এখন যাঁদের দেখছি/ঘরোয়া বৈঠকের শিল্পিগণ

ঊনচল্লিশ

ঘরোয়া বৈঠকের শিল্পিগণ

 এই প্রবন্ধমালায় মাঝে মাঝে এমন কারুর কারুর কথাও কিছু কিছ বলতে হচ্ছে, যাঁরা আর ইহলোকে বাস করেন না। কিন্তু এত অল্পদিন আগেই তাঁরা দেহত্যাগ করেছেন যে, মন যেন তাঁদের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করতে রাজি হয় না। কোন মানুষই এই মানসিক দূর্বলতাকে পরিহার করতে পারে না। প্রিয়জনের মৃত্যুর পরেও কিছুদিন ধ’রে মনে হয়, যেন তাঁরা আমাদের সামনে না থাকলেও কাছাকাছি কোথাও বিদ্যমান আছেন, হয়তো এখনি তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হ’তে পারে। এমন সন্দেহ যক্তিহীন হ’লেও স্বাভাবিক। এবং তা গভীর শোকের মধ্যেও করে কতকটা সান্ত্বনার সঞ্চার।

 কিছুদিন আগে সুরসাগর হিমাংশু দত্তের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছি, কিন্তু এখনো মনে হয় না তিনি পৃথিবী থেকে মহাপ্রস্থান করেছেন। চোখের সামনে না থাকলেও যেন তিনি শহরেরই কোন একান্তে ব’সে এখনো নূতন নূতন গানে করছেন নূতন নূতন সুরসংযোগ।

 আকারে ছোটখাটো, শান্তশিষ্ট, মৃদুভাষী, সুদর্শন মানষটি! তরুণ বয়সেই প্রবীণ শিল্পীর মত সুরসৃষ্টি করবার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তাঁকে মনে হ’লেই আমার স্মরণ হয় রাজা স্যর সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের দৌহিত্র, সঙ্গীতকলাবিশারদ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের কথা। যৌবনসীমা পার হ’তে না হ’তেই তিনিও ধরাধাম ত্যাগ করেছেন, জনসাধারণের কাছে সুপরিচিত হবার আগেই। তবে বাংলা রঙ্গালয়ে যারা “মুক্তার মুক্তি”, “বসন্তলীলা” ও “সীতা” প্রভৃতি নাটক-নাটিকার গান শুনেছেন, তাঁরা সুরকার গুরুদাসের কিছু কিছু পরিচয় পেয়েছেন।  আমার রচিত উপন্যাসকে যখন কালী ফিল্মস “তরুণী” নামক চিত্রে রূপায়িত করে, তখন তার কয়েকটি গানে সুর– সংযোজনার ভার নেন হিমাংশু দত্ত। সেই সময়ে কালী ফিল্মের স্টুডিয়োতেই হিমাংশু দত্তের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তাঁর সুর দেবার শক্তি ও শিল্পীসুলভ সংলাপ আমাকে আকৃষ্ট করে। দুদিন পরেই বুঝতে পারলুম দেশী গান সম্বন্ধে সুপণ্ডিত হয়েও তিনি গোঁড়া ওস্তাদদের মত ছুতমার্গের ধার ধারতেন না, স্বীকার করতেন আধুনিক যুগধর্ম। দরকার হ’লে উচ্চশ্রেণীর কলাবিদের মত পাশ্চাত্য সঙ্গীতের কোন কোন বিশেষত্বকে একেবারে ঘরোয়া জিনিস ক’রে নিতে পারতেন। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের মত তিনিও য়ুরোপীয় সঙ্গীতে লব্ধপ্রবেশ ছিলেন কিনা বলতে পারি না, তবে বিলাতী সুরের সঙ্গে তিনি যে পরিচিত ছিলেন, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই।

 মাঝে মাঝে তিনি আমার বাড়ীতে এসেছেন এবং আমার অনুরোধে গানও গেয়েছেন কিন্তু মৃদুকণ্ঠে। আমার রচিত আর একখানি চিত্রনাট্যের (শ্রীরাধা) গানেও তিনি চমৎকার সুর দিয়েছিলেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানীর একজন স্থায়ী সুরকারের দরকার হয়, আমি কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরই নাম বলি। তাঁরা উপযুক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা ক’রে তাঁকে নিয়ে যান।

 কিছুদিন পরে হিমাংশু দত্ত এসে বললেন, “হেমেন্দ্রবাবু, আমি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ছেড়ে দিয়েছি।”

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনাও হ’ল না বুঝি?”

 তিনি বললেন, “না, তা নয়। বাংলা আর হিন্দী ছবির রাশি রাশি গানে খুব তাড়াতাড়ি সুর দেবার ভার পড়ত আমার উপরে। যেমন তেমন ভাবে তাড়াহুড়ো ক’রে সুর দিয়ে আমি আনন্দ পাই না ।কাজেই আমার পোষালো না।”

 খাঁটি শিল্পীর উক্তি—সচরাচর যা শোনা যায় না। আর্টের মস্ত শত্রু হচ্ছে, ব্যস্ততা। কিন্তু এদেশের সাধারণ রঙ্গালয়ে এবং চলচ্চিত্রশালায় ও-যুক্তি খাটে না। মার্কামারা পেশাদার না হ’লে কোন শিল্পীই সেখানে তিষ্ঠোতে পারে না। দরকার হ’লে সেখানে দুই-এক-দিনের মধ্যেই তিন-চারটে নাচ বা গানের কাজ সেরে ফেলতে হয়। থিয়েটার বা সিনেমার কাজ যেমন তেমন ক’রে চ’লে যায় বটে, কিন্তু শিল্পী বোঝেন তাঁর কাজ হ’ল নিম্নশ্রেণীর। পেশার খাতিরে পেটের দায়ে সাধারণ শিল্পীরা এ বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না, কিন্তু হিমাংশু দত্ত ছিলেন অসাধারণ শিল্পী।

 নজরুল ইসলামের বেলায় দেখেছি এর ব্যত্যয়। তিনি যে অসাধারণ শিল্পী সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু তাঁর মনে গানের কথার সঙ্গে সুর আসত জোয়ারের মত। কতদিন দেখেছি, রীতিমত জনতা ও হরেক রকম বেসুরো গোলমালের মধ্যে অম্লানবদনে ব’সে তিনি রচনা ক’রে যাচ্ছেন গানের পর গান। দেখে অবাক্ হতুম, কারণ আমি নিজে তা পারি না। নির্জন জায়গা না পেলে আমার কলমই সরে না।

 আর কেবলই কি গান? সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত অনায়াসে সুর রচনা করতেন নজরুল। প্রথম প্রথম মনে করতুম, চলতি সব বাঁধা সুরের সঙ্গেই তিনি নিজের গানের কথাগুলি গেঁথে নিতেন। এমন বিশ্বাসের কারণও ছিল।

 একদিন মেগাফোন রেকর্ডের কার্যালয়ে ব’সে আছি, একজন তরুণী মুসলমান গায়িকার কণ্ঠ–পরীক্ষা হচ্ছে। তিনি একটি উর্দু গান গাইলেন,শুনে সচকিত হয়ে উঠলুম। সে গানের সরের সঙ্গে নজরুলের “মোর ঘুমঘোরে এলে প্রিয়তম” নামে বিখ্যাত গানটির সুর অবিকল মিলে গেল। জিজ্ঞাসা করে জানলুম, উর্দু গানটি নতন নয়। বোঝা গেল, নিজের গানের সঙ্গে নজরুল উর্দু গানটির সুর হুবহু চালিয়ে দিয়েছেন। এ কাজ তিনি কেবল একলাই করেননি, বাংলাদেশের আরো বহু বিখ্যাত গীতিকারই উর্দু বা হিন্দী গানের সুর ধার ক’রে বাংলা গান শুনিয়েছেন। এমন কি রবীন্দ্রনাথেরও প্রথম দিকের কোন কোন গানে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যেতে পারে।

 গোড়ার দিকে নজরুলও হয়তো তাই করতেন। কিন্তু তারপর নিয়মিতভাবে সঙ্গীত অনুশীলনের ফলে তাঁর কণ্ঠ হয়েছিল স্বাধীন সুরের প্রস্রবণের মত। তখন তিনি আর পরের ধনে পোদ্দারি করতেন না, নিজেই করতেন সুরসৃষ্টি। হাতে নাতে আমি তার প্রমাণ পেয়েছি। শ্রীমন্মথনাথ রায়ের 'কারাগার' নাটকের জন্যে আমি দশটি গান রচনা করেছিলাম, একটি গানে সুর দি আমি নিজেই। বাকি নয়টি গানে সুর দেবার ভার নিলেন নজরুল। যখন তিনি সুর দিতেন, আমি ব'সে থাকতুম তাঁর পাশে। নানা শ্রেণীর গান ছিল—গম্ভীর, চটুল, প্রেমের, হাসির। চাল আর ছন্দও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কোন চলতি বাঁধা সুর কিছুতেই আমার বিভিন্ন গানের কথার সঙ্গে খাপ খেত না। কিন্তু নজরুল আমার গানের কথাগুলি প'ড়ে নিয়ে প্রত্যেক গানের ভাব, চাল ও ছন্দ অনুসারে এত সহজে ঠিক লাগসৈ সুর বসিয়ে যেতে লাগলেন যে, বিস্মিত না হয়ে পারলুম না। গানের সুর শুনে অভিভূত হ'ত দর্শকরা।

“পায়ে পায়ে বাজে লোহার শিকল,
তালে তালে তার আমরা গাই—
শিকলের গান—শিকলের গান,
শিকলের গান শোনাব ভাই!”

 এই জাতীয় ভাবোদ্দীপক গানটিতে নজরুলের দেওয়া অপূর্ব সুর রঙ্গমঞ্চের উপরে যে উদ্দীপক ভাব সৃষ্টি করত, তা এখনো আমার মনে আছে। কিন্তু প্রথম কয়েক রাত্রির পরে আমার ঐ গানে ইংরেজ গভর্নমেণ্ট রাজদ্রোহের গন্ধ আবিষ্কার করেন এবং তা নিষিদ্ধ হয়।

 কাব্যকার, গীতিকার ও সুরকার নজরুল সাধারণ মানুষ হিসাবে চঞ্চলতায় ও দূরন্তপনায় ছিলেন অদ্বিতীয়! আর কোন কবিকে তাঁর মত মন খুলে হো হো ক'রে অট্টহাস্য করতে শুনিনি। প্রায় প্রৌঢ় বয়সেও তিনি ছিলেন বিষম দামাল। আমার বাড়ীতে শেষ যেদিন তাঁর গানের সভা বসে, সে দিনের কথা স্মরণ হচ্ছে। অনেক রাত্রে গান বন্ধ হ'ল। তাঁর সঙ্গে সেদিন ছিলেন আমার আর এক গায়ক বন্ধু, শ্রীজ্ঞান দত্ত (এখন তিনি দক্ষিণ ভারতে চলচ্চিত্র জগতের সুরকার)।

 নজরুল বললেন, “হেমেনদা, রাত হয়েছে, আজ এইখানেই আমার আহার আর শয়ন। জ্ঞানও থাকবে।”  এ রকম প্রস্তাব নতুন নয়। তাঁদের দু’জনের জন্যে ত্রিতলের শয়নগৃহ ছেড়ে দিয়ে আমি নেমে এলাম দোতলায়।

 গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল আচমকা। ত্রিতলে থেকে থেকে দুড়ুম দুড়ুম ক’রে শব্দ হচ্ছে আর সারা বাড়ী কেঁপে কেঁপে উঠছে।

 তাড়াতাড়ি উপরে ছুটে গিয়ে শয়নগৃহের দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে বললুম, “ওহে কাজী, কাজী! ব্যাপার কি? তোমরা দু’জনে কি মারামারি করছ?” নজরুল দরজা খুলে দিয়ে হো হো ক’রে হেসে উঠলেন।


 না, মারামারি নয়। নজরুল ও জ্ঞান কেউ কারুকে খাটে শয়ে ঘুমোতে দিতে রাজি নন। একজন খাটে উঠলেই আর একজন তাঁকে ধাক্কা মেরে ঘরের মেঝের উপরে ফেলে দেন। বেশ কিছুক্ষণ ধ’রে চলছে এই কাণ্ড।

 মার্গসঙ্গীতের অন্তর্গত হলেও টপ্পাকে বনেদী গান ব’লে মনে করা হয় না, কারণ বয়স তার বেশী নয়। কিন্তু বাংলাদেশের জনসাধারণের ধাতের সঙ্গে ধ্রুপদ ও খেয়ালের চেয়ে টপ্পা বেশী খাপ খায় ব’লে একসময়ে এখানে টম্পার চলন হয়েছিল যথেষ্ট। বাংলায় টপ্পার গান বেধে কীর্তিমান হয়েছেন অনেকেই এবং তাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু। তাঁর কোন কোন গান সুরকে ত্যাগ ক’রে কেবল কথার জন্যে সাহিত্যেও স্থায়ী আসন লাভ করেছে। নটনাট্যকার গিরিশচন্দ্র প্রমুখ লেখকরাও নিধুবাবুর প্রভাব এড়াতে পারেননি। আমাদের বাল্যকালেও নিধুবাবুর টপ্পা শুনতুম যেখানে সেখানে। কিন্তু আমাদের অতি আধুনিক কবিরা টপ্পার গান রচনা করেন না এবং অতি-আধুনিক গায়করাও বিশেষ ঝোঁক দেন না টপ্পার দিকে। আমি কিন্তু টম্পা ভালোবাসি, তাই কিছু কিছু টম্পার গান বেঁধেছি এবং সেগুলি গায়কপ্রবর শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দের কণ্ঠে আশ্রয়লাভ করেছে। টপ্পা হচ্ছে ঠুংরীর অগ্রদূত, ওর দিকে দৃষ্টি রাখা উচিত।

 অনেক দিন পরে আমাদের আসরে এসে নিধুবাবুর টপ্পা শুনিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীকালী পাঠক। আধুনিক গায়কদের মধ্যে তাঁকে টপ্পার অন্যতম প্রধান ভাণ্ডারী বলা চলে। বেশ মিষ্ট গলা তাঁর। গ্রামোফোন ও রেডিয়োর মাধ্যমে তাঁর গান সুপরিচিত হয়েছে। তাঁর জন্যেও আমি গান রচনা করেছি। সম্প্রতি এক আধুনিক যাত্রার আসরে তাঁর অন্য শ্রেণীর গানও শুনে এসেছি। গণী লোক।

 আমার বাড়ীর আসরে এসে আসীন হয়েছেন আরো অনেক সুগায়ক, সকলের পরিচয় দেবার জায়গা হবে না। শ্রীহরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর দেখা হয় না, তাঁর নামও শুনি না। মাঝে মাঝে তিনি এসে রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে যেতেন, তাঁর সুকণ্ঠে রবীন্দ্রগীতি ভালো লাগত। শ্রীবিজয়লাল মুখোপাধ্যায় এবং কে. মল্লিক গ্রামোফোনের রেকর্ডে গান গেয়ে একসময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরাও আমার আমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন। শ্রীজ্ঞান দত্ত ও শ্রীধীরেন দাস তো প্রায়ই দেখা দিতেন। উদীয়মান অবস্থায় অকালমৃত হরিপদ বসু, শ্রীতারাপদ চক্রবর্তী ও শ্রীঅনুপম ঘটকও আমার বাড়ীতে পদার্পণ করেছেন। আরো অনেকে আসতেন, কিন্তু নামের ফর্দ আর বাড়িয়ে কাজ নেই।

  আজ ভাঙা হাটে একলা ব’সে সে সব দিনের কথা স্বপ্ন ব’লে মনে হয়। এখনো মাঝে মাঝে কেউ কেউ দেখা দিয়ে যান বটে, কিন্তু ভাঙা আসর আর জমে না।

শেষ