এখন যাঁদের দেখছি/উদয়শঙ্করের আত্মপ্রকাশ

চৌত্রিশ

উদয়শঙ্করের আত্মপ্রকাশ

 শিষ্ট বাঙালীরা মিষ্ট লাগলেও নৃত্যকে ভদ্র কাজ ব’লে মনে করতেন না। রঙ্গালয়ে “আলিবাবা”, “আলাদীন” ও “আবুহোসেন” প্রভৃতি নৃত্যগীতপ্রধান পালার জনপ্রিয়তা দেখে বেশ বোঝা যায়, নাচ দেখতে তাঁরা ভালোবাসতেন। মড অ্যালান ও আনা পাবলোভা প্রভৃতি নর্তকীরা কলকাতায় এসে বাঙালীদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন প্রভূত অভিনন্দন। ভদ্রসমাজে তরফাওয়ালীদেরও কম কদর ছিল না। কিন্তু শিক্ষিত সমাজের ছেলেমেয়েরা যে নাচবেন বা নাচ শিখবেন, এটা ছিল আগে স্বপ্নেরও অগোচর। যদিও শিশু বয়সে আমরা সকলেই নৃত্য করেছি, কিন্তু তার কারণ হচ্ছে সহজাত প্রবৃত্তি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ প্রবৃত্তিকে আমরা দমন ক’রে ফেলতুম পরম সাবধানে।

 তখন মেয়েদের মধ্যে নাচ ছিল পতিতাদের নিজস্ব। থিয়েটারের মধ্যে যে দুই-চারজন পুরুষ নৃত্যচর্চা করতেন, তাঁরা ছিলেন “বখাটে” ব’লে কুবিখ্যাত। রাস্তায় রাস্তায় নিম্নশ্রেণীর পুরুষরা গান গেয়ে নেচে বেড়াত, কিন্তু সে সব ছিল সঙের নাচ। সাত-আট বৎসর বয়সে এই রকম সঙের নাচে আমি সর্বপ্রথমে পুরুষ নাচিয়েকে দেখি। নাচের গানটির প্রথম কলিটি আজও আমার মনে আছেঃ

“বাংলাদেশের রংলা মুলুক
আমরা এনেছি।”

তখনকার থিয়েটারেও পুরুষদের নাচ ছিল অধিকাংশ স্থলেই সঙের নাচেরই মত। পথে পথে পুরুষদের আর একরকম নাচ দেখা যেত। বাউল নাচ।

 মধ্যযুগের বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে উচ্চাঙ্গের নৃত্য প্রবর্তন ক’রেছিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। তাঁর জীবনী পাঠ করলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না যে তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ নর্তক। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন পুরুষদের উচ্চশ্রেণীর নৃত্য বোধ করি এদেশে কোনকালেই প্রচলিত ছিল না। গত শতাব্দীতে রামকৃষ্ণদেবও নৃত্য করতেন বটে, কিন্তু তারও মধ্যে ছিল ধর্মভাবের উন্মাদনা।

 কিন্তু এদেশে যখন আর কোন শিক্ষিত পুরুষ নাচের নূপুর পরেননি, তখনও আমি সম্ভ্রান্ত সমাজে দুইজন পুরুষের নাচ দেখবার সুযোগ পেয়েছি। প্রথমে নাচতে দেখেছিলুম স্বর্গীয় শিল্পী ও নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথের সহচর যতীন্দ্রনাথ বসুকে। তারপর দেখেছিলুম রবীন্দ্রনাথকে, “ফাল্গুনী” নাটকের অন্ধ বাউলের ভূমিকায়।

 সাতাশ কি আটাশ বৎসর আগেকার কথা। রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা নৃত্যকলাকে জাতে তোলবার চেষ্টা করছেন এবং তাঁরই তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনের কোন কোন তরুণী নাচের ভূমিকায় দেখা দিয়েছেন কোন কোন নাট্যাভিনয়ে। শিক্ষিত সমাজের বাঙালী ছেলেরা তখনও নাচের ডাকে সাড়া দেননি। সাড়া দেবেন কি, সাড়া দিতেও ভয় পেতেন। নিজে নাচা তো দূরের কথা, যবনিকার অন্তরালে থেকে সাহিত্যিক হয়েও শিশির-সম্প্রদায়ের জন্যে আমি কয়েকটি নৃত্য পরিকল্পনা করেছিলুম ব’লে একাধিক পত্রিকার দ্বারা বার বার তীব্র ও নোংরা ভাষায় আক্রান্ত হয়েছিলুম।

 এমনি সময়ে একদিন ভারতবিখ্যাত প্রমোদ-পরিবেশক স্বর্গীয় হরেন ঘোষ, একটি চারুদর্শন তরুণ যুবককে নিয়ে আমার বাড়ীতে এসে উপস্থিত হ’লেন।

 হরেন বললেন, “দাদা, এর নাম উদয়শঙ্কর। ইনি য়ুরোপ–আমেরিকায় আনা পাবলোভার নৃত্যসঙ্গী হয়ে নেচে এসেছেন। এখানেও ইনি নাচতে চান, কিন্তু কোথাও পাত্তা পাচ্ছেন না। কি উপায় করা যায় বলুন তো?”

 অবাক হয়ে উদয়শঙ্করের দিকে তাকালুম। সুশ্রী মুখ, সুগঠিত দেহ—নাচের পক্ষে আদর্শ চেহারা বটে। আর পাবলোভার বিশ্ববিখ্যাত সম্প্রদায়ে যিনি স্থান পেয়েছেন, তাঁর নৃত্যনিপুণতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহই থাকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে পুরুষের নাচ শিক্ষিতদের আসরে জমবে কি?

 বললুম, “হরেন, এঁকে একেবারে জনসাধারণের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো সমীচীন হবে না। তোমরা আগে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের কাছে যাও। আমার বিশ্বাস, তিনি কোন একটা ব্যবস্থা ক’রে দিতে পারবেন।”

 আমার বিশ্বাস ভ্রান্ত হ’ল না। অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার পর স্থির হল, তিনি প্রাচ্য-কলা-সংসদের প্রকাণ্ড হলঘরটি উদয়শঙ্করের নাচের জন্যে ছেড়ে দেবেন এবং নাচের দিনে আমন্ত্রণ করা হবে কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের।

 ইতিমধ্যে য়ুরোপের বিভিন্ন পত্রিকায় উদয়শঙ্করের নাচের সমালোচনা পাঠ করে তাঁর সাফল্য সম্বন্ধে আমার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না। প্যারিসের La Grifie বলেছেঃ “ছন্দ হচ্ছে এই সুন্দর নর্তকের অঙ্গবিশেষের মত, ছন্দহিল্লোলে তিনি পরিপূর্ণ; তাঁর পিত্তলবর্ণ দেহের সমস্ত মাংসপেশী তাঁরই বশীভূত।” বার্লিনের Tempo বলেছেঃ “এক উপভোগ্য অলৌকিক ব্যাপার! দেবতারা ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং যেসব গতির দ্বারা নিজেদের চিত্তকে ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গে কেবল ফুল ও দেবযানীর তুলনা চলতে পারে।” ভিয়েনার Neuess Wiener Tageblatt বলেছেঃ “উদয়শঙ্করের মূর্তি হচ্ছে যৌবনের মূর্তি— পাতলা, দেহ হিসাবে নিখুঁত এবং সেই সঙ্গে ভালো ইস্পাতের মত নমনশীল। তাঁর সকল গতিই নমনীয় লীলায় সুন্দর। তাঁর নৃত্যচিত্রগুলি গভীর রেখায় চমৎকার।”

 উদয়শঙ্কর কোন সম্প্রদায় নিয়ে কলকাতায় আসেন নি। এমন কি তাঁর প্রধান নৃত্যসঙ্গিনী সিমকীও তখন ছিলেন য়ুরোপে। সুতরাং একক নৃত্য ছাড়া আর কিছু দেখাবার উপায় তাঁর ছিল না। তার উপরেও ছিল আর এক মস্ত অসুবিধা। নাচের সঙ্গে চাই বাজনার সঙ্গত। ঐকতানের ব্যবস্থা হবে কেমন ক’রে?

 হাতে সময় নেই, ঐকতানের ব্যবস্থা হ’ল না। কোনরকমে সে অভাব পূরণ করবার জন্যে গ্রেপ্তার ক’রে আনা হ’ল স্বর্গীয় কুমার গোপিকারমণ রায়ের বিদ্যাবতী, কলাবতী ও রূপবতী কন্যা (তিনিও ছিলেন নৃত্যগীতপটীয়সী) স্বর্গীয়া গৌরী দেবীকে। নাচের সঙ্গে তিনি বাজাবেন পিয়ানো।

 ১৩৩৭ খৃষ্টাব্দের আষাঢ় মাসের তেইশে তারিখে প্রাচ্য-কলা–সংসদের হলঘরটি বিশিষ্ট ও বিদগ্ধ স্ত্রীপুরুষের জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সকলেরই মুখে আগ্রহ ও কৌতূহলের চিহ্ন। তাঁরা থিয়েটারে পুরুষদের সঙের নাচ দেখেছেন, তার সঙ্গে এ নাচের পার্থক্য হবে কি-রকম?

 না আছে রঙ্গমঞ্চ, না আছে ঐকতান, না আছে নৃত্যসঙ্গী এবং না আছে আলোকপাতের ব্যবস্থা। কিন্তু একটিমাত্র পিয়ানোর তালে তালে একটিমাত্র শিল্পী সেদিন আসর রাখলেন যে বিচিত্র কৌশলে, সকলেরই কাছে তা ছিল ধারণাতীত। সেইদিনই বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল, নৃত্য হচ্ছে একটি স্বাধীন আর্ট, তা দৃশ্যপট, আলোকপাত বা ঐকতানের মুখাপেক্ষা করে না। রুসীয় ব্যালের দেখাদেখি আজকাল য়ুরোপীয় নৃত্যেও দৃশ্যপট এবং ঐকতান প্রভৃতির বাড়াবাড়ি হয়েছে বটে, কিন্তু রুসীয় নৃত্যনাট্যসম্প্রদায় যাঁরা গঠন করেছিলেন, তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল একাধারে তিনটি আর্টের (নৃত্য, সঙ্গীত ও চিত্র) সম্মিলন দেখানো।

 কলকাতায় তখনও কেউ মণিপুরী ও কথাকলি প্রভৃতি নাচ দেখে নি। উত্তর-ভারতীয় পুরুষদের কথক নাচ দেখবার সুযোগ কারুর কারুর হয়েছিল বটে, কিন্তু নানা কারণে তা শিক্ষিত বাঙালীদের আকৃষ্ট করত না। কথক নাচে উচ্চতর পরিকল্পনা ও ভঙ্গি-বৈচিত্র্য নেই, তার মধ্যে যথেষ্ট কাব্যরস ও নাটকীয় ক্রিয়ার অভাব এবং তা আধুনিক যুগের উপযোগীও নয়।

 কথক নাচে যা ছিল না, তাই পাওয়া গেল উদয়শঙ্করের নাচে। জটিল তবলার বোলের সঙ্গে প্রাণপণে নূপুরের ধ্বনি মেলাবার জন্যে তিনি গলদঘর্ম হবার চেষ্টা করলেন না, অবলীলাক্রমে ধারাবাহিকভাবে নূপুর-গুঞ্জনের ছন্দে ছন্দে গতিশীল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা নয়নাভিরাম ভঙ্গির রেখায় রেখায় প্রকাশ ক’রে গেলেন সুপরিকল্পিত নৃত্যনাট্যের কাহিনী। যেমন অপূর্ব তাঁর নমনীয় দেহ, তেমনি আশ্চর্য তাঁর লীলায়িত বাহু— কাঁধ থেকে আঙুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত বইতে থাকে যেন অপরূপ রূপের তরঙ্গ, এমন বাহু নাচের আসরে আর কখনো দেখা যায় নি।

 সেদিন তিনি দেখিয়েছিলেন ইন্দ্র নৃত্য, গন্ধর্ব নৃত্য ও তাণ্ডব নৃত্য প্রভৃতি। সকলের চোখের সামনে তারাও এনে দিলে অভাবিত বিস্ময়। মনে হ’ল যেন অজন্তা ও ইলোরার চিত্র ও ভাস্কর্যের ভিতর থেকে জীবনলাভ ক’রে আত্মপ্রকাশ করছে পৌরাণিক যুগের দেবতাদের মূর্তিগুলি।

 উদয়শঙ্কর যখন নৃত্যশিল্পীরূপে এদেশে পদার্পণ করেন নি, তখনই আমি মৎসম্পাদিত “নাচঘর” পত্রিকায় (২৬ বৈশাখ, ১৩৩১) বলেছিলুম: “পাশ্চাত্য দেশে গ্রীস, রোম ও মিশরের প্রাচীন মন্দিরাদিতে ক্ষোদিত ভাস্কর্য দেখে পুরাতন নাচের ভঙ্গিগুলিকে আবার বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশেও তো উপাদানের অভাব নেই, তবে সে চেষ্টা হয় না কেন? আমাদের হাতের কাছে কেবল উৎকলের মন্দিরগাত্রের মূর্তিগুলি দেখলেই যে কতরকম চমৎকার নাচের ভঙ্গি পাওয়া যায়, তা আর বলবার নয়। যদি কোন নৃত্যশিক্ষক রঙ্গালয়ে সেই সব ভঙ্গি কাজে লাগাতে পারেন, তবে দুদিনেই তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠবেন। * * * * আসল কথা আমাদের রঙ্গালয়ের নৃত্যশিক্ষকদের শিক্ষাই এখনো সম্পূর্ণ হয় নি। রঙ্গালয়ে কার্য গ্রহণ করবার আগে তাঁদের উচিত, ভারতের নানা প্রদেশে গিয়ে নানা ভঙ্গির নৃত্যপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করা। প্রাচীন মন্দিরাদির ভাস্কর্য থেকেও সাহায্য গ্রহণ না করলে চলবে না।”

 আমাদের কথা পরিণত হয়েছিল অরণ্যে রোদনে। পরে “সীতা” নাট্যাভিনয়ের সময়ে আমরা নিজেরাই ঐ পদ্ধতিতে নৃত্য পরিকল্পনা করবার সুযোগ পাই। আমার রচিত “মঞ্জুল মঞ্জুরী নব সাজে” গানের সঙ্গে যে নাচটি ছিল, তা পরিকল্পিত হয় অজন্তা ও ইলোরার চিত্রে ও ভাস্কর্যে লিখিত মূর্তির বিশেষ ভঙ্গিমা অবলম্বন ক’রে। বাংলা নাচে এদিক দিয়ে সেই হয়েছিল প্রথম প্রচেষ্টা।

 এই নূতন পদ্ধতিতে আধুনিক ভারতীয় নৃত্য পরিকল্পনার সময়ে উদয়শঙ্করের সামনে ছিল কার আদর্শ? তিনি বেশ কিছুকাল ধ’রে আনা পাবলোভার নৃত্য-সম্প্রদায়ে কাজ ক’রেছিলেন। পাবলোভা যখন ভারতবর্ষে আসেন, তখন এখানকার প্রাচীন মন্দিরশিল্পের দিকে অত্যন্ত আকৃষ্ট হন। এবং তারই ফলে তাঁর “অজন্তার ফ্রেস্কো” প্রভৃতি ভারতীয় নৃত্যের জন্ম। আমার অনুমান সত্য কি না জানি না, তবে হয়তো পাবলোভারই প্রভাব পড়েছিল উদয়শঙ্করের পরিকল্পনার উপরে।