এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা/ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যো-বধূ

ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যো-বধূ।

 পূর্ব্বে স্ত্রীলোকেরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যোবধূ। উহাদিগের উপনয়ন হইত। ব্রহ্মবাদিনীরা পতি গ্রহণ করিতেন না। তাঁহারা বেদ পড়িতেন ও পড়াইতেন, জ্ঞানানুশীলনার্থে তাঁহারা অন্যান্য স্থানে ভ্রমণ করিতেন। গরুড় পুরাণে লিখিত আছে যে, মিনা ও বৈতরণী নামে দুই জন ব্রহ্মবাদিনী নারী ছিলেন। হরিবংশে লেখে যে বরুনার এক তপঃশালিনী কন্যা ছিল। মহাভারতে দৃষ্ট হয় যে, মহাত্মা আসুরি আত্ম-জ্ঞানার্থে কপিলের শিষ্য হইয়া শাবরীর বিষয় বিলক্ষণ অবগত হইয়াছিলেন। কপিলা নামে এক ব্রাহ্মণী তাঁহার সহ-ধর্ম্মিণী ছিলেন। প্রিয় শিষ্য পঞ্চশিখ ঐ কপিলার নিকট ব্রহ্মনিষ্ঠ বুদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন।

 মিথিলাধিপতি জনক ব্রহ্মজ্ঞানানুশীলনার্থে অনেক তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিকে আহ্বান করেন। গার্গী নাম্নী এক তত্ত্বজ্ঞা সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া যাজ্ঞবল্ক্যের সহিত অনেক তর্ক বিতর্ক করেন। মহাভারতে লেখে যে সলভা নামে একটী স্ত্রীলোক দর্শন শাস্ত্র ভাল জানিতেন। তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিষয়ে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ব্রহ্মবাদিনীরা জ্ঞানানুশীলন ত্যাগ করিয়া ধ্যানাবৃত হইতেন। ধ্যান কাণ্ড জ্ঞান কাণ্ডের চরমাবস্থা। রঘুবংশে এক ব্রহ্মবাদিনীর উল্লেখ আছে। “এই সুতীক্ষ্ণনামা শান্তচরিত্র আর এক তপস্বী ইন্ধন প্রজ্বলিত হুতাশন চতুষ্টয়ের মধ্যবর্ত্তী ও সূর্য্যাভিমুখী হইয়া তপোনুষ্ঠান করিতেছেন।” আরণ্যকাণ্ডে লেখে “চীরধারিণী জটিলা তাপসী শবরী” রাম দর্শনে অগ্নিতে প্রবেশ করত “আপন বিদ্যুতের[১] ন্যায় দেহ প্রভায় চতুর্দ্দিক উজ্জ্বল করিয়া স্বীয় তপঃপ্রভাবে যে স্থানে সেই সুকৃতাত্মা মুনিগণ বাস করিতেছিলেন, তিনি সেই পুণ্য স্থানে গমন করিলেন।”

 যদিও ব্রহ্মবাদিনীরা ঈশ্বর ও আত্মজ্ঞানানুশীলনে মগ্ন থাকিতেন, তথাচ সদ্যোবধূরা পতিগ্রহণ করিয়াও উক্ত জ্ঞানে বিখ্যাত হইয়াছিলেন। অত্রিবংশীয় দুই নারী ঋগ্বেদের কতিপয় স্তোত্র রচনা করেন। উত্তর রামচরিতেও লেখে যে অত্রিমুনির বনিতা আত্রেয়ী পথে আসিতেছিলেন, একজন পথিক জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কোথায় যাইতেছেন? মুনিপত্নী বলিলেন, আমি বাল্‌মীকির নিকট অধ্যয়ন করিয়া অগস্ত্যের আশ্রমে বেদ অধ্যয়ন করিতে গিয়াছিলাম, সেখানে অনেক তত্ত্বজ্ঞানী ঋষিরা বাস করেন। যাজ্ঞবল্ক্যের স্ত্রী মৈত্রেয়ী অতি উচ্চতা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি স্বামীর নিকট তত্ত্বজ্ঞান উপদেশ পান। ঈশ্বর বিষয়ক যে সকল প্রশ্ন স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তাহা ঋগ্বেদে প্রকাশিত আছে।

 সদ্যোবধূরা উত্তম রূপে শিক্ষিত হইতেন, তাঁহাদিগের শিক্ষা ঈশ্বর ও আত্মা সম্বন্ধীয়, পারলৌকিক উন্নতিই জীবনের উদ্দেশ্য। এই প্রকার শিক্ষিত কতিপয় আধ্যাত্মিক সদ্যোবধূর সংক্ষেপ বিবরণ দেওয়া হইতেছে।


  1. বিদ্যুতের ন্যায় সূক্ষ্ম শরীর যাহা উপনিষদ ও দর্শন শাস্ত্রে বর্ণিত আছে।