এপিক্টেটসের উপদেশ/যেমনটি তাই
যেমনটি তাই।
১। ক্ষুদ্র বৃহৎ যে কোন পদার্থ চিত্তকে আকর্ষণ করে, কোন বিশেষ সুবিধা প্রদান করে, অথবা যে পদার্থকে তুমি ভাল বাসো,— তাহার সম্বন্ধে যখন কোন কথা বলিবে তখন ঠিক সে যেমনটি তাহাই বলিবে, ইহা যেন স্মরণ থাকে। তুমি যদি একটি মৃণ্ময় ঘটকে ভাল বাসো, তাহা হইলে মনে করিবে “আমি একটি মৃন্ময় ঘটকেই ভাল বাসি”; কেন না, এইরূপ ভাবিলে উহা যদি ভাঙিয়া যায়, তাহা হইলে তোমার কষ্ট হইবে না।
২। কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার পূর্ব্বে, ভাবিয়া দেখিবে, কি তুমি করিতে যাইতেছ। যদি কোন তীর্থে স্নান করিতে যাও, তাহা হইলে, যাহা কিছু সেখানে ঘটিয়া থাকে সমস্তই আপনার মানসপটে অঙ্কিত করিবে; সেখানকার জনতা, ঠ্যালাঠেলি, মারামারি, চুরিচামারি ইত্যাদি সমস্ত পূর্ব্ব হইতেই কল্পনা করিয়া দেখিবে। তাহা হইলে আরও নির্ভয়ে, নিশ্চিন্ত মনে সে কাজে প্রবৃত্ত হইতে সমর্থ হইবে; তখন তুমি স্পষ্ট বলিতে পারিবে “আমি তীর্থে স্নান করিতে চাই, এবং প্রকৃতির অনুবর্ত্তী হইয়াই আমার সেই সঙ্কল্প আমি সিদ্ধ করিব।” আমাদের প্রত্যেক কার্য্য সম্বন্ধেই এই কথা খাটে। কেন না, যদি তোমার তীর্থস্নানের সময় কোনও বাধাবিঘ্ন উপস্থিত হয়, তাহা হইলে তখনি তুমি এই কথাটি মনে করিবে তীর্থ-স্নানই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না; পরন্তু প্রকৃতির অনুবর্ত্তী হইয়া আমার সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিব, ইহাই আমার অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু সেখানকার ঘটনাদি দেখিয়া যদি আমি ক্রুদ্ধ হই, তাহা হইলে আমার সে সঙ্কল্প সিদ্ধ করিতে পারিব না।”
২। ইতর ব্যক্তি ও তত্ত্বজ্ঞানীর মধ্যে প্রথম প্রভেদটি এই, ইতর ব্যক্তি এইরূপ বলিয়া থাকে “হায় হায়! আমার সন্তানের, আমার ভ্রাতার, আমার, পিতার সর্ব্বনাশ হইল”! তত্ত্বজ্ঞানীকে যদি কখনও বাধ্য হইয়া বলিতে হয়—“হায় হায়!”—তখনই আত্মসম্বরণ করিয়া কথাটা এইরূপে শেষ করেন—“আমার আত্মার সর্ব্বনাশ হইল।” ইচ্ছাশক্তিমান আত্মাকে আর কেহই বাধা দিতে পারে না, কিম্বা তাহার অনিষ্ট আর কেহই করিতে পারে না—আত্মাই আত্মার বাধা ও শত্রু। অতএব,কষ্টের সময় যদি আপনাকেই আমি দোষী করি, আর এই কথাটি মনে রাখি যে, আমাদের মনের সংস্কারই আমাদের কষ্ট ও উদ্বেগের একমাত্র কারণ, তাহা হইলে জানিবে আমরা কতকটা সাধন-পথে অগ্রসর হইয়াছি। কিন্তু এখন যেরূপ দেখিতে পাই, আমরা আরম্ভ হইতেই, ভিন্ন পথ দিয়া যাত্রা করিয়াছি। শৈশবাবস্থায় অন্যমনস্ক হইয়া হাঁ করিয়া চলিতে চলিতে কোন প্রস্তরে ঠেকিয়া যদি আমাদের কখন পদস্খলন হইত অমনি ধাত্রী তজ্জন্য আমাদের তিরস্কার না করিয়া, সেই প্রস্তরখণ্ডকেই প্রহার করিত। কিন্তু সেই প্রস্তরখণ্ডের দোষ কি? তোমার শিশুটির নির্ব্বুদ্ধিতার দরুণ, তাহার কি পথ ছাড়িয়া সরিয়া যাওয়া উচিত ছিল? আরো দেখ, স্নান করিয়া আসিয়া, যদি আমরা কিছু খাইতে না পাই, আমাদের শিক্ষক আমাদের বাসনাকে কখনই দমন করিতে বলেন না, পরন্তু তিনি পাচককেই প্রহার করেন। বাপু, তোমাকে তো আমরা পাচকের শিক্ষকপদে নিযুক্ত করি নাই, আমাদের শিশুটীর শিক্ষক করিয়াই তোমাকে নিযুক্ত করিয়াছিলাম—শিশুর যাহাতে সুশিক্ষা, সদভ্যাস ও উন্নতি সাধিত হয় তাহাই তোমার দেখিবার কথা। এই প্রকার, আমরা পূর্ণবয়স্ক হইয়াও শিশুবৎ আচরণ করিয়া থাকি। কেননা, সঙ্গীতে শিশু কে?—যে সঙ্গীতে অনভিজ্ঞ। লেখাপড়ায় শিশু কে? যাহার অক্ষর পরিচয় হয় নাই। জীবনে শিশু কে?—তত্ত্বজ্ঞানে যে অশিক্ষিত।
৪। বস্তুসমূহ মনুষ্যকে কষ্ট দেয় না, পরন্তু তৎসম্বন্ধে মানুষের যে সংস্কার তাহাই তাহাকে কষ্ট দেয়। দেখ, মৃত্যু আসলে কিছুই ভীষণ নহে। ভীষণ হইলে সক্রেটিসের নিকটেও ভীষণ বলিয়া প্রতীয়মান হইত। কিন্তু মৃত্যুসম্বন্ধে আমাদের যে সংস্কার, তাহাই ভৗষণ—আমাদের সেই সংস্কারের মধ্যেই যাহা কিছু তাহার ভীষণত্ব। অতএব, যখন আমরা কোন বাধা প্রাপ্ত হই, কোন কষ্টে পতিত হই, কিম্বা শোক-দুঃখে অভিভূত হই, তখন সেই সময়ে আপনাকে ছাড়া—অর্থাৎ আপনার সংস্কার ছাড়া, যেন আর কাহারও দোষ না দেই। যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞানে অশিক্ষিত, তাহার কোন কষ্ট হইলে, সে অন্যকে দোষী করে, যে ব্যক্তি শিক্ষা আরম্ভ করিয়াছে, সে আপনাকেই দোষী করে, যে ব্যক্তি সুশিক্ষিত হইয়াছে, সে অন্যকে দোষী করে না, আপনাকেও দোষী করে না।
৫। যে উৎকৃষ্টতা তোমার নিজস্ব নহে, তাহাতে উৎফুল্লচিত্ত হইও না। যদি তোমার অশ্ব উৎফুল-চিত্ত হইয়া বলে “আমি সুন্দর” সে কথা বরং শ্রুতিযোগ্য, কিন্তু তুমি যদি উৎফুল্ল চিত্তে বল “আমার একটি সুন্দর ঘোড়া আছে”—তখন জানিবে, তুমি যে উৎকৃষ্টতার জন্য উৎফুল্ল হইয়াছ, সে উৎকৃষ্টতা তোমার অশ্বের—তোমার নহে। তবে তোমার নিজস্ব বস্তুটি কি? সে এই—বাহ্যবস্তু সমুহের যথাযোগ্য প্রয়োগ করা। অতএব যখনই তুমি প্রকৃতির নিয়মানুসারে বাহ্য বস্তুর প্রয়োগ করিতে পারিবে, তখনি তুমি উৎফুল্ল হইও, কেন না যে উৎকৃষ্টতা তোমার নিজস্ব তাহার জন্যই তুমি উৎফুল্ল হইতে পার।