পারি না। লিখতে বসলেই মাথার ভিতরে বিষম যাতনা হয়। কলম ছেড়ে উঠে পড়ি।” তাঁর চক্ষের ও কণ্ঠের আর্ত ভাব এখনো আমি ভুলি নি। তারপর সত্য সত্যই শরৎচন্দ্র আর কোন নতুন রচনায় হাত দেন নি।

 এখানে ফ্রান্সের অমর ঔপন্যাসিক আলেকজাণ্ডার ডুমার কথাও মনে হয়। শেষ বয়সেও তাঁর মনের মধ্যে রচনার জন্যে প্রেরণার অভাব ছিল না, তিনি রোজ টেবিলের ধারে গিয়ে বসতেন। তাঁর হাতে থাকত কলম এবং সামনে থাকত কাগজ। কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু তিনি আর লিখতে পারতেন না। তাঁর তখনকার মনের যাতনা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ কল্পনা করতে পারবে না।

 নজরুলের মন বোধ হয় এখন এইরকমই শোকাবিষ্ট হয়েছে। নিজেকে যখন “চিরকবি” ব’লে স্বাক্ষর করছেন, তখন মনে মনে এখনো তিনি নিশ্চয়ই বাস করছেন কাব্য-জগতে। কিন্তু নিজে যা দেখছেন, বা বুঝছেন, ভাষায় তা প্রকাশ করতে পারছেন না। এ যেন মূকের স্বপ্নদর্শন। যা দেখা যায়, তা বলা যায় না। বলতে সাধ হ’লেও বলা যায় না।

 পত্রান্তরে নজরুল সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছি। কিন্তু তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আরো কোন কোন কথা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

 নজরুল যখন প্রথম সাহিত্যক্ষেত্রে পদার্পণ করেন, তখন এখানে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক ও মোহিতলাল মজুমদার প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কবিরা সমুদিত ও সুপরিচিত হয়েছেন। আরো দুই-একজন তখন উদীয়মান অবস্থায়। রবীন্দ্রনাথের লেখনী তখনও অশ্রান্ত। আমাদের কাব্যজগতে সেটা ছিল সুভিক্ষের যুগে। কবিতার কোন অভাবই কেউ অনুভব করে নি।

 কিন্তু যুগধর্ম প্রকাশ করতে পারেন, দেশ যে এমন কোন নূতন কবিকে চায়, নজরুলের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই সত্য উপলব্ধি করতে পারলে সকলেই।

 এদেশে এমনিই তো হয়ে আসছে বরাবর। য়ুগে যুগে আমরা পুরাতন ও পরিচিতদের নিয়েই মেতে থাকতে চেয়েছি, অর্বাচীনদের উপরে কোন আস্থা না রেখেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালী গদ্যলেখকরা যে উৎকট ভাষা ব্যবহার করতেন, তা ছিল পরোমাত্রায় সংস্কৃতের গোলাম। আমরা তারই মধ্যে পেতুম উপভোগের খোরাক, সৌন্দর্যের সন্ধান। হঠাৎ টেকচাঁদ ঠাকুর ও হুতোম আবির্ভূত হয়ে যখন আমাদের ঘরের পানে তাকাতে বললেন, তখন আমরা একটু অবাক হয়েছিলুম বটে, কিন্তু তাঁদের ক’রে রেখেছিলুম কোণঠাসা। সাহিত্যের দরবারে কথ্য ভাষাকে কায়েমী করবার জন্যে পরে দরকার হয়েছিল প্রমথ চৌধুরীর শক্তি ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা। যখন বঙ্কিমচন্দ্র “দুর্গেশনন্দিনী” ও মাইকেল মধূসুদন “মেঘনাদবধ” নিয়ে আসরে প্রবেশ করেন, তখনও কেউ তাঁদের প্রত্যাশা করে নি।

 উপরোক্ত যুগান্তকারী লেখকগণের সঙ্গে নজরুলের তুলনা করা চলে না বটে, কিন্তু বহু কবিদের দ্বারা অধ্যুষিত বাংলা কাব্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি যে এনেছিলেন একটি নূতন সুরু, সে কথা কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না। বিংশ শতাব্দীর তরুণদের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন প্রথম কবি, রবীন্দ্রনাথের যশোমণ্ডলের মধ্যে থেকেও যিনি খুঁজে পেয়েছেন স্বকীয় রচনাভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গি।

 প্রথম মহাযুদ্ধে নজরুল 'ইউনিফর্ম' প’রে সৈনিকের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।পরে ইউনিফর্ম' খুলে ফেললেও কাব্যজগতেও প্রবেশ করেছিলেন সৈনিকের ব্রত নিয়েই। দুর্গত দেশবাসীদের শাক্তের গান শুনিয়ে তিনি দুদিনেই জাগ্রত ক’রে তুললেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেও গ্রহণ করলেন একটি নাতিক্ষুদ্র অংশ। রাজরোষ তাঁকে ক্ষমা করলে না, তাঁর স্থাননির্দেশ করলে বন্দীশালায়। কিন্তু তবু দমিত হ’ল না তাঁর বিদ্রোহ।

 কিন্তু তাঁর এ বিদ্রোহ কেবল দেশের রক্তশোষক শাসক জাতির বিরুদ্ধে নয়, এ বিদ্রোহ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিরুদ্ধে, ছতমার্গগামী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে, বৈড়ালৱতী ভণ্ডদলের বিরুদ্ধে—এককথায় সকল শ্রেণীর অনাচারী দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে।

 নজরুল যখন সবে কবিতা লিখতে সুরু করেছেন, তখনই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। নিত্য আমাদেরই বৈঠক ছিল তাঁর হাঁফ ছাড়বার জায়গা। সেই সময়েই তাঁর গুটিকয় কবিতা প’ড়ে তাঁকে ভালো কবি ব’লে চিনতে পেরেছিলুম। তারপরই তিনি আমাকে রীতিমত বিস্মিত ক’রে তুললেন।

 সাপ্তাহিক “বিজলী” পত্রিকা আমার কাছে আসত নিয়মিতরূপে, তার জন্যে আমি রচনা করেছি উপন্যাস, কবিতা ও গান প্রভৃতি। হঠাৎ এক সংখ্যার “বিজলী”তে দেখলুম, নজরুলের রচিত দীর্ঘ এক কবিতা, নাম “বিদ্রোহী”। দীর্ঘ কবিতা আমাকে সহজে আকৃষ্ট করে না। কিন্তু কৌতূহলী হয়ে সে কবিতাটি পাঠ করলুম। দীর্ঘতার জন্যে কোনখানেই তা একঘেয়ে লাগল না, সাগ্রহে প’ড়ে ফেললুম সমগ্র কবিতাটি। একেবারে অভিভূত হয়ে গেলুম। তার মধ্যে পাওয়া গেল অভিনব স্টাইল, ভাব, ছন্দ, সুর ও বর্ণনাভঙ্গি। এক সবল পুরুষের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। বঝলুম, নজরুল আর উদীয়মান নন, সম্যকরূপে সমুদিত। দেশের লোকরাও তাই বুঝলে। সেই এক কবিতাই তাঁকে যশস্বী ক’রে তুললে সর্বত্র। সবাই বলতে লাগল তাঁকে “বিদ্রোহী কবি”।

 কিন্তু নজরুল কেবল শক্তির দীপক নয়, শুনিয়েছেন অনেক সকুমার প্রেমের গানও। কখনো ধ্রুপদ ধরেন, কখনো ধরেন ঠুংরী। কখনো তূরী-ভেরী, কখনো বেণু-বীণা। বাজিয়েছেন পাখোয়াজ, বাজিয়েছেন তবলাও। তিনি একজন গোটা কবি।

 নজরুলের মুখেই শুনেছি, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, বাল্যকালে তিনিও সেখানে পাঠ করতেন। কিন্তু তিনি বোধ হয় বিদ্যালয়ে বেশী বিদ্যালাভ করেন নি, নিজেকে শিক্ষিত ও মানুষ ক’রে তুলেছেন বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের বাইরে বৃহৎ বিচিত্র পৃথিবীর রাজপথে গিয়ে। একসময়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে তিনি নাকি মফঃস্বলের কোন চায়ের না রুটির দোকানে “বয়” বা ছোকরার কাজ করতেও বাকি রাখেন নি। পাশ্চাত্য দেশে শোনা যায়, প্রথম জীবনে চাকরের কাজ ক’রে পরে কীর্তিমান হয়েছেন অনেক কবি, অনেক লেখক। কিন্তু চায়ের বা রুটির দোকানের ছোকরা পরে দেশপ্রসিদ্ধ কবি হয়ে দাঁড়িয়েছেন, বাংলা দেশে এমন দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আছে ব’লে জানি না।  আগে আমার বাড়ীতে নিয়মিতভাবে গানের বৈঠক বসত । তার উদ্বোধন করেন নজরুলই। এক একদিন তিনি আমার কাছে আসতেন, আর বাড়ী ফেরবার নাম পর্যন্ত মুখে আনতেন না। একদিন যেত, দু' দিন যেত, তিন দিন যেত, নজরুল নিজের স্ত্রী–পুত্রের কথা বেবাক ভুলে আমার কাছে প’ড়ে আছেন গান আর হারমোনিয়াম আর পান আর চায়ের পেয়ালা নিয়ে। স্নান, আহার, নিদ্রা সব আমার সঙ্গেই। আমার বাড়ীর পরিবেশ হয়ে উঠত গানে গানময়। অক্লান্ত ধারাবাহিক গানের স্রোত। ঠংরী, গজল, রবীন্দ্রনাথের গান, অতুলপ্রসাদের গান, মেঠো কবির গান, নিজের গান।

 তখনকার নজরলকে স্মরণ ক’রে কিছুদিন আগে এই কবিতাটি রচনা করেছিলুমঃ—

“নজরুল ভাই, রোজই বাজে
মনের মাঝে স্মৃতির সুর,
সেই অতীতের তোমার স্মৃতি!
—আজকে থেকে অনেক দূর।
যৌবনেরি শ্যামল স্মৃতি

এই জীবনে অমূল্য।
বন্ধু, তাহার বিনিময়ে
চাইনা আমি কোহিনূর।

দরাজ প্রাণের কবি তুমি,
হস্তে ছিল রুদ্রবীণ,
আকাশ-বাতাস উঠত দুলে
বক্ষে তোমার রাত্রি-দিন।
যেথায় যেতে ছড়িয়ে যেতে
মক্ত প্রাণের হাস্যকে,
আপন ক’রে নিতে তাকেও,
তোমার কাছে যে অচিন।

দিনের পরে দিন গিয়েছে,
রাতের পরে আবার রাত,
চাঁদের আলোয় ভাসত যখন
আমার বাড়ীর খোলা ছাত,
তাকিয়ে গঙ্গা নদীর পানে
গানের পরে ধরতে গান—
মুগ্ধ হয়ে নিতাম টেনে
আমার কোলে তোমার হাত।

হায় দুনিয়ায় যে দিন ফরায়,
যায় না পাওয়া আর তাকে।
বসন্ত আর গাইবে নাকো,
উঠলে আঁধি বৈশাখে।
তাইতো ঘরে একলা ব’সে
বাজাই স্মৃতির গ্রামোফোন—
আবার কাছে আসে তখন
দূর অতীতে যে থাকে।

 নজরুলের কাছ থেকে বরাবর আমি অগ্রজের মত শ্রদ্ধালাভ ক’রে এসেছি। তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আমার ছোট ছেলে প্রদ্যোত (ডাকনাম গাবলু) কবে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হয়েছিল। তার খাতায় তিনি এই শ্লোকটি লিখে দিয়েছিলেন:—

“তোমার বাবার বাবা হও তুমি
কবি-খ্যাতিতে যশে,
তব পিতা সম হও নিরুপম
আনন্দ-ঘন রসে।
 স্নেহের গাবলু! অপূর্ণ যাহা
রহিল -মোদের মাঝে,
তোমার বীণার তন্ত্রীতে যেন
পূর্ণ হয়ে তা বাজে।

শুভার্থী—কাজীকা”

 নজরুলের অনেক কথা প্রবন্ধান্তরে বলেছি, এখানে পুন– রুল্লেখের দরকার নেই। যখন আমার বাড়ীর বৈঠকের কথা বলব, তখন অন্যান্য নামী গাইয়েদের সঙ্গে মাঝে মাঝে নজরুলেরও দেখা পাওয়া যাবে।