এপিক্টেটসের উপদেশ/কোন পথে সুখ
কোন পথে সুখ?
১। “আমার যাহা ইচ্ছা তাহাই যেন ঘটে” এই রূপ আকাঙ্ক্ষা না করিয়া, “যাহাই ঘটুক না কেন, আমি তাহা অম্লানবদনে গ্রহণ করিব” —এইরূপ যদি তোমার মনের ভাব হয় তাহা হইলেই তুমি সুখী হইবে।
২। রোগ শরীরেরই বাধা, উহা আত্মার বাধা নহে;—আত্মার বাধা হয়, যদি উহাতে আত্মার সম্মতি থাকে। খঞ্জতা পায়েরই বাধা— উহা আত্মার বাধা নহে। যাহা কিছু ঘটুক না—সকল অবস্থাতেই তুমি এইরূপ বলিতে পার যে, এ বাধা আমার নহে, এ বাধা আর কিছুর।
৩। কে তবে তোমাকে উৎপীড়ন করে—কে তোমাকে কষ্ট দেয়? তোমার অজ্ঞানই তোমাকে উৎপীড়ন করে—তোমাকে কষ্ট দেয়। যখন আমরা বন্ধুবান্ধব হইতে—সুখ সম্পদ হইতে বিযুক্ত হই, তখন নিজের অজ্ঞানই আমাদিগকে উৎপীড়ন করে। ধাত্রী যখন কিয়ৎকালের জন্য শিশুর নিকট হইতে চলিয়া যায়, তখন শিশু ক্রন্দন করে; কিন্তু আবার যেই তাকে কিছু মিঠাই দেওয়া হয় অমনি সে তাহার দুঃখ ভুলিয়া যায়। তুমি কি সেই শিশুর মতন হইতে ইচ্ছা কর?
আমি যেন একটু মিষ্টান্নে ভুলিয়া না যাই, আমি যেন যথার্থ-জ্ঞানের দ্বারা—বিশুদ্ধ ভাবের দ্বারা পরিচালিত হই। সেই যথার্থ জ্ঞানটি কি?
মানুষের এইটুকু বুঝা উচিত—কি বন্ধু বান্ধব, কি পদমর্য্যাদা, এ সমস্ত কিছুই আপনার নহে—সমস্তই পর; নিজের দেহকেও পর বলিয়া বিবেচনা করিবে। ধর্ম্মের নিয়মকেই সর্ব্বদা স্মরণে রাখিবে—চক্ষের সম্মুখে রাখিবে। সে ধর্ম্মের নিয়মটি কি? তাহা এই:—যাহা কিছু বাস্তবিক আপনার—তাহাকেই আঁকড়াইয়া ধরিবে, অন্যের জিনিসে দাবি রাখিবে না। যাহা তোমাকে দেওয়া হইয়াছে তাহাই ব্যবহার করিবে;[১] যাহা তোমাকে দেওয়া হয় নাই তাহাতে লোভ করিবে না; যাহা তোমার নিকট হইতে ফিরিয়া লওয়া হইবে, তাহা তুমি ইচ্ছাপূর্ব্বক সহজে ছাড়িয়া দিবে; যে কয়েক দিনের জন্য ভোগ করিতে পাইয়াছ, তজ্জন্য় প্রদাতাকে ধন্যবাদ করিবে।
হতভাগ্য মনুষ্য! যাহা প্রতিদিন দেখিতেছ তাহাতে কি তুমি সন্তুষ্ট নহ? এই সূর্য্য, এই চন্দ্র, এই সমুদ্র, এই পৃথিবী,—ইহাদের অপেক্ষা মহৎ অথবা বৃহৎ দ্রষ্টব্য পদার্থ আর কি আছে? যিনি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে শাসন করিতেছেন, তিনি তোমার হৃদয়েও আছেন; তাঁহার পথের যদি তুমি পথিক হও, তাহা হইলে ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমার কি আর আস্থা থাকে? আবার যখন, সেই চন্দ্র সূর্য্যকেও তোমার ছাড়িয়া যাইতে হইবে, তখন তুমি কি করিবে?—শিশুর ন্যায় বসিয়া বসিয়া শুধু কি ক্রন্দন করিবে? তুমি এরূপ কষ্ট পাইতেছ কেন? যথার্থ জ্ঞানের অভাবেই কষ্ট পাইতেছ—মোহ বশতই কষ্ট পাইতেছ।
৫। হে মনুষ্য! আর কিছুতেই উন্মত্ত হইও না;—শুধু শান্তির জন্য, মুক্তির জন্য, মহত্ত্বের জন্য উন্মত্ত হও। দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া উন্নত মস্তকে দণ্ডায়মান হও। ঊর্দ্ধে ঈশ্বরের দিকে তাকাইয়া, সাহস পূর্ব্বক এই কথা বল:—“এখন হইতে প্রভো, তোমার যাহা ইচ্ছা, তাহাই আমার প্রতি বিধান কর; তোমার যাহা ইচ্ছ, আমারও তাহাই ইচ্ছা;—আমি তোমারি। তোমার যাহা ভাল মনে হয় আমি তাহা কখনই পরিত্যাগ করিব না; যেখানে ইচ্ছা তুমি আমাকে লইয়া যাও, যে রূপ সজ্জায় আমাকে সজ্জিত করিতে চাহ, সেইরূপ সজ্জাতেই আমাকে সজ্জিত কর। তোমার কি ইচ্ছা,—আমি প্রভুত্ব করি, কিংবা সামান্য লোকের মত থাকি, কিংবা গৃহে অবস্থান করি, কিংবা নির্ব্বাসিত হই, কিংবা দারিদ্র্য ভোগ করি, কিংবা ঐশ্বর্য্য সম্ভোগ করি? যাহা তুমি বিধান করিবে, তাহাই আমি লোকের নিকট সমর্থন করিব, তাহাই উপাদেয় বলিয়া সর্ব্ব-সমক্ষে প্রতিপাদন করিব।”
অতএব, যাহা তোমার পক্ষে বাস্তবিক অমঙ্গল, তাহাই মন হইতে দুর করিয়া দেও। দুঃখ, ভয়, লোভ, ঈর্ষা, মাৎসর্য্য, বিলাসিতা, ভোগাভিলাষ—এই সমস্ত মন হইতে অপসারিত কর। কিন্তু যতক্ষণ তুমি ঈশ্বরের প্রতি দৃষ্টি স্থির না রাখিবে—তাঁহার দ্বারা পরিচালিত না হইবে—তাঁহার পদে জীবন উৎসর্গ করিয়া তাঁহার আদেশ পালন না করিবে, ততক্ষণ ঐ সকল কুপ্রবৃত্তি তোমার মন হইতে কিছুতেই দুর হইবে না। এ ছাড়া তুমি যদি অন্য পথে যাও, তোমা অপেক্ষা প্রবলতর শক্তি আসিয়া তোমাকে অভিভূত করিয়া ফেলিবে। চিরকাল তুমি বাহিরে বাহিরে সুখ-সৌভাগ্য অন্বেষণ করিবে, অথচ কস্মিনকালেও তাহা পাইবে না। কেননা, তুমি সেইখানে উহা অন্বেষণ করিতেছ যেখানে পাইবার কোন সম্ভাবনা নাই, এবং সেইখানে অন্বেষণ করিতে উপেক্ষা করিতেছ যেখানে উহা বাস্তবিকই আছে।
- ↑ মাগৃধঃ কস্যস্বিন্ধনং—উপনিষৎ।