এপিক্টেটাস্ ষ্টোয়িক সম্প্রদায়ের একজন প্রখ্যাত সাধক ও ধর্ম্মোপদেষ্টা। ইনি মুখে-মুখে উপস্থিত মত যে সকল উপদেশ দিতেন তাহাই তাঁহার শিষ্য Arrian লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। ইনি খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ফ্রিজিয়া প্রদেশের হিয়েরোপলিস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি রোম-সম্রাট নীরোর একজন প্রিয় পারিষদের ক্রীতদাস ছিলেন। প্রভু স্বীয় দাসের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতেন। কথিত আছে, একদিন তিনি আমোদ করিয়া তাঁর দাসের পায়ে মোচড় দিতে লাগলেন। এপিক্টেটাস বলিলেন,—“আপনি যদি ক্রমাগত ঐরূপ করিতে থাকেন, তাহা হইলে আমার পা ভাঙ্গিয়া যাইবে। তাঁহার প্রভু তবুও ক্ষান্ত হইলেন না। পা ভাঙ্গিয়া গেল। এপিক্টেটাস অবিচলিত চিত্তে ও প্রশান্তভাবে শুধু এই কথা বলিলেন:—“আমি ত পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, এরূপ করিলে আমার পা ভাঙ্গিয়া যাইবে।” এ গল্পটি কতদূর সত্য তাহা ঠিক বলা যায় না, কিন্তু তিনি যে খঞ্জ ছিলেন তাহা তাঁহার উপদেশ হইতেই অবগত হওয়া যায়। রোমের প্রসিদ্ধ ষ্টোয়িক আচার্য্য Musonius Rufus তাঁহার দীক্ষাগুরু ছিলেন। এই সকল ষ্টোয়িক আচার্য্যগণ নির্ভয়ে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করিতেন বলিয়া সম্রাট্ Domitian ৯৪ খৃষ্টাব্দে, একটা রাজবিধি ঘোষণা করিয়া তাঁহাদিগকে রোম-নগরী হইতে বহিস্কৃত করেন। বোধ হয় সেই সময়ে এপিক্টেটাসও দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিয়া রোমে তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ দিতেন। এই পরোয়ানা জারী হইবার পর, তিনি নিকোপোলিস্ নগরে গিয়া উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন। এইখানেই তিনি জীবনের শেষভাগ বার্ধক্য পর্য্যন্ত অতিবাহিত করেন; এবং এইখানে তিনি যে সকল উপদেশ দিয়াছিলেন তাহাই Arrian লিপিবদ্ধ করিয়া জনসমাজে প্রচার করিয়াছেন।
তাঁহার উপদেশের মর্ম্মগ্রহণ করিতে হইলে ষ্টোয়িক-সম্প্রদায়ের মতামত ও বৃত্তান্ত কিছু জানা আবশ্যক। জিনো-ষ্টোয়িক দর্শনের স্রষ্টা। তাঁহার জন্মভূমি সাইপ্রস্। তিনি “ষ্টোয়া”তে—অর্থাৎ একটা চিত্রিত খিলান-পথে বসিয়া উপদেশ দিতেন বলিয়া তাঁহার সম্প্রদায় “ষ্টোয়িক” নামে অভিহিত হয়। জিনোর পরে, Chrysippus ও Cleanthes এই দুই প্রখ্যাত আচার্য্য, ষ্টোয়িক-দর্শনকে পরিপুষ্ট করেন। জিনো খৃষ্টপূর্ব্ব ৩০০ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েন। ইহার কিছু পূর্ব্বে অ্যালেকজাণ্ডারপ্রমুখ গ্রীকগণ ভারতভূমির সংস্পর্শে আইসেন। তাই এই সময়ে, গ্রীক দর্শনের উপর প্রাচ্য প্রভাব যে কতকটা প্রকটিত হইবে তাহাতে আশ্চর্য্য নাই। ইহারই পূর্ব্বে Pyrrho হিন্দু-তত্ত্বজ্ঞানীদিগের নিকট শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়া স্বপ্নবাদ ও মায়াবাদ গ্রীসে প্রচার করেন। ষ্টোয়িকরা এই মতের বিরোধী হইলেও উহার প্রভাব উঁহারা সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। তাই এপিক্টেটাসের উপদেশে বেদান্তের যেন একটু ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে।
প্রকৃতির পথ অনুসরণ করিয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিবে—ইহাই ষ্টোয়িকদিগের বীজমন্ত্র। কিন্তু “প্রকৃতি” কাকে বলে? তত্ত্বজিজ্ঞাসুর হৃদয়ে ও বিবেক বুদ্ধিতে ঈশ্বরের ইচ্ছারূপে যাহা প্রকাশ পায়, এবং শ্রদ্ধা হৃদয়ে জীবনের ঘটনা সকল পরীক্ষা করিলে, ঐ ঐশী ইচ্ছা সম্বর্য যে সদ্ব্যাখ্যা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাকেই ষ্টোয়িকরা “প্রকৃতি” বলেন।
ধর্ম্মনীতি সম্বন্ধে এপিক্টেটাসের সার কথা এই:— মৃত্যু প্রভৃতি যে সকল ঘটনা অনিবার্য্য, যাহা আমাদের আয়ত্তাধীন নহে, তাহাকে শুভও বলা যায় না, অশুভ ও বলা যায় না। যাহা আমাদের ইচ্ছার অধীন তাহার উপরেই আমাদের শুভাশুভ, ধর্ম্মাধর্ম্ম, প্রকৃত সুখদুঃখ নির্ভর করে। অতএব যাহা অনিবার্য্য, অপরিহার্য্য—তাহা অবিচলিত চিত্তে ও অকাতরে সহ্য করিতে হইবে; এবং আমাদের বিবেকবুদ্ধি আমাদিগকে যে পথে যাইতে বলিবেন, ইচ্ছাশক্তির বলে দৃঢ়তার সহিত সেই পথ অনুসরণ করিতে হইবে। এপিক্টেটাসের নীতিপদ্ধতি, ধর্ম্মের উপর—ঈশ্বরভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এপিক্টেটাসের নীতিবাদে অদৃষ্ট ও পুরুষকারের সুন্দর সমন্বয় লক্ষিত হয়। এপিক্টেটাসের উপদেশ শুষ্ক জ্ঞানের উপদেশ নহে, আচরণের সহিত উহার ঘনিষ্ঠ যোগ। শুধু কথা নহে—তত্ত্বজ্ঞানের উপদেশ জীবনে পরিণত করিতে হইবে—ইহাই তিনি বারবার বলিয়াছেন।
আমাদের এই দৈন্যদশার দিনে, দাসত্বের দিনে, দুর্ভিক্ষ মারীভয়ের দিনে, রাজভয়ের দিনে, যদি আমরা এপিক্টেটাসের উপদেশ অনুসারে চলি তাহা হইলে, শোক তাপে সান্ত্বনা পাইব, বিপদে বল পাইব, মৃত্যুভয়কে জয় করিয়া নির্ভয় হইব—এই বিশ্বাসে আমি এপিক্টেটাসের উপদেশের সার সংকলন করিয়া বঙ্গভাষায় প্রকাশ করিলাম।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।