এখন যাঁদের দেখছি/কল্লোল-গোষ্ঠীর দুইজন
কল্লোল-গোষ্ঠীর দুইজন
এখনকার অধিকাংশ মাসিক পত্রিকার কার্যালয়ে গেলে শোনা যায় খালি কাজের কথা। সাহিত্যিকরা সেখানে আসেন বসেন, দুটো–চারটে কথা বলেন, কিন্তু সবই প্রয়োজনের তাগিদে। ভালো ক’রে আসর জমিয়ে নিয়মিত ভাবে বৈঠকী আলোচনা সেখানে আর হয় না।
আগেকার মাসিক পত্রিকার কার্যালয়েও যে কাজের ভিড় থাকত না, এমন কথা বলি না। কিন্তু কাজ-কর্ম চুকে যাবার পর প্রতিদিনই বৈকালের দিকে সেখানে বসত বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত লেখকদের বৈঠক। হ’ত সাহিত্য ও ললিতকলা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান। হ’ত গল্পগুজব, হাসিমস্করা এবং কোথাও কোথাও শোনা যেত সঙ্গীতের কলরবও। এরই মধ্য দিয়ে নিবিড় হয়ে উঠত পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক। “জাহ্নবী”, “অর্চনা”, “মানসী”, “যমুনা”, “সঙ্কল্প”, “মর্মবাণী”, “ভারতী”, “কল্লোল” ও “শনিবারের চিঠি” প্রভৃতি পত্রিকা ছিল এমনি সব আলাপ-আলোচনার কেন্দ্র।
কিন্তু কেবল পত্রিকার কার্যালয়ে নয়, তখন কোন কোন সাহিত্যরসিক গৃহস্থের বাড়ীতেও নানা শ্রেণীর গুণীদের জন্যে বিছানো হ’ত রীতিমত ঢালা আসর। কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে অক্সফোর্ড মিসনের পার্শ্ববর্তী বাড়ীর কর্তা ছিলেন স্বর্গীয় গজেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ। দুই যুগ আগেও তাঁর বৈঠকখানায় প্রত্যহ গদীয়ান হয়ে বিরাজ করতেন উচ্চশ্রেণীর বহু সাহিত্যিক ও শিল্পী। কার হাতে সিগারেট, কারুর হাতে চুরোট ও কারুর হাতে গড়গড়ার নল এবং ঘন ঘন আসছে আর যাচ্ছে চায়ের পেয়ালা ও তাম্বুলের থানা। জুতো-শেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত কোন কথাই সেখানে অনালোচনীয় ছিল না। তর্কবিতর্ক হ’তে হ’তে মাঝে মাঝে উঠত চায়ের পেয়ালায় তুমুল তরঙ্গ।
সেই আসরেই স্বর্গীয় কৌতুকাভিনেতা চিত্তরঞ্জন গোম্বামী, নাট্যাচার্য শ্রীশিশিরকুমার ভাদুড়ী, স্বর্গীয় ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, রাজনৈতিক শ্রীনির্মলচন্দ্র, অভিনেতা শ্রীনরেশচন্দ্র মিত্র, কবি নজরুল ইসলাম, সুলেখক শ্রীধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও হাস্যরসিক দাদাঠাকুর শ্রীশরৎচন্দ্র পণ্ডিত প্রভৃতির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়।
নজরুল হৈ হৈ ক’রে এসেই বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করতেন টেবিল-হার্মোনিয়ামটাকে এবং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের যানবাহন ও মুক্তজনতার বিষম গোলমাল গ্রাহ্যের মধ্যেও না এনে গেয়ে যেতেন গানের পর গান এবং গাইতে গাইতে থালা থেকে তুলে নিতেন পানের পর পান। কেবল কাঁড়ি কাঁড়ি পান নয়, আঠারো-বিশ পেয়ালা চা না পেলেও সিক্ত হ’ত না তাঁর কণ্ঠদেশ।
নজরুলের সঙ্গে প্রায়ই আসতেন একটি স্বল্পবাক তরুণ। তাঁর মাথায় লম্বা চুল, দেহ একহারা, বর্ণ শ্যাম, সাজগোজ সাদাসিধা, মুখে শালীন ভাব। নাম শুনলুম শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে আমরা নজরুলের বন্ধু ব’লেই গ্রহণ করলুম। তাঁর অন্য কোন পরিচয় জানতুম না এবং আসরের বিখ্যাত সব গুণী জ্ঞানীর মাঝখানে তাঁর দিকে ভালো ক’রে মনোযোগ দিতেও পারি নি।
নৃপেন্দ্র ছিলেন বর্ণচোরা আমের মত। নানা আসরে এমন অনেক লোককে দেখেছি, যাঁরা উল্লেখযোগ্য গুণের অধিকারী না হয়েও বিখ্যাত ব্যক্তিদের মাঝখানে ব’সে সবজান্তার মতন এমন অনর্গল কথার খই ফোটাতে পারেন যে, সহজেই তাঁদের দিকে আকৃষ্ট হয় আর সকলের দৃষ্টি। এই মুখর মানুষগুলি যে সুচতুর, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। নিজেদের ঢনঢনে মস্তিষ্ক সম্বন্ধে জ্ঞান তাঁদের অত্যন্ত টনটনে। তাই বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করে তাঁদের খ্যাতির খানিকটা তাঁরা প্রতিফলিত করতে চান নিজেদের মধ্যে। বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি দেখেছি এমনি সব হসন্ত-মার্কা জীবকে।
নৃপেন্দ্র অন্য ধরণের মানুষ। মুখের কথায় বা হাব-ভাব–ব্যবহারে কোনদিনই নিজেকে তিনি বিজ্ঞাপিত করতে কিম্বা স্বয়ং প্রধান হয়ে উঠতে চান নি। তাই কিছু দিনের আলাপের পরেও আমি পাইনি তাঁর প্রকৃত পরিচয়।
তারপর “কল্লোল” পত্রিকা প্রকাশিত হল এবং “কল্লোলে”র পৃষ্ঠার মধ্যেই আবিষ্কার করলুম যথার্থ নৃপেন্দ্রচন্দ্রকে। তাঁর চেষ্টাবর্জিত, প্রসাদগুণবিশিষ্ট ও তৃপ্তিদায়ক মিষ্ট ভাষা এবং প্রবন্ধরচনায় সুদক্ষ হাত দেখে সত্য সত্যই আমি বিস্মিত না হয়ে পারি নি। এমন একজন শিল্পী আমাদের সঙ্গে এসে মেলামেশা করেছেন, অথচ আমরা তাঁকে কেবল নজরুলের পার্শ্বচর এক সাধারণ ভক্ত ছাড়া আর কিছু ব’লেই ভাবতে পারি নি!
তারপর নৃপেন্দ্রচন্দ্রের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধুত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। বহু সাহিত্য-বৈঠকে, “নাট্যমন্দির” ও “নাট্য-নিকেতনে”র অন্দরের আসরে এবং আমার নিজের বাড়ীতে তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় কাটিয়ে দিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কোন অসতর্ক মুহূর্তেও তাঁর মখে শুনিনি কোন অশোভন উক্তি এবং আত্মগৌরব কথনেও কখনো দেখিনি তাঁর এতটুকু আগ্রহ। বরং বারংবার এই কথাই আমার মনে হয়েছে যে সর্বদাই তিনি যেন আপনাকে সরিয়ে রাখতে চান সকলের পিছনে এবং তিনি যে একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী, নৃপেন্দ্রচন্দ্র নিজেই যেন সে সম্বন্ধে সচেতন নন! তাঁর আর একটি মস্ত গুণ, কখনো তিনি অন্য সাহিত্যিকের বিরুদ্ধে গ্লানি প্রচার করেন না। ব্যক্তিগত হিংসাদ্বেষ তাঁর মনে ঠাঁই পায় না।
কিন্তু তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের সাহিত্যিক। এখানে সাহিত্যের সঙ্গে সৌভাগ্যের সম্পর্ক যদি কিছু থাকে, তবে তা এত দূরসম্পর্ক যে কদাচ হ’তে পারে তারা পরস্পরের নিকটস্থ। ঠিক সেইজন্যে কি না জানি না, অধিকাংশ সময়েই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের মুখের উপরে দেখেছি উদাস-উদাস ভাব। গল্পগুজব ও হাস্যকৌতুকের মাঝখানেও কেমন যেন অনাসক্ত হয়ে থাকেন। কি যেন খুঁজছেন, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না।
মাঝে মাঝে হয়ত অর্থাভাবেই তিনি স্বক্ষেত্র ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চান। উপন্যাস রচনা করেন, কিন্তু সফল হন না। চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় দেখা দেন, কিন্তু বিফল হন। উপন্যাসে ও প্রবন্ধ রচনার মধ্যে পার্থক্য আছে যথেষ্ট। মেকলে ও কার্লাইলের রীতি এক রকম, স্কট ও ডিকেন্সের রীতি আর এক রকম। এটুকু ভুললে শক্তিশালী লেখকরাও নিজেদের সুনাম রক্ষা করতে পারবেন না। আবার লেখক ও অভিনেতা দুজনেই শিল্পী বটে, কিন্তু তাঁরা বিচরণ করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মার্গে। অভিনয়ে অনেকের অশিক্ষিতপটুত্ব থাকতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত গুরুর অধীনে দীর্ঘকালব্যাপী শিক্ষাগ্রহণ না করলে কেহই শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয় না। তেমনি যারা অভিনয়ে অভ্যস্ত, সাহিত্যসাধনা না ক’রে হঠাৎ কলম ধ’রে সেও রাতারাতি লেখক হয়ে উঠতে পারে না। এইজন্যেই প্রবাদে বলে- ‘যার কাজ তারে সাজে, অন্যের পিঠে লাঠি বাজে।’ কুস্তির মহামল্লও যুযুৎসর মল্লের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হয় না—অথচ দুজনেরই কর্তব্য হচ্ছে মল্লযুদ্ধ করা। আমি স্বচক্ষে একজন ক্ষুদ্রাকায় জাপানী যুযুৎসু-বিশেষজ্ঞকে বিশ্ববিজয়ী বিপুলবপু গামাকে সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান করতে দেখেছি, কিন্তু গামা বুদ্ধিমানের মত তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ যুযুৎসুর আর কুস্তির পদ্ধতি এক নয়।
নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের অতুলনীয় গুণপণা দেখা যায় সন্দর্ভ রচনায় এবং জীবনচিত্রাঙ্কনে। শেষোক্ত বিভাগে তিনি কলমের রেখায় যে সব জীবনচিত্র এঁকেছেন, সেগুলি হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য ও অভিনব ঐশ্বর্য। এ শ্রেণীর আরও অনেক ছবি বাংলা দেশেই পাওয়া যাবে, কিন্তু আর কোন ছবিকারই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের নিকটস্থ হ’তে পারবেন না। সেগুলি কেবল সুলেখকের রচনা নয়, সেগুলি হচ্ছে উচ্চশ্রেণীর শিল্পীর রচনা। যাঁদের ভিতর ও বাহির ফুটোতে চান, সম্যকরূপে ও জীবন্ত ভাবে তিনি তা ফুটিয়ে তুলেছেন, অথচ যথাসম্ভব প্রচ্ছন্ন রেখে নিজের আর্টকে এবং বিশেষজ্ঞমাত্রই জানেন, যে আর্ট নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখতে পারে, তাইই হচ্ছে বড় আর্ট। যাঁদের কলমের ছবি তিনি এঁকেছেন, আবার তাঁদেরই দেখাবার চেষ্টা করেছেন এমন আরও লেখকের অভাব নেই। কিন্তু চার পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনার পর তাঁরা যতটুকু দেখিয়েছেন, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মাত্র চারটি লাইনে তার চেয়ে ঢের বেশী দেখাতে পেরেছেন। তাঁর এই নিরতিশয় ভাবগর্ভ লিপিকুশলতা বোঝাতে কি শব্দালঙ্কার ব্যবহার করব? বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর উপামাটা বড়ই পুরাতন হয়ে গিয়েছে। তিনি হচ্ছেন একজন অননস্যাধারণ রেখাচিত্রকার।
প্রায় সেই সময়েই আর একজন উদীয়মান লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয়, এখন তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি হচ্ছেন শ্রীশিবরাম চক্রবর্তী। যদিও তিনি সাহিত্যসাধনা সুরু করেছিলেন স্বতন্ত্র ভাবেই, তবু তাঁকে “কল্লোল” গোষ্ঠীভূক্ত সাহিত্যেকদেরই মধ্যে গণ্য করতে পারি। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়, তিনি তাঁদের সঙ্গে উঠতেন, বসতেন, আলাপ ও বিচরণ করতেন বটে, তবে অদ্যাবধি নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন—অর্থাৎ সব দলের সঙ্গেই মেলামেশা করেন, কিন্তু কোন বিশেষ দলের খাতায় নিজের নাম লিখতে রাজি হন না।
তখন আমাদের “ভারতী” উঠে গিয়েছে, কিন্তু “ভারতী” কার্যালয়ের বাড়ী থেকেই মুদ্রিত হয় “নাচঘর”, যার যুগ্ম-সম্পাদক ছিলুম আমি ও নলিনীমোহন রায়চৌধুরী। আমরা ত্রিতলে বসে কাজ করতুম, একতলায় ছিল স্বর্গীয় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের “কান্তিক প্রেস”। সেই ছাপাখানায় মুদ্রিত হ’ত শিবরামের দ্বারা সম্পাদিত একখানি সাময়িক পত্রিকা, তার নাম আমার সঠিক স্মরণ হচ্ছে না—হয়তো “যুগান্তর”। শিবরামের তখন প্রথম যৌবন। কিন্তু সেই বয়সেই তিনি কেবল সম্পাদক নন, গ্রন্থকার রূপেও আত্মপ্রকাশ ক’রেছেন। তবে সেদিনকার লেখক শিবরাম এবং এখনকার হাসির গল্প-লিখিয়ে ও শব্দশ্লেষের রাজা শিবরামের মধ্যে পার্থক্য আছে অনেকখানি। আগেকার শিবরাম ঘুরে বেড়াতেন সাহিত্য-জগতের নানা পথে কখনো সাংবাদিক, কখনো ঔপন্যাসিক, কখনো নাট্যকার, কখনো প্রবন্ধকার এবং কখনো বা কবি রূপ ধারণ ক’রে। কিন্তু এখনকার মানুষ শিবরাম আজও দুপুর রোদে গোটা কলকাতার পথেবিপথে, অপথে-কুপথে হাঘরের মত, চর্কীর মত টো টো ক’রে ঘুরে বেড়ান বটে, তবে লেখক শিবরাম আশ্রয় নিয়েছেন সাহিত্য-জগতের বিশেষ এক প্রান্তে। বড়দের জন্যে মাঝে মাঝে এখনো দুই-একটা লেখায় হাত দেন, কিন্তু ছোটদের জন্যেই তাঁর বেশী মাথাব্যাথা।
শিবরাম কবি। দিব্য কবিতা লিখতেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতেও ছিল প্রভূত নতুনত্ব। তাঁর কবিতার কেতাবও বাজারে বেরিয়েছে, কিন্তু আজ তা ক্রেতাদের পুস্তকাগারে সুরক্ষিত আছে, কিম্বা তথাকথিত “শ্বেত পিপীলিকা” দের কবলগত হয়েছে সে খবর দিতে পারব না। যে কারণেই হোক, কাব্যলক্ষ্মী র সঙ্গে এখন তাঁর আর বড়-একটা বনিবনাও নেই, অথচ তাঁর কবিত্বের ক্ষেতে যে অজন্মার যুগ আসে নি, সে প্রমাণও পাই মাঝে মাঝে।
শিবরাম নাট্যকার এবং কাঁচা বয়স থেকেই পাকা নাট্যবোদ্ধা। যখন তিনি উদীয়মান, সেই সময়েই শরৎচন্দ্রের “দেনা-পাওনা” কে নাট্যকারে পরিবর্তিত ক’রে তার নাম রাখেন “ষোড়শী”। যদিও তা “ভারতী”তে প্রকাশিত এবং রঙ্গালয়ে অভিনীত হয়েছিল শরৎচন্দ্রেরই নামে, কিন্তু নাট্যরূপের সফলতার জন্যে অনেকখানি প্রশংসার উপরে দাবি করতে পারেন শিবরামই। তারপরেও তিনি “নাট্যনিকেতনে”র কর্তৃপক্ষের অনুরোধে নিরুপমা দেবীর “দিদি” উপন্যাসকেও নাট্যাকারে পরিবর্তিত করেছিলেন বটে, কিন্তু শিশিরকুমারের প্রতিভা ও শরৎচন্দ্রের নামের মহিমা থেকে বঞ্চিত হয়ে “দিদি” লোকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি।
মৌলিক নাটক রচনাতেও তিনি হচ্ছেন রীতিমত করিতকর্মা। বহুকাল আগে রচনা করেছিলেন “চাকার নিচে” নামে এক নাটক এবং আমার “নাচঘরে” তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবার সময়ে গৌরচন্দ্রিকায় আমি লিখেছিলুমঃ “শিবরামবাবু এই নাটকখানি রচনা করেছেন অতি-আধুনিক প্রথায়। এবং একটিমাত্র অঙ্কে, একটিমাত্র ঘরের ভিতরে মোট তিন-চার ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তিনি আধুনিক জীবনের যে বিচিত্ররসবহুল, অপূর্ব ও জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন, আমরা আগে থাকতে তার আভাস দিয়ে রসভঙ্গ করব না। পাঠকরা ধীরে ধীরে তার পরিচয় পাবেন এবং পরিণামে যে মুগ্ধ ও তৃপ্ত হবেন, সে বিষয়েও কিছুমাত্র সন্দেহ নেই” প্রভৃতি।
কিন্তু তিনি নাট্যকার হয়েও হলেন না—“ছেড়ে দিলেন পথটা, বদলে গেল মতটা।” বিপুল উৎসাহে ঢুকে পড়লেন ছোটদের খেলাঘরে, তাঁর অশ্রান্ত লেখনী হুড় হুড় ক’রে রচনা করতে লাগল রাশি রাশি হাসির গল্প, ভূরি পরিমাণে শব্দশ্লেষ (pun) ও অনুপ্রাস ছড়াতে ছড়াতে পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে। আজকের বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতন এত বেশী হাসির গল্প রচনা করেন নি আর কোন লেখকই।
“পান্”এর দিকে ঝোঁক তাঁর অতিমাত্রায়। তার লোভে তিনি গল্পের বাঁধুনিও শ্লথ ক’রে ফেলবার জন্যে সর্বদাই প্রস্তুত। প্রাণপণে “পান্”-এর পরে “পান্” চালিয়ে তিনি পান আনন্দ এবং এদিকে তাঁর বিস্ময়কর কৃতিত্ব জাহির হ’লেও গল্পের আর্ট ও ক্ষুণ্ণ হয় অল্পবিস্তর। কেবল লেখবার সময় নয়, বন্ধুসভায় আসীন হয়ে গল্প করবার সময়েও তাঁর সংলাপ হয়ে ওঠে শব্দশ্লেষের জন্যে কৌতুককর।
বেশ আলাভোলা, মিষ্ট মানুষ এই শিবরাম। গতি তাঁর সর্বত্রই, কিন্তু কোথাও বেশীক্ষণ থাকবার পাত্র নন, এক আড্ডা ছেড়ে ছোটেন আর এক আড্ডার দিকে, তারপর আর এক আড্ডায়। চিরকুমার, নেই কোন সংসারজালা এবং সেই কারণেই হয়তো যখন-তখন নির্মল কলহাস্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারেন। বয়সে প্রৌঢ়, কিন্তু তরলমতি বালকের মত হাবভাব। বুড়োর চেয়ে আকৃষ্ট হন বালকদের দিকেই। যখন কারুর বিরুদ্ধে কোন মজার গল্প বলেন, তখনও তাঁর ভিতরে থাকে না তিলমাত্র রাগের ভাব। তাঁর সঙ্গসুখ উপভোগ করবার জন্যে কখনো কখনো তাঁকে জোর ক’রে ধ’রে এনেছি। এবং অনুভব করেছি খানিকটা মুক্ত বাতাসের মিষ্ট স্পর্শ।