এখন যাঁদের দেখছি/মোহিতলাল মজুমদার

নয়

মোহিতলাল মজুমদার

 আমার বয়স তখন কত? ঠিক মনে নেই, তবে অর্ধশতাব্দী আগেকার কথা বলছি নিশ্চয়ই। এবং এটাও ঠিক, তখনও আমি কৈশোর অতিক্রম করিনি।

 স্বর্গীয় ডক্টর সত্যানন্দ রায় ছিলেন আমার প্রতিবেশী ও দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়। ছেলেবেলায় তাঁর চেয়ে ঘনিষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ সুহৃদ আমার আর কেউ ছিলেন না। সত্যানন্দ পরে বিলাতে যান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে কলকাতা কর্পোরেশনের শিক্ষা বিভাগে প্রধান কর্মচারীর পদে অধিষ্ঠিত হন।

 সত্যানন্দের সঙ্গে সেই কিশোর বয়স থেকেই সুরু হয়েছিল আমার সাহিত্যসাধনা। বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ বিখ্যাত রচনা তখনই আমরা প’ড়ে ফেলেছি এবং বিলাত থেকেও আনাতুম বালকদের উপযোগী ভালো ভালো বই। তখনকার এক চমৎকার গ্রন্থমালার কথা আজও আমার মনে আছে, তা হচ্ছে বিখ্যাত ডবলিউ টি স্টেডের সম্পাদনায় প্রকাশিত “দি বুক ফর দি বেন্‌র্স্‌”। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রখ্যাত কথাগ্রন্থগুলি ছোটদের উপযোগী ক’রে পরিবেশন করা হ’ত। প্রত্যেক খণ্ডের মূল্যও ছিল যৎসামান্য।

 সত্যানন্দ ও আমার, দু’জনেরই ছিল একখানি ক’রে হাতে-লেখা পত্রিকা। সত্যানন্দ ছিলেন কেবল প্রবন্ধকার, কিন্তু আমি সমান বিক্রমে আক্রমণ করতুম প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা প্রভৃতি বিভাগকে। লেখাগুলিকে অবশ্য ছাইভস্ম বললে অত্যুক্তি হবে না। যদিও আমার সেই হস্তলিখিত পত্রিকারই একটি গল্প দু তিন বৎসর পরে ছাপার হরপে “বসুধা” মাসিকপত্রে স্থান পায়। সেই-ই আমার প্রকাশিত প্রথম রচনা। আর এক বিষয়েও সত্যানন্দ আমার কাছে হেরে যেতেন। তিনি তুলি ধরতে পারতেন না, আমি পারতুম। (এবং আঁকতুম কেবল কাকের ছানা বকের ছানা)। কাজেই আমার পত্রিকা ছিল সচিত্র।

 আমাদের সেই সাহিত্যসাধনার উদ্‌যোগ-পর্বে সত্যানন্দের বাড়িতেই প্রথম দেখি মোহিতলাল মজুমদারকে। সত্যানন্দের সঙ্গে তাঁরও কি যেন একটা দূর-সম্পর্ক ছিল। সে বয়সে আলাপ জমতে দেরি হয় না। বালকরা কথায় কথায় বন্ধু পায় এবং বন্ধু হারায় (আর বলতে কি সাহিত্যক্ষেত্রে তরলমতি বুড়ো খোকারও অভাব নেই)। মোহিতলাল সেখানে গিয়েছিলেন দুই-তিনবার। সে সময়ে কিরকম বিষয়বস্তু আমরা আলাপ্য ব’লে মনে করতুম, আজ আর তা স্মরণে আসছে না। মোহিতলাল সেই বয়সেই কাব্যকুঞ্জবনে প্রবেশ করেছিলেন কিনা, তাও আমি বলতে পারব না। অন্তত তাঁর মুখে থেকে এ সম্পর্কে কোন কথা শুনেছিলাম ব’লে মনে হচ্ছে না। তবে তাঁর দিকে যে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলুম, তাতে আর সন্দেহ নেই।

 আমাদের সেই সাহিত্যের বেলেখেলাঘরেই মাঝে মাঝে আর একটি বালক আসতেন, পরে যিনি এখানকার সাহিত্য সমাজে বিশেষ আলোড়ন উপস্থিত করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন “কল্লোল” সম্পাদক স্বর্গীয় দীনেশরঞ্জন দাস। কিন্তু তিনি তখন কালিকলম নিয়ে সুবোধ বালকের মত ইস্কুলের লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু করতেন ব’লে মনে হয় না।

 বালক হ’ল যুবক, কাঁচা হ’ল পাকা। কেটে গেল কয়েকটা বছর। আমার নানাশ্রেণীর রচনা প্রকাশিত হয় “ভারতী”, “নব্যভারত”, “মানসী”, “বাণী”, “ঐতিহাসিক চিত্র”, “অর্চনা”, “জন্মভূমি” ও অন্যান্য পত্রিকায়। সেই সময়ে একদিন অধুনালুপ্ত প্রখ্যাত বিদ্যায়তন “শ্রীকৃষ্ণ পাঠশালা”র ত্রিতলের ঘরে গিয়ে সবিস্ময়ে দেখলুম কবির এক পরম সাধক মূর্তি। দেখলুম শয্যাগত, উত্থানশক্তিহীন বৃদ্ধ কবিবর দেবেন্দ্রনাথ সেনকে। তাঁর দৃষ্টি প্রায় অন্ধ, সর্বাঙ্গ বাতে পঙ্গু, হাতে কলম পর্যন্ত ধরতে পারেন না, তবু নিদারুণ রোগযন্ত্রণার মধ্যেও প্রশান্ত আননে মুখে মুখেই তিনি রচনা ক’রে যাচ্ছেন কবিতার পর কবিতা। কোন কবিতার মধ্যেই নেই ব্যাধিজর্জর দেহের দুঃখ-বেদনার সুর, কোন কবিতাতেই নেই অন্ধকারের ছোপ, প্রত্যেক কবিতাই হচ্ছে আলোর কবিতা, যার প্রভাবে হাহাকারও হয় নন্দিত ও নিস্তব্ধ। মন করলে নতিস্বীকার।

 কবির রোগশয্যার পার্শ্বেই আবার দেখা পেলুম বাল্যবন্ধু মোহিতলালের।

 তীর্থযাত্রীর মত প্রায় প্রত্যহই যেতুম দেবেন্দ্রসদনে। প্রতিদিন না হোক, প্রায়ই সেখানে মোহিতলালের সঙ্গে দেখাশুনো হ’তে লাগল, এবং অবিলম্বেই আবিষ্কার করলুম তিনি তখন হয়েছেন কাব্যগতপ্রাণ। কেবল কবিতা-পাঠক নন, কবিতা-লেখকও—যদিও সাময়িক পত্রিকায় তাঁর কোন কবিতা তখনও আমার চোখে পড়েনি। তিনি নিজেই স্বলিখিত কবিতা পাঠ ক’রে শোনালেন। ভালো লাগল।

 দিনে দিনে জ’মে উঠল আমাদের আলাপ, দৃঢ়তর হ’ল আমাদের মৈত্রীবন্ধন। দেখা হ’লেই কবিতার প্রসঙ্গ, সময় কাটে কাব্যালোচনায়। কোন কোন দিন এক সঙ্গেই যাই কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী বা কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। সেখানেও হ’ত নতুন নতুন কবিতা শোনা, উঠত স্বদেশী-বিদেশী নানা কবি ও কবিতার প্রসঙ্গ। জীবন হয়ে উঠেছিল কবিতাময়। দু’জনের কেহই তখনও সংসারে লব্ধপ্রবেশ হ’তে পারিনি, কারুকেই ঝড়-ঝাপটাও সহ্য করতে হয়নি, তাই এটা আমাদের ধারণার বাইরে থেকে গিয়েছিল যে, কবিতা যতই মহত্তম হোক, জীবনের যাত্রাপথে তাকে সম্বল ক’রে পথ চলতে হলে যথেষ্ট বিড়ম্বনার সম্ভাবনা আছে। মোহিতলালের মনের কথা বলতে পারি না, তবে নিজে আমি এ সত্যটি উপলব্ধি করেছি বহু বিলম্বে, অত্যন্ত অসময়ে। তিনকাল গিয়ে যখন এক কালে ঠেকে, তখন আর কেঁচে গণ্ডুষ করা চলে না।

 “যমুনা” পত্রিকার কার্যালয়ে বসল আমাদের বৃহৎ আসর। ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বৈঠক হয়ে উঠল জমজমাট। সেখানেও সর্বদাই কাব্যকৌমুদীতে মন হয়ে থাকে প্রসন্ন। নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করেন মোহিতলাল। তাঁর লেখনীও কবিতা প্রসব করে ঘন ঘন। তিনি কেবল লিখেই তুষ্ট থাকতে পারেন না, স্বরচিত কবিতা অপরকে শোনাবার জন্যেও আগ্রহ তাঁর উদগ্র। হয়তো সন্ধ্যা উৎরে গিয়েছে। কলকাতার পথে গ্যাসের আলো জ্বলেছে। মোহিতলাল চলেছেন পদব্রজে। তাঁর পকেটে আছে একটি নূতন কবিতা। বুঝি সেটি তখনও কারুকে শোনানো হয়নি। হঠাৎ এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। মোহিতলাল অমনি ফুটপাথের উপরে একটা গ্যাসপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর সেই জনাকীর্ণ পথকে গ্রাহ্যের মধ্যে না এনেই বন্ধুকে সামনে রেখে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন।

 “যমুনা” পত্রিকা উঠে গেল। সেখানেই বসল সাপ্তাহিক সাহিত্যপত্রিকা “মর্মবাণী”র বৈঠক। সভ্যের সংখ্যা আরো বেড়ে উঠল। এলেন কথাশিল্পী মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, এলেন কবিবর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ও আসতেন মাঝে মাঝে। করুণানিধান ও অন্যান্য কবিরাও আসতেন। সেইখানেই শ্রীকালিদাস রায়কেও প্রথম দেখি। মোহিতলাল আসতেন। তিনি তখন উদীয়মান কবি হিসাবে সুপরিচিত হয়েছেন।

 অধিকাংশ বাংলা পত্রিকাই দীর্ঘজীবন লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে না। খোঁটার জোর থাকলেও অকালমৃত্যু তাদের ছিনিয়ে নেয়। আমাদের সাময়িক সাহিত্যের ইতিহাস হচ্ছে ঘন ঘন জন্ম ও মৃত্যুর ইতিহাস। নাটোরাধীশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ ক’রেও “মর্মবাণী” আত্মরক্ষা করতে পারলে না। এক বৎসর পরে মাসিক “মানসী”র সঙ্গে মিলে কোন রকমে তখনকার মত মানরক্ষা করলে। এখন “মানসী ও মর্মবাণী”ও অতীতের স্মৃতি।

 “ভারতী” সম্পাদনার ভার গ্রহণ করলেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে সাহায্য করবার জন্যে আহূত হলুম আমি। “ভারতী” কার্যালয়েই বসল আমাদের নতুন বৈঠক—রবীন্দ্রনাথের ভক্ত না হ’লে সেখানে কেউ বৈঠকধারী হ’তে পারতেন না। সেখানেও মোহিতলাল যোগ দিলেন আমাদের দলে। এই সময়েই তাঁর কবিতাপুস্তক “স্বপনপসারী” প্রকাশিত হয়।

 মোহিতলাল আধুনিক কবি হ’লেও এবং তিনি আধুনিক যুগধর্মকে স্বীকার করলেও, তাঁর কবিতার মূল সুরের মধ্যে পাওয়া যাবে পুরাতন যুগেরই প্রতিধ্বনি। কি পদ্যে এবং কি গদ্যে তাঁর ভাষাও মেনে চলে অতীতের ঐতিহ্য। তথাকথিত নূতনত্ব দেখাতে গিয়ে কোথাও তিনি যথেচ্ছাচারকে প্রশ্রয় দেন না। এই নূতনত্বের মোহে একেলে অনেকের কবিতা হয়ে ওঠে রীতিমত উদ্ভট। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আধুনিক কবি এখনো এদেশে জন্মগ্রহণ করেননি। ভাবে ও ভাষায় তাঁকে ডিঙিয়ে আর কেউ এগিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কোথাও উদ্ভট নন। শ্রেষ্ঠ কবিরা উদ্ভট হ’তে পারেন না। মোহিতলালেরও এ দোষ নেই।

 কবিরূপে মোহিতলালের আসন যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, তখন তিনি হাত দেন সাহিত্যের অন্য এক বিভাগে। পদ্যে নয়, গদ্যে। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময়েই বুঝতে পারতুম, তিনি একজন উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যবোদ্ধা। দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ তিনি কেবল সাগ্রহে অধ্যয়নই করেন না, অধীত বিষয় নিয়ে স্বাধীনভাবে যথেষ্ট চিন্তাও করেন। সমালোচক হবার অনেক গুণ পূর্বেই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করেছিলুম, কিন্তু গোড়ার দিকে প্রকাশ্যভাবে তিনি সমালোচকের আসনের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি, মশগুল হয়ে ছিলেন কবিতার প্রেমেই।

 বাংলা দেশে আজকাল সাহিত্যপ্রবন্ধের এবং সমালোচনার অভাব হয়েছে অত্যন্ত। প্রবন্ধের দৈন্য বেড়ে উঠছে দিনে দিনে এবং যে সব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার অধিকাংশেরই মধ্যে থাকে না সাহিত্যরস। মাসিকপত্রগুলি হাতে নিলে দেখি, রাশি রাশি গল্প আর উপন্যাসের ভিড়ে, দু-একটা চুট্‌কি নিবন্ধ কোনরকমে কোণঠাসা হয়ে আছে। আগেকার ধারা ছিল আলাদা। আগে গল্প বা উপন্যাস নয়, পত্রিকার গৌরববর্ধন করত প্রবন্ধই। এদেশে যাঁরা শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও প্রবন্ধকার ব’লে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের কেহই অতিআধুনিক যুগের মানুষ নন। গল্প ও উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম অঙ্গ বটে, কিন্তু প্রবন্ধদৈন্য ও স্থায়ী সমালোচনার অভাব থাকলে কোন সাহিত্যই উচ্চতর শ্রেণীতে উন্নীত হ’তে পারে না।

 মোহিতলাল মানুষ হয়েছেন গত যুগেরই প্রতিবেশ-প্রভাবের মধ্যে। তাই অতিআধুনিকদের ছোঁয়াচ লাগেনি তাঁর মনে। তিনি এই সাহিত্যপ্রবন্ধের দুর্ভিক্ষের যুগেও অবহিতভাবে ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ক’রে যাচ্ছেন প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ রচনা। প্রাচীন বয়সেও এ বিভাগে মোহিতলালের সাহিত্যশ্রম দেখলে বিস্মিত হ’তে হয়। আজকাল কবিরূপে নয়, সমালোচকরূপেই তাঁর দেখা পাওয়া যায় যখন তখন। তাঁর সব মতের সঙ্গে যে সকলের মত মিলবে, এমন আশা কেউ করে না। বিভিন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি হয় বিভিন্ন। কিন্তু নির্ভীক, নিরপেক্ষভাবে সাহিত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা রেখে যিনি নিজের কর্তব্য পালন করবেন, তাঁকে অনায়াসেই অভিনন্দন দেওয়া চলে।

 বলেছি, প্রাচীন বয়সেও মোহিতলালের সাহিত্যশ্রম হচ্ছে বিস্ময়কর। কিন্তু যখন তিনি ঠিক বৃদ্ধত্ব লাভ করেননি, তখনই তাঁর মনে জেগেছিল নিরাশার সুর। ষোলো বৎসর আগে ঢাকা থেকে একখানি পত্রে তিনি লিখেছিলেন: “ভাই হেমেন্দ্রকুমার, তোমার অতীত স্মৃতির আবেগভরা স্নেহপূর্ণ পত্র পাইয়া আনন্দিত হইলাম। আমাদের কাল এখন ‘সেকাল’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, সে যুগ এখনই কাব্যস্মৃতিময় হইয়া উঠিয়াছে। দুই চারিজন এখনও যাহারা এখানে-ওখানে ছড়াইয়া আছি, তাহাদের মধ্যে প্রাণের সূক্ষ্মতন্ত্রীর যোগ অদৃশ্য হইলেও দৃঢ় ও অটুট হইয়া আছে, বরং জীবনসায়াহ্নে প্রভাতের সেই অরুণ-রাগ ক্রমেই করুণ ও কোমল হইয়া উঠিতেছে, তার প্রমাণ তোমার ও আরও দুই-একজন বন্ধুর চিঠি। তুমি জানো, সাহিত্য আমার ধর্মব্রত ছিল; যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছিলাম, তাহার জন্য নির্মমভাবে নিজের সকল স্বার্থ, আত্মপ্রীতি ও মমতা সকলই বর্জন করিয়াছি। সেজন্য “কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ”। কিন্তু আজ আমি ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন, আমার শরীর একেবারে ভাঙ্গিয়াছে, মনের উৎসাহ আবেগ আর নাই, গত কয়েক মাস যাবৎ আমি লেখনীকর্ম ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছি। যদি একটু সুস্থ হইতে পারি, তবে হয়ত জন্মগত ব্যবসায় আবার কিছু কিছু করিতে হইবে। তুমি যে এখনও সমান উৎসাহে সাহিত্যব্রত উদ্‌যাপন করিতেছ, ইহা কম কৃতিত্বের কথা নয়। প্রার্থনা করি, তোমার আয়ুষ্কাল দীর্ঘ হউক এবং আমাদের বিদায় গ্রহণের বহু পরেও গত যুগের সাক্ষীরূপে তুমি মাঝে মাঝে আমাদিগকে স্মরণ করিও। সেজন্যও তোমার দীর্ঘায়ুঃ কামনা করি” প্রভৃতি।

 কিন্তু মহাকালের কবলে “আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান”—মোহিতলাল, না আমি? তারই যখন নিশ্চয়তা নেই, তখন মোহিত– লাল ইহলোকে বিদ্যমান থাকতে থাকতেই বন্ধকৃত্যটা সেরে ফেলাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কার্য। তিনি তো আমারই সমবয়সী, কার ডাক কবে আসবে, কে জানে?