এখন যাঁদের দেখছি/রাজারাও ধীরেন্দ্রনারায়ণ
তেত্রিশ
রাজারাও ধীরেন্দ্রনারায়ণ
বাংলা দেশে এমন সব সাহিত্যিকের অভাব নেই, যাঁদের ভূষণ হচ্ছে রাজা বা মহারাজা উপাধি। বিশেষভাবে কয়েকজনের নাম মনে পড়ে।
নাটোরের রাজবংশ বহুদিন থেকেই রচনাশক্তির জন্যে বিখ্যাত। রাণী ভবানীর পত্র মহারাজা রামকৃষ্ণ রায় সঙ্গীত রচনায় প্রভূত কৃতিত্ব প্রকাশ ক’রে গিয়েছেন। গায়কদের বৈঠকে আজও শোনা যায় তাঁর রচিত কোন কোন গান। যেমন—
“মন যদি যায় ভুলে।
তবে বালির শয্যায় কালীর নাম
দিও কর্ণমূলে।”
মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় ছিলেন উচ্চশ্রেণীর কবি, সন্দর্ভকার ও সম্পাদক। তাঁর পুত্র মহারাজা শ্রীযোগীন্দ্রনাথ রায়ও কবি। যোগীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার শ্রীজয়ন্তনাথ রায় রচিত কাব্যপুস্তক “স্বর্ণরেখা” আমি পাঠ করেছি। কবিতাগুগুলির মধ্যে দক্ষ হাতের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা গদ্যসাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। সাহিত্যিকরূপে প্রথম জীবন আরম্ভ ক’রে পরে রাজা বা মহারাজা খেতাব পেয়েছেন তিনজন সুপরিচিত ব্যক্তি— রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মহারাজা স্যর যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও রাজা স্যর সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। মাত্র ষোলো বৎসর বয়সেই সৌরীন্দ্রমোহন নাটক (“মুক্তাবলী”) রচনা করেছিলেন। রাজা রাধাকান্ত দেব “শব্দকল্পদ্রুমে”র জন্যে অক্ষয় খ্যাতি অর্জন করেছেন। রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবেরও ইংরেজী ভাষায় লিখিত গ্রন্থ আছে। বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চন্দ্র মহাতাব কয়েকখানি পুস্তকের লেখক। কাশিম বাজারের মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীও গ্রন্থকার। সুসঙ্গের কুমুদচন্দ্রও ছিলেন সাহিত্যিক।
লালগোলার কুমার ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায় যখন “রাজা” উপাধি লাভ করেননি, তখন থেকেই একান্তভাবে সাহিত্যসেবা ক’রে আসছেন। এই সাহিত্যানুরাগের উৎস কোথায় তা অনুমান করা কঠিন নয়। তাঁর পিতামহ দানবীর মহারাজা রাও যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় অবাঙালী হয়েও বাংলাদেশে এসে মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যে বাংলা সাহিত্যের কত বড় বন্ধু ছিলেন, সে কথা এখানে নতুন ক’রে বলবার দরকার নেই। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে তাঁর স্মরণীয় অবদান আছে। অসংখ্য সাহিত্যিক অলঙ্কৃত করতেন তাঁর আসর। এমন কি সাহিত্যগুরু বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত কিছুদিনের জন্যে তাঁর আতিথ্য স্বীকার ক’রে রাজবাড়ীতে বসে রচনা করেছিলেন “আনন্দমঠে”র কিয়দংশ। এই পরিবেশের মধ্যে সুকুমার বয়স থেকে মানুষ হয়ে ধীরেন্দ্রনারায়ণেরও চিত্তে উপ্ত হয়েছিল সাহিত্যের বীজ।
তারপর তিনি দীর্ঘকালব্যাপী ছাত্রজীবন যাপন করেন আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অধীনে এবং তাঁর কাছেই ধীরেন্দ্রনারায়ণের সাহিত্যশিক্ষা আরম্ভ হয়। এমন অসাধারণ সাহিত্যবীরকে উপদেশকরূপে লাভ ক’রেই তিনি বঙ্গবাণীর পরম ভক্ত না হয়ে পারেননি। রামেন্দ্রসুন্দর ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পরস্পরের অনুরাগী এবং দুজনেই আনাগোনা করতেন দুজনের আলয়ে। সেই সময়ে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন কিশোর ধীরেন্দ্রনারায়ণ এবং দুই সাহিত্যশিল্পীর কলালাপের ফাঁকে ফাঁকে আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। তাঁর তরুণ কণ্ঠে স্বরচিত কবিতার আবৃত্তি শুনে রবীন্দ্রনাথ আনন্দপ্রকাশ করতেন।
সুতরাং বোঝা যায়, সাময়িক খেয়াল চরিতার্থ করবার জন্যে তিনি হঠাৎ সাহিত্যিক হয়ে ওঠেননি। সাহিত্য তাঁর আবাল্য সাধনার বস্তু। দীর্ঘকাল ধ’রে তিনি লেখনী চালনা ক’’রে আসছেন। গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, কবিতা ও সঙ্গীত রচনা করেছেন। একদিন বাড়ীতে ফিরে এসে দেখি, আমার লেখবার টেবিলের উপরে পড়ে রয়েছে একটি হস্তলিখিত কবিতা। পাঠ করে বুঝলুম, ধীরেন্দ্রনারায়ণ এসেছিলেন, কিন্তু আমার দেখা না পেয়ে সেইখানেই ব’সে কবিতাটি রচনা ক’রে রেখে গিয়েছেন। কিছুকাল আগে তিনি “নীল সাড়ী” নামে একখানি স্বরচিত নাটকও পাঠ ক’রে শুনিয়ে গিয়েছেন। নাটকখানি আমার ভালো লেগেছিল। তাঁর দুইখানি উপন্যাসের নাট্যরূপ রঙ্গমঞ্চের উপরে প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এই মৌলিক নাটকখানি এখনো পাদপ্রদীপের সামনে স্থাপিত হয়নি।
নাট্যজগতের দিকেও তাঁর আকর্ষণ খুব প্রবল। শুনেছি লালগোলায় তিনি বড় বড় ভূমিকায় সৌখীন অভিনেতারূপে দেখা দিয়েছেন। তাঁর কোন অভিনয় দেখবার সুযোগ আমার হয়নি বটে, কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন রঙ্গালয়ের প্রেক্ষাগৃহে নাট্যরসিক দর্শকরূপে তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখেছি।
ষ্টার থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ঊনত্রিশ-ত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। লক্ষ্য করলুম, একটি সুন্দর্শন, দীর্ঘদেহ যবক দূর থেকে ঘন ঘন আমার দিকে তাকিয়ে দেখছেন। তারপর তিনি নিজেই আমার কাছে এসে আলাপ করলেন। পরিচয় পেয়ে জানলুম, তিনি হচ্ছেন লালগোলার কুমার ধীরেন্দ্রনারায়ণ। বললেন, “আমি আপনার পরম ভক্ত।” কি গুণে আমি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলুম জানি না, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে উঠল অত্যন্ত নিবিড়। লালগোলা থেকে কলকাতায় এলেই তিনি আমার বাড়ীতে ছুটে আসতেন। দীর্ঘকাল ধ’রে গল্পসল্প চলত—আজও চলে। আমি আজকাল বাড়ীর বাইরে পারতপক্ষে পা বাড়াই না, কিন্তু তিনি আমার বাড়ীতে এসে উপস্থিত হন যখন তখন এবং অভিযোগ করেন, কেন আমি তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি না?
একদিন সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে তিনি বেড়াতে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে পড়লেন। তারপর দুইজনে গাড়ী থেকে নেমে গিয়ে বসলুম গড়ের মাঠের এক বেঞ্চের উপরে। আমি টানতে লাগলুম সিগারেট, তাঁর জন্যে অনুচর নিয়ে এল আলবোলা।
ধীরেন্দ্রনারায়ণ বললেন, “উঁহ,, খালি ধোঁয়া খেয়ে তো পেট ভরে না দাদা! আপনাকে কিছু নিরেট খাবার খেতে হবে।”
আমি বললুম, “এই গঙ্গার ধারে খাবার কোথায় পাবেন?”
“আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনি আসছি” —ব’লেই তিনি আবার গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। তারপর নিজে চাঙ্গুয়া হোটেলে গিয়ে খাবার কিনে আবার হাসতে হাসতে ফিরে এলেন। সঙ্গে অনুচর ছিল, গাড়ীর চালক ছিল, কিন্তু তবু তিনি খাবার কেনবারভার দিলেন না তাদের হাতে। স্বহস্তে খাবার না কিনে এনে তাঁর তৃপ্তি হ’ল না।
তাঁর বন্ধুপ্রীতি ও আন্তরিকতার আরো কত প্রমাণই যে পেয়েছি! আমার সহধর্মিণী যখন পরলোকে গমন করেন, তখন তিনি শিলং-এ গিয়েছিলেন বায়ু পরিবর্তনের জন্যে। কিন্তু খবর পেয়েই তিনি কলকাতায় ফিরে এসে আমার সঙ্গে দেখা ক’রে করুণ স্বরে বললেন, “দাদা, আপনার এই সর্বনাশের কথা শুনে না এসে থাকতে পারলুম না।”
নানা ব্যসনের জন্যে ধনিকদের নাম হয় কুবিখ্যাত। ধীরেন্দ্রনারায়ণেরও যদি কোন ব্যসন থাকে এবং যদি তাকে ব্যসন বলা যায়, তবে তা হচ্ছে, সাহিত্য ও শিল্প। সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সাহচর্য লাভ করবার জন্যে সর্বদাই তিনি প্রভূত আগ্রহ প্রকাশ ক’রে থাকেন। এবং তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করেন সমকক্ষ, নিরভিমান, অমায়িক সুহৃদের মতই। ভালোবাসা তাঁর সোদরপ্রতিম। কেবল ভালোবাসা নয়, দুঃস্থ সাহিত্যিকদের অভাব-অভিযোগের কথা শুনলে তৎক্ষণাৎ তিনি হন মক্তহস্ত। কত সাহিত্যিককে তিনি যে গোপনে অর্থসাহায্য করেছেন, এ কথা বাইরে কোন দিন প্রকাশ পায়নি। জমিদারী প্রথা তুলে দেওয়া হ’ল। এ প্রথা ভালো কি মন্দ, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। কিন্তু এ প্রথা উঠে গেলে দেশে আর কেউ কাশিমবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র ও লালগোলার যোগীন্দ্রনারায়ণের মত দান-শৌণ্ড মহারাজার নাম শুনতে পাবে না। মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ গোপনে যে বিপুল অর্থদান ক’রে গিয়েছেন, কাকপক্ষীকেও তা টের পেতে দেননি। কিন্তু তাঁর যে অন্যান্য দানের হিসাব পাওয়া যায়, তার পরিমাণ হবে প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা!
এমন মহাদাতার পৌত্র হয়ে ধীরেন্দ্রনারায়ণও যে বংশের ধারা বজায় রাখবার চেষ্টা করবেন, সে কথা অনায়াসেই অনুমান করা যায়। সাধারণ সৎকার্যে অকাতরে অর্থব্যয় করবার জন্যে সর্বদাই তিনি প্রস্তুত। বীরভূম জেলার কলেশ্বর নামক স্থানে পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রকাণ্ড এক শিবমন্দির নির্মাণ ক’রে তিনি নিজের ধর্মপ্রাণতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের 'বয়েজ স্কাউট’দের জন্যেও দান করেছেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাঁর সমগ্র দানের পরিমাণ আমার জানা নেই বটে, তবে এ কথা আমি জানি যে, বহু আশ্রম, বহু প্রতিষ্ঠান ও বহু অভাবগ্রস্ত পরিবারকে দরাজ হাতে সাহায্য করতে কুণ্ঠিত হননি। আজ তাঁর জমিদারীর অধিকাংশ হয়েছে পাকিস্তানের কুক্ষিগত, কিন্তু এখনো হ’তে পারেননি তিনি হাতভারী।
মনের জোরও তাঁর কম নয়। ইংরেজ আমলে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিলে উপাধিধারী পরিবারভুক্ত ব্যক্তিগণকে যথেষ্ট বিপন্ন হ’তে হ’ত। তিনি কিন্তু নির্ভয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। লবণ আইন সংক্রান্ত সত্যাগ্রহের সময়ে স্বয়ং অগ্রণী হয়ে সর্বপ্রথমে নিষিদ্ধ লবণ ক্রয় করতে বিরত হননি। এজন্যে সরকারপক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছিল স্বর্গীয় মহারাজের কাছে। এমন কি তাঁর বন্দুকের লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল ক’রে দেবার প্রস্তাব হয়েছিল। তিনি কিন্তু ভয় পাননি। বহরমপুরের জেলখানায় গিয়ে রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতেন। প্রহরীদের উৎকোচে বশীভূত ক’রে আড়ালে সরিয়ে দিয়ে বন্দীদের মধ্যে করতেন অর্থবিতরণ।
একবার “মিলনী” সমিতি ষ্টিমার-পার্টির আয়োজন করে, ধীরেন্দ্রনারায়ণ তখনও রাজা উপাধি পাননি। রবীন্দ্রনাথকে আসবার জন্যে আমন্ত্রণ করা হয়, তিনি কিন্তু অনিচ্ছক। তখন ধীরেন্দ্রনারায়ণ তাঁকে ধ’রে আনতে গেলেন এবং তিনিও হাসিমুখে ধরা দিতে আপত্তি করলেন না। বালক ধীরেন্দ্রনারায়ণ তাঁর কাছ থেকে আদর পেয়েছেন এবং শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ও লালগোলার মহারাজের কাছে ঋণী। এ দানের কথা বাইরের কেউ জানত না, প্রকাশ পেয়েছে কেবল রবীন্দ্রনাথেরই এক পত্রে: “লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুরের বদান্যতায় আমাদের বিদ্যালয় রক্ষা পাইয়াছে।” কাজেই ধীরেন্দ্রনারায়ণের হস্তে আত্মসমর্পণ ক’রে রবীন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত হলেন ষ্টিমার-পার্টিতে।
ধীরেন্দ্রনারায়ণ বললেন, “আপনার স্পর্শ পেয়ে আমাদের তরী আজ সোনার তরী হয়ে উঠেছে।”
রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, “তুমি সুন্দর কথা বলেছ।”
সেখানে হাজির ছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রও। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁরও ফোটো তোলা হ'ল।
শরৎচন্দ্র খুসি হয়ে ধীরেন্দ্রনারায়ণকে বলেছিলেন, “কুমার, আপনার কাছে আমি ঋণী। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল রবীন্দ্রনাথের পাশে ব’সে ফোটো তুলি। আপনারই জন্যে আমার সে ইচ্ছা এতদিনে পূর্ণ হ'ল।”
একবার মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলুম বাংলার হতভাগ্য নবাব সিরাজদৌলার সমাধি দেখবার জন্যে। সেখান থেকে লালগোলা খুব কাছে। ধীরেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে গেলুম।
তখন প্রায় দুপুর বেলা। প্রাসাদের ফটক পেরিয়ে সুদীর্ঘ চবুতর অতিক্রম ক’রে গাড়ী-বারান্দার কাছে এসে দেখি, হাঁটুর উপরে তোলা একখানা ময়লা কাপড় প’রে ধীরেন্দ্রনারায়ণ আদুড় গায়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ভৃত্য তাঁর সর্বাঙ্গে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। প্রথমটা এমন অবাক হয়ে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না-যেন পর্বত এসে উপস্থিত হয়েছে মহম্মদের কাছে।
তারপর আমার রচিত একটি গানের পংক্তি উদ্ধার ক’রে ব’লে উঠলেন, “নয়ন য’দিন রইবে বেঁচে তোমার পানেই চাইব গো!” এবং বিপুল আনন্দে সেই এক-গা তেল মাখা অবস্থাতেই দীর্ঘ দুই বাহু বিস্তার ক’রে আমাকে আলিঙ্গন করবার জন্যে ছুটে এলেন। বহ কষ্টে তাঁর সেদিনকার ভালোবাসার অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলুম। তারপর সে কি যত্নাদর, যার তুলনা হয় না। আধ ঘণ্টা পরেই এল এতরকম খাবার যে, আসনে ব’সে হাত বাড়িয়ে সব পাত্রের নাগাল পাওয়া যায় না।
বৈকালের পরে আমাকে তিনি টেনে নিয়ে গেলেন পাখী শিকার করবার—অর্থাৎ দেখবার জন্যে। তরুশ্যামল লালগোলার উপকণ্ঠ। তৃণহরিৎ প্রান্তর। এখানে ওখানে থই থই করছে জল। সূর্য অস্তাচলে। সন্ধ্যা আসন্ন। শুনেছি 'স্নাইপ' বা কাদাখোঁচা পাখী শিকার করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু সেই প্রায়ান্ধকারেই ধীরেন্দ্রনারায়ণ উপরি-উপরি বন্দক ছুঁড়ে স্নাইপদের মাটির উপরে পেড়ে ফেললেন, একবারও তাঁর লক্ষ্য ব্যর্থ হ’ল না।
ধীরেন্দ্রনারায়ণের বন্ধত্বলাভ, আমার জীবনের একটি স্মরণীয় আনন্দ।