এখন যাঁদের দেখছি/কল্লোলের দল

একত্রিশ

কল্লোলের দল

 “কল্লোল যুগ” নামে একখানি বই বেরিয়েছে, লেখক হচ্ছেন শ্রীঅচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। বইখানি ভালো লাগল। পূর্বস্মৃতির কাহিনী ভালো ক’রে গুছিয়ে বলতে পারলে বরাবরই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। মানুষ যৌবনের সীমানা পেরিয়ে যতই প্রাচীনতার দিকে অগ্রসর হয়, ততই তার মন ফিরে ফিরে আসে অতীতের দিকে। কারণ অতীতে থাকে সুখের শৈশব, উৎসবমুখর যৌবন। এমন কি অতীতের অশ্রুও হয় না তেমন বেদনাদায়ক।

 প্রাচীনদের ভবিষ্যতে থাকে মৃত্যুর দুঃস্বপ্ন। বর্তমানকে নিয়েও হয় না তারা পরিতুষ্ট। তাই সর্বদেশের সর্বকালের বৃদ্ধেরাই চিরদিনই অতীতের দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব’লে ওঠে— “হায়রে সোনার সেকাল!” সকলেই এ বিলাপ আগেও শুনেছে, আজও শুনেছে এবং ভবিষ্যতেও শুনবে। এই অতীতপ্রীতির ফলেই হয় স্মৃতিকথার জন্ম।

 কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশে “কল্লোল যুগ” ব’লে কোন যুগের অস্তিত্ব ছিল কি? ক্ষুদ্র পত্রিকা “কল্লোলে"র পরমায়ু দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি এবং তাকে যুগস্রষ্টা ব’লেও গ্রহণ করা চলে না। “কল্লোলে”র সময়েই তার সমধর্মী আর একখানি পত্রিকা ছিল— “কালি-কলম”। “ভারতী” বেঁচে থাকতে থাকতেই “কল্লোলের” জন্ম এবং “ভারতী”র আসরে আর একদল শক্তিশালী আধুনিক সাহিত্যিক সাহিত্যসাধনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের সামনেও ছিল বিশেষ এক আদর্শ। উপরন্তু “শনিবারের চিঠি”তেও আর এক শ্রেণীর সুলেখক নিয়মিতভাবে লেখনীচালনা করতেন (এই সঙ্গে “প্রবাসী”, “মানসী ও মর্মবাণী” “মাসিক বসুমতী” ও “ভারতবর্ষে”র নাম না করলেও চলে, কারণ ওগুলি ছিল সব দলের পত্রিকা)।

 মোট কথা হচ্ছে এই, পূর্বকথিত কোন পত্রিকাকেই নবযুগের প্রবর্তক ব’লে গণ্য করা যায় না। তাদের কারুর আদর্শ ও রচনা ভঙ্গিই আজ পর্যন্ত সার্বজনীন হ’তে পারে নি। রবীন্দ্রনাথের জীবনকালের মধ্যে জন্মগ্রহণ ক’রে তারা প্রত্যেকেই লালিত হয়েছে রবীন্দ্রপ্রভাবের মধ্যেই। সুতরাং আসলে সেটা ছিল রবীন্দ্রযুগ। ছিল বলি কেন, এখনো আমরা রবীন্দ্রযুগের প্রভাবের দ্বারাই আচ্ছন্ন হয়ে আছি। রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করা তো দূরের কথা, অদ্যাবধি আর কেউ তাঁর কাছাকাছি গিয়েও হাজির হ’তে পারেন নি। অতিআধুনিক লেখক যাযাবর রচিত “দৃষ্টিপাত” অতিশয় লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং “দৃষ্টিপাত” যে সার্থক রচনা, সে বিষয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মধ্যেও সর্বত্র পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের প্রভূত প্রভাব। রবীন্দ্রসাহিত্য হচ্ছে মহানদের মত। “ভারতী”, “কল্লোল”, “কালি-কলম” ও “শনিবারের চিঠি” প্রভৃতি হচ্ছে সেই মহানদ থেকে নির্গত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখার মত, কিছু দূর অগ্রসর হয়েই যারা হারিয়ে যায়, শুকিয়ে যায় বালুকাবিতানের ভিতরে। “কল্লোল যুগ” হচ্ছে অশ্রুতপূর্ব কথা। তবে হ্যাঁ, “কল্লোলের” একটি নিজস্ব দল ছিল বটে এবং সে দল গঠিত হয়েছিল কয়েকজন রচনাকুশল তরুণ সাহিত্যিকের দ্বারা। আজ তাঁরা চল্লিশের কোঠা পেরিয়ে পঞ্চাশের কোঠায় চলা-ফেরা করছেন এবং সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে কিনেছেন যথেষ্ট সুনাম।

 সেই দলের নেতা ছিলেন স্বর্গীয় দীনেশরঞ্জন দাস। দীনেশ আমার বাল্যবন্ধু ও সমবয়সী। আমি যখন এগারো-বারো বছর বয়সের বালক, তখন আমার এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়ীতে মাঝে মাঝে তাঁর দেখা পেতুম। তারপর সুদীর্ঘকাল আর দীনেশের দেখা পাইনি, তাঁর কথা আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলুম বললেও অত্যুক্তি হবে না।

 দুই যুগেরও বেশী কাল কেটে গেল। হঠাৎ খবর পেলুম দীনেশ একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। আমাদের “ভারতী” কার্যালয়ের অনতিদূরে অবস্থিত কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের ছোট্ট একটি কার্যালয় থেকে ছোট্ট কাগজ “কল্লোল” প্রকাশিত হ’ত। দীনেশের সঙ্গে দেখাও হ’ল এবং দুইজনেই আবার ধরলুম পুরাতন বন্ধুত্বের খেই। দুই-একদিন “কল্লোল” কার্যালয়েও হাজিরা দিলুম, কিন্তু সেখানকার আসর তখনও ভালো ক’রে জমে ওঠেনি। এ হচ্ছে ১৯২৪ কি ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের কথা।


 সেই সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পরলোকগমন করেন। দীনেশের অনুরোধে দেশবন্ধুর তিরোধান উপলক্ষ্যে একটি কবিতা রচনা ক’রে “কল্লোল” কার্যালয়ে দিয়ে এলুম। “কল্লোলে”র জন্যে সেই আমার প্রথম রচনা। তার কিছু কাল পরে “কল্লোলে”র কার্যালয় উঠে যায় পটুয়াটোলায় এবং পত্রিকার আকারও কিছু বাড়ে। তার পৃষ্ঠায় ছাপা হয় আমার কয়েকটি কবিতা এবং দুই-একটি ছোট গল্প। “কল্লোল” কার্যালয়েও গিয়ে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছি। সে ঘরখানিও ছোট এবং সেখানকার বৈঠকও ছিল না আমাদের “ভারতী”র মত বড়। কিন্তু সেই অপ্রশস্ত ঘরে প্রশস্ত চিত্ত নিয়ে যে কয়েকটি তরুণ হামেসাই ওঠা-বসা করতেন, তাঁদের চক্ষে ছিল মনীষার দীপ্তি, তাঁদের মুখে ছিল সাহিত্যের বাণী এবং তাঁদের মনেও ছিল বোধ করি নিজেদের ভবিষ্য সম্ভাবনা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। অপরিসর জায়গার মধ্যে কোনক্রমে নিজেদের কুলিয়ে নিয়ে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কিম্বা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাঁরা করতেন কলালাপ, করতেন গল্পগুজব, করতেন হাস্য-পরিহাস। জীবনের বন্ধুর যাত্রাপথে অনেক দূর এগিয়ে এসেও আজও তাঁরা নিশ্চয় ভুলতে পারেন নি পিছনে প’ড়ে-থাকা আশায় আনন্দে রঙিন সেই সুমধর দিনগুলিকে। অন্ততঃ অচিন্ত্যকুমার যে ভুলতে পারেন নি তার নজীর হচ্ছে তাঁর “কল্লোল যুগ”।

 “কল্লোল” পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিত না বটে, কিন্তু তার নাম বিশেষভাবে বিজ্ঞাপিত করবার জন্যে প্রদীপ্ত উৎসাহে নিযুক্ত হয়েছিলেন “শনিবারের চিঠি”র দল। তার ফলে লাভবান হয়েছিল উভয় পক্ষই। বেড়ে উঠেছিল দুই পত্রিকারই গ্রাহক-সংখ্যা। নানা রচনায় স্থলবিশেষ উদ্ধার ক’রে “শনিবারের চিঠি” প্রমাণিত করতে চাইলে, “কল্লোল” হচ্ছে একখানা অপাঠ্য, অতি অশ্লীল পত্রিকা। বঙ্কিমচন্দ্র কোথায় যেন এই মর্মে বলেছিলেন যে, কোন কোন দুরন্ত ছেলে ভূতের ভয় দেখালে ভয় পায় না, উল্টে ভূতকে দেখবার জন্যেই আগ্রহ প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা সেই রকমই। “কল্লোলে” অশ্লীল গল্প বেরোয় শুনে অনেকেই তা পাঠ করবার জন্যে ট্যাঁকের কড়ি ফেলতে লাগল। সুতরাং “শনিবারের চিঠি”র গালাগালি “কল্লোলে”র পক্ষে হয়ে দাঁড়াল শাপে বরের মতই।

 শনিবারের চিঠির অভিযোগ নিয়ে আমি এখানে মাথা ঘামাতে চাই না। অশ্লীলতার জন্যে “কল্লোল”কে আক্রমণ হয়তো অন্য কোন উদ্দেশ্যসাধনের একটা উপলক্ষ্য মাত্র। কারণ তথাকথিত অশ্লীলতার আশ্রয় না নিলেও আক্রান্ত হতেন “কল্লোলে”র লেখকরা। দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিজের কথাই বলতে পারি। “কল্লোলে” প্রকাশিত আমার কোন কোন কবিতাও ধিক্কৃত হয়েছে “শনিবারের চিঠি”তে। কিন্তু অশ্লীলতার জন্যে এ পরিবাদ নয়, আমি আক্রান্ত হয়েছি কেবল “কল্লোলে”র লেখক ব’লেই।

 কি যে শ্লীল আর কি যে অশ্লীল, তার মানদণ্ড নির্ধারণ করা সহজ নয়। সমস্তই নির্ভর করে এক এক শ্রেণীর পাঠকের মানসিক প্রতিক্রিয়ার উপরে। “ম্যাডাম বোভারি” রচনা করে অশ্লীলতার জন্যে রাজদ্বারে অভিযুক্ত হয়েছিলেন ফরাসী সাহিত্যাচার্য ফ্লবেয়ার। কিন্তু সেই “ম্যাডাম বোভারি”ই আজ স্থান পেয়েছে বিশ্বসাহিত্যে। এমন আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়।

 কিন্তু একটা সত্য অস্বীকার করতে পারি না। “কল্লোল” সম্পাদকের মনের গড়ন ছিল একটু অদ্ভুত। গল্প হচ্ছে গল্পই। আর্ট হিসাবে যদি তা নির্দোষ হয়, তাকে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে আপত্তি থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয়। দীনেশ কিন্তু একথা মানতেন না। তাঁর ফরমাশে একবার একটি ছোট গল্প রচনা করলুম। তারপর গল্পটি তাঁকে শুনিয়ে এলুম “কল্লোল” কার্যালয়ে গিয়ে। সেখানে আর একজন সাহিত্যিকও (মনে হচ্ছে, শ্রীপবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়) উপস্থিত ছিলেন।

 প্রায় দুই যুগ আগেকার ঘটনা। গল্পটির হুবহ, আখ্যানবস্তু স্মরণে আসছে না। তবে মোটামুটি তা বোধ হচ্ছে এই রকমঃ অতি সাধারণ পরিবারের একটি পাড়াগেঁয়ে অশিক্ষিতা রূপসী তরুণী। স্বামী তার নিঃস্ব ও রোগশয্যায় শায়িত। সমাজের উচ্চতর স্তরে সুনীতি ও দুর্নীতির যে বাঁধা-ধরা মাপকাঠি আছে তরুণী তার খবর রাখে না বটে, কিন্তু স্বামীকে সে ভালোবাসে। তাদেরই এক প্রতিবেশী—ধনিক ও রূপরসিক— তাদের বাড়ীতে সে আনাগোনা করে। তরুণীকে টাকার লোভ দেখায়, অর্থসাহায্য করতে রাজি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে করে কুপ্রস্তাবও। অর্থাভাবে স্বামীর চিকিৎসা হচ্ছে না ব’লে তরুণী ধনী প্রতিবেশীর প্রেম-নিবেদন সহ্য করে এবং লীলাময়ীর মত তার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতেও ছাড়ে না। তারপর প্রেমাকাঙ্ক্ষী প্রতিবেশীর টাকায় চিকিৎসার পর স্বামীর আরোগ্য লাভ। প্রতিবেশী তখন তরুণীর দেহলাভ করতে চাইলে। তরুণী গ্রাম্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে তাকে বিতাড়িত করলে।

 গল্পটি শুনে দীনেশ বললেন, “গল্পটি বেশ ভালোই হয়েছে। কিন্তু এ গল্প তো আমার কাগজে চলবে না।”

 আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন?”

 দীনেশ সাফ জবাব দিলেন, “তুমি নারীর সতীত্ব দেখাবার চেষ্টা করেছ।”

 দীনেশের এমনি সব বেয়াড়া “ফ্যাড” বা খেয়াল ছিল। হয়তো এইদিকে লক্ষ্যই রেখে “কল্লোলে”র তরুণ লেখকগণকে গল্প রচনা করতে হ’ত। কিন্তু আমার আদর্শ অন্যরকম। তাই পরে অনুরুদ্ধ হয়েও আমি দীনেশের জন্যে আর কোন নতুন গল্পে হাত দিই নি। এই রকম সব খেয়ালের ভিতরে নেই চিন্তাশীলতা, আছে দুর্বলতা। এই দুর্বলতারই সুযোগ গ্রহণ করত “শনিবারের চিঠি”।

 কিন্তু তখনকার “কল্লোলে”র সেই নবীন লেখকরা আজ হয়েছেন প্রবীণ। হয়তো আগে তাঁদের কারুর কারুর রচনার ভিতরে অন্বেষণ ক’রে পাওয়া যেত অল্পবিস্তর ময়লামাটি। কিন্তু তাঁদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত ময়লামাটি ক্রমে ক্রমে থিতিয়ে পড়েছে নীচের দিকে এবং তাঁদের রচনাও ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ ও নির্মল।

 “কল্লোলে”র লেখকদের মধ্যে ছিলেন শ্রীঅচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীবুদ্ধদেব বসু, শ্রীঅজিত দত্ত, শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্র, শ্রীমণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব) ও শ্রীহেমচন্দ্র বাগচী এবং আরো কেউ কেউ। ওঁদের মধ্যে প্রথমে চারিজনের সাহিত্যসাধনা আজও আছে অব্যাহত। কিন্তু বাংলা দেশের দুর্গত সিনেমার নেশায় মেতে প্রেমেন্দ্র এখন সাহিত্য-জগতে মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মারেন মাত্র। মণীশের মধ্যে ছিল প্রভূত সম্ভাবনা, কিন্তু তিনি এখন লেখনী ত্যাগ ক’রে ব’সে আছেন। হেমচন্দ্র বাগচী বেশ কবিতা লিখতেন, কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির বিধানে তিনি হন উন্মাদগ্রস্ত।

 এই প্রসঙ্গে আর এক ভাগ্যবান কবির কথা মনে হচ্ছে। নজরুল ইসলাম। আমার মত তিনিও ঠিক “কল্লোল” গোষ্ঠীভুক্ত সাহিত্যিক ছিলেন না, তবে তার সম্পর্কে এসেছেন বটে। দেশবন্ধুর তিরোধান উপলক্ষ্যে আমার সঙ্গে তাঁরও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল “কল্লোলে”র পৃষ্ঠায়। তার কিছুকাল পরে স্বর্গীয় কবিবর যতীন্দ্রমোহন বাগচীর আরপুলি লেনের ভবনে এক সন্ধ্যায় আহূত হয়ে গিয়ে দেখি, সেখানে উপস্থিত আছেন নজরুল ইসলাম ও “কল্লোলে”র কোন কোন সাহিত্যিক। নজরুল হার্মোনিয়ম নিয়ে গান গাইতে সুরু করলেন।

 তার আগেই আমাদের নিজস্ব আসরে নজরুলের কণ্ঠে শুনেছি অসংখ্য গান। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল না বটে শিক্ষিত ওস্তাদের মত, কিন্তু তাঁর আন্তরিকতার গুণে প্রত্যেক শ্রোতাই হতেন বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট। আগে তিনি গাইতেন রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদ সেন প্রভৃতির গান কিন্তু সেদিনকার আসরে গীতিকার ও সুরকার রূপে নজরুলের পরিচয় পেলুম সর্ব প্রথমে। তাঁর মুখে শুনলুম গজল গানের পর গজল গান। বাংলা দেশে গজল গান আগেও ছিল। আমাদের ছেলেবেলায় লোকের মুখে মুখে এই গজলটি শুনতুম—“কুঞ্জবনে যমুনারি তীরে, রাধা রাধা বলে কে বাঁশী বাজায়।” কিন্তু সেদিন নজরুলের রচিত যে গজলগুলি শুনলুম, তাদের গড়নও সম্পূর্ণ নতুন এবং কবিত্বেও তারা সর্ব প্রকারে সমৃদ্ধ।

 তারপর “কল্লোলে” আত্মপ্রকাশ করল নজরুলের সেই প্রখ্যাত গজলটি -“বসিয়া বিজনে কেন একা মনে, পানিয়া ভরণে চললো গোরী!” তাঁর আরো কয়েকটি গজল “কল্লোলে” প্রকাশিত হয়েছিল এবং অনতিবিলম্বেই সেগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে-বাইরে যেখানে-সেখানে। বাংলা দেশে কিছুকাল ধ’রে চলল গজল গানের রেওয়াজ।

 নজরুলের কথা অন্যত্র বিস্তৃতভাবেই বলেছি, সুতরাং আর তা নতুন ক’রে বলবার দরকার নেই। এর পর আমি “কল্লোলে”র অন্যান্য কয়েকজনের কথা নিয়ে আলোচনা করব।