এখন যাঁদের দেখছি/ইনি, উনি, তিনি
বত্রিশ
ইনি, উনি, তিনি
আমার যখন বাল্যকাল, তখন স্বর্গীয় গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের পুস্তকালয় ছিল বর্তমান বাড়ী ছাড়িয়ে একটু উত্তর দিকে। তখনও সাহিত্যিক হইনি, কিন্তু মনের মধ্যে সাহিত্যমদিরা পানের ইচ্ছা ছিল যথেষ্ট প্রবল। কেতাব কেনবার জন্যে প্রায়ই যেতুম ওখানে। তার নাম ছিল তখন বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী। এটি অপনাম। নাটক, নভেল ও কবিতা প্রভৃতি যেখানে প্রধান বিক্রয়, সেখানে “মেডিক্যাল” শব্দটির আবির্ভাব কেন, এমন প্রশ্ন জাগতে পারে অনেকেরই মনে। শুনেছি, গুরুদাসবাবু বইয়ের ব্যবসা সুরু করেন প্রথমে ডাক্তারী কেতাব নিয়েই। তারপর ব্যবসায়ের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সাহিত্য সম্পর্কীয় গ্রন্থমালাই প্রাধান্য লাভ করে এবং পুস্তকালয়ের নামও পরিবর্তিত হয়। কিন্তু লোকে সংক্ষেপে তার নাম রেখেছিল “গুরুদাস লাইব্রেরী”।
ওখানকার বর্তমান অন্যতম স্বত্বাধিকারী শ্রীহরিদাস চট্টোপাধ্যায়কে সর্বদাই দেখতুম ছেলেবেলায় বই কিনতে গিয়ে। কাঁচা বয়সেই বইয়ের ব্যবসায়ে তিনি পিতাকে সাহায্য করতেন। পরে যে আমি হব গ্রন্থকার এবং তিনি হবেন আমার অন্যতম প্রকাশক, তখন এটা ছিল আমার স্বপ্নের অগোচর। তাঁর আগেকার চেহারা আমার বেশ মনে পড়ে। আজ তিনি প্রাচীন, কিন্তু এখনো তাঁর মধ্যে সেই নবীন বয়সের আদল খুঁজে পাওয়া যায়, সাধারণতঃ যা দেখা যায় না।
অর্ধ শতাব্দী আগে কলকাতার বড় বড় রাজপথে—এমন কি অলিগলিতেও আজকের মত বইয়ের দোকানের ছড়াছড়ি ছিল না। সাহিত্য সম্পর্কীয় কেতাবের দরকার হ’লে সবাই আগে যেত গুরুদাস লাইব্রেরীতে এবং আগেকার প্রত্যেক প্রখ্যাত লেখকেরই পুস্তক প্রকাশিত বা বিক্রীত হ’ত ঐখান থেকেই। সেই সূত্রে ওখানে আনাগোনা করতেন সেকালকার নামকরা বড় বড় সাহিত্যিকরা। রোদ প’ড়ে এলে গুরুদাসবাবু পুস্তকালয়ের বাইরে আসতেন। ফুটপাথের উপরে পাতা থাকত একখানি বেঞ্চি। তারই উপরে আসীন হয়ে তিনি আলাপ করতেন সমাগত সাহিত্যিকদের সঙ্গে। গুরুদাসবাবু যখন বৃদ্ধ ও দৃষ্টিশক্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তখনও তিনি ছাড়তে পারেননি এই পূর্ব-অভ্যাসটি। বড় বড় সাহিত্যিকদের সঙ্গে চোখের দেখা হবে, এই লোভে বালক ও কিশোর বয়সে প্রায়ই আমি গুরুদাস লাইব্রেরীর সামনে দিয়ে আনাগোনা করতুম। তখন সাহিত্যিকদের ভাবতুম, ভিন্ন জগতের বিস্ময়কর মানুষ। এখন মনের মধ্যে এমন মহাপুরুষার্চনের ভাব জাগ্রত হয় কদাচ। এখন জেনেছি, অধিকাংশ তথাকথিত সাহিত্যিকই হচ্ছেন রাম-শ্যামের মতই সাধারণ মানুষ। উপরন্তু কোন কোন নামজাদা সাহিত্যিকের চেয়ে অনামা রাম-শ্যামের সঙ্গ অধিকতর প্রীতিপ্রদ ও নিরাপদ।
পরে গুরুদাস লাইব্রেরীর মত এম. সি. সরকারের পুস্তকালয়ও পরিণত হয়েছিল সাহিত্যিকদের মিলন-ক্ষেত্রে। কেবল “ভারতী”র দলের নয়, “কল্লোলে"র দলের সাহিত্যিকরাও সেখানে এসে আসর জমিয়ে তুলতেন। নজরুল, অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব ও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ প্রভৃতির সঙ্গে তো আগেই পরিচিত হয়েছিলুম, ওঁদের অন্যান্য সহযাত্রীর মধ্যে জসীমউদ্দীন, হুমায়ূন কবীর, অজিত দত্ত, ভূপতি চৌধুরী ও হেমচন্দ্র বাগচীর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় এম. সি. সরকারের পুস্তকালয়েই। কেবল “ভারতী”র ও “কল্লোলে”র দলের নয়, অন্যান্য বহু বিখ্যাত ব্যক্তিও ওখানে আনাগোনা করতেন বা এখনো করেন—যেমন স্বর্গীয় ডক্টর সতীশচন্দ্র বাগচী, স্যর যদুনাথ সরকার, শ্রীরাজশেখর বসু ও শ্রীশিশিরকুমার ভাদুড়ী প্রভৃতি। এ জায়গাটি ছিল প্রবীণ ও নবীনদের কলাকেলির আসর।
“কল্লোলে”র আর একজন নিয়মিত লেখক হচ্ছেন শ্রীসুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মাতুল এবং সাহিত্যশিষ্য। শরৎচন্দ্রের লেখা গল্প “মন্দির” প্রকাশিত হয় ১৩০৯ সালের “কুন্তলীন পুরস্কার” নামক বার্ষিক গ্রন্থে। কিন্তু গল্পটি তিনি চালিয়ে দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথেরই নামে। তিনি কলকাতার লোক নন, তবে এখানে এলেই আমরা তাঁর দেখা পেতুম। “ভারতী”র বৈঠকে এসে আলাপ-আলোচনা করতেন। মিতভাষী, কিন্তু গম্ভীর ছোটখাটো সৌম্যদর্শন মানুষটি। তাঁকে আমরা নিজেদের গোষ্ঠীর ভিতরেই টেনে নিয়েছিলুম। আমরা বারোজন মিলে রচনা করেছিলুম “বারোয়ারি উপন্যাস”—তার লেখকদের নাম হচ্ছে প্রমথ চৌধুরী (বীরবল), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও হেমেন্দ্রকুমার রায়। “ভারতী”তেই এই শ্রেণীর আয়োজন করেন প্রথমে সরলা দেবী, তারপর মণিলাল। “বারোয়ারি উপন্যাসে”র শেষাংশের ভার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ “মধুরেণ সমাপয়েৎ” করবেন ব’লে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যখন তাঁর পালা এল তখন তিনি য়ুরোপে। কাজেই শেষরক্ষা করবার ভার নেন প্রমথ চৌধুরী।
বয়সে নবীন “কল্লোলে”র লেখকদের দলে ভিড়ে বয়সে প্রবীণ সুরেন্দ্রনাথ কিছুমাত্র অসুবিধা বোধ করেন নি, এটা তাঁর মানসিক তারুণ্যেরই পরিচয় দেয়। “কল্লোলে” তিনি ধারাবাহিকভাবে শরৎচন্দ্রের জীবনকথা লিখেছিলেন, মাসিকপত্রে শরৎচন্দ্রের জীবন নিয়ে আলোচনা সেই বোধ করি প্রথম। তারপর “ভারতবর্ষে”ও শরৎচন্দ্রের প্রসঙ্গ নিয়ে লেখনী চালনা করেন। তিনি একজন শক্তিশালী লেখক। উপন্যাসে ও ছোটগল্পে রীতিমত দক্ষতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একনাগাড়ে সাহিত্যশ্রম বোধ হয় তাঁর কাছে রুচিকর নয়। মাঝে মাঝে বেশ কিছু কাল ধ’রে কলম ছেড়ে তিনি সকলের চোখের আড়ালে ব’সে থাকতে ভালোবাসেন। ফলে গভীর রেখাপাত হয় না জনসাধারণের চলচিত্তে।
এম. সি. সরকারের পুস্তকালয়ে আরো দুজন আধুনিক সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যাঁরা রচনায় বিশেষ গুণপণা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গিয়েছেন। এঁদের একজন হচ্ছেন সদালাপী প্রসন্নমুখ শ্রীমণীন্দ্রলাল বসু। “প্রবাসী”তে প্রকাশিত তাঁর “রমলা” উপন্যাস সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাঁর অন্যান্য রচনাও আছে। আর একজন হচ্ছেন শ্রীভূপতি চৌধুরী। “কল্লোল” দলভুক্ত গল্পলেখক। লেখক হিসাবে এঁরা দুইজনেই সাহিত্যক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু মণীন্দ্রলাল ব্যারিষ্টার এবং ভূপতি বাস্তুকার হয়ে এখন লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে অল্পবিস্তর হস্তগত করবার জন্যে এতই ব্যস্ত হয়ে আছেন যে, সরস্বতীর মুখ দেখবার ফুরসত পান না। এবং এই দলের লোক ব’লেই গণ্য করতে পারি হুমায়ূন কবীর ও শ্রীমণীশ ঘটককেও। তাঁদেরও বোধ হয় আর বাংলা সাহিত্যের স্বপ্ন দেখবার অবসর নেই।
সব বীজে চারা জন্মায় না। কিন্তু চারা দেখা দিয়ে বড় হয়ে দু-একবার রঙিন ফুল ফুটিয়ে যদি ফুল ফুটানোর পালা অসময়েই সাঙ্গ ক’রে দেয়, তাহলে মনে থাকে না আক্ষেপের অবধি। পুষ্পিত হ’তে পারি, কিন্তু পুষ্পিত হব না। শক্তি আছে, কিন্তু শক্তিকে রাখব শ্রমবিমুখ ক’রে। এই রীতি অনুসারে চললে শিল্পী কেবল নিজের উপরে নয়, অবিচার করেন শিল্পের উপরেও।
বাংলা সাহিত্যে এই শ্রেণীর দুর্ঘটনা আরো দুইবার ঘটতে ঘটতে ঘটেনি। প্রমথ চৌধুরী জীবনের পূর্বার্ধে “বীরবল” নামের আড়ালে থেকে কালেভদ্রে দুই একটি প্রবন্ধ রচনা করতেন কথ্য ভাষায়। একে তো সেকালকার অতিশয় সাধু সাহিত্যিকরা কথ্যভাষাকে সুপথ্য ব’লে বিবেচনা করতেন না, তার উপরে ন-মাসে ছ-মাসে প্রকাশিত সেই রচনাগুলির ভিতরে প্রভূত মুনসীয়ানা থাকলেও সেগুলিকে মনে করা হ’ত চুটকি জিনিস বা ফালতো মাল। বীরবল যদি লেখাচ্ছলে কালি ছড়িয়ে সেই পর্যন্ত এগিয়েই থেমে যেতেন তাহলে স্থায়ী সাহিত্যের মজলিসে কল্কে পেতেন না নিশ্চয়ই।
সৌভাগ্যক্রমে স্বর্গীয় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় হঠাৎ তাঁর স্কন্ধে চাপিয়ে দিলেন “সবুজ পত্রে”র ভার। সবুজের সংস্পর্শে এসে প্রৌঢ় প্রমথ চৌধুরীরও চিত্ত হয়ে উঠল শ্যামল। মেতে উঠলেন তিনি এক নূতন অনুপ্রাণনায়, ভূরি পরিমাণ রচনায় রচনায় ছেয়ে দিলেন “সবুজ পত্র”কে। কথ্যভাষার আসন প্রতিষ্ঠিত করলেন বাংলা সাহিত্যের দরবারে, এমন কি নিজের পক্ষে টেনে আনলেন রবীন্দ্রনাথকেও এবং তিনিও অবলম্বন করলেন কথ্যভাষা। সবাই পেলে প্রমথ চৌধুরীর সম্যক পরিচয়। জানলে তিনি কেবল উচ্চশ্রেণীর শিল্পী ও প্রথম শ্রেণীর প্রবন্ধকার নন, সেই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ কবি ও গল্পলেখকও।
শরৎচন্দ্র সতেরো বৎসর বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করেন। গল্পের পর গল্প, উপন্যাসের পর উপন্যাস লিখে যান। তাঁর ‘বড়দিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’ ও ‘দেবদাস’ প্রভৃতি সেই প্রথম যুগেরই রচনা। সে সব রচনা তখনকার মত পাণ্ডুলিপির আকারেই অপ্রকাশিত থাকে। তারপর লেখার পাট তুলে দিয়ে তিনি রেঙ্গুণে গিয়ে করেন কেরাণীগিরি। প্রায় এক যুগ পর্যন্ত কেটে যায়। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অখ্যাত ও অনাদৃত হয়ে তিনি হয়তো কেরাণীগিরি করেই কাটিয়ে দিতেন। পরে তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা অপ্রকাশিত ও অপেক্ষাকৃত কাঁচা রচনাগুলি ছাপিয়ে দিলেও শরৎচন্দ্রের নাম এমন অনন্যসাধারণ হ’তে পারত না।
কিন্তু তা হবার নয়। বন্ধুবান্ধবের বিশেষ পীড়াপীড়িতে এবং “যমুনা” সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পালের নির্বন্ধাতিশয়ে শরৎচন্দ্র আবার এক যুগ পরে লেখনী ধারণ করতে বাধ্য হলেন। সঙ্গে সঙ্গে সার্থক হয়ে উঠল তাঁর পুনরাগমন, তাঁর রচনাগুলি কাজ করলে মন্ত্রশক্তির মত, দিকে দিকে শোনা গেল বহু কণ্ঠের অভিনন্দন। তখন নতুন প্রেরণা লাভ ক’রে মাছি মারা কেরাণী আবার এসে বসলেন রূপেস্রষ্টা শিল্পীর আসনে। বাংলা সাহিত্য বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পরে আবার লাভ করলে একজন প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিককে। প্রমথ চৌধুরী ও শরৎচন্দ্রের মন ফিরেছে দৈব ঘটনার জন্যে। তা না হ’লে কত মহান দান থেকে বঞ্চিত হ’ত বাংলা সাহিত্য।
“কল্লোলে”র আর এক আড্ডাধারী হচ্ছেন শ্রীপবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। সাহিত্যক্ষেত্রে বিচরণ করছেন বহুকাল, “কল্লোল” সম্পাদক ছাড়া দলের আর সকলের চেয়ে বয়সেও বড়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে এবং নানা সাহিত্য-বৈঠকে আনাগোনা ক’রে তিনি বাংলা দেশের অধিকাংশ প্রখ্যাত সাহিত্যিকের সঙ্গে স্থাপন করেছেন বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাঁর রচনাশক্তিও আছে, কিন্তু অনুবাদের দিকেই ঝোঁক বেশী। তিনি অনেকগুলি বিদেশী বই তর্জমা করেছেন।
কবি জসীমউদ্দীনের চেহারাখানিও মেঠো এবং সাধারণতঃ রচনাও করেন মেঠো কবিতা। তাঁর এক একটি কবিতা নগরের ইষ্টককোটরে বহন ক’রে আনে গ্রাম্য মাটির সোঁদা গন্ধ। নিজের জন্যে তিনি বেছে নিয়েছেন বিশিষ্ট একটি পথ—তার উপরে আছে মুক্ত নীলিমার আশীর্বাদ এবং ছায়াতরুর স্নিগ্ধ প্রসাদ; তার দুই পাশে আছে দিগন্তে বিলীন তেপান্তর ধানের ক্ষেতের হরিৎ ফসল, আকাশ-নীল সরোবর। সহর পালানো মন পায় ছুটির আমোদ।
“কল্লোলে”র অধিকাংশ লেখক উপন্যাস, গল্প ও কবিতা রচনার দিকে যতটা দৃষ্টি দিয়েছেন, প্রবন্ধ রচনা ও সমালোচনার দিকে ততটা দেন নি। কেবল গল্প ও পদ্য নিয়ে কোন সাহিত্যই পরিপূর্ণতার দাবি করতে পারে না। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধকাররূপেও প্রচুর খ্যাতিলাভ করেছেন।
“কল্লোল” গোষ্ঠীর ভিতরে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের বেলায় এর ব্যতিক্রম দেখি। প্রবন্ধের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ এবং তাঁর অনেক প্রবন্ধই গল্পের মত চিত্তহারী ও কবিতার মত উপভোগ্য। ঐ দলের আর একজন লেখক হচ্ছেন শ্রীঅজিত দত্ত। অদ্যাবধি তাঁর সাহিত্যসেবা অব্যাহত আছে। কিছু লাজুক, শান্তশিষ্ট, সুদর্শন চেহারা। বুদ্ধদেবের বাল্যবন্ধু, অল্পবয়স থেকে একসঙ্গে সাহিত্যচর্চা সুরু করেন তাঁরা দুজনেই। অজিত একাধারে কবি ও প্রবন্ধকার। কিছুদিন আগে “রৈবত” ছদ্মনামে তাঁর রচিত একখানি বই পড়েছি, তার নাম “মনপবনের নাও”। প্রধানতঃ সাহিত্য ও চারুকলা নিয়ে সাতাশটি নিবন্ধের সমষ্টি। দৃষ্টি তাঁর রসিক সমালোচকের। তাঁর সব মতই যে সকলের মনের মতন হবে, এমন আশা কেউ করে না। কিন্তু তিনি যা কিছু দেখেছেন, যা কিছু, বলেছেন, মুক্ত দৃষ্টি আর মুক্ত মন নিয়েই দেখেছেন এবং বলেছেন। তাঁর ভাষার ও বক্তব্যের দুই টুকরো নমুনা দিঃ
(১) “তথাকথিত মাইনের লেখকেরা প্রত্যেক দেশের কাব্যসাহিত্যের একটা বিশিষ্ট অংশের রচয়িতা। অন্যান্য সাহিত্যের মত বাঙলা সাহিত্যের একটা উৎকৃষ্ট ও বৃহৎ অংশ যে অজ্ঞাতনামা লেখকদের লেখা একথা কে না জানে? লোকসাহিত্য এবং পদাবলী সাহিত্যের অজ্ঞাত ও প্রচ্ছন্ননামা লেখক তো অসংখ্য। এখানে নামজাদা বা মেজর-মাইনরের প্রশ্ন ওঠে না। ভালো-মন্দ লেখার প্রশ্নই সর্বপ্রধান।”
(২) “কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের বিশেষ ক’রে নির্জনতা খুঁজে বেড়াতে হয় চোখের দেখা মানুষগুলোকে মনের দেখা দেখবার জন্য। সেই দেখা না দেখলে তাদের নিয়ে সৃষ্টি হয় না, আঁকা যায় না তাদের স্পষ্ট ক’রে.........বাইরের দেখা, বাইরের শোনা, বাইরের পাওয়া না ফুরোলে মনের দেখা মনের শোনা মনের পাওয়া সুরু হয় না।”