এখন যাঁদের দেখছি/দেব-দেবী সংবাদ
বাইশ
দেব-দেবী সংবাদ
দেব হচ্ছেন শ্রীনরেন্দ্র এবং দেবী হচ্ছেন শ্রীমতী রাধারাণী। দু’জনেই কবি। এমন মানিকজোড়ের মত একসঙ্গে থেকে কাব্যসাধনা করার দৃষ্টান্ত বাংলা দেশে আর আছে ব’লে জানি না।
গদ্য রচনায় দক্ষ এমন একাধিক দম্পতি এখানে আগেও ছিলেন এবং এখনো আছেন। কিন্তু স্বামী ও ভার্যা দু’জনেই কবিতা লেখেন, এমন দম্পতির নাম স্মরণে আনতে পারছি না। তবে একবার এমন সুযোগের সম্ভাবনা হয়েছিল বটে। আমি সরলা দেবী ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথা বলছি। সরলা দেবীর কবিতা সাময়িক পত্রিকায় দেখেছি। তাঁর “অতীত গৌরবকাহিনী মম বাণী” নামক জাতীয় সঙ্গীতটির কথা তো সকলেই জানেন। গল্পলেখকরূপে বিখ্যাত হবার আগে প্রভাতকুমারও সাময়িক পত্রিকার (“দাসী”) জন্যে কবিতা রচনা করতেন। তিনি যখন জনপ্রিয় গল্পলেখক, তখনও তাঁর কবিতায় রচিত একখানি হাস্যনাট্য ধারাবাহিকভাবে “মর্মবাণী” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সরলা দেবীর সঙ্গে প্রভাতকুমারের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরে পাকা ঘুঁটি কে’চে যায়।
যে যুগে “ভারতবর্ষ” মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, সেই সময়ে নরেন্দ্র দেবের কবিতা দৃষ্টি আকর্ষণ করত মাঝে মাঝে। কিন্তু তখনও আমরা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব-সূত্রে আবদ্ধ হইনি। অথচ পরে জেনেছিলুম, আমাদের এই বন্ধুত্বকে বংশানুক্রমিক বলাও চলে। কারণ নরেনের পিতৃদেব ও আমার পিতৃদেবও ছিলেন পরস্পরের সুহৃদ।
আমার সাহিত্যসাধনা তখন খুব জোর চলছে। একদিকে আমি মাসিক “ভারতী”র সেবক, আর একদিকে দৈনিক “হিন্দুস্থানে”র প্রাত্যহিক লেখক এবং অন্যান্য প্রধান প্রধান পত্রিকাতেও আমার রচনা প্রকাশিত হয়। কয়েকখানি গ্রন্থও বাজারে দেখা দিয়ে মন্দ অভ্যর্থনা লাভ করেনি। সেই সময়ই একবার দেওঘরে বেড়াতে গিয়ে নরেনের সঙ্গে হঠাৎ আমার আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল। এবং অল্প দিন যেতে না যেতেই আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধুনি হয়ে উঠল রীতিমত সুদৃঢ়।
“ভারতী” গোষ্ঠীভুক্ত সাহিত্যিকদের বৈঠক তখন জমজম করছে। সে বৈঠকের বাইরে যে সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার মনের মিল হ’ত, আমি তাঁকেই “ভারতী”র দলভুক্ত হবার জন্যে সাদরে আহ্বান করতুম এবং সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন একাধিক বন্ধু। নরেনও তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের বৈঠকে এসেই তিনি একেবারে জ’মে গেলেন; হয়ে পড়লেন নিয়মিত সভ্য।
অপূর্ব ছিল আমাদের সেই সাহিত্যসভা, কাব্য, সঙ্গীত ও শিল্প নিয়ে সর্বদাই সেখানে চলত কলগুঞ্জন। আজ যাঁরা সাহিত্যে ও শিল্পে অক্ষয় যশের অধিকারী হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই সেই কাব্যকুঞ্জের দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন মধুলোভী ভ্রমরের মত। ‘ভারতী’র নিজস্ব দলের কথা ছেড়ে দি (সে দলেরও প্রায় সকলেই আজ সুবিখ্যাত), বাহির থেকেও যাঁরা সেখানে এসে সংলাপে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা হচ্ছেন স্বর্গীয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, “বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের” প্রখ্যাত লেখক দীনেশচন্দ্র সেন, গায়ক কবি অতুলপ্রসাদ সেন, কথ্য ভাষার পুরোধা প্রমথ চৌধুরী, “ভারতী”র ভূতপূর্ব সম্পাদিকা সরলা দেবী, “প্রবাসী” সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, গায়ক দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হাসির কবি সুকুমার রায় চৌধুরী, পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, শিল্প ও সাহিত্যের আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী ও কবি নজরুল ইসলাম প্রভৃতি।
ঐ সাহিত্যসভা থেকে আমরা সকলেই লাভ করেছি কত প্রেরণা এবং রচনার নব নব উপাদান। ওখান থেকে কয়েক বৎসরের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, রসরচনা ও কবিতা ভূরি পরিমাণেই। ওখানে গিয়ে নিয়মিতভাবে আসন গ্রহণ করলে লেখকদের রচনাশক্তি প্রবুদ্ধ হয়ে উঠত অধিকতর। নরেনের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হ’ল না। বেড়ে উঠল তাঁর লেখনীর প্রজননশক্তি। তিনি লিখতে লাগলেন রাশি রাশি কবিতা। অন্য শ্রেণীর রচনাতেও করলেন হস্তক্ষেপ।
মাঝে মাঝে আমরা দল বেঁধে কলকাতার বাইরে বেরিয়ে পড়তুম। সাধারণতঃ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, চিত্রশিল্পী চারুচন্দ্র রায়, “মৌচাক” সম্পাদকসুধীরচন্দ্র সরকার, নরেন্দ্র দেব ও আমাকে নিয়েই দল গড়া হ’ত। একবার আমরা কটক ও ভুবনেশ্বর হয়ে পুরীতে গিয়েছি, সেখান থেকে যাব কণারকে। কিন্তু নরেনের জন্যে সে যাত্রা আমাদের আর কণারকে যাওয়াই হ’ল না।
পুরীতে সবাই মিলে সাগরে নেমেছি স্নান করব ব’লে। আমি মন্দ সাঁতার জানি না, এক সময়ে গঙ্গায় এপার-ওপার করেছি। কিন্তু পুরীর অশান্ত সমুদ্রকে ভয় করতুম, সেখানে সাঁতার দেবার ভরসা হ’ত না। প্রেমাঙ্কুর জানেন নামমাত্র সাঁতার, হাঁটু জলের বেশী আর অগ্রসর হ’লেন না। সাঁতারু হিসাবে নরেনেরও কোন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের কথা শুনিনি, অথচ দেখলুম তিনি বেশ সোঁ সোঁ করে সমুদ্রের ভিতরে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা চীৎকার ক’রে তাঁকে সাঁতারে নিরস্ত হ’তে বললুম, কিন্তু তিনি জলের উপরে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে আরো বেশী দূর এগিয়ে যেতে লাগলেন। আমরা তখন পর্যন্ত বুঝতে পারিনি যে, নরেন মোটেই সাঁতার দিচ্ছিলেন না, তাঁকে জোর ক’রে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সমুদ্রের “আণ্ডার কারেণ্ট” বা অন্তঃস্রোত। তারপর আমাদের স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনেই নরেনের দেহটা তলিয়ে গেল সমুদ্রের ভয়াবহ “ব্রেকার” বা তটে প্রতিহত ভগ্নোর্মিমালার মধ্যে।
চারিদিকে হৈ হৈ রব। তাবৎ স্নানার্থী সভয়ে তাড়াতাড়ি ডাঙায় উঠে পড়ল। প্রেমাঙ্কুর বালকের মত কাঁদতে লাগলেন। আমরা আচ্ছন্নের মত দাঁড়িয়ে রইলুম—চোখের সামনে সব অন্ধকার।
কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যাঁকে রাধারাণী দেবীর কেশবীথির প্রান্তে এঁকে দিতে হবে সিন্দূরের রক্তরাগ, এমনভাবে তাঁকে অকালে লাভ করতে হবে সলিলসমাধি, নিশ্চয়ই তা ছিল না নিয়তির বিধানে।
“ব্রেকারে”র ওপারে সমুদ্রের জল অত্যন্ত শান্ত ও স্বচ্ছ, তলাকার বালুকাশয্যা পর্যন্ত স্পষ্ট ক’রে দেখা যায়। দৈবগতিকে এবং নরেনের সৌভাগ্যক্রমেই সেখানে সন্তরণে নিযুক্ত ছিল কয়েকজন স্থানীয় বালক। তারাই নরেনের চৈতন্যহীন দেহকে আবার ডাঙায় তুলে আনলে।
হ’তে বসেছিল বিয়োগান্ত দৃশ্যের অবতারণা, নরেন নিজেই তাকে পরিণত করলেন প্রহসনে।
বেলাবালুকার উপরে নিষ্পন্দ হয়ে পড়ে আছে নরেনের অচেতন দেহ। তাঁর দুই চক্ষু মুদ্রিত, মুখ হাঁ করা। তাঁর চারিধার ঘিরে বৃহৎ জনতা। ক্রমে বোঝা গেল, ধীরে ধীরে তাঁর সংবিৎ ফিরে আসছে। একদল মাড়োয়ারী স্ত্রীলোক সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্যে হায় হায় করছিল। হঠাৎ নরেন মিটমিট ক’রে তাদের পানে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “রাম নাম সত্য হায়, রাম নাম সত্য হায়।”
মাড়োয়ারী স্ত্রীলোকরা ক্ষাপ্পা। ভাবলে, বাঙালী বাবুটা লোক ঠকাবার জন্যেই এতক্ষণ ঢং ক’রে পড়েছিল। তারা গালাগালি দিতে দিতে চ’লে গেল।
স্বর্গীয় কবি গিরিজাকুমার ও তাঁর ভার্যা লেখিকা শ্রীমতী তমাললতা বসু তখন কার্মাটারে বাস করছিলেন। তাঁদের আমন্ত্রণে একবার আমরাও সবাই কার্মাটারে গিয়ে হাজির হলুম। সেইখানেই একদিন তরুণী রাধারাণী আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন; তখন তাঁর উপাধি ছিল, ‘দত্ত’। তখনই তিনি কাব্যসাধনা সুরু ক’রে দিয়েছেন সাময়িক পত্র-পত্রিকায়। তবে সে সময়েই নরেনের সঙ্গে তাঁর চোখের দেখা উভয়ের মনের মিলনের ভিত্তি রচনা করেছিল কি-না বলতে পারি না, কারণ নরেন সে কথা আমাদের কাছে প্রকাশ করেননি ঘুণাক্ষরেও। প্রথম দিনেই রাধারাণী দেবীর সঙ্গে আলাপ ক’রে আমার মনে হয়েছিল তাঁর মুখে চোখে ও ভাষায় আছে মনীষার প্রভাব। পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আসবার সুযোগ পেয়ে অধিকতর বদ্ধমূল হয়েছে আমার সেই ধারণা।
সেইবারেই আমাদের একটি বৃহৎ দল কার্মাটার থেকে ঝাঁঝায় গিয়েছিল বনভোজনের আনন্দ উপভোগ করতে। সেখানেও নরেনের প্রাণহানি না হোক, অঙ্গহানি হবার সম্ভাবনা উপস্থিত হয়েছিল। সে গল্পটাই বা বাকি থাকে কেন।
সবুজ-মাখানো, পাখী-ডাকানো, ছায়া-দোলানো নিরালা বনভূমি, তারই ভিতরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে শৈলের পর শৈল এবং তারই ভিতরে জলবীণা বাজাতে বাজাতে ও সূর্যকরে হীরার হার গাঁথতে গাঁথতে উচ্ছ্বল আমোদে বয়ে চলেছে নৃত্যশীলা তটিনী। বনভোজনের পক্ষে আদর্শ জায়গা। আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠের আনন্দ-কলরবে মুখরিত হয়ে উঠল সেখানকার বিজনতা।
কিন্তু আচম্বিতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই হ’ল অভাবিত দৃশ্যপরিবর্তন। অঝোরে নামল অকালবর্ষা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—বনে বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দিতে লাগল হেঁকে হেঁকে। দেখতে দেখতে পাহাড়ের গা বয়ে হুড় হুড় ক’রে জল নেমে আসায় ক্ষীণা গিরিনদী হয়ে উঠল একেবারেই দুস্তর। আমাদের সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন মহিলা, তাঁদের নিয়েই সকলে অধিকতর বিব্রত হয়ে পড়লেন। সকলেরই অবস্থা হয়ে উঠল ভিজে বিড়ালের মত।
তারপর যেমন সহসা এসেছিল, তেমনি সহসাই অদৃশ্য হয়ে গেল সেই বনবাসী ঝড়বৃষ্টি। আবার রোদ উঠল। তমাললতা দেবী একটা গাছতলায় খিচুড়ির হাঁড়ি চড়িয়ে দিলেন।
সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নরেন খবরদারি করছেন, হঠাৎ সচমকে দেখি তাঁর পিছন দিকে কোমরের উপরে একটা বৃশ্চিক! তেমন ভয়াবহ, সুবৃহৎ ও হৃষ্টপুষ্ট পাহাড়ে-বিছে জীবনে আমি আর কখনো দেখিনি, কামড়ালে আর রক্ষা নেই!
চেঁচিয়ে উঠলাম, “নরেন, তোমার পিঠে একটা মস্ত বিছে!”
ব্যাস, আর কিছু বলতে হ’ল না, ঝাঁকুনি দিয়ে বিপদকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলবার জন্যে নরেন চোখ কপালে তুলে এবং দুই বাহু ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত ক’রে এমন আশ্চর্য নর্তন–কুর্দন সুরু ক’রে দিলেন যে, কোথায় লাগে তার কাছে উদয়শঙ্করের তাণ্ডবনৃত্য!
আমার হাতে ছিল একগাছা বৃহৎ লগুড় —যাকে বলে দস্তুরমত প্রচণ্ড কোঁতকা, তার এক ঘা খেলে বাঘেরও মাথা ফেটে চৌচির হ’তে পারত।
গিরিজাকুমার হস্তদন্তের মত আমার হাত থেকে ফস্ ক’রে সেই লগুড়গাছা টেনে নিয়ে বিছেটাকে নরেনের পিঠের উপরেই মারবার জন্যে দুই হাতে বেগে সেটাকে শূন্যে তুলে ধরলেন।
“কর কি, কর কি গিরিজা!” বলে চেঁচিয়ে সামনে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে আমি তাঁর দুই হাত চেপে ধরলুম।
সেই বিষম লগুড় প্রহারে বিছেটা মারা পড়ত বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে নিশ্চিতরূপে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যেত নরেনের মাজাও।
তারপর বৃশ্চিকটাকে পিঠের উপর থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় এবং নরেনেরও তাণ্ডব নাচ থামে।
বাংলা সাহিত্যে মহিলা কবিদের দান আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু আগেকার অনেকের দান ছিল মহার্ঘ্য, এখনকার দান তুল্যমূল্য নয়, উপরন্তু অধিকাংশ স্থলেই সেগুলি একান্ত অকিঞ্চিৎকর। অতি-আধুনিক মহিলা কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন কেবল শ্রীমতী উমা দেবী।
রাধারাণী প্রাচীন বা অতি আধুনিক যুগের কবি নন, তাঁর স্থান মধ্যবর্তীকালে এবং তিনি সাড়া দেন আধুনিক যুগধর্মের প্রভাবের মধ্যে থেকেই। অতীত থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত কাব্যসাধনার ভিতর দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি একাধিক যুগ। বাংলা সাহিত্যের দরবারে তাঁর উচ্চাসন আজ কায়েমী হয়ে গিয়েছে এবং নিঃসংশয়ে বলা যায়, জীবিত মহিলা কবিদের মধ্যে আর কেউ নেই তাঁর জুড়ি। আমি স্বকর্ণে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের মুখে তাঁর মনীষার প্রশস্তি। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রকেও।
আমার এই ব্যক্তিগত স্মৃতিকথাগুলি সমালোচনা নয়, আমি বড় জোর বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ বিশেষ গুণের দিকে ইঙ্গিতমাত্র ক’রে ক্ষান্ত হ’তে পারি। রাধারাণী অজস্র কবিতা রচনা করেছেন, তার অধিকাংশই তাঁর ‘লীলাকমল’, ‘বুকের বীণা’, ‘পরবাসিনী’, ‘বিচিত্ররূপিণী’, ‘আঙ্গিনার ফুল’, ‘সীঁথিমৌর’ ও ‘বনবিহগী’ কাব্যপুঁথির মধ্যে আশ্রয় লাভ করেছে। স্বল্প পরিসরে এতগুলি কবিতা পুস্তকের সমালোচনা করতে যাওয়ার মানেই হচ্ছে অসম্পূর্ণতার সাহায্যে সমগ্রকে বোঝাবার চেষ্টা করা। কাজেই সে ব্যর্থ চেষ্টা আর করলুম না।
তবে একটা কথা উল্লেখ করতে পারি। প্রায় দুই যুগ আগে “ভারতবর্ষ” পত্রিকায় শ্রীমতী অপরাজিতা দেবীর অপরিচিত নামসংবলিত গার্হস্থ্য কবিতার পর কবিতা প্রকাশিত হ’তে থাকে। একেবারে নতুন ধরণের গার্হস্থ্য কবিতা। পুরুষদের মধ্যে কবিবর দেবেন্দ্রনাথ সেন কবিতার পটে অপূর্ব ঘরোয়া ছবি এঁকে এদেশে অতুলনীয় হয়ে আছেন। আরো কেউ কেউ কখনো-সখনো ঘরোয়া ছবি এঁকেছেন বটে, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের মত আর কেউ বিশেষ ঝোঁক দেননি এদিকে। তারপরে—বহুকাল পরে অপরাজিতা দেবীই আবার খুলে বসলেন বিচিত্র গার্হস্থ্য চিত্রশালা। তাঁর অনুপম লিপিকুশলতায় আমাদের নিত্যদৃষ্ট গৃহস্থালীর ছোট ছোট খুঁটিনাটিগগুলিও কাব্য-সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল হয়ে অভিনব রূপ ধারণ করতে লাগল।
কিন্তু কে এই অপরাজিতা দেবী? তিনি যে নূতন লেখিকা নন, তাঁর পরিপক্ক রচনাচাতুর্যই সে প্রমাণ দেয়। নিশ্চয়ই তিনি সিদ্ধ সাধিকা, কিন্তু তবু এর আগে তাঁর দেখা পাইনি কেন?
বেশ কিছুকাল পরে খোঁজখবর নিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করলুম। যিনিই অপরাজিতা, তিনিই রাধারাণী। যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছিলুম। কারণ রাধারাণীর সঙ্গে অপরাজিতার মিল নেই কিছুমাত্র—কি ভাষায়, কি ছন্দে, কি বিষয়বস্তুতে ও কি বর্ণনাভঙ্গিতে। এমন সার্থক আত্মগোপন দেখা যায় না।