এখন যাঁদের দেখছি/যতীন্দ্র গুহ (গোবরবাবু)
তেরো
যতীন্দ্র গুহ (গোবরবাবু)
স্বর্গীয় বন্ধুবর নরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন একজন ধনী ও সুরসিক ব্যক্তি। তাঁর বসতবাড়ি ছিল মসজিদবাড়ি স্ট্রীটে পূর্বদিকের প্রায় শেষ প্রান্তে। সেইখানে প্রায়ই—বিশেষ ক’রে প্রতি শনিবারে হ’ত বন্ধু-সম্মিলন। যাঁরা উপস্থিত থাকতেন তাঁদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিলেন নবীন ও উদীয়মান ব্যারিস্টার। অন্যান্য শ্রেণীর লোকেরও অভাব ছিল না। নরেনবাবুর সাহিত্যবোধও ছিল, তাই একাধিক সাহিত্যিকও যেতেন তাঁর বৈঠকে। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছি আমি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৃহৎ গ্রন্থ “বাঙ্গলার ইতিহাস” প্রকাশিত হয়েছিল নরেনবাবুদেরই অর্থানুকূল্যে।
একদিন সেই বৈঠকে গিয়ে দেখলুম এক অসাধারণ মূর্তি। বিপুলবপু—যেমন লম্বায়, তেমনি চওড়ায়। দেখলেই বোঝা যায়, বিষম জোয়ান তিনি। তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে অমিতশক্তির প্রত্যেকটি লক্ষণ। বাঙালীদের মধ্যে তেমন চেহারা দুর্লভ।
জিজ্ঞাসা ক’রে জানলুম, তিনি হচ্ছেন নরেনবাবুর আত্মীয় পালোয়ান গোবরবাবু।
গোবরবাবু। তার আগেই তাঁর নাম এর-তার মুখে কিছু কিছু শুনতে পেতুম বটে, কিন্তু সে বিশেষ কিছুই নয়। যেখানে বৃহৎ বৃক্ষের অভাব সেখানে লোকে মস্ত ব’লে ধ’রে নেয় এরণ্ডকেই। কবি বলেছেন, “অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব।” এদেশে তখন কেউ আখড়ায় গিয়ে মাসকয়েক কুস্তি লড়লেই পালোয়ান ব’লে নাম কিনে ফেলত। কিন্তু গোবরবাবু যখন তরুণ (প্রায় বালক) বয়সে দ্বিতীয়বার ইংলণ্ডে যান, তখন তিনি সেখানকার সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লদের সগর্বে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন এবং তাঁর কীর্তিকাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল “প্রবাসী” পত্রিকায়।
প্রথমে তাঁর সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করে স্কটল্যাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর ক্যাম্পবেল। তাকে হার মানতে হ’ল গোবরবাবুর কাছে। তারপর তাঁর সঙ্গে লড়তে আসে জিমি ইসেন। বেজায় তার খাতির, কারণ সে ছিল সমগ্র বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের চ্যাম্পিয়ন—অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ বাহাদুর মল্ল। ইংরেজরা মনে মনে ঠিক দিয়ে রেখেছিল যে, এই ছোকরা কালা আদমি তাদের সেরা পালোয়ানের পাল্লায় প’ড়ে নাস্তানাবুদ ও হেরে ভূত হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ালো অন্যরকম। খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তির পরেই ইসেন বুঝতে পারলে, গোবরবাবুর কাছে সে নিজেই ক্রমেই কাবু হয়ে পড়ছে। তখন নাচার হয়ে, অন্যায় উপায়ের দ্বারা নিজের মান বাঁচাবার জন্যে সে কুস্তি ছেড়ে বক্সিংয়ের প্যাঁচ কষলে—অর্থাৎ গোবরবাবুকে করলে মুষ্ট্যাঘাত। কিন্তু নাছোড়বান্দা গোবরবাবু কুস্তির প্যাঁচেই তাকে করলেন কুপোকাত। “দুর্বল” ব’লে কীর্তিত বাঙালীর ছেলে হ’ল ইংলণ্ডের সর্বজয়ী মল্ল!
“প্রবাসী” পত্রিকায় এই অভাবিত “রোমান্সের” কাহিনী পাঠ করবার পর থেকেই আমি হয়ে পড়েছিলুম গোবরবাবুর একান্ত ভক্ত। সাহিত্যে ও ললিতকলায় কোনদিনই বাঙালীর সাধুবাদের অভাব হয়নি। কিন্তু মল্লযুদ্ধেও বাঙালী যে বলদর্পিত ইংরেজদের গর্ব খর্ব করতে পারবে, সেদিন পর্যন্ত এটা ছিল একেবারেই কল্পনাতীত। কিন্তু তখনও আমাদের মন ছিল এমন চেতনাহীন যে বৃটিশ-সিংহের ঘরে গিয়ে তাকে লাঞ্ছিত ও পরাজিত ক’রে প্রথম বাঙালীর ছেলে যেদিন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন, সেদিন পুষ্পমাল্য, পতাকা নিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করবার কথা কারুর মনেই উদয় হয়নি। বোধ হয় আমরা ভাবতুম, পালোয়ান উচ্চশ্রেণীর মানুষ ব’লেই গণ্য হ’তে পারে না। আজও কি জাগ্রত হয়েছে আমাদের চেতনা? কত দিকে কত সফরী স্বল্পজলে লাফঝাঁপ মেরে এখানে জনসাধারণের দ্বারা অভিনন্দিত হচ্ছে, কিন্তু য়ুরোপ-আমেরিকার প্রথম দিগ্বিজয়ী বাঙালী যোদ্ধাকে তাঁর স্বদেশ আজ পর্যন্ত দিয়েছে কি কোন অভিনন্দন?
নরেনবাবুর মজলিসে জাতির গৌরব এই বঙ্গবীরকে সামনাসামনি পেয়ে আমার মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
একটা কথা ভেবে প্রায়ই আমার মনে জাগে বিস্ময়। স্বাধীন ভারতের হামবড়া কর্তাব্যক্তিরা আজ বাঙালীকে কাবু ও কোণঠাসা করবার জন্যে কোন চেষ্টারই ত্রুটি করেননি। বাংলার বর্তমান রাজ্যপালও এই সেদিন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ভারতের অন্য কোন দেশের লোকই বাঙালীকে দু-চোখে দেখতে পারে না। অথচ এই বাঙালী জাতিই উচ্চতর অধিকাংশ বিভাগে সর্বপ্রথমে আধুনিক ভারতের মর্যাদা বাড়াবার চেষ্টা করেছে। বাগ্মিতার জন্যে ইংলণ্ডে সর্বপ্রথমে খ্যাতিলাভ করেছিলেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন। আর্যধর্ম প্রচারের দ্বারা ভারতের দিকে পৃথিবীর দৃষ্টি সর্বপ্রথমে আকৃষ্ট করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ভারতের অতুলনীয় বৈজ্ঞানিক ব’লে সর্বপ্রথমে খ্যাতিলাভ করেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। ভারতীয় আধুনিক কাব্য যে বিশ্বসাহিত্যে স্থান পেতে পারে, নোবেল পুরস্কার লাভ ক’রে তা সর্বপ্রথমে প্রমাণিত করেছেন বঙ্গসাহিত্যগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রাচ্য চিত্রকলাপদ্ধতি প্রবর্তিত ক’রে আধুনিক ভারত-শিল্পকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সর্বপ্রথমে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতীয় অভিনেতৃ সম্প্রদায় নিয়ে সর্বপ্রথমে পাশ্চাত্য দেশে দেখা দিয়েছেন নাট্যাচার্য শ্রীশিশিরকুমার ভাদুড়ী। ভারতীয় নৃত্যকলাকে নবজন্ম দিয়ে প্রতীচ্যকে অভিভূত করেছেন সর্বপ্রথমে নটনসুর শ্রীউদয়শঙ্কর এবং ভারতবর্ষ যে অধৃষ্য মল্লের দেশ, এ সত্য য়ুরোপের চোখে আঙুল দিয়ে সর্বাগ্রে দেখিয়েছিলেন গোবরবাবু ও শ্রীশরৎকুমার মিত্র; কারণ তাঁরাই গামা, ইমামবক্স, গামু ও আহম্মদ বক্স প্রভৃতিকে সঙ্গে ক’রে সর্বপ্রথমে নিয়ে গিয়েছিলেন য়ুরোপে। এর আগেও আরও দুইজন ভারতীয় পালোয়ান অবশ্য য়ুরোপে গিয়েছিলেন। প্রথম হচ্ছেন প্রাচীন ভুটান সিং; কিন্তু যুবক হেকেনস্মিথের কাছে তিনি পরাজিত হন। দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন গোলাম, ভারতে আজ পর্যন্ত যাঁর নাম অতুলনীয় হয়ে আছে। কিন্তু তুর্কী পালোয়ান আহম্মদ মদ্রালীর কাছে হার মানতে হয়েছিল তাঁকেও। কিন্তু গামা ও ইমামবক্স য়ুরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ পালোয়ানদের অনায়াসেই ভূমিসাৎ ক’রে অজেয় নাম কিনে দেশে ফিরে আসেন। সেই-ই প্রথম য়ুরোপে ভারতীয় পালোয়ানদের জয়যাত্রার সূত্রপাত।
মল্লযুদ্ধের দিকে গোবরবাবুদের প্রবৃত্তি হয়েছিল সহজাতসংস্কারের জন্যেই। বাংলা দেশে এই পুরুষোচিত ক্রীড়ার চর্চা চ’লে আসছে তাঁদের পরিবারে বহুকাল থেকেই। তাঁর পিতামহ অম্বুবাবু ও ক্ষেতুবাবু প্রভূত অর্থের মালিক হয়েও সাধারণ নিষ্কর্মা ধনীদের মত কমলবিলাসীর জীবনযাপন করতেন না। মুক্তকচ্ছ হয়ে বৈষ্ণবী মায়া নিয়ে তাঁরা মেতে থাকেননি, শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা পেয়ে তাঁরা হয়েছিলেন বীরাচারী শক্তিসাধক। বাড়ীতেই ছিল তাঁদের বিখ্যাত কুস্তির আস্তানা, সেখানকার মাটি গায়ে মাখেননি, ভারতের প্রথম শ্রেণীর পালোয়ানদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা বেশী নয়। এবং অম্বুবাবু ও ক্ষেতুবাবু নিজেরাও ছিলেন প্রখ্যাত কুস্তিগীর, তাঁদের নাম ফিরত লোকের মুখে মুখে। কেবল বাংলা দেশে নয়, বাংলার বাইরেও। গোবরবাবুদের পিতৃদেবকেও আমি দেখেছি। তিনিও কুস্তি লড়তেন কিনা ঠিক জানি না, কিন্তু খুব সম্ভব লড়তেন। কারণ দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে তিনিও ছিলেন বিশালকায়। এমন বলী বংশে জন্মগ্রহণ করলে যোদ্ধা না হওয়াই অস্বাভাবিক।
ধীরে ধীরে গোবরবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ জ’মে উঠতে লাগল। এবং ধীরে ধীরে আমার সামনে খুলে যেতে লাগল তাঁর প্রকৃতির নূতন নূতন দিক। সাধারণতঃ লোকের বিশ্বাস, পালোয়ানরা কেবল কুস্তি লড়ে, মুগুর ভাঁজে ও ডন-বৈঠক দেয় এবং অবসরকালে ভোম হয়ে থাকে ভাঙের নেশায়। জানি না গোবরবাবু বাঙালী ব’লেই এটা সম্ভবপর হয়েছে কি না, কিন্তু তাঁকে দেখে বুঝলুম, পালোয়ানকুলেও প্রহ্লাদ জন্মায়।
নরেনবাবুর বাড়ীতে কেবল গালগল্পের মজলিস বসত না। প্রতি শনিবারে সেখানে নাতিবৃহৎ মাইফেলের আয়োজন হ’ত এবং প্রতি শনিবারের সন্ধ্যায় কেবল নামজাদা স্থানীয় শিল্পীরা নন, বাংলার বাইরেকার ভারতবিখ্যাত গাইয়ে-বাজিয়েও এসে আসরে আসীন হতেন। এমন দিন ছিল না, গোবরবাবু যেদিন সেখানে হাজিরা না দিতেন। কেবল হাজিরা দেওয়া নয়, তাঁর মুখ দেখলেই বোঝা যেত, সঙ্গীতসুধা পান করছেন তিনি প্রাণমনকান ভ’রে। সস্তায় সমঝদার সাজবার জন্যে থেকে থেকে বাঁধা বুলি কপচে উঠতেন না, চুপ ক’রে ব’সে ব’সে উপভোগ করতেন গানবাজনা। পরে শুনলুম তিনি নিজেও সঙ্গীতশিল্পী, তাঁকে তালিম দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ব্যাঞ্জো-বাদক স্বর্গীয় ককুভ খাঁ।
ক্রমে গোবরবাবুর সঙ্গে পরিচয় হ’ল আরো ঘনিষ্ঠ। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে সাহিত্য সম্পর্কীয় আলোচনাও হ’তে লাগল। বুঝলুম পালোয়ানি প্যাঁচের মধ্যে পড়ে তাঁর মস্তিষ্ক আড়ষ্ট হয়ে যায় নি, তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধ আছে, সাহিত্য-প্রসঙ্গ তুললেও তাঁর মুখ বন্ধ হয় না, স্বদেশী ও বিদেশী সাহিত্য সম্বন্ধেও খবরাখবর রাখবার জন্যে তাঁর আগ্রহের অভাব নেই।
তারপর প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই বসতুম গিয়ে তাঁর বৈঠকখানায়। আর একজন সাহিত্যিক সেখানে শিকড় গেড়ে বসলেন, তিনি হচ্ছেন শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী। গালগল্প হ’ত, খেলাধূলার আলোচনা হ’ত, দুনিয়ার বিখ্যাত বলবান ব্যক্তিদের কথা হ’ত, সাহিত্য ও অন্যান্য শিল্পের প্রসঙ্গও বাদ দেওয়া হ’ত না। সেখানে আরো যে সব ব্যক্তি উপস্থিত থাকতেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন গোবরবাবুর আখড়ার শিক্ষার্থী পালোয়ান এবং মাঝে মাঝে আসরাসীন হ’তেন বিখ্যাত ভীম ভবানীও। উচ্চতর আলোচনা পরিপাক করবার শক্তি তাঁদের ছিল না বটে, তবে তাঁরা চুপচাপ ব’সে ব’সে শুনতেন আমাদের কথোপকথন। এর আগেই বলেছি, ভীম ভবানী এক সময়ে বিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলেন। পরে তিনি অল্পবয়সেই লেখাপড়া ছেড়ে শক্তিচর্চা নিয়ে মেতে ওঠেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি যদি মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্যে অল্পবিস্তর অবহিত হ’তেন, তাহ’লে সিদ্ধির পথে নিশ্চয়ই হ’তে পারতেন অধিকতর অগ্রসর।
দেহে ও মনে সমানভাবে শিক্ষিত যোদ্ধারা যে কতদূর অগ্রসর হ’তে পারেন, আমেরিকার বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা জেনে টুনির কথা স্মরণ করলেই সে সত্য উপলব্ধি করা যায়। উচ্চশিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে টুনি ছিলেন বিদ্বজ্জনদেরই একজন, অথচ মুষ্টিযুদ্ধ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন আট নয় বৎসরকাল। এই সময়ের মধ্যে তিনি একবার মাত্র হেরে গিয়েছিলেন প্রখ্যাত যোদ্ধা হ্যারি গ্লেবের কাছে। কিন্তু তারপরেই তাঁকে উপর-উপরি তিনবার হারিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেন। টুনি যে বৎসরে মুষ্টিযুদ্ধ শুরু করেন, সেই বৎসরেই (১৯১৯ খৃঃ) জ্যাক ডেম্পসি “পৃথিবীজয়ী” উপাধি লাভ করেন। তারপর থেকে তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারে পৃথিবীতে এমন কেউ আর রইল না। একজন মাত্র মুষ্টিযোদ্ধাকে তাঁর সমকক্ষ ব’লে সকলে মনে করত, তিনি হচ্ছেন ফ্রান্সের জর্জেস কার্পেনটিয়ার। কিন্তু ১৯২১ খৃষ্টাব্দে ডেম্প্সি তাঁকেও মাত্র চার রাউণ্ডে হারিয়ে দিলেন। তারই তিন বৎসর পরে টুনিও হারিয়ে দিলেন কার্পেনটিয়ারকে এবং ডেম্পসিকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধের জগতে ডেম্প্সি তখন বিরাজ করছেন নেপোলিয়নের মত, তাঁর নাগাল ধরবার জন্যে টুনিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অবশেষে ১৯২৬ খৃষ্টাব্দের শেষের দিকে টুনির সঙ্গে ডেম্প্সির শক্তিপরীক্ষা হয় এবং দশ রাউণ্ডের মধ্যে ডেম্প্সি হেরে যান। “পৃথিবীজেতা” উপাধি হারিয়ে পূর্ব গৌরব পুনরুদ্ধার করবার জন্যে পর বৎসরেই ডেম্প্সি আবার টুনির সঙ্গে মুখোমুখি হন এবং আবার হেরে যান। ডেম্প্সির পতনের পর টুনি হলেন পৃথিবীজেতা মুষ্টিযোদ্ধা ও বিপুল বিত্তের অধিকারী, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গ্রহণ করলেন চিরবিদায়। বললেন, “আমি হাতে বক্সিং-এর দস্তানা পরেছিলুম কেবল টাকা রোজগারের জন্যে। আমার সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, আর লড়াই নয়, এবার থেকে লেখাপড়া নিয়ে আমি কাল কাটাতে চাই।” আমেরিকার মুষ্টিযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, টুনি হচ্ছেন একমাত্র “হেভি ওয়েট” যোদ্ধা, পৃথিবীজেতা উপাধি লাভ করবার পরেও যিনি অক্ষুন্ন গৌরবে বিদায় নিতে পেরেছিলেন। আর সবাই অতিরিক্ত টাকার লোভে যৌবনসীমা পেরিয়েও বার বার লড়াই করেছেন এবং অবশেষে মান ও উপাধি হারিয়ে স’রে পড়েছেন চোখের আড়ালে। টুনি ছিলেন বিদ্বান, এ ভ্রম তিনি করেননি। এখন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন বৎসর চলছে এবং মুষ্টিযুদ্ধের আসর থেকে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন ত্রিশ বৎসর বয়স পূর্ণ হবার আগেই। কেবল টুনি নন, আমেরিকার আরো কয়েকজন মুষ্টিযোদ্ধা উচ্চশিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছেন।
সর্বকালেই অতুলনীয় জ্যাক জনসন। শ্বেতাঙ্গরা তাঁকে কোনদিনই হারাতে পারত কি না কে জানে, কিন্তু “পৃথিবীজেতা” উপাধি ত্যাগ না করলে পাছে তাঁকে শ্বেত গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয়, সেই ভয়ে জ্যাক জনসন দায়ে প’ড়ে জেস উইলার্ড নামে এক নিকৃষ্ট যোদ্ধার কাছে যেচে হার মানতে বাধ্য হন।
জনসন জাতে নিগ্রো এবং পেশায় মুষ্টিযোদ্ধা বটে, কিন্তু তাঁকেও অন্ততঃ বিদ্বৎকল্প বলা যেতে পারে। কারণ সাংবাদিকরা যখনই তাঁর কাছে গিয়েছেন তখন প্রায়ই তাঁর মুখে শুনেছেন দর্শনশাস্ত্রের কথা। ভারতবর্ষে উচ্চশ্রেণীর পালোয়ানদের মধ্যে গোবরবাবু ছাড়া আর কোন শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন বলে জানি না। এখানকার সর্বশ্রেষ্ঠ দুই পালোয়ানই (গামা ও ইমাম) নিরক্ষর।
গোবরবাবু যখন দ্বিতীয় বার ইংলণ্ডে গিয়ে শ্বেতদ্বীপ জয় করেন, তখন মরিস ডিরিয়াজ নামে একজন প্রথম শ্রেণীর পালোয়ান প্যারিস শহরে একটি মস্ত দঙ্গলের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সেখানে কুস্তি লড়েছিলেন বহু শ্বেতাঙ্গ পালোয়ান। গোবরবাবু ও সেই দঙ্গলে যোগ দিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ সেটা ১৯১২ কি ১৩ খৃষ্টাব্দের কথা। জ্যাক জনসন তখন শ্বেতাঙ্গ গুণ্ডাদের অত্যাচারে আমেরিকা ছেড়ে প্যারিসে পালিয়ে এসেছিলেন এবং সেই সময়ে গোবরবাবুদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় হয়।
কেবল কুস্তির কৌশল নয়, পালোয়ানদের দৈহিক শক্তির উপরেও যথেষ্ট নির্ভর করতে হয়। গায়ের জোরে স্যাণ্ডো যে গামার চেয়ে বলবান ছিলেন, এমন কথা মনে করবার কারণ নেই। গোবরবাবু ও একজন মহাবলী ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর মুখে মুষ্টিযোদ্ধা জ্যাক জনসনের সহ্যক্ষমতা ও শারীরিক শক্তির যে বর্ণনা শুনেছি, তা চমকপ্রদ ও বিস্ময়জনক।
বক্সারদের মুষ্টি আর ভারতীয় পালোয়ানদের “রদ্দা”, এ দুইই হচ্ছে ভয়াবহ ব্যাপার। যাদের অভ্যাস নেই, মহাবলবান হ’লেও বড় পালোয়ানের হাতের এক রদ্দা খেলে তারা মাটির উপরে আর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু জ্যাক জনসন একদিন শখ ক’রে গোবরবাবুকে তাঁর ঘাড়ের উপরে রদ্দা মারবার জন্যে আহ্বান করেছিলেন। গোবরবাবু তাঁকে বিশ-পঁচিশবার রদ্দা মারেন সজোরে, কিন্তু জনসন একটুও কাতর না হয়ে হাসিমুখে অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন।
তারপর জনসন একটি সংকীর্ণ গণ্ডীর ভিতরে গিয়ে গোবরবাবুকে বলেন, “এইবারে আমাকে ঘুসি মারো দেখি।” কিন্তু এমনি তাঁর ক্ষিপ্রকারিতা ও পাঁয়তারার কায়দা যে, বহু চেষ্টার পরেও গোবরবাবু জনসনের দেহ স্পর্শ করতেও পারেননি।
গোবরবাবুর বৈঠকখানায় আমরা বেশ কিছু কাল সানন্দে কাটিয়ে দিয়েছিলুম। সন্ধ্যার পর প্রায়ই সেখানে আসতেন অদ্বিতীয় সরদবাদক স্বর্গীয় ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, স্বর্গীয় ওস্তাদ গায়ক জমীরুদ্দিন খাঁ, প্রসিদ্ধ তবলাবাদক স্বর্গীয় দর্শন সিং ও গায়কশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে প্রভৃতি শিল্পিগণ। গুণীরা বইয়ে দিতেন সুরের সুরধুনী এবং লীলায়িত হয়ে উঠত আমাদের মন তারই ছন্দে ছন্দে। এক-একদিন আমাদের সৌন্দর্যের স্বপ্নভঙ্গ হ’ত প্রায় ভোরের বিহঙ্গকাকলির সঙ্গে সঙ্গে।
তারপর গোবরবাবু আবার দীর্ঘকালের জন্যে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে গেলেন আমেরিকার দিকে।