এখন যাঁদের দেখছি/উদয়শঙ্করের দৃশ্য সঙ্গীত

উদয়শঙ্করের দৃশ্যসঙ্গীত

 উদয়শঙ্কর প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসেন সেদিন তাঁর মুখেই শুনেছিলুম, য়ুরোপে থাকতে একাধিক ভারতীয় রাজা-মহারাজা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, স্বদেশে ফিরে এলে তাঁরা তাঁকে সাহায্য করতে ত্রুটি করবেন না।

 কিন্তু কাজে পরিণত হয়নি তাঁদের মুখের কথা। স্বদেশে প্রত্যাগমন ক’রে উদয়শঙ্কর কোন রাজা-মহারাজাকেই লাভ করেননি পৃষ্ঠপোষকরূপে। কিন্তু কাঞ্চনকৌলীন্যগর্বিত খেতাবী ধনিকের পরিবর্তে যে মনস্বী শিল্পাচার্য এই তরুণ শিল্পীর সহায়করূপে এগিয়ে এলেন, তথাকথিত কোন রাজা-মহারাজার সাহায্যই তার চেয়ে ফলদায়ী হ’ত না। প্রাচ্যকলা-সংসদে প্রথম দিন যাঁরা আমন্ত্রিত হয়ে নাচ দেখতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যে, ললিত কলায় ও সংস্কৃতির জন্যে বিখ্যাত বহু ব্যক্তি। তাঁরা সকলেই উদয়শঙ্করের অভাবিত নৃত্য-নৈপুণ্য দেখে যখন একবাক্যে মৌখিক অভিনন্দন দান করলেন, তখনই ভবিষ্যতের জন্যে আমাদের মনে রইল না আর অনুমাত্র সন্দেহ।

 বাংলার প্রথম ও প্রধান ‘ইম্প্রেসারিও’ হরেন ঘোষও তখন ভরসায় বুক বেঁধে মাসখানেক পরে নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে উদয়শঙ্করের নাচ দেখাবার ব্যবস্থা করলেন। সেবারেও উদয়শঙ্কর একা এবং তিনি উচিতমত ঐকতানের সাহায্যও পেলেন না। মিঃ ফ্রাঙ্গোপোলোর নেতৃত্বে যে বিলাতী অর্কেষ্ট্রা বেজেছিল, তা আহত করেছিল ভারতীয় নৃত্যের ছন্দকে। কেবল একটি নাচে শোনা গিয়েছিল শ্রীতিমিরবরণের দেশীয় ঐকতান এবং সেইজন্যেই তার সার্থকতাও হয়েছিল নিখুঁত।

 প্রেক্ষাগৃহে দেখলুম বৃহতী জনতা এবং শুনলুম টিকিট না পেয়ে ফিরে গিয়েছেও শত শত লোক। বুঝলুম প্রাচ্যকলা-সংসদে অনুষ্ঠিত অপূর্ব নৃত্য-প্রদর্শনীর খ্যাতি এর মধ্যেই সহরের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে; নইলে বাংলা দেশের অনভ্যস্ত দর্শকরা একটিমাত্র অপরিচিত পুরুষ নর্তকের নাচ দেখবার জন্যে কখনোই এমন বিপুল আগ্রহ প্রকাশ করত না।

 এবং একাই সকলকে অভিভূত করলেন উদয়শঙ্কর। প্রথমেই তিনি “technique and rhythm of the body-movements”— দেখিয়ে দর্শকদের চমৎকৃত ক’রে দিলেন। সকলে অবাক্ হয়ে দেখলেন, ভালো নাচতে হ’লে দেহের ও মাংসপেশীর উপরে নর্তকের কতখানি প্রভুত্ব থাকা দরকার! তাঁর আঙুলের, বাহুর, গ্রীবার ও কটিদেশের নমনীয়তা অত্যন্ত বিস্ময়কর— না দেখলে বিশ্বাস করাই অসম্ভব। ইচ্ছা করলেই দেহের বিশেষ কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাংসপেশীর ভিতর দিয়ে তিনি যেন ছন্দের স্রোত প্রবাহিত করতে পারেন, অত্যন্ত অবহেলায়।

 তারপর সুরু হ’ল তাঁর নাচ—কখনো ইন্দ্র সেজে, কখনো গন্ধর্ব সেজে, কখনো শিব সেজে। তিনি দেখালেন ছোরা-নাচ ও অসি–নৃত্য। আবার নারী সেজে লাস্যলীলাতেও সকলের মনকে মাতিয়ে তুললেন। সে রকম নাচ বাঙালীর চোখ তার আগে আর কখনো দেখেনি। তারপর জনসাধারণের মধ্যে উদয়শঙ্করকে দেখবার আগ্রহ এতটা বেড়ে উঠল যে, পরে আরো দুইদিন পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নাচ দেখাবার আয়োজন করতে হ’ল।

 তারপরের কথা আর বিস্তৃতভাবে বর্ণনা না করলেও চলবে। কিছুকাল পরে উদয়শঙ্কর যখন সম্প্রদায় গঠন ক’রে রীতিমত প্রস্তুত হয়ে আবার কলকাতায় আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন ভাবীকালের জন্যে ভারতীয় নৃত্যকলার আসরে নির্দিষ্ট হয়ে গেল তাঁর চিরস্থায়ী আসন। তাঁর সম্মান দেখে নৃত্যভীত বাঙালীর ছেলেরা সাহস সঞ্চয় ক’রে দলে দলে যোগ দিতে লাগল নাচের আসরে। উদয়শঙ্কর না থাকলে এটা সম্ভবপর হ’ত না। তিনি আগে পৃথিবী জয় ক’রে দেশে ফিরেছেন ব’লেই বাংলার নৃত্যকলাকে এত সহজে জাতীয় ক’রে তুলতে পেরেছেন।

 তাঁর আর্ট ঠুনকো নয়। নাচকে আগে এখানে সাধারণতঃ লঘু, বা চটুল ব’লেই মনে করা হ’ত। উদয়শঙ্কর কিন্তু একাধিক স্মরণীয় নৃত্যনাট্য রচনা ক’রে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, জীবনের গুরুতর সমস্যাগুলিও নাচের ছন্দের ভিতর দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায় এবং প্রকাশ করা যায় একটা সমগ্র জাতির আশা ও আকাঙ্ক্ষা। সে সব আসরে হাল্কা মন নিয়ে হাজির হ’লে দর্শকদেরও হ’তে হবে উপভোগ থেকে বঞ্চিত। তাঁর এই শ্রেণীর কোন কোন নাচে দেখা যায় রুসীয় ‘ব্যালে’র অল্পবিস্তর প্রভাব। কিন্তু এটা নিন্দনীয় নয়। আর্টের ক্ষেত্রে এমন লেনদেনের প্রথা চিরকালই প্রচলিত আছে। বাংলা সাহিত্যের সর্বত্রই দেখা যায় য়ুরোপীয় প্রভাব। কিন্তু সেজন্যে বাংলার সাহিত্য হয়ে ওঠেনি য়ুরোপের সাহিত্য। পাশ্চাত্য চিত্রকলার উপরে পড়েছে জাপানী, মিসরীয়—এমন কি অসভ্য কাফ্রীদেরও শিল্পের প্রভাব। তবু পাশ্চাত্য আর্ট হারিয়ে ফেলেনি নিজের জাত।

 উদয়শঙ্করের জনপ্রিয়তার মূলে আছে আরো কোন কোন কারণ। তিনি দেশ-বিদেশের নাচের সঙ্গে সুপরিচিত হবার জন্যে ব্যয় করেছেন বহু সময়, বহু পরিশ্রম। নিজে ‘ক্লাসিকাল’ নৃত্য যে জানেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যাচার্য শঙ্করম নম্বুদিরির কাছে গিয়ে মুদ্রাপ্রধান “কথাকলি” নাচও শিক্ষা করেছেন। য়ুরোপে বাস ক’রে ও রুস-নৃত্যসম্প্রদায়ে যোগ দিয়ে তিনি যে য়ুরোপীয় নাচের বিশেষত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এটকুও অনুমান করা যায় অনায়াসে। কিন্তু কোন বিশেষ পদ্ধতিই তাঁর সক্রিয় মস্তিষ্ক ও স্বকীয় পরিকল্পনাকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলতে পারেনি। যখনই দরকার মনে করেছেন তখনই তিনি যেখান থেকে খুসি তিল তিল সৌন্দর্য আহরণ ক’রে গ’ড়ে তুলতে চেয়েছেন আপন পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ নূতন এক তিলোত্তমাকে।

 নৃত্যপ্রধান চলচ্চিত্র “কল্পনা” দেখিয়ে তিনি তাঁর মুন্সীয়ানার আর এক পরিচয় দিয়েছেন। এই ছবিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন শিল্পীর উদ্ভট কল্পনাবিলাস, ইংরেজীতে যাকে বলে “ফ্যাণ্টাসি”। ও বস্তুটির প্রকৃত অর্থ এদেশের অনেকেই জানে না, তাই ছবিখানির আখ্যানভাগের আসল মর্ম হয়তো অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যে ও ললিতকলায় আছে “ফ্যাণ্টাসি”র বহু স্মরণীয় উদাহরণ। “কল্পনা”কে একাধারে “ফ্যাণ্টাসি” ও “ডকুমেণ্টারি” ছবির শ্রেষ্ঠ উদাহরণরূপে গ্রহণ করা যায়, কারণ তার মধ্যে আছে আজব কল্পনার খেলার সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যের অজস্র নমুনা। ধরতে গেলে প্রধানতঃ নানা শ্রেণীর নাচ দেখাবার জন্যেই কল্পনাকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে পটভূমিকার মত। ছবিখানি কেবল এদেশেই নয়, পৃথিবীর নানা দেশের সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশস্তি অর্জন করতে পেরেছে।

 উদয়শঙ্করকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, চিত্রপরিচালনার অভিজ্ঞতা আপনি কোথা থেকে সঞ্চয় করলেন? উত্তরে তিনি এদেশের অধিকাংশ হাম-বড়া চিত্রপরিচালকের মত ফাঁকা বুলির ঝুলি না ঝেড়ে, নিজের স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে অম্লানবদনে বলেছিলেন, “চিত্রপরিচালনার কোন অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না।”

 তবু ছবি হিসাবে কল্পনা এমন উতরে গেল কেন? তথাকথিত বাঙালী পরিচালকদের মত উদয়শঙ্করও পাশ্চাত্য ছবির বাজার থেকে পরিকল্পনা সংগ্রহ করেননি বা ব্যক্তিগত বদখেয়াল মেটাবার জন্যে যা খুশি তাই দেখাতে চাননি। একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে পরিপূর্ণ ক’রে তোলবার জন্যে তিনি স্বাধীনভাবেই মস্তিষ্ক চালনা করেছেন এবং এমন নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন নিজের সহজ বুদ্ধিকে যে কোথাও হয়নি আধিক্যেতা বা ছন্দপাত।

 নাচের আসরে তিনি প্রমাণিত করেছেন আর একটি সত্য। এদেশী নৃত্যধুরন্ধররা যখন প্রাচীন বা প্রাদেশিক নানা শ্রেণীর নাচ নিয়ে খুব খানিকটা ধোঁয়াভরা বড় বড় কথার ফানুস ওড়াতে ও তর্কাতর্কি করতে নিযুক্ত ছিলেন, উদয়শঙ্কর তখন মানুষের সত্যকার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করবার জন্যে লোক-নৃত্যের সাহায্যে রচনা করতে লাগলেন দৃশ্যকাব্যের পর দৃশ্যকাব্য। নাচের ওস্তাদরা সব লোকনৃত্যের আভিজাত্য স্বীকার করতে নারাজ, উদয়শঙ্করের নৃত্য-প্রতিভায় সেইগুলিই হয়ে উঠেছে বিদগ্ধজনের উপযোগী, বেগবান, বলিষ্ঠ ও বিচিত্র জীবনের উৎস এবং রূপে, রসে, বর্ণে ও দৃশ্যসঙ্গীতে অনুপম। কে বলতে পারে এই লোকনৃত্যের গতি ও ছন্দের ভিতর থেকেই আত্মপ্রকাশ করবে না ভবিষ্যতের ভারতীয় প্রধান নৃত্য?

 কিন্তু দক্ষিণ ভারতের একাধিক নৃত্যবাচস্পতি বাঙালী উদয়শঙ্করের প্রতিভাকে স্বীকার করতে প্রস্তুত নন। শিল্প-সমালোচক শ্রীভেঙ্কটাচলমের মতে, “কথাকলি ও ভারত নাট্যমের শিল্পীদের কাছে উদয়শঙ্কর হচ্ছেন শিক্ষার্থী ও সৌখীন (নভিস অ্যাণ্ড এমেচার) মাত্র।”

 যিনি বাল্যকাল থেকে একান্তভাবে নৃত্যসাধনা ক’রে আজ অর্থশতাব্দী পার হয়ে এসেছেন এবং যিনি ভারতের এবং য়ুরোপ—আমেরিকার দেশে দেশে লাভ করেছেন অতুলনীয় অভিনন্দন, তিনিই নাকি “শিক্ষার্থী ও সৌখীন”! এর চেয়ে অতিবাদ শোনা যায় না।

 কিন্তু কেন? উদয়শঙ্করের আর্ট জটিল, দুর্বোধ ও কষ্টসাধ্য নয় ব’লে? আমরা এতদিন জানতুম, যে আর্ট নিজের কৃত্রিমতা ও জটিলতা গোপন ক’রে সহজ, স্বাভাবিক ও সুবোধ্য হয়ে উঠতে পারে, তাকেই যথার্থভাবে বলা চলে উচ্চশ্রেণীর। প্যাঁচালো কায়দা দেখিয়ে গলদ্‌ঘর্ম হওয়াই প্রকৃত শিল্পীর লক্ষণ নয়। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃত্যগুরুর কাছে উদয়শঙ্কর কথাকলি নৃত্য শিক্ষা করেছেন, কিন্তু কথাকলির অতিরিক্ত মুদ্রাপ্রাধান্যকে আমল দিয়ে নিজের আর্টের বা নাচের সরলতা ক্ষুণ্ণ করতে চান নি। বর্তমান যুগে যিনি মধ্য যুগের ফতোয়া প্রতি পদে মাথা পেতে মেনে নেবেন, তাঁর মনীষা ও সার্থকতা আমি স্বীকার করতে নারাজ।

 হরেন ঘোষ ও উদয়শঙ্করের আমন্ত্রণে একটি ঘরোয়া বৈঠকে অতুলনীয়া নর্তকী বালাসরস্বতীর নাচ দেখবার সুযোগ পেয়েছিলুম। সেই জটিল নাচে শ্রীমতীর অপূর্ব কৃতিত্ব দেখে বিস্মিত হলুম। কেবল কি তাই? ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ’রে সেই বহুশ্রমসাধ্য কঠিন ও প্যাঁচালো নাচে তিনি একাই যে শক্তি জাহির করলেন, তা অভাবিত বললেও অত্যুক্তি হবে না।

 উদয়শঙ্কর আমার পাশেই বসেছিলেন। তিনি নিজের স্বভাবসিদ্ধ বিনয় প্রকাশ ক’রে বললেন, “দাদা, চেষ্টা করলেও আমি একা এতক্ষণ ধ’রে এমন কঠিন নাচ নাচতে পারতুম না।”

 তিনি যে চেষ্টা করলে পারতেন না, এ কথা বিশ্বাস করি না। কিন্তু তিনি সে চেষ্টা করেন নি ব’লে ভগবানকে ধন্যবাদ দি। কারণ সে চেষ্টায় সফলতা অর্জন করে তিনি প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যকলার অন্যতম প্রধান শিল্পী ব’লে পরিচিত হ’লেও যুগান্তকারী প্রতিভাধর স্রষ্টা ব’লে স্বীকৃত এবং সার্বজাগতিক আসরে নেমে এমনভাবে অভিনন্দিত হ’তে পারতেন না।

 সহধর্মিণীরূপেও তিনি নির্বাচন করেছেন আর এক অনুপম নৃত্যশিল্পীকে—শ্রীমতী অমলা দেবী। এমন অপূর্ব মিলন দেখা যায় না, রাজযোটকও বলা চলে।

 এক নাচের আসরে উদয়শঙ্করকে বলেছিলুম, “অমলা দেবীকে সহনর্তকীরূপে পাবার পর থেকে আপনার সম্প্রদায়ে বিশেষভাবে হাসির আবির্ভাব হয়েছে।”

 অমলা দেবী হাসতে হাসতে বললেন, “তাতে কোন দোষ হয়েছে কি?”

 আমি বললুম, নিশ্চয়ই নয়! আগেও এ দলের মেয়েরা নাচতেন যথেষ্ট, কিন্তু তাঁদের হাসি ছিল না পর্যাপ্ত।”

 নৃত্য যেখানে আনন্দের উচ্ছ্বাস, মন চায় সেখানে হাসির শোভন প্রাচুর্য।