এখন যাঁদের দেখছি/শিশিরকুমারের আত্মপ্রকাশ
দশ
শিশিরকুমারের আত্মপ্রকাশ
আমাদের সৌভাগ্যক্রমে বাংলা দেশের বিভিন্ন বিভাগে এখনো এমন কয়েকজন প্রতিভাধর বাঙালী বিরাজ করছেন, সমগ্র ভারতে যাঁরা অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। যেমন চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, নাট্যশিল্পী শিশিকুমার ভাদুড়ী ও নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর।
একটি কারণে শিশিরকুমারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস ও নৃত্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু বাংলার বাইরে উল্লেখযোগ্য সাধারণ রঙ্গালয় নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। পশ্চিম ভারতের একাধিক সহরে যে-সব অভিনয় দেখেছি তা রীতিমত হাস্যকর। দক্ষিণ ভারতের অনেক গুণী সাহিত্য, শিল্প ও নৃত্যচর্চায় প্রভূত শক্তি প্রকাশ করেছেন বটে এবং চলচ্চিত্রেও সেখানকার কয়েকজন খ্যাতিমানের নাম করা যায়, কিন্তু আধুনিক কালেও সেখানে দানীবাবু, নির্মলেন্দু, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়, শিশিরকুমার, নরেশচন্দ্র মিত্র ও অহীন্দ্র চৌধুরী প্রভৃতির সঙ্গে তুলনীয় একজন শিল্পীকেও আবিষ্কার করা যাবে না।
এ আমার নিজস্ব মত নয়। কিছুদিন আগে বোম্বাই প্রদেশ থেকে আগত একটি বিদুষী মহিলাকে আমি কলকাতার কোন কোন রঙ্গালয়ে নিয়ে গিয়েছিলুম। তিনি সবিস্ময়ে বলেছিলেন, “অভিনয় যে এমন অপূর্ব হওয়া সম্ভবপর, দক্ষিণ ভারতে কেউ তা কল্পনাতেও আনতে পারবে না। আমাদের দেশে মাঝে মাঝে অভিনয়ের যে আয়োজন হয়, এখানকার তুলনায় তাকে অভিনয় বলাই চলে না।” বিশেষভাবে তাঁকে অভিভূত করেছিল শিশিরকুমারের কৃতিত্ব। তাঁকে তিনি বলেছিলেন, “আপনি যদি আমাদের দেশে যান, তা’হলে সর্বত্রই অভিনন্দন লাভ করবেন।”
এবারে আমরা শিশিরকুমারের কথাই বলব। কিন্তু তাঁর গুণপনা ভালো ক’রে বুঝতে হ’লে কি—রকম পটভূমিকার উপরে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, সে সম্বন্ধেও কিছু কিছু ইঙ্গিত দেওয়া দরকার।
গিরিশোত্তর কালে প্রায় একযুগের মধ্যে বাংলা রঙ্গালয়ে এমন একজন নূতন শিল্পীকে দেখা যায়নি, যিনি দ্বিতীয়—এমন কি তৃতীয়—শ্রেণীতেও স্থানলাভ করতে পারেন। গিরিশ—যুগের গৌরবময় ঐতিহ্য বহন করে তখনও বিদ্যমান ছিলেন যে কয়েকজন বিখ্যাত নট-নটী, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন দানীবাবু, তারকনাথ পালিত, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তারাসুন্দরী।
কিন্তু দানীবাবুর তারকা তখন আর ঊর্ধ্বগামী নয়। তিনি ভালো অভিনয় করেন বটে, কিন্তু যারা আগেকার দানীবাবুকে দেখেছিল, তারা তাঁর অভিনয়ের ভিতর থেকে আর কোন নতুনত্ব আবিষ্কার করতে পারত না।
তারক পালিত, অপরেশচন্দ্র ও তারাসুন্দরীর শক্তি তখনও অটুট ছিল। আমার তো মনে হয়, নাট্যজীবনের উত্তরার্ধেই অপরেশচন্দ্রের নাট্যনৈপুণ্য উঠেছিল অধিকতর উচ্চশ্রেণীতে। কিন্তু দর্শকদের মধ্যে প্রাকৃতজনরা সে সময়ে দস্তুরমত দলে ভারি হয়ে উঠেছিল। উচ্চশ্রেণীর অভিনয়ের চেয়ে নিম্নশ্রেণীর নাটকের রোমাঞ্চকর ঘাতপ্রতিঘাতই তাদের আকৃষ্ট করত বেশী মাত্রায়।
ওথেলো নাটকে তারক পালিত, অপরেশচন্দ্র ও তারাসুন্দরী অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু দর্শকদের সহানভূতির অভাবে সে নাটকের পরমায়ু হয়েছিল খুব সংক্ষিপ্ত। ইবসেন অবলম্বনে রচিত “রাখীবন্ধন” নাটকেও তারক পালিত ও তারাসুন্দরীর অভিনয় হয়েছিল যারপরনাই চমৎকার। কিন্তু সে নাটকও দর্শক আকর্ষণ করতে পারেনি। তারপরেই তারক পালিতও রঙ্গালয়ের সংস্রব ত্যাগ করেন। কিন্তু তখনকার দর্শকরা অমন উঁচু দরের একজন শিল্পীরও অভাব অনুভব করেছিল ব’লে মনে হয়নি। আজকাল কাগজে কাগজে নাট্যজগতের রামা-শ্যামার যা তা খবর প্রকাশ করা হয়; কিন্তু নাট্যজগতে যাঁর স্থান ছিল ঠিক দানীবাবুর পরেই, সেই তারক পালিত কবে ইহলোক ত্যাগ করেন, সে খবর পর্যন্ত কোন কাগজেই স্থান পায়নি।
১৯১৬ খৃষ্টাব্দ। শুনলুম মনোমোহন থিয়েটারে একখানি ঐতিহাসিক নাটকের অভিনয় দেখবার জন্যে কাতারে কাতারে লোক ভেঙে পড়ছে। কৌতূহলী হয়ে দেখতে গেলুম। কিন্তু পুরো এক অঙ্ক পর্যন্ত অভিনয় দেখতে পারলুম না—যেমন নিকৃষ্ট নাট্যকারের রচনা, তেমনি প্রাণহীন অভিনয়! দানীবাবু পর্যন্ত নূতন কোন চরিত্র সৃষ্টির চেষ্টা না ক’রে নিজের পূর্বসঞ্চিত পণ্যের (Stock-in-trade) ভিতর থেকে বেছে বেছে যে কলকৌশলগুলি প্রয়োগ ক’রে গেলেন, তা ঘন ঘন হাততালির দ্বারা অভিনন্দিত হ’ল বটে, কিন্তু তার প্রত্যেকটিই ছিল আমার কাছে সুপরিচিত। বিতৃষ্ণা ভরা মন নিয়ে প্রকাশ্যে নাটক ও অভিনয়ের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ ক’রে প্রেক্ষাগার ছেড়ে বেরিয়ে এলুম। মজা দেখলুম এই, জনপ্রাণীও আমার বিরদ্ধে সমালোচনার প্রতিবাদ করলে না।
মনোমোহন থিয়েটারের পরেই লোকপ্রিয় ছিল তখন মিনার্ভা থিয়েটার। সেখানে আমার রচিত একখানি নাটিকা অভিনীত হয়েছিল। সেই সূত্রে আমি প্রায়ই রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যে আনাগোনা করতুম। অবিলম্বে একখানি নূতন নাটকের মহলা শুরু হবে শুনলুম। একদিন গিয়ে দেখলুম নূতন পালার আপন আপন ভূমিকা নিয়ে মিনার্ভার দুইজন বিখ্যাত নট পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। একজন আর একজনকে ডেকে বললেন, “ওহে, পার্ট নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি তো অমুক পালায় অমুক পার্ট করেছ। এ পার্টটাও তারই মত। সেই পার্টটার মত ক’রে এটা ছ’কে নিলেই চলবে।”
কথা শুনে বিস্মিত হলুম। সত্যিকার অভিনেতারা এক একটি পুরাতন ভূমিকাও নূতন নূতন ধারণা (Conception) অনুসারে প্রস্তুত ক’রে তুলতে চেষ্টা করেন, আর এ’রা পুরাতন ভূমিকার ছাঁচে ফেলেই তৈরি করতে চান নূতন ভূমিকা!
আসল কথা, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিনেতার স্বাধীন মস্তিষ্কের সঙ্গে থাকত না অভিনয়ের সম্পর্ক। ধরা-বাঁধা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সকলে কাজ করে যেতেন কলের পুতুলের মত। যে সব নাটকের চরিত্র, ভাব ও ভাষা হ’ত সম্পূর্ণ অভিনব, তখনকার বেশীর ভাগ অভিনেতার কাছেই তা হয়ে উঠত অত্যন্ত গুরুপাক।
এই জন্যেই নব্য বাংলার সুধীসমাজের সঙ্গে গিরিশোত্তর যুগের বাংলা রঙ্গালয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠবার সুযোগ হয়নি। শিক্ষিত ও সুরসিক দর্শকরা যে বাংলা রঙ্গালয়কে একেবারেই বয়কট করেছিলেন এমন কথা বলতে পারি না। কিন্তু দলে হাল্কা ছিলেন তাঁরা এবং দলে ভারি ছিল সেখানে প্রাকৃতজনরাই। প্রায় ১৯২১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা রঙ্গালয়ের অবস্থা ছিল অল্পবিস্তর একইরকম। এ অবস্থা যে হঠাৎ পরিবর্তিত হবে, এমন কোন লক্ষণ দেখা যায়নি তখন পর্যন্ত।
এই সময়ে কলকাতার ওল্ড ক্লাব নামক সৌখীন নাট্য প্রতিষ্ঠান থেকে স্টার থিয়েটারে একটি সাহায্য রজনীর আয়োজন হয়। সৌখীন শিল্পীদের উপরে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল না। তবু উপরোধে প’ড়ে একখানি টিকিট কিনি। শুনলুম য়ুনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের শিশিরকুমার ভাদুড়ী “পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস” নাটকে ভীম ও বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। প্রফেসরররূপে তাঁর খ্যাতি আগেই আমার কাণে গিয়েছিল এবং লোকের মুখে মুখে শুনতুম, তিনি নাকি ভালো অভিনয় করেন। কিন্তু অতি-সেকেলে পৌরাণিক নাটক “পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে” একজন আধুনিক অধ্যাপক এমন কি স্মরণীয় অভিনয় করবেন, সেটুকু ধারণায় আনতে পারলুম না।
যবনিকা উঠল। দেখা গেল প্রথম দৃশ্য। গোড়া থেকেই দৃষ্টি হয়ে উঠল সচকিত, তারপর ক্রমে ক্রমে যা দেখতে ও শুনতে লাগলুম, আমার কাছে ছিল তা একেবারেই অভাবিত ব্যাপার! সেকেলে নাটক “পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস” কে মনে হ’ল আনকোরা নতুনের মত। অভিনেতাদের চেহারাই খালি সুন্দর নয়, প্রত্যেকের ভাব, অঙ্গভঙ্গী, সংলাপ—এমন কি প্রবেশ ও প্রস্থানের পদ্ধতি পর্যন্ত কল্পনাতীতরূপে অভিনব। কোথাও বহু পরিচিত কৃত্রিম থিয়েটারি ঢং নেই, প্রয়োগকৌশলেও প্রভূত স্বাতন্ত্র্য্য। এরকম উপভোগ্য বিস্ময়ের জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না, আমার অবস্থা হ’ল আকাশ থেকে সদ্যপতিতের মত।
আর একটা ব্যাপার সেইদিনই লক্ষ্য করলুম। বাল্যকাল থেকেই অভিনয় দেখে আসছি। কিন্তু বাংলা রঙ্গালয়ে কোনদিনই কোন পালাতেই প্রত্যেক নট-নটীকে সমানভাবে একসঙ্গে আপন আপন ভূমিকার উপযোগী অভিনয় করতে দেখিনি। এমন কি যে পালায় গিরিশচন্দ্র ও অর্ধেন্দুশেখর প্রভৃতি অতুলনীয় অভিনেতারা থাকতেন, সেখানেও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও অপ্রধান ভূমিকাগুলির অভিনয় প্রায়ই হ’ত নিতান্ত নিম্নশ্রেণীর। তাই দেখে দেখে আমরা এমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলুম যে, কৌতুক বোধ করলেও অসুবিধা বোধ করতুম না। লোকে তখন এক একজন বিখ্যাত ব্যক্তির উচ্চশ্রেণীর অভিনয় দেখলেই পরিতুষ্ট হ’ত, ছোট ছোট ভূমিকা নিয়ে কিছুমাত্র মাথা ঘামাত না।
কিন্তু “পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে”র সেই সৌখীন পুনরভিনয়েই বাংলা রঙ্গালয়ে প্রথম দেখলুম, নাট্যাভিনয়ে প্রত্যেকেই—এমন কি মূক দৌবারিকটি পর্যন্ত ভূমিকার উপযোগী নিখুঁত অভিনয় ক’রে গেল। এও এক আশ্চর্য অগ্রগতি। শিশিরকুমারের যে কোন নাট্যানুষ্ঠানে আজ পর্যন্ত এই বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। আগে আর কেউ এদিকে সমগ্রভাবে দৃষ্টি দেননি। কেবল অর্ধেন্দুশেখর এদিকে দৃষ্টি রাখবার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু সে চেষ্টাও সম্পূর্ণরূপে সুফল প্রসব করতে পারত না। কিন্তু তাঁরও একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। গিরিশচন্দ্রের উক্তি থেকে জানতে পারি, অনেক সময়ে তিনি বড় বড় ভূমিকাকে অবহেলা ক’রে ছোট ছোট ভূমিকা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকতেন।
“পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে”র সেই অভিনয়ে শিশিরকুমার যে প্রথম শ্রেণীর কলাকুশলতা প্রকাশ করলেন, এতদিন পরে তা নিয়ে আর বিশেষ আলোচনা না করলেও চলবে। কেবল এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, ভেবেছিলুম দেখব কোন নবীন শিক্ষার্থীকে, কিন্তু গিয়ে দেখলুম এক প্রতিভাবান ওস্তাদকে। তারপর সেইদিনই খবর পেলুম, সৌখীন শিল্পিরূপে এই হচ্ছে শিশিরকুমারের শেষ অভিনয়, অদূর ভবিষ্যতেই তিনি আমাদের সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রকাশ্য ভাবে যোগদান করবেন। মন আশান্বিত হয়ে উঠল।
সেদিনকার নাট্যানুষ্ঠানে আরো যাঁদের দেখা পাওয়া গেল, তাঁদের মধ্যেও নির্মলেন্দু লাহিড়ী, বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, ললিতমোহন লাহিড়ী, ও রমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (দৃশ্য-পরিকল্পক) পরে সাধারণ রঙ্গালয়ে যোগ দিয়ে নাম কিনে গিয়েছেন। এক দলে এতগুলি গুণীর আবির্ভাব! একালে আর কোন সৌখীন নাট্য-প্রতিষ্ঠান এমন গৌরব অর্জন করতে পারেনি।
আমি তখন দৈনিক “হিন্দুস্থান” পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার পৃষ্ঠায় উচ্ছ্বসিত ভাষায় এই অভিনব শিল্পী সম্প্রদায়কে অভিনন্দন দান করলুম। তার ফলেই আমি শিশিরকুমারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হই।
অনতিবিলম্বেই “আলমগীর” নাটকের নাম-ভূমিকায় শিশিরকুমারের রঙ্গাবতরণ হ’ল ম্যাডানদের কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে। সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা এতদিন সাধারণ রঙ্গালয়কে বিশেষ প্রীতির চোখে দেখতেন না, সেই বিদ্বজ্জনগণ দলে দলে এসে প্রেক্ষাগৃহকে পরিপূর্ণ ক’রে তুলতে লাগলেন। যাঁরা কখনো সাধারণ রঙ্গালয়ে পদার্পণ করেননি, তাঁদেরও দেখা পাওয়া যেতে লাগল কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে। বাংলা রঙ্গালয়ের জন্যে নূতন এক শ্রেণীর দর্শক তৈরি হয়ে উঠল।